প্রাকৃতিক দুর্যোগের ভেতর এই একটিমাত্র দুর্যোগ কোনো পূর্বাভাস দিয়ে আসে না। তবে দীর্ঘদিন যাবৎ এর আসন্নতার লক্ষণ প্রকাশ করে। অতিসম্প্রতি, ২৮ মার্চ, ভয়াবহ ভূমিকম্প প্রত্যক্ষ করেছে পৃথিবীর মানুষ। মিয়ানমার ও থাইল্যান্ডে ৫ হাজারেরও বেশি মানুষের প্রাণহানি ঘটেছে, নেমে এসেছে ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয়, এবং উদ্ধারকাজ এখনও চলমান। আমরা বিভিন্ন মানুষের ধারণকৃত ভিডিওচিত্রে দেখেছি, তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়ছে বহুতল দালান। ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়ছে মানুষ। ধুলার মেঘে ঢেকে যাচ্ছে গোটা শহর। উপদ্রুত এলাকা থেকে দ্রুত সরে পড়তে চেষ্টা করছে আক্রান্ত মানুষ।
বাংলাদেশও কি উচ্চঝুঁকির মধ্যে নেই? এক দশকেরও বেশি সময় ধরে বলা হচ্ছে, বড় ধরনের ভূমিকম্পের শিকার হতে পারে বাংলাদেশ। তবে নেই প্রস্তুতি। যে প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের বিপরীতে বৃহত্তর প্রস্তুতি গ্রহণের জন্য ঘটনার কারণ, ধরনসহ সম্যক প্রকৃতি জানা জরুরি। একাধিক ভূমিকম্পের আশঙ্কা অনুধাবন করে চলতি বছরে ২৮ জানুয়ারি ভূগোল-বিষয়ক গণমাধ্যম ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক একটি প্রতিবেদন ‘হোয়াট কজেস আর্থকোয়াক’ অথবা ‘কেন ভূমিকম্প হয়’ এই শিরোনামে একটি নিবন্ধ উপস্থাপন করে। লেখাটি সেই নিবন্ধের অনুসরণে লিখিত।
ভূমিকম্পের কারণ
ভূমিকম্প এতটাই ভয়াবহ ধ্বংসাত্মক হতে পারে যে, বিশ্বজুড়ে প্রতিদিন ছোট ছোট কম্পন হাজার হাজার মানুষ দ্বারা অনুভূত হয়; তা কল্পনা করাও কঠিন। বেশির ভাগই এত ছোট যে মানুষ তা অনুভব করতে পারে না। ছোট ভূমিকম্পও আলোড়ন সৃষ্টি করতে পারে, সবশেষে মেইনের ইয়র্ক হারবারের কাছে চলতি বছরের ২৭ জানুয়ারি ৩.
সবচেয়ে বেশি ভূমিকম্প কোথায় হয়
পৃথিবীর প্রায় ৮০ শতাংশ ভূমিকম্প প্রশান্ত মহাসাগরের তীরে ঘটে, যাকে “আগুনের বলয়” বলা হয়। কারণ, সেখানে আগ্নেয়গিরির কার্যকলাপও বেশি থাকে। বেশির ভাগ ভূমিকম্প ফল্ট জোনে ঘটে, যেখানে টেকটোনিক প্লেটগুলো পৃথিবীর ওপরের স্তর তৈরি করে, এমন বিশাল শিলা স্ল্যাবগুলো একে অপরের সঙ্গে সংঘর্ষের সৃষ্টি হয়। এই প্রভাবগুলো সাধারণত ধীরে ধীরে হয় এবং উপরিভাগে অলক্ষিত। তবে প্লেটগুলোর মধ্যে প্রচণ্ড চাপ তৈরি হতে পারে। যখন এই চাপ দ্রুত নির্গত হয়, তখন এটি বিশাল কম্পনের সৃষ্টি করে, যাকে সিসমিক তরঙ্গ বলা হয়। এটি প্রায়ই পাথরের মধ্য দিয়ে শত শত মাইল দূরে এবং পৃষ্ঠে উঠে যায়। প্লেটগুলো প্রসারিত বা চাপা হলে ফল্ট জোন থেকে অনেক দূরে অন্যান্য ভূমিকম্প ঘটতে পারে।
ফল্টের ধরন
ডিপ স্লিপ ফল্ট, রিভার্স ফল্ট, স্ট্রাইক স্লিপ ফল্টসহ বিভিন্ন ধরনের ফল্ট রয়েছে। এখানে তাদের বর্ণনা দেওয়া হলো।
স্ট্রাইক স্লিপ
যখন পৃথিবীর ভূত্বকের কিছু অংশ পার্শ্ব অভিমুখে সরে যায়, তখন ফলাফল “স্ট্রাইক স্লিপ” ফল্ট বরাবর একটি অনুভূমিক গতি হয়। সবচেয়ে বিখ্যাত উদাহরণ হলো ক্যালিফোর্নিয়ার সান আন্দ্রেয়াস ফল্ট, যা দক্ষিণ ক্যালিফোর্নিয়া থেকে সান ফ্রান্সিসকোর উত্তরে প্রায় ৬০০ মাইল (১০০০ কিলোমিটার) বিস্তৃত। ফল্টের শাখাগুলোর পার্শ্ব অভিমুখ গতি উত্তর আমেরিকার মহাদেশীয় ভূত্বকের নিচে উত্তর-পশ্চিমে প্রশান্ত মহাসাগরের ভূত্বক প্লেটের সরে যাওয়ার কারণে ঘটে।
ডিপ স্লিপ
ভূমিকম্পে ওপর-নিচে গতি তথাকথিত “ডিপ স্লিপ” ফল্টের ওপর ঘটে, যেখানে ফল্ট জোনের ওপরের ভূমি হয় নেমে যায় (একটি স্বাভাবিক ফল্ট) অথবা ওপরে ঠেলে দেওয়া হয় (একটি বিপরীত ফল্ট)। একটি স্বাভাবিক ফল্ট ঘটে, যেখানে ভূত্বকের গভীর অংশ একটি ওপরের অংশ থেকে সরে যায়।
একটি সাধারণ ফল্টের উদাহরণ হলো উটাহ ও আইডাহোর অন্তর্নিহিত ২৪০ মাইল দীর্ঘ ওয়াসাচ ফল্ট, যা আবার পশ্চিম-উত্তর আমেরিকার নিচে প্রশান্ত মহাসাগরীয় প্লেট চলাচলের কারণে ঘটে। সম্ভবত ৫৫০ বছর আগে ফল্ট বরাবর ৭.০ মাত্রার একটি ভূমিকম্প ফল্টের একপাশে তিন ফুট (এক মিটার) মাটি বিদীর্ণ করে ফেলেছিল। মার্কিন ভূতাত্ত্বিক জরিপ এই ফল্টটিকে ৭.০ মাত্রার বেশি ভূমিকম্পের ঝুঁকি হিসেবে দেখেছে।
তির্যক
ভূমিকম্পবিদরা যেসব ফল্টের সাথে পার্শ্ববর্তী অংশে ওপরে-নিচে গতি একত্র হয়, তাকে তির্যক বলে। সান ফ্রান্সিসকোর দক্ষিণে সান্তা ক্লারা ভ্যালিতে তির্যক গতির প্রবণতা রয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, ১৯৯৯ সালের এক ভূমিকম্পে দেখা গিয়েছে।
ভূমিকম্পের মাত্রার রেটিং
বিজ্ঞানীরা ভূমিকম্পের তীব্রতা এবং সময়কালের ওপর ভিত্তি করে ভূমিকম্পের মাত্রা নির্ধারণ করেন। ৩ থেকে ৪.৯ মাত্রার ভূমিকম্পকে ছোট বা হালকা বলে মনে করা হয়; ৫ থেকে ৬.৯ মাত্রার ভূমিকম্পকে মাঝারি থেকে শক্তিশালী বলে মনে করা হয়; ৭ থেকে ৭.৯ মাত্রার ভূমিকম্পকে বড় এবং ৮ বা তার বেশি মাত্রার ভূমিকম্পকে বড় বলে মনে করা হয়। ভূমিকম্পের পরে সর্বদা আফটারশক হয়, যা মূল ভূমিকম্পের পরে ছোট ভূমিকম্প এবং কয়েক সপ্তাহ ধরে চলতে পারে। এমনকি কিছু ক্ষেত্রে বছরের পর বছর পর্যন্ত। ইউএসজিএস অনুসারে, কিছু ভূমিকম্পের পূর্বাভাসও থাকে অথবা ছোট ভূমিকম্প; যা বড় ভূমিকম্পের আগে হয়। সবচেয়ে শক্তিশালী ভূমিকম্প ছিল ১৯৬০ সালে দক্ষিণ চিলিতে আঘাত হানা ৯.৫ মাত্রার ভূমিকম্প। সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত শহরটির নাম অনুসারে ভালদিভিয়া ভূমিকম্পে প্রায় ১ হাজার ৬৫৫ জন নিহত হয়। এ ছাড়া দুই মিলিয়ন মানুষ গৃহহীন হয়ে পড়ে। এর ফলে প্রশান্ত মহাসাগরজুড়ে ছড়িয়ে পড়া সুনামির সৃষ্টি হয় এবং জাপান, হাওয়াই ও নিউজিল্যান্ডের উপকূলরেখা প্লাবিত হয়।
ভূমিকম্পের ক্ষতি বিবেচনায় করণীয়
গড়ে প্রতি বছর কোথাও না কোথাও ৮ মাত্রার ভূমিকম্প হয় এবং প্রতি বছর গড়ে প্রায় ১০ হাজার মানুষ ভূমিকম্পে মারা যায়। গত মাসের ভূমিকম্পেই মৃতের সংখ্যা ৫ হাজার ছাড়িয়ে গেছে। বছরজুড়ে পৃথিবীর নানান জায়গায় আরও ভূমিকম্প অনুভূত হবে, তাতে কোনো সন্দেহ নাই। বেশির ভাগ প্রাণহানির ঘটনা ঘটে ভবন ধসে, তবে ধ্বংস প্রায়ই কাদামাটির ধস, আগুন, বন্যা বা সুনামিতে ঘটে। বড় ভূমিকম্পের পরের দিনগুলোতে সাধারণত ছোট ছোট ভূমিকম্প হয়, যা উদ্ধার প্রচেষ্টাকে জটিল করে তুলতে পারে এবং আরও মৃত্যু ও ধ্বংসের কারণ হতে পারে।
বাংলাদেশকে দীর্ঘকাল ধরে চোখ রাঙাচ্ছে ইন্ডিয়ান-বার্মা প্লেট। সম্প্রতি মিয়ানমার-থাইল্যান্ডকে বিপর্যস্ত করে তোলা ভূমিকম্পের মাত্রা ছিল গড়ে ৭.৭। বাংলাদেশসহ আশপাশের অঞ্চলে ভূমিকম্পের অনুমিত মাত্রা ধরা হয়েছে ৮.২ থেকে ৯। কাঠামোগত কারণে সবচেয়ে বেশি প্রাণহানির আশঙ্কা করা হচ্ছে ঢাকা ও চট্টগ্রামে। সরকারের প্রয়োজন– দ্রুত জরুরি পরিকল্পনা প্রণয়ন। এ পরিকল্পনা নগরায়ণসংক্রান্ত ও ক্ষয়ক্ষতি তুলনামূলক নিরসন উদ্ধারকার্যের প্রস্তুতিসংক্রান্ত হতে পারে। সরকারের পক্ষ থেকে নাগরিকদের এ-সংক্রান্ত শিক্ষা ও দীক্ষা দান জরুরি। ভূমিকম্পে ভেঙে পড়ার পরিবর্তে তরঙ্গঘাত সহ্য করে দুলতে থাকবে এমন নির্মাণশৈলীর (বেস আইসোলেশন) ভবন নির্মাণ উৎসাহিত করা যেতে পারে। v
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: ভ ম কম প ম ত র র ভ ম কম প ভ ম কম প র প ছ ট ভ ম কম প ভ ম কম প ক প ফল ট ফল ট র ভ ত বক র ওপর সবচ য
এছাড়াও পড়ুন:
বিস্ফোরক মামলায় চিন্ময় দাসকে কারাফটকে জিজ্ঞাসাবাদের আদেশ
চট্টগ্রামে বিস্ফোরক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে করা মামলায় সনাতনী জাগরণ জোটের মুখপত্র চিন্ময় দাসকে কারাফটকে জিজ্ঞাসাবাদের আদেশ দিয়েছেন আদালত। পুলিশের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে আজ সোমবার দুপুরে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট এস এম আলাউদ্দিন এ আদেশ দেন।
নগর পুলিশের অতিরিক্ত উপকমিশনার (প্রসিকিউশন) মফিজ উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, কারাগারে থাকা চিন্ময় দাসকে কোতোয়ালি থানার বিস্ফোরক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনের মামলায় কারাফটকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আবেদন করেন মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা। শুনানি শেষে আদালত তা মঞ্জুর করেছেন।
গত বছরের ২৬ নভেম্বর সনাতনী জাগরণ জোটের মুখপত্র চিন্ময় দাসের জামিনকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষের মধ্যে আইনজীবী সাইফুলকে পিটিয়ে ও কুপিয়ে হত্যা করা হয়। এ হত্যার ঘটনায় তাঁর বাবা জামাল উদ্দিন বাদী হয়ে ৩১ জনের নাম উল্লেখ করে হত্যা মামলা করেন। এ ছাড়া পুলিশের ওপর হামলা, কাজে বাধা এবং আইনজীবী ও বিচারপ্রার্থীদের ওপর হামলা ও ককটেল বিস্ফোরণের ঘটনায় আরও পাঁচটি মামলা হয়। ৬টি মামলায় গ্রেপ্তার হন ৫১ জন। তাঁদের মধ্যে হত্যায় জড়িত অভিযোগে ২১ জন গ্রেপ্তার রয়েছেন।
আদালত সূত্র জানায়, সাইফুল হত্যার আসামিদের মধ্যে চন্দন দাস, রিপন দাস ও রাজীব ভট্টাচার্য আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। এতে উল্লেখ করা হয়, আইনজীবীর ঘাড়ে বঁটি দিয়ে দুটি কোপ দেন রিপন দাস। আর কিরিচ দিয়ে কোপান চন্দন দাস। পরে রাস্তায় পড়ে থাকা সাদা শার্ট ও কালো প্যান্ট পরা এই আইনজীবীকে লাঠি, বাটাম, ইট, কিরিচ ও বঁটি দিয়ে তাঁরা ১৫ থেকে ২০ জন পিটিয়ে হত্যা করেন।
গত বছরের ৩১ অক্টোবর চট্টগ্রাম নগরের চান্দগাঁও মোহরা ওয়ার্ড বিএনপির তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক ফিরোজ খান বাদী হয়ে কোতোয়ালি থানায় চিন্ময় দাসসহ ১৯ জনের বিরুদ্ধে জাতীয় পতাকা অবমাননায় রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগে মামলা করেন। পরে ফিরোজ খানকে বিএনপি থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। এ মামলায় চিন্ময় দাসকে ২৫ নভেম্বর ঢাকা থেকে গ্রেপ্তার করা হয়।