দেশ স্বাধীনের পর থেকে শ্রম মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে যাঁরা ছিলেন, তাঁরা কেউই শ্রমিকদের পক্ষে শিল্পমালিকদের বিরুদ্ধে দাঁড়াননি বলে মন্তব্য করেছেন শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন। তিনি বলেছেন, এত দিন যাঁরা শ্রম মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে ছিলেন, সবার সঙ্গে শিল্পমালিকদের স্বার্থের সম্পর্ক ছিল। এ কারণে এ মন্ত্রণালয়ে কেউ কখনো মালিকদের বিরুদ্ধে দাঁড়াননি।

আজ বুধবার সচিবালয়ে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে এক সংবাদ সম্মেলনে এ কথা বলেন শ্রম উপদেষ্টা। শ্রম সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদন নিয়ে এ সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়। সেখানে শ্রম উপদেষ্টার কাছে প্রতিবেদনটি তুলে দেন কমিশনের প্রধান সৈয়দ সুলতান উদ্দিন আহমেদ। এ সময় অন্যান্যের মধ্যে শ্রমসচিব এ এইচ এম সফিকুজ্জামানসহ শ্রম সংস্কার কমিশনের সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন। এর আগে ২১ এপ্রিল শ্রম সংস্কার প্রতিবেদনটি প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে জমা দেওয়া হয়।

শ্রম উপদেষ্টা বলেন, শ্রম মন্ত্রণালয়ে দায়িত্ব নেওয়ার পর শ্রমিকের পক্ষে তিনি বেশ কিছু পদক্ষেপ নিয়েছেন। শ্রমিকদের পক্ষে অবস্থান নিতে গিয়ে মালিকদের বিরুদ্ধে যেতে হয়েছে। তিনি বলেন, ‘তাঁরা আমার ওপর অনেক ক্ষ্যাপা। অনেক সংবাদ পাই। আমি তাঁদের বলেছি, আপনি মালিক সবকিছু করতে পারেন। গাড়িতে চড়েন। বিদেশে যান। আপনার কোনো অসুস্থতা হলে চিকিৎসকের কাছে যান। অথচ যখন আপনাকে শ্রমিকের বেতন দিতে বলা হয়, তখন আপনি নানাবিধ সমস্যা তুলে ধরেন। বলেন যে আমার টাকা নেই। আমাকে ব্যাংক ধরেছে। আপনাকে ব্যাংক ধরবে না কেন? আপনি ব্যাংক থেকে টাকা নিয়ে ফেরত দিচ্ছেন না। আপনাকে তো ব্যাংক ধরবেই।’

শ্রম সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনের বিষয়ে উপদেষ্টা বলেন, প্রতিবেদনটি পর্যালোচনা করতে এ মন্ত্রণালয়ের একজন অতিরিক্ত সচিবকে প্রধান করে একটি কমিটি গঠন করা হবে। কমিটি সংস্কার প্রতিবেদনের ওপর একটি সমীক্ষা করে দেখবে। ইতিমধ্যে কী কী বিষয় নিয়ে কাজ হয়ে গেছে। কতখানি সামঞ্জস্য আছে। কতটা পার্থক্য আছে।

এ প্রসঙ্গে উপদেষ্টা বলেন, ‘মনে রাখতে হবে, কমিশন তাদের সুপারিশ করেছে। বাস্তবতার মুখোমুখি আমি হচ্ছি। আমাকে আর্থসামাজিক বিষয়গুলো খেয়াল রাখতে হবে। সবাইকে নিশ্চয়তা দিচ্ছি, যেসব বিষয় বাস্তবায়নের সুযোগ রয়েছে, তা করা হবে। প্রধান উপদেষ্টার অপেক্ষায় থাকব না। নিজের কাজ নিজেই করব। এটি আমার কাজ।’

এক সাংবাদিক প্রশ্ন করেন, আগামী ডিসেম্বরের আগে কোনো সুপারিশ বাস্তবায়ন করা সম্ভব কি না। জবাবে শ্রম উপদেষ্টা বলেন, ‘আমার পক্ষে ডিসেম্বর লাগবে না। পারলে কালকেই বাস্তবায়ন করব। সময়সীমা দিতে পারব না। ডিসেম্বর বললে আমি নভেম্বর থেকে শুরু করব। তাই সময়সীমা বেঁধে দিতে চাই না। আমি আমার মতো অগ্রাধিকার ঠিক করে কাজ করব।’

এক প্রশ্নের জবাবে উপদেষ্টা বলেন, ‘নির্বাচন কবে হবে আমি জানি না। ডিসেম্বর নাকি জুনে, তা বলতে পারব না। কমিশনের সুপারিশ অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বাস্তবায়নের চেষ্টা করব।’

সংবাদ সম্মেলনে শ্রম সংস্কার কমিশনের প্রধান সৈয়দ সুলতান উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘শ্রম সংস্কারসংক্রান্ত প্রতিবেদনটি যাতে ফাইলবন্দী হয়ে না থাকে। টানা পাঁচ মাস খেটে প্রতিবেদনটি করা হয়েছে। এখানে যেসব সুপারিশ করা হয়েছে, সেসবের বাস্তবায়ন দেখতে চাই।’

সৈয়দ সুলতান উদ্দিন আহমেদ বলেন, বৈষম্যহীন বাংলাদেশ গড়তে হলে, চব্বিশের গণ-আন্দোলনের আকাঙ্ক্ষা পূরণ করতে হলে প্রথমে বৈষম্য দূর করতে হবে। বাংলাদেশে সবচেয়ে বড় বৈষম্য হচ্ছে, অপ্রাতিষ্ঠানিক ও প্রাতিষ্ঠানিক খাতের শ্রমিকদের মধ্যে বৈষম্য। ৮৫ শতাংশ শ্রমিক আইনি সুরক্ষা পান না। এর চেয়ে বড় বৈষম্য আর হতে পারে না। এই ৮৫ শতাংশ শ্রমিকের সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি নেই। তাঁরা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে তাঁদের সমস্যার কথা বলতে পারেন না। এতে রাষ্ট্রও তাঁদের সমস্যার কথা জানতে পারে না। এতে শুধু শ্রমিকই ক্ষতিগ্রস্ত হন না, রাষ্ট্রও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এ অবস্থার অবসান করতে হবে। ৮৫ শতাংশ শ্রমজীবীকে বাদ দিয়ে একটি জাতি চলতে পারে না। একটা দেশ এগোতে পারে না। সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হতে পারে না।

সব শ্রমিককে আইনি সুরক্ষার আওতায় আনার প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরে সৈয়দ সুলতান উদ্দিন আহমেদ বলেন, তাঁর মজুরি, সামাজিক নিরাপত্তা ও শ্রমিক হিসেবে স্বীকৃতি দিতে হবে। বিপদে পড়লে প্রতিকারের ব্যবস্থা থাকতে হবে। ন্যূনতম মজুরির মানদণ্ড নির্দিষ্ট করতে হবে। সেই মানদণ্ড যাতে প্রত্যেক পেশাজীবী ব্যক্তি দাবি করতে পারেন। সেই মানদণ্ড প্রতি তিন বছর পরপর মূল্যায়ন করা ও পুনর্নির্ধারণ করতে হবে।

সৈয়দ সুলতান উদ্দিন আহমেদ বলেন, ৯০ ভাগ নারী মাতৃত্বকালীন সময়ে মাসিক বেতন পান না। প্রাতিষ্ঠানিকভাবেও অস্থায়ী নারীরা মাতৃত্বকালীন সময়ে মাসিক বেতন পান না। তাঁদের সামাজিক স্কিমে যুক্ত করতে হবে।

সৈয়দ সুলতান উদ্দিন আহমেদ আরও বলেন, ‘এখন থেকে মজুরি নিয়ে দর-কষাকষি দেখতে চাই না। একটি সর্বজনীন সামাজিক নিরাপত্তা স্কিমের সুপারিশ করা হয়েছে প্রতিবেদনে। আমরা সেটির বাস্তবায়ন দেখতে চাই। যেখানে প্রত্যেক মানুষ কোনো না কোনো সহযোগিতা পাবেন।’

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: ড স ম বর সমস য

এছাড়াও পড়ুন:

মুসলমান বলেই রোহিঙ্গারা ভয়াবহ পরিস্থিতির শিকার

রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের দুরবস্থা বর্তমান সময়ে অন্যতম করুণ মানবিক সংকট বলে উল্লেখ করেছেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস। তিনি বলেছেন, শুধু মুসলমান হওয়ার কারণেই রোহিঙ্গারা এই ভয়াবহ পরিস্থিতির শিকার।

গতকাল সোমবার রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় তুরস্কের একটি সংসদীয় প্রতিনিধিদলের সঙ্গে সাক্ষাতের সময় এ কথা বলেন প্রধান উপদেষ্টা। পাঁচ সদস্যের ওই প্রতিনিধিদলের নেতৃত্ব দিয়েছেন তুরস্ক-বাংলাদেশ সংসদীয় মৈত্রী গ্রুপের সভাপতি ও তুর্কি পার্লামেন্ট সদস্য মেহমেত আকিফ ইয়িলমাজ।

সাক্ষাতে দুই পক্ষ বাণিজ্য, বিনিয়োগ ও মানবিক সহায়তার ক্ষেত্রগুলোতে দ্বিপক্ষীয় সহযোগিতা আরও জোরদার করার উপায় নিয়ে আলোচনা করে। এ সময় মেহমেত আকিফ ইয়িলমাজ বলেন, তুরস্ক ও বাংলাদেশের মধ্যে গভীর সাংস্কৃতিক ও ঐতিহাসিক সম্পর্ক রয়েছে। দুই দেশের মধ্যে বিদ্যমান দৃঢ় বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের ওপর আলোকপাত করেন তিনি।

ইয়িলমাজ বলেন, তাঁদের প্রতিনিধিদল রোববার কক্সবাজারে রোহিঙ্গা শিবির পরিদর্শন করেছে এবং তুর্কি বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি সংস্থা, বিশেষ করে তুর্কি ফিল্ড হাসপাতালের মানবিক কার্যক্রম সম্পর্কে অবহিত হয়েছে। এ সময় রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের প্রতি তুরস্কের অবিচল সমর্থনের জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন প্রধান উপদেষ্টা। তুর্কি উদ্যোক্তাদের বাংলাদেশে বিনিয়োগের আহ্বান জানান তিনি।

অধ্যাপক ইউনূস বলেন, ‘রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের দুরবস্থা আমাদের সময়ের অন্যতম করুণ মানবিক সংকট। তারা শুধু মুসলমান বলেই এই ভয়াবহ পরিস্থিতির শিকার এবং তাদের নাগরিকত্ব কেড়ে নেওয়া হয়েছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘আট বছর ধরে আশ্রয়শিবিরে থাকায় রোহিঙ্গা শিশুদের শিক্ষা ও ভবিষ্যৎ সুযোগ একেবারেই সীমিত হয়ে পড়েছে। এই অবস্থা হতাশা ও অস্থিতিশীলতার জন্ম দিতে পারে।’

সম্পর্কিত নিবন্ধ