গত ২০ এপ্রিল রাজধানীর একটি হোটেলে বিএনপির সঙ্গে সিপিবি ও বাসদের বৈঠকটি অনানুষ্ঠানিক হলেও পরিস্থিতি বিবেচনায় তা যে তাৎপর্যবহ– এ নিয়ে সন্দেহ নেই। দৃশ্যত রুদ্ধদ্বার হলেও সেখানে আলোচনার প্রায় সবই সংবাদমাধ্যমে এসেছে।

বৈঠকে দলের আরও দুই নেতার সঙ্গে উপস্থিত ছিলেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু। তিনি বলেন, ‘আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন প্রশ্নে কীভাবে গ্রেটার ঐক্য করা যায়, সে ব্যাপারে সিপিবি, বাসদসহ বাম ধারার দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা হয়। এরই মধ্যে তারাও নির্বাচনের বিষয়ে মত প্রকাশ করেছে’ (বণিক বার্তা, ২০ এপ্রিল, ২০২৫)।

অন্যদিকে বৈঠক প্রসঙ্গে সিপিবির সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স বলেছেন, ‘আমাদের আলোচনায় উঠে আসছে, আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে পরিবর্তন আনা উচিত। যেমন আমরা একে অন্যের সঙ্গে কথা বলি না, বসি না। এ ধারার যেন পরিবর্তন হয়। রাজনৈতিক দল হিসেবে আমরা যেন এমন কোনো আচরণ না করি, যা নিয়ে অরাজনৈতিক মহলে কথা বলার সুযোগ পায়। আমরা যার যার কথা বলব। জনগণ কার পক্ষে থাকবে না-থাকবে সেটি জনগণ সিদ্ধান্ত নেবে। এখনকার এজেন্ডা হচ্ছে নির্বাচন’ (বণিক বার্তা, ২০ এপ্রিল, ২০২৫)। উভয় নেতার বক্তব্যে এটা স্পষ্ট, ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে ধোঁয়াশা তারা দ্রুত কাটাতে চান।

অন্তর্বর্তী সরকার এরই মধ্যে রাষ্ট্র সংস্কারে গঠিত বিভিন্ন কমিশনের প্রতিবেদন নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করছে। বিএনপি শুরু থেকেই ন্যূনতম সংস্কার করে দ্রুত জাতীয় নির্বাচনের কথা বলে আসছে। এ নিয়ে নবগঠিত দল জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) সঙ্গে তাদের রীতিমতো বিরোধ বেধেছে। দীর্ঘদিনের সঙ্গী জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গেও বিএনপির দূরত্ব বেড়েছে এই নিয়ে। তাই দলটি চাইছে নতুন সঙ্গী বাড়াতে। এ প্রেক্ষাপটে সিপিবি-বাসদের মতো দলগুলোর সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বিএনপির জন্য বিশেষ কিছু হতে পারে। কারণ প্রথম দিকে পরিষ্কার করে না বললেও, সিপিবি-বাসদসহ আরও কয়েকটি বাম দল নিয়ে গঠিত বাম গণতান্ত্রিক জোট এখন শুধু ডিসেম্বরের মধ্যেই নির্বাচন চাচ্ছে না, এর সুনির্দিষ্ট তারিখও দাবি করছে।

প্রসংগত, ২০১৮ সালের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি ড.

কামাল হোসেনের নেতৃত্বে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গঠন করে অংশ নিয়েছিল। সে নির্বাচনী জোটে বাম গণতান্ত্রিক জোটের তৎকালীন দুই শরিক গণসংহতি আন্দোলন ও বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি থাকলেও মুখ্যত সিপিবির কারণে জোটের অন্যরা তাতে যোগ দেয়নি। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগেও বামদের কাছে টানার চেষ্টা করে বিএনপি। যুগপৎ আন্দোলনের ক্ষেত্র প্রস্তুতের অংশ হিসেবে ২০২২ সালের ২৪ মে থেকে ৩ আগস্ট পর্যন্ত দলটি প্রথম দফায় ২২টি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সংলাপ করে। ওই সময় সিপিবি-বাসদসহ বাম জোটের সঙ্গে বসার আগ্রহ দেখালেও ইতিবাচক সাড়া মেলেনি। তবে ৫ আগস্ট-পরবর্তী নতুন রাজনৈতিক বাস্তবতায় দু’পক্ষই পরস্পরের কাছাকাছি আসার তাগিদ বোধ করে। রোববারের বৈঠক তারই ফল। 

বিএনপির সঙ্গে সিপিবি-বাসদের বৈঠক নিয়ে বাম শিবিরে কিছু উষ্মা ও সমালোচনা উঠেছে। বাম জোটের মধ্যে এ নিয়ে নীতিগত কোনো আপত্তি না থাকলেও বিএনপির সঙ্গে অন্যদের বাদ দিয়ে শুধু দুই দলের সাক্ষাৎকে জোটের সংহতির জন্য ভালো নয় বলে কেউ কেউ মনে করেন। উল্লেখ্য, চলতি বছরের শুরুতে ‘বাম, গণতান্ত্রিক, প্রগতিশীল, উদারনৈতিক ও স্বাধীনতার পক্ষের’ রাজনৈতিক দলগুলোকে নিয়ে একটি নতুন জোট গঠনের উদ্যোগ নেওয়া হয়। এর নেপথ্যে ছিল সিপিবি, বাসদ এবং ২০১৮ সালের নির্বাচনের পর আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪ দল থেকে বের হয়ে আসা বাংলাদেশ জাসদ।

উষ্মা বেশি এসেছে বিএনপির সঙ্গে ইতোপূর্বে যুগপৎ আন্দোলনকারী বাম দলগুলোর পক্ষ থেকে। তাদের সমালোচনা বাংলা প্রবাদের মতো– ‘সেই তো নথ খসালি, তবে কেন লোক হাসালি।’ তারা মনে করেন, ২০১৮ সালে তাদের মতো কিংবা ২০২২ সালেও যদি বিএনপির ডাকে অন্য বামেরা সাড়া দিত তাহলে নাকি গণঅভ্যুত্থানে বাম দলগুলোর প্রভাব এতটাই থাকত, যা ধর্মীয় উগ্রবাদীদের প্রভাব ঠেকিয়ে দিত। আমার কাছে অবশ্য এমন মতকে কাল্পনিকই মনে হয়। কারণ জুলাই আন্দোলনের চালকের আসনে ছিল মূলত জামায়াত ও তার ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্রশিবির। এটা এখন আর গোপন কিছুও নয়। আন্দোলনের সহযোগী সাংবাদিকসহ বিভিন্ন পেশার মানুষের পাশাপাশি খোদ অভ্যুত্থানের মুখ বলে পরিচিত ছাত্রনেতাদের কাছ থেকেই এ স্বীকারোক্তি এসেছে।

সমালোচনাটা নির্বাচন প্রশ্নে সিপিবি-বাসদের সঙ্গে ওই দলগুলোর বর্তমান অবস্থানের পার্থক্যজাত। তাদের মত, নির্বাচন ডিসেম্বরে হলে বামপন্থিদের কোনো লাভ নেই। নির্বাচন দেরিতে হলে অন্তর্বর্তী সরকার কিছু সংস্কার করত, তাতে বরং রাজনীতি একটু সুস্থ হতো; যার জন্য বামপন্থিরা যুগ যুগ ধরে সোচ্চার। কিন্তু এটাও এক প্রকার নিজের নাক কেটে অন্যের– এ ক্ষেত্রে বিএনপির যাত্রাভঙ্গ করার মতো কাণ্ড। এর সুযোগ যে জামায়াত বা অতি রক্ষণশীল দলগুলো নেবে না, তা কিন্তু কেউ নিশ্চিত করে বলতে পারছে না। সর্বোপরি, গণতান্ত্রিক সরকার গঠনের স্বপ্ন দেখিয়ে জনগণকে পথে নামিয়ে দীর্ঘদিন দেশকে অনির্বাচিত সরকারের অধীনে রেখে দেওয়া এক প্রকার প্রতারণাও বটে। দেশের অর্থনীতি ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি যে গভীর চ্যালেঞ্জের মধ্যে আছে, তাও কি এ সরকারের পক্ষে সফলভাবে মোকাবিলা করা সম্ভব?

৫ আগস্টের আগে ও পরের পরিস্থিতি এক নয়। এখন জামায়াত প্রশ্নে বিএনপিকে যতটা চাপ দেওয়া যায়, তখন তা সম্ভব হতো না। সর্বোপরি, ৫ আগস্ট বোতলবন্দি চরম ডানপন্থাকে যেভাবে মুক্তবিহঙ্গ বানিয়ে দিয়েছে, অন্তত বিএনপিকে তার থেকে আলাদা রাখাও একটা বিরাট কাজ। ফলে সিপিবি-বাসদ সময়োচিত সিদ্ধান্ত নিয়েছে, এ কথা বলা যায়।

আগেও বলেছি, এখনও বলি, গণতান্ত্রিক বাম জোট যদি ৫ আগস্টের পরপর অন্য সব বাম শক্তিকে নিয়ে শুধু দ্রব্যমূল্য, শ্রমিকের মজুরি ও চাকরি এবং জননিরাপত্তা ইস্যুতেও মাঠে নামত, তাহলে আজকে তারা যা চায় তার অনেক কিছুই বাস্তবায়ন করতে পারত। একই সঙ্গে তারা ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘু, মাজারপন্থিসহ মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন স্থাপনার ওপর হামলার বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নিলে মুক্তিযুদ্ধের আবেগধারী বহু মানুষকে তারা সঙ্গে পেত। এ অবস্থায় বিএনপির সঙ্গে নির্বাচনসহ জনস্বার্থসংশ্লিষ্ট কিছু ইস্যুতে সমঝোতা বা জোট গড়ে পথে নামলে বাম জোটই রাজনীতির গতিপথ নির্ধারণ করত।

তবে সেটা হয়নি বলে যে সব শেষ হয়ে গেছে, এমন নয়। বিএনপি ও বর্তমান সরকারের শ্রেণি অবস্থানে পার্থক্য নেই। সমর্থকের চরিত্র বিচারেও উভয়ে প্রায় একই শিবিরভুক্ত। তাই বিএনপির পক্ষে নির্বাচন ইস্যুতে সরকারকে অর্থপূর্ণ চাপ দেওয়া কঠিন। কিন্তু বাম জোট আন্তরিক হলে এ ক্ষেত্রে বিএনপিকে সঙ্গে পাওয়া অসম্ভব হবে না।

সাইফুর রহমান তপন: সহকারী সম্পাদক, সমকাল

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: ব এনপ গণত ন ত র ক ব এনপ র স দলগ ল র ৫ আগস ট দ র মত সরক র অবস থ

এছাড়াও পড়ুন:

৪৪তম বিসিএসের ৪০০ রিপিট ক্যাডার বাদ দিচ্ছে সরকার, নতুন সিদ্ধান্ত আসছে

৪৪তম বিসিএসে পুনরাবৃত্তি হওয়া ৪০০ ক্যাডারকে বাদ দেওয়া হচ্ছে। তারা ৪৩তম বিসিএসে বা আগের বিসিএসে যে ক্যাডারে আছেন ৪৪তম বিসিএসেও একই ক্যাডার পেয়েছিলেন। এই ৪০০ ক্যাডারকে নিয়ে সিদ্ধান্ত দ্রুতই হবে বলে জানিয়েছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের একজন উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তা।

প্রথম আলোকে ওই কর্মকর্তা আজ বৃহস্পতিবার বলেন, ৪০০ ক্যাডারকে নিয়ে পিএসসির কিছু সুপারিশ আমরা পেয়েছি। এগুলো বাদ দিতে সরকার কাজ করছে। বাদ দিলে কি করা হবে তা নিয়েও কাজ করছে সরকার। এখন পিএসসিকে এ বিষয় নিয়ে একটি মতামত দিতে বলা হয়েছে। পেলেই তা পর্যালোচনা করে এ বিষয়ে প্রজ্জাপন দেওয়া হবে। এটি যাতে স্থায়ীভাবে বন্ধ হয় সেজন্য আমরা কাজ করছি।

আরও পড়ুন৪৯তম বিসিএস: অনলাইন আবেদন ও ফি জমাদানে পিএসসির নতুন নির্দেশনা৩০ জুলাই ২০২৫

৪৪তম বিসিএসের চূড়ান্ত ফল ৩০ জুন প্রকাশিত হয়। এতে বিভিন্ন ক্যাডারে ১ হাজার ৬৯০ জনকে নিয়োগের জন্য সরকারি কর্ম কমিশন (পিএসসি) সাময়িকভাবে মনোনীত করেছে।

প্রকাশিত ফলাফল বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ১ হাজার ৬৯০ জনের মধ্যে প্রায় ৪০০ জন প্রার্থী একাধিকবার বিসিএস পরীক্ষায় অংশ নিয়ে একই ক্যাডারে পুনরায় সুপারিশপ্রাপ্ত হয়েছেন (রিপিট ক্যাডার)। এই ৪০০ জনের তালিকা পেয়েছে পিএসসি। এই রিপিট ক্যাডার বন্ধে বিধি সংশোধন করা হচ্ছে। এ–সংক্রান্ত চিঠি জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে পাঠায় পিএসসি।

পিএসসি জনপ্রশাসনের চিঠিতে বলছে, এই রিপিট ক্যাডারের ফলে নতুন ও অপেক্ষমাণ মেধাবীরা সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। এটি প্রশাসনিক কাঠামো ও জনসম্পদের সদ্ব্যবহারে বাধা সৃষ্টি করছে। এখন এটি অনুমোদনের অপেক্ষায় আছে।

একাধিকবার বিসিএস পরীক্ষায় অংশ নিয়ে একই ক্যাডারে পুনরায় সুপারিশপ্রাপ্ত হওয়া বন্ধ করার জন্য বিদ্যমান বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস (বয়স, যোগ্যতা ও সরাসরি নিয়োগের জন্য পরীক্ষা) বিধিমালা ২০১৪–এর বিধি-১৭ এর শেষে নিম্নোক্ত শর্ত যুক্ত করার প্রস্তাব করেছে পিএসসি।

আরও পড়ুনসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষকের ৩৪০০০ শূন্য পদ পূরণে উদ্যোগ২৯ জুলাই ২০২৫শর্তে কী আছে—

পিএসসির চিঠিতে শর্ত হিসেবে বলা আছে, ‘তবে শর্ত থাকে যে এই বিধির আওতাধীন সরকারের নিকট সুপারিশ প্রেরণ করিবার প্রাক্কালে, কিংবা কোনো বিসিএস পরীক্ষার চূড়ান্ত ফলাফল প্রস্তুতকালে, সংশ্লিষ্ট প্রার্থী কর্তৃক প্রদত্ত লিখিত তথ্যের ভিত্তিতে কিংবা কমিশন কর্তৃক নির্ধারিত কোনো পদ্ধতির মাধ্যমে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে যদি কমিশনের নিকট প্রতীয়মান হয় যে এই বিধির আওতাধীন মনোনয়নযোগ্য কিংবা মনোনীত কোনো প্রার্থী একই ক্যাডার পদ, সমপদ কিংবা প্রার্থীর আগ্রহ নেই এমন কোনো সার্ভিস বা ক্যাডার পদে পুনরায় মনোনীত হইবার কারণে মনোনীত সার্ভিসে বা ক্যাডার পদে যোগদান করিতে অনিচ্ছুক, এইরূপ ক্ষেত্রে কমিশন অনাগ্রহ প্রকাশকারী প্রার্থীকে এই বিধির আওতাধীন সরকারের নিকট সুপারিশ করা হইতে বিরত থাকিতে পারিবে; আরও শর্ত থাকে যে প্রথম শর্তাংশে বর্ণিত বিধান অনুযায়ী কোনো প্রার্থীকে সুপারিশ করা হইতে বিরত থাকিবার কারণে উদ্ধৃত শূন্য পদে নিয়োগের লক্ষ্যে সুপারিশ প্রেরণ করিবার জন্য উত্তীর্ণ প্রার্থিগণের মধ্য হইতে মেধাক্রম অনুযায়ী প্রার্থী নির্বাচনপূর্বক কমিশন সম্পূরক ফলাফল প্রকাশ এবং সার্ভিসে বা ক্যাডার পদে নিয়োগের জন্য সরকারের নিকট সুপারিশ প্রেরণ করিতে পারিবে;আরও অধিকতর শর্ত থাকে যে দ্বিতীয় শর্তাংশে উল্লিখিত সম্পূরক ফলাফল দ্বারা বা উহার পরিণতিতে প্রথম ঘোষিত ফলাফলে সার্ভিস বা ক্যাডার পদের জন্য মনোনীত কোনো প্রার্থীর প্রতিকূলে কোনো পরিবর্তন ঘটানো কিংবা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা যাইবে না।’

আরও পড়ুনবস্ত্র অধিদপ্তরে বড় নিয়োগ, চাকরির সুযোগ ১৯০ জনের২৯ জুলাই ২০২৫

সম্পর্কিত নিবন্ধ