বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘ঐকতান’ কবিতার মতোই এক অনন্য বন্ধন গড়ে তুলেছে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকপ্রশাসন ও সরকার পরিচালনা বিদ্যা বিভাগের অষ্টম ব্যাচ। তারা নিজেদের নাম দিয়েছে ‘ঐকতান’। স্নাতক চতুর্থ বর্ষে
থাকাকালীন তারা বান্দরবান ও কক্সবাজারে পাঁচ দিনের এক ফিল্ডওয়ার্ক আয়োজন করে। এই ভ্রমণ শুধু দর্শনীয় স্থান ঘুরে দেখা নয়, বরং শিক্ষার নতুন দিগন্ত উন্মোচন করার এক অনন্য অভিজ্ঞতা ছিল।
ভ্রমণের প্রথম পর্ব: বান্দরবান
নীলগিরি, নীলাচল, চিম্বুক পাহাড়, শৈলপ্রপাত, মেঘলা—বান্দরবানের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য শিক্ষার্থীদের মন জয় করে নেয়। পাহাড়ি পথের প্রতিটি বাঁকে নতুন রোমাঞ্চ, প্রতিটি দৃশ্য ছিল শিক্ষণীয়। ভ্রমণ শুধু বিনোদন নয়, এটি বাস্তবজ্ঞান অর্জনের একটি অন্যতম মাধ্যম। যেভাবে পাহাড়ের ঢালু পথে চলতে হলে ধৈর্য ও সতর্কতা প্রয়োজন, তেমনি জীবনের পথচলাতেও ধৈর্য ও স্থিরতা গুরুত্বপূর্ণ।
সমুদ্রের ডাকে কক্সবাজার
সুগন্ধা, কলাতলী, ইনানী, মহেশখালী, মেরিন ড্রাইভ, হিমছড়ি—প্রতিটি স্থান যেন ছিল নতুন এক অভিজ্ঞতা। ঢেউয়ের গর্জন, সমুদ্রের অসীমতা আর সূর্যাস্তের রঙিন দৃশ্য সবার মনে গভীর প্রভাব ফেলে। সমুদ্রের মতোই প্রতিটি শিক্ষার্থী নতুন কিছু শেখার জন্য উন্মুখ ছিল। তাদের মাঝে দলগত সংহতি ও নেতৃত্বের গুণাবলি আরও সুদৃঢ় হয়।
ভ্রমণের শিক্ষণীয় দিক
আমরা সবাই ভাবি যে, জ্ঞান আহরণের সর্বোৎকৃষ্ট পন্থা হচ্ছে বই পড়া। কিন্তু বাস্তবে, প্রকৃত জ্ঞান অর্জনের অন্যতম উৎকৃষ্ট মাধ্যম হচ্ছে ভ্রমণ। যে যত বেশি জায়গা ঘোরে, সে তত বেশি জানে ও শেখে। স্টাডি ট্যুরের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো ম্যানেজমেন্ট স্কিলের বিকাশ। চল্লিশ-পঞ্চাশ জন শিক্ষার্থীর একটি ট্যুর সফলভাবে পরিচালনা করতে হলে দরকার দক্ষ নেতৃত্ব, কৌশলগত চিন্তাভাবনা ও পারস্পরিক বোঝাপড়া।
নেতৃত্ব ও সংগঠনের বিকাশ
স্টাডি ট্যুরে সবসময় একটি ‘লিড গ্রুপ’ থাকে, যারা পুরো আয়োজনের দায়িত্ব নেয়। প্রশাসনিক অনুমতি, বাস ও হোটেল ব্যবস্থাপনা, বাজেট পরিকল্পনা, সময়সূচি নির্ধারণ, যে কোনো সমস্যার সমাধান– এসব দক্ষতা গড়ে ওঠে এই ভ্রমণের মাধ্যমে। পাশাপাশি, পারস্পরিক সহনশীলতা, সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির বিকাশ ঘটে।
ঐকতান: একতার শক্তি
এই ভ্রমণ ‘ঐকতান’ ব্যাচের সদস্যদের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক আরও গভীর করেছে। প্রতিটি মুহূর্ত ছিল শিক্ষণীয় ও আনন্দদায়ক। শুধু বইয়ের পাতায় সীমাবদ্ধ না থেকে জীবনের বাস্তব অভিজ্ঞতা অর্জনের জন্য ভ্রমণের গুরুত্ব অপরিসীম। ‘ঐকতান’ ব্যাচের এই ভ্রমণ তাদের জীবনে এক স্মরণীয় অধ্যায় হয়ে থাকবে, যা তাদের শিক্ষাজীবন ও ভবিষ্যতের পথচলায় প্রেরণা জোগাবে।
উৎস: Samakal
এছাড়াও পড়ুন:
মিরাজে দুর্দান্ত জয় বাংলাদেশের
এমন পারফরম্যান্সই তো চাওয়ার থাকে ভালো দলের কাছে। মেহেদী হাসান মিরাজের অলরাউন্ড নৈপুণ্য, সাদমান ইসলামের সেঞ্চুরি, তাইজুল ইসলামের ৯ উইকেট শিকারে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে ইনিংস ও ১০৬ রানের বিশাল জয় এনে দেয় বাংলাদেশকে। প্রথম টেস্ট হারের পর যে সমালোচনা হয়েছিল, তার জবাবটা বোধ হয় দ্বিতীয় টেস্ট তিন দিনে জিতে দিয়ে দিলেন নাজমুল হোসেন শান্তরা। ‘বাউন্স ব্যাক’ করে সিরিজ ড্র ১-১-এ।
চট্টগ্রামের বীরশ্রেষ্ঠ মতিউর রহমান স্টেডিয়ামে বীরোচিত পারফরম্যান্স ছিল টাইগারদের। এটি সম্ভব হয়েছে পছন্দের উইকেটে খেলা হওয়ায়। স্পিন ভুবনে উইকেট উৎসব করেছেন তাইজুল, মিরাজ গাঁটছড়া বেঁধে। সিরিজ নির্ধারণী টেস্টে দুটি সেঞ্চুরি দারুণ অর্জন অধারাবাহিক ব্যাটিং লাইনআপের। এই টেস্টে ওপেনিং জুটি ভালো করেছে। লম্বা সময় পর টেস্ট খেলার সুযোগ পাওয়া এনামুল হক বিজয় ভালোই সঙ্গ দেন সাদমানকে। লোয়ার মিডলঅর্ডারে মিরাজের লড়াই ছিল দেখার মতো।
টেলএন্ডারদের নিয়ে রীতিমতো বাজিমাত করেছেন তিনি। শেষ ৩ উইকেটে তৃতীয় দিন ১৫৩ রান যোগ করেন। বাংলাদেশকে পৌঁছে দেন ৪৪৪ রানে। ২১৭ রানের লিড থাকায় ইনিংস ব্যবধানে জয়ের স্বপ্ন দেখায়। মিরাজের অলরাউন্ড পারফরম্যান্সে সে স্বপ্ন পূরণ হয়। সাকিব আল হাসান ও সোহাগ গাজীর পর তৃতীয় বাংলাদেশি ক্রিকেটার হিসেবে সেঞ্চুরি ও পাঁচ উইকেট শিকার তাঁর।
গত বছর দেশের মাটিতে টেস্টে ভালো করতে পারেনি বাংলাদেশ। শ্রীলঙ্কার পর দক্ষিণ আফ্রিকার কাছে হোয়াইটওয়াশ হয়েছে। ২০২৫ সালের শুরুটাও ভালো ছিল না। সিলেটে জিম্বাবুয়ের কাছে হেরেছে। সিরিজ বাঁচাতে চট্টগ্রামে জিততেই হতো। লক্ষ্যে পৌঁছাতে কন্ডিশনেও পরিবর্তন আনা হয়। চট্টগ্রামের উইকেটে খেলা হয় দ্বিতীয় টেস্ট। যেখানে শাসন ছিল স্পিনারদের। পছন্দের উইকেট পাওয়ায় তিন স্পিনার নিয়ে খেলে বাংলাদেশ। তিনজনই দারুণ বোলিং করেন প্রথম থেকে।
দীর্ঘ বিরতির পর টেস্ট খেলার সুযোগ পাওয়া অফস্পিনার নাঈম হাসান চ্যালেঞ্জ নিয়ে বোলিং করে গেছেন। বেশি উইকেট না পেলেও এক প্রান্তে ব্যাটারদের চাপে ফেলেছেন। যার সুফল তাইজুল ও মিরাজ পেয়েছেন অন্য প্রান্তে। প্রথম দিন শেষ সেশনে ব্রেক থ্রু দেন তিনি। বাঁহাতি স্পিনার পরে পিক করে ৬ উইকেট শিকার করেন। জিম্বাবুয়ে ৯ উইকেটে ২২৭ রানে প্রথম দিন শেষ করে। পরের দিন এক বল খেলে ওই রানেই অলআউট হয়। বাংলাদেশ ব্যাটিং শুরু করে বড় লক্ষ্য নিয়ে। সাদমান ইসলাম ও এনামুল হক বিজয় ১১৮ রানের ওপেনিং জুটি করায় প্রতিপক্ষকে ছাড়িয়ে যাওয়া সহজ হয়। সাদমানের সেঞ্চুরি ও মুমিনুল হক, মুশফিকুর রহিম কিছু রান করায় ৭ উইকেটে ২৯১ রানে দ্বিতীয় দিন শেষ করে বাংলাদেশ।
সেদিন সংবাদ সম্মেলনে সাদমান আশা প্রকাশ করেন, মিরাজ ও তাইজুল জুটি করবেন। অষ্টম উইকেটে ৬৪ রানের জুটি দু’জনের। বেশি ভালো করেছেন পেসার তানজিম হাসান সাকিব। মিরাজের সঙ্গে ১৫৬ বলে ৯৬ রানের জুটি। অভিষেক টেস্টে সাকিবের ব্যাটিং দারুণ লেগেছে অধিনায়ক শান্তর কাছে। ৮০ বলে ৪১ রান করেন তিনি। সবচেয়ে বড় কথা, মাথায় বল লাগার পরও বিচলিত হননি তিনি। মিরাজ ছাড়া চট্টগ্রাম টেস্টের প্রাপ্তি হিসেবে ওপেনিং জুটির ভালো খেলা, সাদমানের সেঞ্চুরি, তাইজুলের ৫ উইকেট শিকার ও সাকিবের রান করাকে মনে করেন শান্ত।
শেষের তিন উইকেটে তৃতীয় দিন প্রায় দুই সেশন ব্যাট করে বাংলাদেশ। তাইজুল, সাকিব ও হাসানকে নিয়ে ১৫৩ রান যোগ করে। মিরাজ ১০৪ রান করে ওয়েলিংটন মাসাকাদজাকে উইকেট দেন। নার্ভাস নাইটির ঘরে প্রবেশ করে কিছুটা ঝুঁকির মুখে ছিলেন মিরাজ। ৯৮ রানে পৌঁছানোর পর সেঞ্চুরি ছুঁতে দুই রান নিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু ফিল্ডারের কাছে বল চলে যাওয়ায় এক রানে থামতে হয়। তখন স্ট্রাইকে হাসান থাকায় দুশ্চিন্তায় পড়ে গিয়েছিল সবাই। ড্রেসিংরুমে খেলোয়াড় ও কোচিং স্টাফের সবাই দাঁড়িয়ে গিয়েছিলেন। কখন হাসান আউট হয়ে যায়, সে ভয় কাজ করছিল হয়তো। কিন্তু হাসান ছিলেন দৃঢ়চেতা। মাসাকাদজাকে ডিফেন্স করে স্বস্তি দেন।
মিরাজ স্ট্রাইকে এসে মেদেভেরের প্রথম দুই বলে ঝুঁকি নেননি। তৃতীয় বলে এক রান নিয়ে ক্যারিয়ারের দ্বিতীয় টেস্ট সেঞ্চুরির স্বাদ নেন। জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে সিরিজ ও দ্বিতীয় টেস্টের সেরা খেলোয়াড় মিরাজ। প্রথম ম্যাচের উভয় ইনিংসে ৫ উইকেট করে ছিল তাঁর। চট্টগ্রামে অতীতের সব পারফরম্যান্স ছাড়িয়ে গেছেন। সেঞ্চুরির সঙ্গে ৫ উইকেটপ্রাপ্তি, দুই হাজার রানের মাইলফলক পেয়েছেন। ২০২১ সালে এই চট্টগ্রামেই ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে সেঞ্চুরি করেছিলেন তিনি। ২১৭ রানে পিছিয়ে থাকা জিম্বাবুয়ে দ্বিতীয় ইনিংসে অলআউট হয় ১১১ রানে। ফ্লাডলাইটের আলো জ্বেলে নির্ধারিত সময়ের বেশি খেলান আম্পায়াররা। প্রায় সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত খেলা হয়। জিম্বাবুয়ে ক্রিকেটাররা তাতে আপত্তি করেননি। তাইজুল ৩, নাঈম ১ ও মিরাজ ৫ উইকেট নিলে ম্যাচ শেষ হয়।
সিলেটে প্রথম টেস্ট হারের পর চট্টগ্রামে প্রভাব বিস্তার করে খেলে ম্যাচ জেতার পরও খুশি নন অধিনায়ক শান্ত, ‘আমি টেস্ট সিরিজ ড্র করে খুশি না। কারণ, প্রথম টেস্টে আমরা একেবারেই ভালো খেলিনি। এই টেস্টে একপেশে খেলে জিতলেও সিরিজে আরও ভালো খেলা উচিত ছিল। সিরিজটি জিততে হতো।’ টাইগার দলপতি জানান, এই পারফরম্যান্স শ্রীলঙ্কা সফরে কাজে দেবে। দেশের মাটিতে স্পোর্টিং উইকেট বানিয়ে বিদেশে খেলার পরিবেশ তৈরি করছিল বিসিবি। ২০২৩ সালে নিউজিল্যান্ড সিরিজ থেকে স্পোর্টিং উইকেটে খেলা হচ্ছে। কিউইদের বিপক্ষে সিলেটে ঐতিহাসিক জয় পেলেও মিরপুর থেকে হারতে শুরু করে। দেশের মাটিতে টানা ছয় হারের পর জয়ের দেখা পেল বাংলাদেশ।