নতুন এই হিমাগার প্রযুক্তি কি কৃষককে স্বস্তি দেবে
Published: 27th, April 2025 GMT
কৃষকের হাত থেকে বাজার পর্যন্ত পৌঁছাতে পৌঁছাতেই মলিন হয় অনেক ফল-সবজি। কখনো কখনো পচেও যায়। কখনো কখনো উৎপাদনের প্রায় অর্ধেক এভাবে নষ্ট হয়ে যায়। গবেষকদের হিসাব অনুযায়ী সংখ্যাটা ২৩ দশমিক ৬ থেকে ৪৩ দশমিক ৫ শতাংশ। কৃষকের কষ্টের ফসল বাজারে এনে সঠিক দাম না পাওয়া, মৌসুমে অতিরিক্ত সরবরাহের কারণে দাম পড়ে যাওয়া—এসব আমাদের দেশে চেনা চিত্র। হিমাগারগুলোর বেশির ভাগই কেবল আলু সংরক্ষণের উপযোগী। অন্য কোনো ফল বা সবজি সংরক্ষণে কার্যকর ব্যবস্থা খুব একটা নেই।
দীর্ঘদিনের এ সমস্যারই সমাধান খুঁজছিলেন বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকেরা। তারই অংশ হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষিশক্তি ও যন্ত্র বিভাগ এবং অ্যাগ্রোমেক ডেভেলপমেন্ট ইনিশিয়েটিভস (এডিআই) যৌথভাবে উদ্ভাবন করেছে একটি অভিনব হিমাগার প্রযুক্তি। নাম দেওয়া হয়েছে ‘বিএইউ-এডিআই হর্টিকুল’।
ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের সহায়তায় ২০২৩ সালে নেওয়া হয় ‘বাংলাদেশে ফল ও সবজির ফলন-সংগ্রহোত্তর ক্ষতি হ্রাসে কোল্ড স্টোরেজ প্রযুক্তি’ প্রকল্প। এ প্রকল্পের আওতায় উদ্ভাবনের নেতৃত্ব দিয়েছেন কৃষিশক্তি ও যন্ত্র বিভাগের অধ্যাপক চয়ন কুমার সাহা। তাঁর সঙ্গে ছিলেন একই বিভাগের প্রভাষক মো.
বিএইউ-এডিআই হর্টিকুল প্রযুক্তির বড় বৈপ্লবিক দিক হলো এটি বাসাবাড়ির সিঙ্গেল-ফেজ (২২০ ভোল্ট) বিদ্যুতে কাজ করতে পারে, যেখানে প্রচলিত হিমাগারগুলো কাজ করে থ্রি-ফেজ বিদ্যুতে (৪৪০ ভোল্ট)। গ্রামাঞ্চলে থ্রি-ফেজ বিদ্যুৎ পাওয়া অনেক সময় কষ্টকর। ব্যয়বহুলও বটে। সাধারণত যেসব শীতাতপনিয়ন্ত্রণ যন্ত্র হিমাগারে ব্যবহার করা হয়, সেসবের মাধ্যমে তাপমাত্রা ১৬ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে নামানো সম্ভব হয় না। বাকৃবির নতুন এই প্রযুক্তিতে ব্যবহার করা হয়েছে একটি বিশেষ পদ্ধতি, যাতে মাইনাস ২ থেকে ৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ সম্ভব।
শুধু তা–ই নয়, এটি এমন এক হাইব্রিড হিমাগার প্রযুক্তি, যেখানে জাতীয় গ্রিডের বিদ্যুতের পাশাপাশি সৌরবিদ্যুৎ ব্যবহৃত হবে। ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ৬৬ থেকে ৬৯ শতাংশ সময় এটি সৌরবিদ্যুতে চলতে পারে। ফলে বিদ্যুৎ খরচ অনেকাংশে কমে আসার সম্ভাবনা আছে।
গবেষকদের হিসাব অনুযায়ী, এই হিমাগারের ধারণক্ষমতা দুই হাজার কেজি। স্থানীয়ভাবে তৈরি করা যায়, রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয়ও কম, এমনকি প্রয়োজনে এটি স্থানান্তরযোগ্য। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকৌশল কারখানায় গবেষণার পর এই প্রযুক্তির মাঠপর্যায়ের পরীক্ষা করা হয়েছে টাঙ্গাইলের মধুপুর ও রংপুরের বদরগঞ্জে। পরীক্ষায় দেখা গেছে, আম, আনারস, টমেটো, কাঁচা মরিচ, গাজর ইত্যাদি ফল ও সবজি ৮ থেকে ১২ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় এক থেকে দেড় মাস পর্যন্ত তাজা থাকে।
বিএইউ-এডিআই হর্টিকুলের তাপমাত্রা, আর্দ্রতা, সৌর ও গ্রিড বিদ্যুতের ব্যবহার—সবই মোবাইল অ্যাপে পর্যবেক্ষণ করা যায়। শুধু তা-ই নয়, গবেষণার পরবর্তী ধাপে এমন এক স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থার উন্নয়ন কার্যক্রম চলছে, যাতে কৃষক নিজেই মোবাইল অ্যাপ থেকে তাপমাত্রা ও আর্দ্রতা নিয়ন্ত্রণ করতে পারবেন।
প্রধান গবেষক বলেন, ‘আমাদের উদ্ভাবন যদি সঠিকভাবে কৃষকের কাছে পৌঁছায়, তাহলে তাঁরা ধাপে ধাপে বাজারে পণ্য সরবরাহ করতে পারবেন। এতে একদিকে পণ্যের ন্যায্য দাম মিলবে, অন্যদিকে বাজারের স্থিতিশীলতাও বজায় থাকবে। এই প্রযুক্তির ব্যবহার শুধু কৃষকের অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নয়নেই নয়, বরং খাদ্য ও পুষ্টিনিরাপত্তা নিশ্চিত করতেও বড় ভূমিকা রাখবে। ফল ও সবজির অপচয় কমবে, খাদ্যের সঠিক ব্যবহার বাড়বে। দেশের সামগ্রিক কৃষি ব্যবস্থাপনায় আসবে সুস্থ ও টেকসই পরিবর্তন।’
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ব যবহ র
এছাড়াও পড়ুন:
হনুমান কি পর্বত কাঁধে করে উড়ে এসেছিলেন?
হিন্দু ধর্মগ্রন্থ রামায়ণের এক বিশিষ্ট অধ্যায়ে উঠে আসে এক অলৌকিক ঘটনার কথা। রাম-রাবণের মহাযুদ্ধে শ্রীরামচন্দ্রের ভাই লক্ষ্মণ অচেতন হয়ে পড়লে, তাঁকে জীবিত রাখতে প্রয়োজন হয় একটি বিশেষ ভেষজ উদ্ভিদের—সঞ্জীবনী বুটি। আয়ুর্বেদাচার্য সুষেণের পরামর্শে হনুমান ছুটে যান হিমালয়ের পাদদেশে গন্ধমাদন পর্বতে।
রামায়ণে বর্ণিত আছে, নির্দিষ্ট গাছটি শনাক্ত করতে না পারায় হনুমান পুরো গন্ধমাদন বা দ্রোণগিরি পর্বতটাই তুলে কাঁধে নিয়ে পা বাড়ান লঙ্কার উদ্দেশে। বিশ্বাস করা হয় যে তিনি দীর্ঘ আকাশপথ পাড়ি দেন এই পাহাড় বহন করে। পথিমধ্যে তিনি কিছু স্থানে বিশ্রামও নেন; যেসব স্থান আজও ‘হনুমান টোক’, ‘হনুমান চট’, ‘হনুমান ধারা’ নামে পরিচিত।
নির্দিষ্ট গাছটি শনাক্ত করতে না পারায় হনুমান পুরো গন্ধমাদন বা দ্রোণগিরি পর্বতটাই তুলে কাঁধে নিয়ে পা বাড়ান লঙ্কার উদ্দেশে।পৌরাণিক গ্রন্থগুলোয় সব ঘটনা রূপকভাবে লেখা আছে। এককথায় পুরাণের মধ্যে সবকিছু গোলমাল পাকিয়ে আছে। গোলটা ফেলে মালটা বের করতে পারলে পৃথিবীর অনেক কল্যাণ হয়। এই ঘটনার রূপকতা ব্যাখ্যা করতে একটা গল্পের উল্লেখ করছি।
আরও পড়ুনভারতের আদিতম মহাকাব্য রামায়ণ১১ ফেব্রুয়ারি ২০২৩বাড়িতে ২০০ মানুষকে নিমন্ত্রণ করে এক ব্যক্তি বাজারে গিয়ে অনেক বাজার করেছেন। ফেরার সময় তিনি নিজের সাইকেলের দুই হ্যান্ডলে দুটো ব্যাগ ঝুলিয়েছেন, পেছনে দুটো ব্যাগ ঝোলানো, ক্যারিয়ারে একটা বস্তা বাঁধা। জায়গা না পেয়ে নিজের দুই কাঁধে দুটো ব্যাগ ঝুলিয়ে বাজার থেকে বাড়ির উদ্দেশে যাওয়ার পথে রাস্তায় এক লোক তাঁকে দেখে বললেন ‘কী হে ভাই, তুমি তো দেখি পুরা বাজার উঠিয়ে নিয়ে এসেছ!’ এর মানে কিন্তু এই নয় যে সেই ব্যক্তি পুরো বাজার উঠিয়ে নিয়ে এসেছেন।
তিনি আসলে অনেক বাজার করেছেন। হনুমানের ক্ষেত্রেও একই রকম ঘটেছিল।
রামভক্ত হনুমান ছিলেন যোগী পুরুষ। তিনি যোগবলে অনেক অলৌকিক শক্তি অর্জন করেছিলেন। তিনি যোগবলে নিজের আকার এত ছোট করে ফেলতে পারতেন যে তাঁকে খালি চোখে দেখা কষ্টকর হয়ে যেত। আবার তিনি ইচ্ছা করলে যোগবলে নিজের আকার অনেক বড় করে ফেলতে পারতেন। আর তিনি ছিলেন অত্যন্ত শক্তিশালী।
‘কী হে ভাই, তুমি তো দেখি পুরা বাজার উঠিয়ে নিয়ে এসেছ!’ এর মানে কিন্তু এই নয় যে সেই ব্যক্তি পুরো বাজার উঠিয়ে নিয়ে এসেছেন। তিনি আসলে অনেক বাজার করেছেন।তিনি আসলে ‘সঞ্জীবনী বুটি’ চিনতে না পেরে যোগবলে নিজের শরীরটা অনেক বড় করে সামনে যত ধরনের বৃক্ষ ও লতাপাতা পেয়েছিলেন, সেই সবকিছু সংগ্রহ করে বিশাল এক বোঝা বানিয়ে নিজের পিঠের ওপর তুলে যখন অতি দ্রুত এক পাহাড় থেকে অন্য পাহাড়ে লাফ দিচ্ছিলেন, তখন সেই বিশালদেহী হনুমানকে দেখে মনে হচ্ছিল যেন গোটা পাহাড়টাই পিঠে তুলে নিয়ে লাফাচ্ছেন।
আরও পড়ুনদুর্গাপূজার কাহিনি২০ অক্টোবর ২০২৩হনুমানের এই অসাধারণ কীর্তিকে অনেকেই অলৌকিক বলেই ভাবেন। কিন্তু অলৌকিকতা ছাপিয়ে এটা তাঁর গুরুর প্রতি শ্রদ্ধা এবং গুরুর আদেশের প্রতি দৃঢ় সংকল্পের প্রতীক। ভারতের হিমাচল, উত্তরাখন্ড, মধ্যপ্রদেশ এমনকি বাংলাদেশের মহেশখালীর আদিনাথ ধামসহ কিছু স্থানে এই ঘটনার স্মৃতি বহন করে, এমন লোককথা এখনো প্রচলিত।
একটি পাহাড় কাঁধে বহন করে উড়ে যাওয়া প্রকৃতির নিয়মের বাইরে। আর অবতার, মহাপুরুষ বা প্রেরিত পুরুষেরা কখনো প্রকৃতির নিয়মের বাইরে যান না। রামায়ণের এ ঘটনাকে মূলত রূপক বা প্রতীকী ঘটনা হিসেবেই বিবেচনা করেন হিন্দুধর্মীয় অবতার-মহাপুরুষেরা। আর পৃথিবীতে অলৌকিক বলে কিছু নেই।
রামায়ণের এ ঘটনাকে মূলত রূপক বা প্রতীকী ঘটনা হিসেবেই বিবেচনা করেন হিন্দুধর্মীয় অবতার-মহাপুরুষেরা। আর পৃথিবীতে অলৌকিক বলে কিছু নেই।মনে করেন, একজন যোগী পুরুষ নদীর তীর থেকে যোগবলে অদৃশ্য হয়ে নদীর মধ্যে ভেসে উঠলেন। আমি দেখতে পাচ্ছি না, জানতে পারছি না যে তিনি কীভাবে গিয়েছেন, তাই আমার কাছে অলৌকিক। আর ওই যোগী জানেন যে তিনি কীভাবে গিয়েছেন, তাই তাঁর কাছে লৌকিক।
যুগের পর যুগ ধরে লাখ লাখ ভক্তের হৃদয়ে এই ঘটনা গুরুর প্রতি শিষ্যের ভালোবাসা এবং নিজেকে গুরুর প্রতি সম্যকভাবে ন্যস্ত করার এক আস্থা ও অনুপ্রেরণার গল্প হয়ে রয়েছে। হনুমানের এই গাথা তাঁর ভক্তিমূলক চরিত্রকে যেমন সমৃদ্ধ করে, তেমনি মানবজাতির দুর্দম সাহস ও আত্মত্যাগের কথাও মনে করিয়ে দেয়।
তথ্যসূত্র: ১. বাল্মীকি রামায়ণ. ২. কৃত্তিবাসী রামায়ণ, ৩. শ্রীশ্রী ঠাকুর অনুকূলচন্দ্র কথিত ‘আলোচনা প্রসঙ্গে’ গ্রন্থ, ৪. মহেশখালীর আদিনাথ ধাম অঞ্চলের লোককথা।
পার্থ দেব বর্মন: গবেষক, সৎসঙ্গ রিসার্চ সেন্টার
আরও পড়ুনরামচন্দ্র, বিষ্ণুর অবতার কিন্তু মানবিক১৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৩