ঝুঁকি বেড়ে গেছে বৈশ্বিক আর্থিক খাতের: আইএমএফ
Published: 23rd, April 2025 GMT
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের পাল্টা শুল্কঝড়ে বিশ্বের আর্থিক খাত চাপের মুখে পড়ে গেছে বলে জানিয়েছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)। এ পরিস্থিতিতে আর্থিক খাতের ঝুঁকি অনেকটা বেড়ে গেছে বলে মনে করছে সংস্থাটি।
পরিস্থিতি মোকাবিলায় উদীয়মান দেশগুলোকে রাজস্ব সংগ্রহ বৃদ্ধির পরামর্শ দিয়েছে আইএমএফ। সংস্থাটি বলছে, গত কয়েক বছরে উচ্চ নীতি সুদহারের কারণে উদীয়মান দেশগুলোকে উচ্চ সুদে ঋণ করতে হয়েছে। এখন পরিস্থিতির অবনতি হলেও তাদের আরও উচ্চ সুদে ঋণ নিতে হতে পারে। ফলে এসব দেশের রাজস্ব আদায় বাড়ানোর বিকল্প নেই বলে মনে করে আইএমএফ।
বিশ্বব্যাংক-আইএমএফের চলমান বসন্তকালীন সভা ২১ এপ্রিল যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটনে শুরু হয়েছে। এই সভাকে কেন্দ্র করে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক পূর্বাভাস–সংক্রান্ত প্রতিবেদনের পাশাপাশি আর্থিক স্থিতিশীলতা প্রতিবেদনও প্রকাশ করেছে আইএমএফ। সেই প্রতিবেদনে এসব ঝুঁকির কথা বলা হয়েছে।
আইএমএফের প্রতিবেদনে ঝুঁকিপূর্ণ আর্থিক সম্পদের মূল্যহ্রাসের কথাও বলা হয়। ট্রাম্পের পাল্টা শুল্ক ঘোষণার পর যেভাবে দেশে দেশে শেয়ারের দাম কমেছে, সেই বিষয়টি স্মরণ করিয়ে দিয়ে আইএমএফ বলেছে, ভবিষ্যতে শেয়ারের দাম আরও কমতে পারে।
বৈশ্বিক আর্থিক স্থিতিশীলতা সম্পর্কে আইএমএফ বলছে, একদিকে নীতিগত অনিশ্চয়তা বাড়ছে, আরেক দিকে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের গতিও কমে আসছে। এ দুটি বিষয় একত্র হওয়ায় নেতিবাচক পরিস্থিতি তৈরির ঝুঁকি বেড়ে গেছে। সংস্থাটি বলছে, বর্তমানে বৈশ্বিক আর্থিক খাত নানাবিধ ঝুঁকির মুখে আছে। বেশ কিছু খাতের শেয়ার ও বন্ডের দাম অতি মূল্যায়িত; এমনকি সাম্প্রতিক মূল্যহ্রাসের পরও এসব শেয়ারের দাম বেশি। এ ছাড়া হেজ ফান্ডসহ বেশ কিছু আর্থিক প্রতিষ্ঠান অতি মাত্রায় ঋণ নিয়েছে। ফলে তাদের বিনিয়োগ থেকে কাঙ্ক্ষিত মুনাফা না হলে এসব প্রতিষ্ঠান আরও ভঙ্গুর হয়ে যেতে পারে। সেই সঙ্গে বিশ্বের অনেক দেশের সরকারের ঋণও মাত্রা ছড়িয়ে গেছে। এখন সুদহার আরও বাড়লে বা তাদের অর্থনীতি দুর্বল হয়ে গেলে সরকারের ঋণ পরিশোধের সক্ষমতা কমবে।
সার্বভৌম বন্ডের বাজারে অস্থিরতা ছড়িয়ে পড়তে পারে বলে সতর্ক করেছে আইএমএফ, বিশেষ করে যেসব দেশে সরকারি ঋণের পরিমাণ বেশি। সংস্থাটির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এমনিতেই গত কয়েক বছরে উচ্চ নীতি সুদহারের কারণে উদীয়মান দেশগুলোকে উচ্চ সুদে ঋণ নিতে হয়েছে। এখন ট্রাম্পের শুল্কের ঝড়ে অর্থনৈতিক সংকট সৃষ্টি হলে তাদের আরও বেশি ঋণ করতে হতে পারে। বড় বড় অর্থনীতির দেশগুলো আর্থিক ঘাটতি মেটাতে হয়তো আরও বন্ড ছাড়বে, যদিও বন্ড বাজারের পরিস্থিতি আরও নাজুক।
এই বাস্তবতায় বিশ্ববাজারে ঋণের সুদ বাড়লে উদীয়মান দেশগুলো বিপদে পড়তে পারে বলে সতর্ক করেছে আইএমএফ। একদিকে এসব দেশের ঋণ পরিশোধের সক্ষমতা নিয়ে বিনিয়োগকারীদের মনে সন্দেহ। আরেক দিকে এসব দেশের আর্থিক খাতের ভঙ্গুরতার কারণে এই পরিস্থিতির আরও অবনতি হতে পারে। তাই আইএমএফ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ব্যাংকগুলোকে সতর্ক থাকার পরামর্শ দিয়েছে। সরকারের প্রতি তাদের পরামর্শ, সংকট মোকাবিলায় ব্যাংকগুলোর হাতে যেন পর্যাপ্ত তারল্য থাকে, তা নিশ্চিত করা। সুনির্দিষ্টভাবে আইএমএফের আহ্বান, এই সংকট মোকাবিলায় ব্যাংকগুলো যেন বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ব্যাংক ব্যাসেল-৩ নীতিমালা মেনে চলে। ২০০৮ সালের আর্থিক সংকটের পর ব্যাংকের স্বাস্থ্য সুরক্ষায় এই নীতিমালা প্রণয়ন করা হয়।
সম্প্রতি প্রাইভেট ক্রেডিট ফান্ড সিস্টেম বা বেসরকারি ঋণ তহবিল থেকে ঋণ নেওয়া বেড়ে গেছে। অনেক কোম্পানি এসব তহবিল থেকে ঋণ নিচ্ছে; বড় বড় বিনিয়োগকারী সেই তহবিলে সহায়তা করছে। আইএমএফের ভয়, এসব বেসরকারি ঋণ তহবিলের সংকট দ্রুতই অন্যান্য খাতে ছড়িয়ে পড়তে পারে। অনেক প্রতিষ্ঠান ও দেশ সে কারণে আক্রান্ত হতে পারে, কেননা এগুলো পরস্পরের সঙ্গে সম্পৃক্ত।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প যতই বিশ্বায়ন ছুড়ে ফেলার চেষ্টা করুন না কেন, আইএমএফ বলছে, বিশ্বের প্রতিটি দেশ পরস্পরের সঙ্গে এত বেশি সম্পৃক্ত যে এক দেশে আর্থিক সংকট তৈরি হলে তা আরেক দেশে ছড়িয়ে পড়তে খুব বেশি সময় লাগে না। তাই আইএমএফ মনে করছে, বৈশ্বিক প্রবৃদ্ধির গতি কমে আসবে। আইএমএফের নতুন পূর্বাভাস অনুসারে, বৈশ্বিক গড় জিডিপি প্রবৃদ্ধি হবে ২ দশমিক ৮ শতাংশ। আর এশিয়ার গড় জিডিপি হতে পারে সাড়ে ৪ শতাংশ।
ভূরাজনৈতিক ঝুঁকি উদ্ভূত সম্ভাব্য আর্থিক স্থিতিশীলতার ঝুঁকি মোকাবিলায় আর্থিক প্রতিষ্ঠান এবং তত্ত্বাবধানকারী সংস্থাগুলোকে ভূরাজনৈতিক ঝুঁকি চিহ্নিত, মাত্রা নির্ধারণ ও ব্যবস্থাপনার জন্য পর্যাপ্ত সম্পদ বরাদ্দ করা উচিত বলে মনে করে আইএমএফ। বিশেষ করে উদীয়মান বাজার ও উন্নয়নশীল অর্থনীতিগুলোকে প্রতিকূল ভূরাজনৈতিক অভিঘাত সামলানোর জন্য আর্থিক বাজারের গভীরতা বৃদ্ধির পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। পরিশেষে তারা বলেছে, যথেষ্ট পরিমাণে রাজস্ব সংগ্রহ করতে হবে। সেটা হলে সংকট মোকাবিলা করা সহজ হবে।
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: আর থ ক খ ত আইএমএফ ব আইএমএফ র পর স থ ত আর থ ক স র পর ম সরক র র আরও তহব ল
এছাড়াও পড়ুন:
রোজার আগেই নির্বাচন, এরপর আগের কাজে ফিরে যাবেন
অন্তর্বর্তী সরকার সময়মতো ও বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন আয়োজনের জন্য অঙ্গীকারবদ্ধ বলে উল্লেখ করেছেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস। তিনি বলেছেন, আগামী ফেব্রুয়ারিতে পবিত্র রমজানের আগেই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। নির্বাচনের পর তিনি তাঁর আগের কাজে ফিরে যাবেন।
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ব্যবস্থাপনা পরিচালক ক্রিস্টালিনা জর্জিয়েভাকে এসব কথা বলেছেন প্রধান উপদেষ্টা। মঙ্গলবার সন্ধ্যায় ওয়াশিংটন থেকে ভিডিও ফোনকলে অধ্যাপক ইউনূসের সঙ্গে কথা বলেন জর্জিয়েভা।
এ সময় তাঁরা বাংলাদেশের চলমান অর্থনৈতিক সংস্কার, আঞ্চলিক পরিস্থিতি এবং আগামী ফেব্রুয়ারিতে সাধারণ নির্বাচনের পূর্ববর্তী চ্যালেঞ্জ নিয়ে আলোচনা করেন।
আলোচনায় প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বের ভূয়সী প্রশংসা করেন ক্রিস্টালিনা জর্জিয়েভা। তিনি বলেন, অধ্যাপক ইউনূস দায়িত্ব গ্রহণের পর বাংলাদেশের অর্থনীতি উল্লেখযোগ্যভাবে ঘুরে দাঁড়িয়েছে এবং এই কৃতিত্ব তাঁর নিজের।
অর্থনীতির সংকটকালীন পরিস্থিতি স্মরণ করে আইএমএফ প্রধান বলেন, ‘আপনার অর্জন আমাকে মুগ্ধ করেছে। অল্প সময়ে আপনি অনেক কিছু করেছেন। যখন অবনতির ঝুঁকি অত্যন্ত বেশি ছিল, তখন আপনি দেশের দায়িত্ব নিয়েছেন। আপনি সঠিক সময়ে সঠিক ব্যক্তি।’
ক্রিস্টালিনা জর্জিয়েভা বিশেষভাবে বৈদেশিক মুদ্রা বাজারের স্থিতিশীলতা এবং রিজার্ভ পুনরুদ্ধারের জন্য সরকারের সাহসী পদক্ষেপ, বাজারভিত্তিক বিনিময় হার প্রবর্তনের প্রশংসা করেন।
অধ্যাপক ইউনূস বাংলাদেশের এক সংকটময় সময়ে আইএমএফ প্রধানের অবিচল সহায়তার জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে বলেন, ‘চমৎকার সহায়তার জন্য ধন্যবাদ।’ তিনি স্মরণ করিয়ে দেন, গত বছর নিউইয়র্কে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে তাঁদের প্রথম সাক্ষাৎ বাংলাদেশের অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের পথ সুগম করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল।
কথোপকথনে আইএমএফ প্রধান অভ্যন্তরীণ রাজস্ব আয় বৃদ্ধি এবং ব্যাংকিং খাতে গভীর সংস্কার বাস্তবায়নের ওপর গুরুত্বারোপ করেন। তিনি বলেন, ‘শক্ত অবস্থানে থাকতে হলে সংস্কার অনিবার্য। এটি বাংলাদেশের ইতিহাসের এক অমূল্য মুহূর্ত।’
অধ্যাপক ইউনূস জানান, তাঁর সরকার ইতিমধ্যে ব্যাংকিং খাত পুনর্গঠন এবং রাজস্ব সংগ্রহ জোরদারের জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। তিনি বলেন, ‘আমরা এক বিধ্বস্ত ও সম্পূর্ণ ভেঙে পড়া অর্থনীতি উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়েছি। কিছু ব্যক্তি আক্ষরিক অর্থে ব্যাগভর্তি টাকা ব্যাংক থেকে নিয়ে পালিয়ে গেছে।’
এ ছাড়া আঞ্চলিক পরিস্থিতি নিয়েও আলোচনা হয়। এর মধ্যে ছিল নেপালে চলমান যুব আন্দোলন এবং আসিয়ানভুক্তির জন্য বাংলাদেশের আকাঙ্ক্ষা। অধ্যাপক ইউনূস আঞ্চলিক কানেক্টিভিটি জোরদারের লক্ষ্যে ঢাকার বৃহৎ অবকাঠামো উদ্যোগ—যেমন নতুন বন্দর ও টার্মিনাল প্রকল্প—সম্পর্কেও অবহিত করেন।
আলোচনাকালে অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ এবং অর্থসচিব খায়রুজ্জামান মজুমদার উপস্থিত ছিলেন।