Prothomalo:
2025-09-18@04:57:36 GMT

দাদাভাইকে মনে পড়ে

Published: 9th, April 2025 GMT

১৯৭৯ সালে আমি ঢাকায় এসে চারুকলায় ভর্তি হই। তখন দেশের বড় সংবাদপত্র ইত্তেফাক। কুমিল্লার মানুষ শিল্পী আইনুল হক এই পত্রিকার সাহিত্য বিভাগের শিল্পী এবং শিশুসংগঠন ‘কচি–কাঁচার মেলা’র সাধারণ সম্পাদক। এলাকার মানুষ হিসেবে মাঝেমধ্যেই ইত্তেফাক–এ তাঁর সঙ্গে দেখা করি। রোকনুজ্জামান খান দাদাভাই ইত্তেফাক–এর ফিচার সম্পাদক ও কচি–কাঁচার মেলার পরিচালক। পাশেই সাহিত্য বিভাগ দেখেন কবি আল মুজাহিদী। দাদাভাইয়ের সঙ্গে আমার পরিচয় করিয়ে দেন আইনুল হক ভাই।

‘বাকবাকুম পায়রা মাথায় দিয়ে টায়রা’ ও ‘গাধার কান’ রোকনুজ্জামান খান দাদাভাইয়ের দুটি ছড়া পাঠ্যবইয়ে পড়ে এসেছি। মানুষটাকে সামনাসামনি দেখে রোমাঞ্চিত হই। দাদাভাই আমাকে ডাকতে শুরু করেন ‘শ্রীমান’ বলে। একসময় ‘কচি–কাঁচার আসর’ ও ‘মহিলা অঙ্গন’ ক্রোড়পত্রের কিছু ইলাস্ট্রেশন করতে দেন আমাকে। মহিলা অঙ্গন পাতার সম্পাদক ছিলেন বেবী মওদুদ। ইত্তেফাক–এ গেলে আইনুল হক ভাই ও বেবী আপা আমাকে খাওয়াতেন ঐতিহ্যবাহী দেশবন্ধু হোটেলের রুটি-ভাজি।

সারা দেশে কচি–কাঁচার মেলার শাখা আসরের সংখ্যা তিন শতাধিক। সংগঠনের কাজে প্রচুর সময় দিতে হয় দাদাভাইকে। শাখা আসরগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ রাখা, পাশাপাশি দাপ্তরিক কাজ তো আছেই। তখন ইত্তেফাক–এর প্রচারসংখ্যা শীর্ষে। প্রতিদিন বিকেল থেকে রাত ১১টা–১২টা পর্যন্ত দাদাভাইয়ের কচি-কাঁচার মেলার অফিসে কাটে। ৫৮/১এ পুরানা পল্টনে ক্রীড়া নিয়ন্ত্রণ বোর্ডের উত্তর পাশে কচি–কাঁচার মেলার অফিস। এখানে বসে ইত্তেফাক–এর বিশেষ সংখ্যা ও বেগম–এর চূড়ান্ত সম্পাদনার কাজটি করেন। দাদাভাইয়ের স্ত্রী নূরজাহান বেগম বিখ্যাত বেগম পত্রিকার সম্পাদক, শ্বশুর সওগাত সম্পাদক মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীন।

১৯৮৮ সালের দিকে আমি তখন দৈনিক বাংলা ভবনের সাপ্তাহিক বিচিত্রার আর্টিস্ট। দাদাভাই মাঝেমধ্যে তখন হুট করে বিচিত্রা অফিসে চলে আসতেন।

এক রুমের বিচিত্রার অফিস। গাদাগাদি করে বসতে হয়। দাদাভাইয়ের বগলে পাণ্ডুলিপির ফাইল। আমাকে ইত্তেফাক–এর ঈদসংখ্যার গল্পের ইলাস্ট্রেশন করতে দিয়ে যেতেন। দাদাভাই অফিসে এলেই সম্পাদক শাহাদত চৌধুরী, শাহরিয়ার কবির, মঈনুল আহসান সাবের—দাদাভাইকে ঘিরে দাঁড়াতেন। শাহাদত ভাইসহ অনেকেই ছিলেন কচি–কাঁচার মেলার সাবেক কর্মী। দাদাভাই চেয়ার ধরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কথা বলে চলে যেতেন অথবা বলতেন, ‘শ্রীমান, সন্ধ্যায় মেলার অফিসে এসো।’

সন্ধ্যায় মেলার অফিসে গিয়ে দেখি, দাদাভাইয়ের সামনে ঘিরে বসে আছেন কথাসাহিত্যিক শওকত ওসমান, শওকত আলী, বিজ্ঞানলেখক আবদুল্লাহ আল–মুতী শরফুদ্দিন, শিল্পী হাশেম খান, প্রাণেশ মণ্ডল, আবুল বার্‌ক্‌ আলভী প্রমুখ। পান খেয়ে ঠোঁট টুকটুকে লাল করে বসে আছেন কথাসাহিত্যিক রিজিয়া রহমান। দাদাভাই বসে আছেন, তাঁর টেবিলের ওপর চিঠিপত্র, ছড়া-কবিতার স্তূপ। পেপারওয়েট দিয়ে চাপা দেওয়া। এত পেপারওয়েট কোথায় পাবেন, ছোট ছোট পাথর দিয়ে চাপা দেওয়া আছে চিঠিপত্র। সময়টা আশির দশকের মাঝামাঝি, তখনো চুয়াত্তর-পঁচাত্তরে আসা অনেক চিঠির খাম খোলা হয়নি।

আমরা শিল্পীরা বসে আছি এক এক করে গল্পের পাণ্ডুলিপি হাতে নিয়ে। তোতলাতে তোতলাতে গল্পটা সিরিয়াসলি বলে যাচ্ছেন দাদাভাই। আমরা শুনছি। কোন জায়গাটা আঁকতে হবে, তা আন্ডারলাইন করে বলে দিতেন। ইত্তেফাক–এর পর বেগম–এর ঈদসংখ্যার লেখা।

দৌড় দিয়ে পালিয়ে যেতে ইচ্ছা হতো, পুরো গল্পটা দাদাভাই মুখে বলতেন। চা–শিঙাড়া খাচ্ছি। দাদাভাইয়ের ডান পাশে স্ট্যান্ডের ওপর সাদা–কালো টেলিভিশন। এটা চলত প্রায়ই ঝিরঝির করে। ভেতরের মানুষগুলো এঁকেবেঁকে যাচ্ছে। দাদাভাই সেটাই মনোযোগ দিয়ে দেখছেন। মাঝেমধ্যে টিভিতে চাঁটি মারছেন।

ঢাকায় পড়তে এসে আমার ঠিকানা হয় খেলাঘর অফিসে—৮২ নয়াপল্টনে। একবার ঢাকায় ভীষণ শীত পড়েছে। আমার জামাকাপড় বিশেষ কিছু নেই। একদিন সন্ধ্যায় কচি–কাঁচার অফিসের সামনে দাঁড়িয়ে আছি, দাদাভাই অফিস থেকে বেরিয়ে যেতে আইনুল হক ভাইকে কী যেন বলে গেলেন। কিছুক্ষণ পর এসে একটি প্যাকেট হাতে দিয়ে বললেন, ‘খুব শীত পড়েছে, সোয়েটারটা গায়ে লাগে কি না, দেখ। না হলে পাল্টে আনা যাবে।’

কচি–কাঁচার অফিসে তিনতলায় বাচ্চাদের ক্লাস হয়। সেখানে দেয়ালজুড়ে স্থায়ী একটা প্রদর্শনীর গ্যালারি করবেন। দেয়ালে বোর্ড লাগানো হয়েছে। রং করতে হবে। রংমিস্ত্রি পাওয়া যাচ্ছে না। ঈদের ছুটিতে কাজটা করাতে চান দাদাভাই। তখন টাকাপয়সার অভাবে আর চলতে পারছি না। আইনুল হক ভাইকে বললাম রং করার কাজটা আমাকে দিতে। আইনুল হক ভাই দাদাভাইকে এ কথা জানালে তিনি বলেন, ‘এটা রংমিস্ত্রির কাজ। ও কেন করবে?’

আইনুল হক ভাই দাদাভাইকে রাজি করান।

আমি টুলের ওপর দাঁড়িয়ে দেয়ালে সিরিশ ঘষছি, সারা শরীরে দেয়ালের চুনকালি। খাবারের সময় দাদাভাই দেশবন্ধুর রুটি–ভাজি, শিঙাড়া নিয়ে নিচে দাঁড়িয়ে থাকতেন, আমার খুব মনে পড়ে।

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: ম ল র অফ স

এছাড়াও পড়ুন:

অমর একুশে বইমেলা ফেব্রুয়ারিকে স্পর্শ করুক

অমর একুশে বইমেলা বাংলাদেশের মানুষের প্রাণের মেলা। মূলত প্রকাশকদের উদ্যোগে মুক্তিযুদ্ধ উত্তর বাংলাদেশে এই বইমেলার সূত্রপাত। সম্প্রতি এই বইমেলা নানা কারণে-অকারণে ডিসেম্বরে করার কথা শোনা যাচ্ছে। এ প্রেক্ষিতে সুস্পষ্টভাবে বলতেই হচ্ছে -ডিসেম্বরে কিছুতেই মেলা করা যাবে না। কারণ সেসময় সারাদেশে শিক্ষার্থীদের বার্ষিক পরীক্ষা চলবে।

বইমেলার প্রধান পাঠক আমাদের শিক্ষার্থী। তারা ডিসেম্বরে কিছুতেই মেলায় আসতে পারবে না। প্রধান পাঠকই যদি মেলায় আসতে না পারে তাহলে মেলা প্রাণহীন হয়ে পড়বে। বইমেলায় অংশগ্রহণকারি প্রকাশকরাও ভয়াবহ ক্ষতির মুখে পড়বে। তাছাড়া একুশের চেতনাকে ধারণ করে যে অমর একুশে বইমেলা, সেটা ফেব্রুয়ারিকে স্পর্শ করুক। ভাষা শহীদদরর প্রতি বইমেলার মাধ্যমে আমাদের যে শ্রদ্ধাঞ্জলি, তা অক্ষুন্ন থাকুক। 

আরো পড়ুন:

রাজশাহীতে বইপড়ায় কৃতিত্বের পুরস্কার পেল ২৩০৩ শিক্ষার্থী

‘গল্পকারের পছন্দের ৫০ গল্প’ গ্রন্থ প্রকাশিত

সর্বোপরি ৫ জানুয়ারি থেকে ৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, এই সময়ে বইমেলা হতে কোন সমস্যা হওয়ার কথা নয়। অথবা তারিখ দুই একদিন এদিক-সেদিক করে নেয়া যেতে পারে। এ সময়ে রোজা নেই, নির্বাচনও নেই। নির্বাচনী ক্যাম্পেইন চলবে। এই মাঠে বইমেলা চলাকালীন সর্বদলীয় সিদ্ধান্তে কেউ সভা-সমাবেশ না করার সিদ্ধান্ত নিলে অনায়াসে এই সময়টাতে বইমেলা করা যেতে পারে। আমার বিশ্বাস- সব দলই অমর একুশে বইমেলার জন্য এই ছাড়টুকু দেবেন।

প্রায় পঞ্চাশ বছরের অধিক সময়ের  প্রচেষ্টায় অমর একুশে বইমেলা মহিরুহ হয়ে আমাদের কাছে আবির্ভূত, হঠকারি কোন সিদ্ধান্তে তা যেনো ধ্বংস হওয়ার উপক্রম না হয়। জেনে শুনে বাঙালির এতো বড় একটি সাংস্কৃতিক উৎসবকে ভয়াবহভাবে ক্ষতিগ্রস্থ না করে বরং তা যে কোন মূল্যে আমাদের রক্ষা করা উচিত।

জানুয়ারিতে বাণিজ্যমেলায়ও হয়ে থাকে। এতে অমর একুশে বইমেলার ওপর কোনো বিরূপ প্রভাব পড়বে বলে আমি তা মনে করি না। বইমেলার প্রধান পাঠক শিক্ষার্থী। তারা বইমেলায় আসার জন্য মুখিয়ে থাকে। বাণিজ্য মেলায় যাওয়ার লোকজন বেশির ভাগই আলাদা। তবে অনেকেই বইমেলা এবং বাণিজ্যমেলা দুটোতেই যান। এটা তারা ম্যানেজ করে নিতে পারবেন বলে আমার বিশ্বাস।

আমি বলেছি শুধুমাত্র মেলার মাঠ প্রাঙ্গনে সভা-সমাবেশ না করার মাধ্যমে যদি সর্বদলীয় একটা সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় তাহলে জানুয়ারি- ফেব্রুয়ারি মিলিয়ে  বইমেলা করা সম্ভব।আমার মনে হয়, বইমেলা চলাকালীন এই মাঠ কোন দলকে সভা-সমাবেশের জন্য সরকার বরাদ্দ না দিলে, অথবা বইমেলা চলাকালীন দলগুলো নিজের থেকেই এই মাঠের বরাদ্দ না চাইলে সমস্যা আর থাকে না।

লেখক: প্রকাশক পাঞ্জেরী পাবলিকেশন্স লিমিটেড

ঢাকা/লিপি

সম্পর্কিত নিবন্ধ