কক্সবাজারের মহেশখালীতে পৃথক দুর্ঘটনায় ২ জন নিহত হয়েছে। শনিবার (২৬ এপ্রিল) সকালে উপজেলার বড় মহেশখালী ইউনিয়নে এসব দুর্ঘটনা ঘটে।

নিহতরা হলো- পূর্ব ফকিরাঘোনা গ্রামের মোহাম্মদ আলমের ছেলে বাবু (৬) ও বড় মহেশখালী সিপাহী পাড়ার মকবুল আহমেদের ছেলে আবু রায়হান (১৬)।

পুলিশ জানায়, সকালে গোরকঘাটা-জনতা বাজারে রাস্তা পার হওয়ার সময় অটোরিকশার চাপায় শিশু বাবু ঘটনাস্থলেই মারা যায়। অপরদিকে, আম গাছ থেকে পড়ে আবু রায়হান আহত হয়। দ্রুত তাকে উদ্ধার করে মহেশখালী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে গেলে চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন।

আরো পড়ুন:

গজারিয়ায় গরম বিলেট মাথায় পড়ে শ্রমিক নিহত

রাঙামাটিতে পিকআপের ধাক্কায় অটোরিকশার ৫ যাত্রী নিহত

মহেশখালী থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) কায়সার হামিদ পৃথক দুর্ঘটনায় ২ জন নিহতের বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।

ঢাকা/তারেকুর/রাজীব

.

উৎস: Risingbd

কীওয়ার্ড: চ কর চ কর ন হত দ র ঘটন দ র ঘটন

এছাড়াও পড়ুন:

ফেলে দেওয়া পশুর হাড়-শিংয়ে শত কোটি টাকার রপ্তানি বাণিজ্য

একসময় কোরবানির পশুর হাড়, শিং, নাড়িভুঁড়ি, চর্বি বা অণ্ডকোষ ছিল গৃহস্থের চোখে ময়লা যা পড়ে থাকত ডাস্টবিনের পাশে, কিংবা নালার গায়ে। অথচ এই ফেলনা জিনিসই আজ রপ্তানিযোগ্য পণ্যে পরিণত হয়ে দেশের অর্থনীতিতে যোগ করছে শত কোটি টাকা। 

তৈরি হচ্ছে সাবান, ক্যাপসুল, সিরামিক কাঁচামাল, মাছ ও পাখির খাদ্য, এমনকি বিদেশি রেস্তোরাঁয় জনপ্রিয় কিছু প্রিয় খাবার। এই অপ্রচলিত অথচ সম্ভাবনাময় খাতটি এখনো অনেকের অজানা থাকলেও বাস্তবতা বলছে সচেতনতার অভাবে আমরা আজও গরুর মাথার হাড় কিংবা অণ্ডকোষ নষ্ট করে ফেলছি, যেগুলোর কেজিপ্রতি মূল্য দাঁড়াতে পারে ২৫ টাকারও বেশি।

টোকাই থেকে ওষুধ কোম্পানির কারখানা পর্যন্ত

ঢাকার গাবতলী, ফার্মগেট, উত্তরা থেকে শুরু করে হাজারীবাগ, কামরাঙ্গীরচর, যাত্রাবাড়ী কিংবা কেরানীগঞ্জের অলিগলিতে কোরবানির পরে শুরু হয় পশুর হাড়-শিং সংগ্রহের উৎসব। পথশিশু থেকে মৌসুমি ব্যবসায়ী—সবাই ব্যস্ত থাকেন এই অস্থায়ী বাজারে। কেউ বিক্রি করছেন নাড়িভুঁড়ি, কেউ বা ব্যস্ত গরুর পাকস্থলী নিয়ে। 

ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের পরিচ্ছন্নতাকর্মী পরিমল যেমন সিক্কাটুলি ডাস্টবিনে দাঁড়িয়ে গরুর শিং আর অণ্ডকোষ সংগ্রহ করছিলেন।

তিনি বলেন, ‘‘এগুলোকে আমরা বলি সাতপর্দা, পইক্যা বা গোল্লা। এগুলো প্রতি বছর সংগ্রহ করি, কেউ বিক্রি করলে কিনেও নিই।’’ 

কাপ্তান বাজারের মাংস ব্যবসায়ী জসিম উদ্দিন বলেন, ‘‘কোরবানির সময় হাড়, অণ্ডকোষ, নাড়ি, পাকস্থলী কেনা হয় ২৫-৪০ টাকা করে। মাথার হাড় কিনি ৭ থেকে ১০ টাকা কেজি। রান্না করা হাড়ের দাম আরও বেশি। পরে হাজারীবাগ বা কামরাঙ্গীরচরে বিক্রি করি।’’ 

ঢাকা থেকে বিশ্ববাজারে

হাজারীবাগ, কামরাঙ্গীরচর, যাত্রাবাড়ী, চিটাগাং রোড ও কেরানীগঞ্জে গড়ে উঠেছে অর্ধশতাধিক হাড় ভাঙার কারখানা। এসব কারখানায় হাড় ধুয়ে, শুকিয়ে গুঁড়া করে পাঠানো হয় ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানিতে, যারা এগুলো দিয়ে তৈরি করে ক্যাপসুলের কভার, কোলাজেন প্রোডাক্টস, ওষুধের কাঁচামাল। হাড়ের গুঁড়ো ‘নিটবন’ নামে পরিচিত যা পোলট্রি ফিড ও সার হিসেবেও ব্যবহৃত হয়।

হাজারীবাগের ব্যবসায়ী মনির হোসেন বলেন, ‘‘প্রতি মাসে দেশে ৪০-৪৫ কোটি ক্যাপসুলের কভার লাগে। এ জন্য দরকার কয়েক শ’ টন পশুর হাড়। কেজি ১৫-২২ টাকায় হাড় কিনি, ২৫-৩০ টাকায় বিক্রি করি। বড় কোম্পানিগুলো সারা বছর আমার কাছ থেকে হাড় নেয়।’’ 

তিনি আরও জানান, পশুর নাড়ি দিয়ে তৈরি হয় অপারেশনের সেলাইয়ের সুতা, রক্ত দিয়ে পাখির খাদ্য, চর্বি দিয়ে সাবান, খুরা দিয়ে ভিডিও ক্লিপ। অণ্ডকোষ দিয়ে জাপান, কোরিয়া, চীন, জার্মানিতে তৈরি হয় প্রিয় খাবার সুসেড রুল।

হাড়ের বোতাম যাচ্ছে জার্মানিতে

সৈয়দপুরের অ্যাগ্রো রিসোর্স কোম্পানি লিমিটেড গরু-মহিষের হাড়-শিং দিয়ে তৈরি করছে উন্নতমানের বোতাম। প্রতিষ্ঠানটি বছরে ১৮-২০ কোটি টাকার বোতাম রপ্তানি করছে জার্মানি, চীন ও স্পেনে। শার্ট, কোট, স্যুট-সবখানে এই বোতামের ব্যবহার বাড়ছে।

কোম্পানির জিএম সোহরাব জামান বলেন, ‘‘মাত্র ৩২ কোটি টাকার বিনিয়োগে আমরা বছরে ২০ কোটি টাকার রপ্তানি করছি। হাড়ের বোতাম দুনিয়াজুড়ে পরিবেশবান্ধব হিসেবে জনপ্রিয়তা পাচ্ছে।’’ 

প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের তথ্য

সরকারি হিসাব অনুযায়ী, ২০২৫ সালে দেশে ৯১ লাখ ৩৬ হাজার ৭৩৪টি পশু কোরবানি হয়েছে। এর মধ্যে গরু-মহিষ ছিল প্রায় ৪৭ লাখ ৫ হাজার। গড়ে ১৫ কেজি করে হাড় ধরা হলে পাওয়া যায় ৭ কোটি ২০ লাখ কেজির মতো হাড়। যার সম্ভাব্য বাজারমূল্য ৫৭ কোটি টাকার বেশি, যদি কেজিপ্রতি ৮ টাকা ধরা হয়। যদিও সব হাড়ই সংগ্রহ করা হয় না।


সম্ভাবনার সঙ্গে সঙ্গে সীমাবদ্ধতা

ঢাকা মেট্রোপলিটন মাংস ব্যবসায়ী সমিতির মহাসচিব রবিউল আলম বলেন, ‘‘দেশে পশুর হাড়, শিং, ভুঁড়ি, চর্বি, অণ্ডকোষ সবই রপ্তানিযোগ্য। কিন্তু আমরা এখনো সচেতন না হওয়ায় অর্ধেকের বেশি বর্জ্য নষ্ট হয়ে যায়। একটা গোটা শৃঙ্খল দরকার, যেখানে এসব অঙ্গপ্রত্যঙ্গ সঠিকভাবে সংগ্রহ, প্রক্রিয়াজাত ও রপ্তানি হবে।’’ 

জাতীয় চিড়িয়াখানার সাবেক কিউরেটর ড. এস এম নজরুল ইসলাম বলেন, ‘‘রক্ত, নাড়ি, চর্বি—সবকিছুর ব্যবহার সম্ভব। শুধু রক্ত শুকিয়ে দিলেই তা মুরগির খাবারে রূপান্তর করা যায়।’’

বাপা নেতা ও স্টামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. আহমদ কামরুজ্জামান মজুমদার বলেন, ‘‘হাড়ের গুঁড়া শুধু হাঁস-মুরগির খাদ্যই নয়, এটি জমিতে সার হিসেবেও দারুণ কার্যকর। আর নাড়িভুঁড়ির বর্জ্য মাছের খাদ্য তৈরিতে ব্যবহৃত হয়। এ খাতে নজর দিলে দেশ অর্থনীতিতে একটি নতুন দ্বার খুলতে পারে।’’

যাত্রাবাড়ীর ব্যবসায়ী লোকমান হোসেন বলেন, ‘‘এতকাল যেগুলো আমরা বর্জ্য হিসেবে দেখেছি, সেগুলো থেকেই দেশের অর্থনীতিতে যোগ হচ্ছে কোটি কোটি টাকা। প্রয়োজন শুধু সচেতনতা, সুসংগঠিত সংগ্রহব্যবস্থা এবং আধুনিক প্রক্রিয়াজাতকরণ। কোরবানির পশুর হাড়-শিং আর শুধুই জঞ্জাল নয়—এখন তা দেশের জন্য সম্ভাবনার এক নতুন খনি।’’

চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের‘কাসেম ব্রাদার্স রেন্ডারিং ফ্যাক্টরি’র ব্যবস্থাপক আমিনুল হক বলেন, ‘‘ঈদের সময়ের হাড় থেকেই বছরে আমাদের ৬০ শতাংশ কাঁচামাল আসে। এসব হাড় থেকে আমরা তৈরি করি বোন মিল, ট্যালো, কোলাজেন ও জেলাটিন।’’

আন্তর্জাতিক বাজারে চাহিদা বাড়ছে

বাংলাদেশ প্রাণিসম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিএলআরআই) জানায়, দেশে বছরে প্রায় ৮০ হাজার টন হাড় পাওয়া যায়। যার অর্ধেকের বেশি এখন রপ্তানিযোগ্য। চট্টগ্রাম কাস্টমসের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালে বাংলাদেশ থেকে প্রায় ৭ হাজার টন বোন মিল ও হাড়জাত পণ্য রপ্তানি হয়। এর বড় অংশ যায় চীন ও ভিয়েতনামে। এসব দেশে হাড় থেকে তৈরি হয় প্রাণিখাদ্য, জৈব সার, এমনকি হাই-এন্ড কসমেটিকস পণ্য।

এক পশুর হাড় থেকে যা তৈরি হয়:

বোন মিল : পোলট্রি ও মাছের খাদ্য। ট্যালো: চর্বি থেকে তৈরি, সাবান ও প্রসাধনীতে ব্যবহার
জেলাটিন ও কোলাজেন: ওষুধ ও ফার্মাসিউটিক্যালে বহুল ব্যবহৃত।
ফসফেট ও ক্যালসিয়াম: জৈব সার ও পশুখাদ্যে উপাদান


বাজার বড়, কিন্তু নিয়ন্ত্রণ নেই

এত বড় বাজার থাকা সত্ত্বেও এই খাতে নেই কোনো সুনির্দিষ্ট নীতিমালা বা সরকারি তদারকি। হাড় সংগ্রহ, পরিবহন, সংরক্ষণ ও প্রক্রিয়াজাতকরণ সবই চলে ব্যক্তি বা গোষ্ঠীগত উদ্যোগে।

হাজারীবাগের  ব্যবসায়ী  সানি  বলেন, ‘‘আমরা দীর্ঘ ১০ বছর ধরে ব্যবসা করি। ঢাকার বিভিন্ন জেলা থেকে মাল আসে। দিনদিন হাড়সহ পশুর বিভিন্ন অংশের পরিমান বেশি আসছে এবং ব্যবসাও ভাল।’’

পরিবেশকর্মী ও গবেষক ড. মোমতাজ হক বলেন, ‘‘এই রেন্ডারিং খাতটি ব্যবস্থাপনা ছাড়া চললে তা শুধু পরিবেশ নয়, জনস্বাস্থ্যের জন্যও হুমকি হতে পারে। হাড় ও চর্বি থেকে নির্গত গ্যাস, বর্জ্য পানি ও দুর্গন্ধ নিয়ন্ত্রণে সুনির্দিষ্ট নীতিমালা ও পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তির প্রয়োজন।’’

তিনি আরও বলেন, ‘‘আমরা যদি আধুনিক রেন্ডারিং সিস্টেমে যাই, তাহলে এর মাধ্যমে জৈব সার ও খাদ্যপণ্য প্রস্তুত করে সারাবছর একটি টেকসই শিল্প গড়ে তোলা সম্ভব।’’


ডিএনসিসির উদ্যোগ

ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) এক কর্মকর্তা জানান, গত বছর পরীক্ষামূলকভাবে আমরা গাবতলীতে হাড়-চর্বি আলাদা সংগ্রহের একটি উদ্যোগ নিই, যা ভালো সাড়া পেয়েছে। এবার আরও কয়েকটি এলাকায় বর্জ্য আলাদা সংগ্রহকারী দল গঠন করেছি।

তিনি জানান, ভবিষ্যতে হাড় ও চর্বি সংগ্রহকে একটি সিটি করপোরেশন-নিয়ন্ত্রিত কাঠামোর মধ্যে আনা হবে এবং প্রক্রিয়াজাতকরণের জন্য সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্বে উদ্যোগ নেওয়ার কথা ভাবা হচ্ছে।

কী করা প্রয়োজন

এই নীরব শিল্পকে সুসংগঠিত ও টেকসই করতে করণীয়: সরকারি নিবন্ধন ও লাইসেন্স: হাড় প্রক্রিয়াজাত ও পরিবহনের জন্য আলাদা নীতিমালা। 

আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার: পরিবেশবান্ধব রেন্ডারিং প্লান্ট স্থাপন।

শ্রমিকদের সুরক্ষা ও ন্যায্য মজুরি: স্বাস্থ্য সুরক্ষা ও সামাজিক নিরাপত্তা কাভারেজ।

রপ্তানি উৎসাহ: হাড়জাত পণ্যের জন্য আলাদা এইচএস কোড এবং প্রণোদনা।

হাজারীবাগের ব্যবসায়ী কেফায়েত উল্লাহ বলেন, ‘‘ঈদের পর যে জিনিসগুলোকে অনেকে দেখেন আবর্জনা হিসেবে, সেটাই কারও কাছে জীবিকা, কারও কাছে শিল্পের কাঁচামাল। হাড়-চর্বির এই নীরব বাজার আজ কোটি টাকার রপ্তানি খাত। প্রয়োজন শুধু সরকারি স্বীকৃতি, নীতিমালা ও দায়িত্বশীল ব্যবস্থাপনার। তাহলে এই শিল্প কেবল দুর্গন্ধ নয়, বরং দেশের কৃষি, রপ্তানি ও কর্মসংস্থানের এক উজ্জ্বল দিগন্ত হয়ে উঠতে পারে।’’

ঢাকা/টিপু

সম্পর্কিত নিবন্ধ