সারাদেশে ১ মে থেকে ডিম ও মুরগির খামার বন্ধ রাখার ঘোষণা দিয়েছে প্রান্তিক খামারিদের সংগঠন বাংলাদেশ পোল্ট্রি অ্যাসোসিয়েশন (বিপিএ)। আজ বৃহস্পতিবার গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিবৃতিতে এ তথ্য জানানো হয়েছে।

বিবৃতিতে বিপিএ’র সভাপতি মো. সুমন হাওলাদার অভিযোগ করেন, সারাদেশে প্রান্তিক ডিম ও মুরগির খামারিদের মধ্যে হাহাকার দেখা দিয়েছে। গত দুই মাসে প্রায় ১ হাজার ২৬০ কোটি টাকার লোকসানের মুখে পড়েছেন তারা। এমন পরিস্থিতিতেও সরকার নীরব ভূমিকা পালন করছে।

বিপিএ সভাপতি বলেন, প্রান্তিক খামারিরা রমজান ও ঈদ মৌসুমেও ভয়াবহ লোকসান গুণে প্রতিদিন ২০ লাখ কেজি মুরগি উৎপাদন করেছেন। প্রতি কেজিতে ৩০ টাকা লোকসান ধরে এক মাসে লোকসান হয়েছে প্রায় ৯০০ কোটি টাকা। এছাড়া দৈনিক ৪ কোটি ডিমের মধ্যে ৩ কোটি ডিম উৎপাদন করেছেন প্রান্তিক খামারিরা। প্রতি ডিমে ২ টাকা করে লোকসান ধরে দুই মাসে ডিমে লোকসান হয়েছে ৩৬০ কোটি টাকা। সবমিলিয়ে দুই মাসে ডিম ও মুরগির খাতে মোট ১ হাজার ২৬০ কোটি টাকা লোকসান দাঁড়িয়েছে।

এই অবস্থায় সরকার ও নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর নীরব ভূমিকার সুযোগে কিছু করপোরেট কোম্পানি পুরো পোল্ট্রি শিল্প দখলের ষড়যন্ত্রে নেমেছে উল্লেখ করে বিবৃতিতে বলা হয়, করপোরেট কোম্পানিগুলো শুধু ফিড, বাচ্চা ও ওষুধই নয়; ডিম ও মুরগির বাজারও নিয়ন্ত্রণ করছে। তারা কৃত্রিম সংকট তৈরি করে ‘কন্ট্রাক্ট ফার্মিংয়ের’ দাসত্বের দিকে ঠেলে দিচ্ছে প্রান্তিক খামারিদের।

বিবৃতিতে বিপিএ সভাপতি বলেন, আমরা করপোরেট দাসত্ব মানবো না। আগামী ১ মে থেকে সারাদেশে প্রান্তিক খামারিরা খামার বন্ধ রাখবেন। সরকার যতক্ষণ পর্যন্ত সিন্ডিকেট ভাঙতে কার্যকর ব্যবস্থা না নেবে, ততক্ষণ পর্যন্ত এ কর্মসূচি চলবে।

গণমাধ্যমে পাঠানো ওই বিবৃতিতে বাংলাদেশ পোল্ট্রি অ্যাসোসিয়েশনের (বিপিএ) পক্ষ থেকে ১০ দফা দাবি জানানো হয়েছে। দাবিগুলো হলো-

১) পোল্ট্রি পণ্যের জন্য জাতীয় মূল্যনিয়ন্ত্রণ নীতিমালা ও নির্ধারণ কমিটি গঠন করতে হবে।
২) ‘কন্ট্রাক্ট ফার্মিং’ নিয়ন্ত্রণে কঠোর আইন করে এটি নিষিদ্ধ করতে হবে।
৩) পোল্ট্রি বাজার রেগুলেটরি অথরিটি গঠন করতে হবে।
৪) ক্ষতিগ্রস্ত খামারিদের জন্য সরকারের পুনর্বাসন প্যাকেজ দিতে হবে।
৫) খামারিদের রেজিস্ট্রেশন ও আইডি কার্ড দিতে হবে।
৬) কোম্পানিকে শুধু কাঁচামাল উৎপাদনে সীমাবদ্ধ রাখতে হবে।
৭) কন্ট্রাক্ট ফার্মিং ও কোম্পানির খামার নিষিদ্ধ করতে হবে।
৮) কেজি ভিত্তিক ডিম ও মুরগি বিক্রির নীতিমালা প্রণয়ন করতে হবে।
৯) ডিম-মুরগির রপ্তানির সুযোগ বৃদ্ধিতে পদক্ষেপ নিতে হবে।
১০) পূর্ণাঙ্গ ‘পোল্ট্রি উন্নয়ন বোর্ড’ গঠন করতে হবে।

বিবৃতিতে এসব দাবি না মানা হলে কঠোর কর্মসূচি অব্যাহত থাকবে বলেও জানিয়েছে বাংলাদেশ পোল্ট্রি অ্যাসোসিয়েশন (বিপিএ)।

.

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: ম রগ র ড ম ম রগ ড ম ও ম রগ র ম রগ র খ সরক র

এছাড়াও পড়ুন:

আমার জন্মঋতু

আমি বন্ধনহীন মৌসুমী বায়ু—, ভ্রমি দেশে দেশে দেশে

শেষে পৌঁছেছি এনে আমার প্রিয় বাংলাদেশে।

তোমার স্পর্শ পেয়ে পেয়ে আমাকে ঝরতে হবে জানি।

তোমার প্রতিটি নদী-নালা, পথ-ঘাট, পুকুর-প্রান্তর,

খাল-বিল, গুহা-গিরি আমাকে করতে হবে জানি।

শরৎ আসার পরে আমাকে মরতে হবে জানি।

(বর্ষার মতো প্রেমিক)

প্রতিটি বর্ষায় আমি কিছু না কিছু কবিতা লিখি। আমাদের পত্রিকাগুলো বর্ষার ওপর বিশেষ সংখ্যা প্রকাশ করে। ওই সব পত্রিকার সাহিত্য বিভাগের সম্পাদকদের মধ্যে কেউ কেউ আমার কাছে বর্ষার ওপর রচিত নতুন কবিতা চান। আমি পারতপক্ষে তাদের নিরাশ করি না। বিষয়ভিত্তিক কবিতা রচনায় আমার মন আজকাল আগের মতো সাড়া দেয় না। তবে বর্ষার কথা ভিন্ন। বর্ষার আগমনে আমার কবিচিত্ত মাটির তলায় লুকিয়ে থাকা ব্যাঙের মতোই মহানন্দে আত্মপ্রকাশ করে তার প্রিয় সঙ্গমসঙ্গিনীকে খুঁজে বেড়ায়। ফলে প্রতিটি বর্ষায়, তা কোনো পত্রিকা আমার কাছে বর্ষার ওপর কবিতা চান বা না চান, আমি লিখি।

না লিখে পারি না আমার কবিতার সতর্ক পাঠক যদি থেকে থাকেন, তো মানলেন যে, আমার কবিতায় যে ঋতুটি সবচেয়ে বেশি প্রভাব রেখেছে, বারবার ঘুরে ফিরে এসেছে, তার নাম বর্ষা। আমার আরেক প্রিয় ঋতু হলো বসন্ত। বাংলার অন্য সকল কবির মতোই বসন্তেও আমি কম উন্মাদ হই না। তবে বর্ষার তুলনায় কম। এর কারণ, নিশ্চিত জানি আমার জন্মের মধ্যে নিহিত। বর্ষা আমার জন্মসূত্রে পাওয়া ঋতু। আষাঢ় মাসের সপ্তম দিনের এক বৃষ্টিঝরা সকালে আমার জন্য হয়েছিল। এ শুধুই আমার শোনা কথা নয়, আমার স্মৃতিকথাও। আমি কান পাতলেই আমার জন্মগ্রামের আকাশ কালো করে নামা সেই আষাঢ়ীবর্ষণের মার্গসংগীতধ্বনি এখনো স্পষ্ট শুনতে পাই।

বর্ষার ওপর রচিত আমার কবিতাসমূহের একটি পৃথক কাব্যসংকলন আমি প্রকাশ করেছি। বসন্তের ওপরও একটি কাব্যসংকলন আছে। তবে বর্ষার ওপর লেখা আমার কবিতার সংখ্যা যেমন বেশি, মান বিচারেও তারা অধিক গুণী। যে কবিতাটি ওপরে উদ্ধৃত করেছি, কোনো পত্রিকার সাহিত্য পাতার চাহিদা পূরণের জন্য নয়, বর্ষাসিক্ত কবিচিত্তের অন্তর্গত চাহিদা মেটাতেই সেটি সম্প্রতি রচিত হয়েছে। কবিতাটিতে বাংলাদেশকে কল্পনা করা হয়েছে গ্রীষ্মতপ্ত প্রেয়সীরূপে, কবি যেন বিরহী যক্ষ। মৌসুমি বায়ুরূপে বিশ্বভ্রমণ শেষে সে ফিরে এসেছে তার প্রেয়সীর দেহসীমায়। যক্ষপ্রিয়ার দেহের সকল তৃষিত অঞ্চলে সে ঢালবে তার সঙ্গে করে নিয়ে আসা মেঘজলধারা। আকাশ কাঁপিয়ে, শুকনো মাটি ভিজিয়ে নামবে বৃষ্টি। অবিচ্ছিন্ন লয়ে বাংলার তপ্তশুষ্ক মাটি আর মেঘভারেনত আকাশকে সে বেঁধে দেবে অন্তহীন অঝোর বর্ষণে।

এ হচ্ছে সেই বৃষ্টি, যা হয়েছিল নূহের প্লাবনের সময়; এ হচ্ছে সেই বৃষ্টি, মানবমনের ভেতরের সুপ্ত কাম ও বিরহবোধকে যে জাগ্রত করে, ববীন্দ্রনাথের মতো নমিতকামের কবিও তখন বিশ্বাস করেন—এমন দিনেই তারে বলা যায়, এমন ঘনঘোর বরিষায়, এ হচ্ছে সেই বৃষ্টি, পবিত্র বেদে যাকে কল্পনা করা হয়েছে মহান মৃত্যুর সঙ্গে। এ হচ্ছে সেই বৃষ্টি, কবি শহীদ কাদরী যাকে তুলনা করেছেন সন্ত্রাসের সঙ্গে।

আমার জীবনের প্রথম ষোল বছর প্রায় অবিচ্ছিন্নভাবে আমি আমার জন্মগ্রামে কাটিয়েছি। শহরে যারা জন্মগ্রহণ করেন তাদের জন্মকে সামান্যতম খাটো না করেও বলি, গ্রামে জন্মগ্রহণ করার জন্য আমি নিজেকে খুব সৌভাগ্যবান বলে মনে করি। প্রকৃতির সঙ্গে আমার যে সম্পর্ক, তাকে যে আমি খুব কাছের করে চিনেছি, আপন বলে জেনেছি, সেটা সম্ভব হয়েছে অবিচ্ছিন্নভাবে আমি আমার শৈশব-কৈশোর গ্রামের বন-জঙ্গলে কাটাতে পেরেছি বলেই। বাংলার ষড়ঋতুর রূপবৈচিত্র্যকে আমি খুব কাছে থেকে প্রত্যক্ষ করার যে সুযোগ পেয়েছি, তাকে আমি যে আমার কবিতায় সেভাবে ধরতে পারিনি, তার জন্য দায়ী আমার প্রয়োজনীয় কারাশক্তির অভাব। সে কারণে আমার আত্মগ্লানি আছে বটে, কিন্তু তার নিবিড় সান্নিধ্যলাভের স্মৃতি আমার চির গৌরবের ধন। প্রকৃতিকে আমি কখনো পেয়েছি প্রেয়সীরূপে, কখনো দেখেছি জননীরূপে। আমি বুঝেছি, তার সঙ্গে আমার অস্তিত্ব এক অন্তহীন লীলায় জড়ানো। ফলে বলা যায় একেবারে খোলা আকাশের তলায় দাঁড়িয়ে বর্ষার আগমন, অবতরণ ও তার প্রত্যাগমনকে দেহেমনে মিলিয়ে খুব কাছে থেকে প্রত্যক্ষ করেছি। গুনেছি আকাশে আকাশে মেয়ের গুরুগুরু ডাক। বুঝেছি, গ্রীষ্ম-অবসানে আসছে আমার। জন্মসহোদর, আমার সবচেয়ে প্রিয় ঋতু বর্ষা। আসছে আষাঢ়। আমার বেসুরো কণ্ঠেও লতিয়ে উঠেছে গান— 'আবার এসেছে আষাঢ় আকাশ ছেয়ে।' আহ, কী চমৎকার।

বর্ষা আমাকে খড়কুটোর মতো ভাসিয়ে নিয়ে গেছে তার সঙ্গে করে। দু কূল প্লাবিত করা নদীর আনন্দে, মাঠে-ঘাটে, ঝালে-বিলে, পুকুরে প্রান্তরে আমি বর্ষাকে তার জলজগৎ বিস্তার করতে দেখেছি। সে আমার কানে কানে বলেছে, আমি কীভাবে আমার দেশপ্রিয়ার সঙ্গে সঙ্গম করি দেখো। আমি দেখেছি। প্রাণ ভরে

দেখেছি বর্ষার রূপ।

আমি যখন এই বর্ষাবন্দনা লিখছি, তখন আষাঢ় গত হয়েছে। চলছে শ্রাবণ। শ্রাবণের পুরোটাই সামনে পড়ে আছে। বলা যায় এখন বর্ষার ভরা যৌবন। ঢাকায় বসে তার রূপ দেখছি টিভির পর্দা আর পত্রিকার পাতায়। তার প্রকৃত চেহারাটা দেখতে পাচ্ছিনে এখানে। এই নিয়ে কবিতাও লিখেছি। গ্রামে ছোট ভাইয়ের কাছে জানতে চাইলাম, বর্ষা, কতটা জাঁকিয়ে বসেছে সেখানে। সে জানিয়েছে, যদি বর্ষা বিষয়ে নতুন করে কিছু লিখতেই চাও তো গ্রামে চলে এসো। বর্ষা দেখে যাও। আজ তিন দিন হলো দিন-রাত বৃষ্টি। নদী-নালা, মাঠ-ঘাট, পথ-প্রান্তর ডুবিয়ে সে মেলে ধরেছে তার চোখজুড়ানো রূপ। আমি চোখ বন্ধ করে, কল্পনায় তার রূপ দেখলাম। মনে পড়ল, কত অপরূপ রূপে মা তোমায় হেরিনু পল্লীজননী।

বাংলার কবির কাছে, কবির চোখে বর্ষার কি আলাদা কোনো রূপ আছে? এর উত্তর সহজ নয়। জীবনানন্দ বলেছেন—সকলেই পবি নয়, কেউ কেউ করি। তার এই স্মরণীয় উক্তিটি ছোট কবিদের ভিড় থেকে বড় কবিদের পৃথক করার প্রয়োজন মেটায়। কিন্তু প্রকৃতির রাজ্যে সব মানুষই যে কমবেশি করি, আমার এই উপলব্ধিকে বাতিল করে না। বাংলার লোককবিদের রচিত কাব্যে, গানে তারই পরিচয় দেখতে পাই। অন্য কবিদের জন্মকথা বলতে পারিনে, তবে আমার কবিজন্ম যে বর্ষামায়ের গর্ভে, সে কথা না বললে নিশ্চিত জানি, স্বর্ণে বসে চিত্রগুপ্ত অকৃতজ্ঞের তালিকায় আমার নামটিও লিপিবদ্ধ করবেন।

সম্পর্কিত নিবন্ধ