সাইফুল শেখের পরিবারকে দেখতে আমরা মুজিবনগর ভবেরপাড়া গ্রামে যাই। এক জীর্ণ মাটির ঘর। কৃষক সাইফুল শেখ কয়েক দিন আগেই চাষে লোকসান আর ঋণের ভার সইতে না পেরে আত্মহননের পথ বেছে নিয়েছেন।
মা রমেসা খাতুন হাহাকার করে কেঁদে উঠলেন– ‘আমার ছেইলে, আমার পাখি তো আর নাই রে বাবু!’ পক্ষাঘাতগ্রস্ত, চলাফেরায় অক্ষম সাইফুল শেখের স্ত্রী হতবিহ্বল সোনাভানু একবার কথা বলেন আবার চুপ হয়ে যান। পেঁয়াজ, কচু চাষ করে, বর্গার গরু-ছাগল পালন করে জীবিকা নির্বাহ করতেন সাইফুল শেখ। কন্যা রোজেফাকে খুব আগ্রহে পড়াশোনায় উৎসাহ দিতেন। বিষপানের দু’দিন আগে তাকেই বলছিলেন ধারদেনা, লোকসান আর হতাশার কথা।
২৫ মার্চ প্রতিদিনের মতো মাঠে গিয়েছিলেন তিনি। বিকেলে বাড়ি ফিরেই হঠাৎ বমি করে ফেলেন। বমি থেকে অস্বাভাবিক গন্ধ পেয়ে জানতে চাইলে কচুক্ষেতে ব্যবহার্য বিষ পান করেছেন বলে জানান তিনি। দু’দিন ধরে এই হাসপাতাল ওই হাসপাতাল করেও শেষ রক্ষা হয়নি। ২৭ মার্চ চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান কৃষক সাইফুল শেখ।
তাঁর স্ত্রী, মা ও মেয়ে এখন আর কিছুই বুঝে উঠতে পারছেন না। শোক বড়; হঠাৎ ফাঁকা হয়ে যাওয়া সংসারটাও বড়। তার চেয়েও বড় আগামীকালের ভাতের দুশ্চিন্তা। একদিকে পরিবারের চরম অনিরাপত্তা, অন্যদিকে ক্ষুদ্রঋণ, সারের ডিলার, বর্গার জমি আর মুদি দোকানের ঋণের মতো নানাবিধ চাপ। বর্গা জমি, ধারে সার, কীটনাশক, ছত্রাকনাশকের ব্যবস্থা, ঋণ নিয়ে শ্রমিকের মজুরি, চাষ-সেচের খরচ, ফসল ওঠা পর্যন্ত সংসার চালাতে বিবিধ ধারদেনা, তারপর ফসলের দাম না পাওয়া, ঋণ পরিশোধের চাপ– এগুলো আমাদের প্রান্তিক কৃষকের জন্য চক্রাকারে চলতে থাকে। আমরা যখন সাইফুল শেখের বাড়ি থেকে ফিরছি, তখন জানা গেল রাজশাহীর বাঘায় আরও একজন কৃষক চলন্ত ট্রেনের নিচে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করেছেন। তিনিও ঋণের দায় ও লোকসানের চাপে ছিলেন।
এসব মৃত্যু কেবল এক ব্যক্তির নয়, বরং একটি কাঠামোর ব্যর্থতার প্রতিচ্ছবি। যেখানে কৃষকের ঋণের হিসাব মেলে না, সেখানে ফসল ফলানো মানেই অনিশ্চয়তার আতঙ্ক। লোকসানের ধসেই ভেঙে পড়েছে সাইফুল শেখের গোটা পৃথিবী; সঙ্গে তাঁর পরিবারের বর্তমান ও ভবিষ্যৎ। কথাটি শুনতে হয়তো পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তির জন্য এক রকমের স্বার্থপরতাই শোনায়, কিন্তু বাংলাদেশের বহু প্রান্তিক পরিবারের পরম্পরায় পরিবারের প্রধান পুরুষের ওপরে সবার এই নির্ভরতা সত্য। অপরিবর্তনীয় সত্য হলো, এই বাড়ির বাকি প্রত্যেক সদস্যই নারী। মা রমেসা বেগম কিংবা রোজেফা খাতুন যেভাবে বলতে পেরেছেন সাইফুল শেখ কী খেতে পছন্দ করতেন, কখন কাজে যেতেন, কখন ফিরতেন; সেভাবে বলতে পারেননি বর্গার এক বিঘা জমিটুকু ঠিক কত টাকায় বর্গা নেওয়া। তাদের না বোঝার আছে নিজের জমির খতিয়ান। না চেনেন বর্গা জমির মালিককে; না আছে কৃষিঋণের ভাষা বোঝার জ্ঞান; না আছে বাজারে দরদাম বোঝার সুযোগ। নারী হয়ে, গরিব হয়ে, প্রান্তিক গ্রামে থেকে তারা তিন গুণ ভঙ্গুর হয়ে পড়েছেন এই দুনিয়ার চোখে। তাদের দিন ও রাত এখন শুধুই শোক আর সংগ্রামের নাম।
আমাদের জানার ছিল, সাইফুল শেখ কেন আত্মহত্যা করলেন? কিন্তু ভবেরপাড়া থেকে ফিরে এসে আমাদের আজকের প্রশ্ন, আসলে সাইফুল শেখকে আমরা কেন বেঁচে থাকার স্বপ্ন দেখাতে পারিনি? ফসলের দাম ওঠানামা করে। জীবনও কি তা-ই করবে? সাইফুল শেখ কি আর কখনও ফিরবেন? তিনি জীবিকার জন্য কৃষিকাজ করছিলেন, নাকি অনিশ্চিত মূল্য তাঁর আত্মহত্যার জন্য জমি প্রস্তুত করছিলেন! লোকসান হলে কৃষক মরে। লাভ তাহলে কার ঘরে যায়?
আমার স্মৃতিতে একটা কোদাল আর একটি ছবি পড়ে আছে সাইফুল শেখের বাড়ি। কেউ আর সেই কোদাল নিয়ে ক্ষেতে বেরোবে না; ছেলেকে ক্ষেত থেকে ফিরে আসতে দেখে রমেসা খাতুন বলে উঠবেন না– ‘বাবা আইছো?’ রাষ্ট্র এই শূন্যতা, অসহায়ত্ব বোঝে কিনা; জানি না। তবে এই গল্প কেবল সাইফুল শেখের গল্প নয়; এটি আমাদের কৃষকের গল্প। একটি দেশের আত্মার ক্ষয় হয়ে যাওয়ার গল্প।
এখন সিদ্ধান্ত আমাদের। আমরা কী শুনতে চাই? আত্মহত্যায় কৃষকের মৃত্যুর খবর? রোজেফা, রমেসা, সোনাভানুদের হাহাকার! নাকি কৃষক বাঁচাতে, দেশের কৃষি বাঁচাতে কৃষকের চাওয়া?
দুর্দশা বা দরকারের কথা কে শুনবে; কৃষক কোথায় বলবে? সেই পথ কি আমরা তৈরি করছি?
উম্মে সালমা: উন্নয়নকর্মী
ummesalmapopi@gmail.
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: পর ব র র আম দ র র জন য
এছাড়াও পড়ুন:
বিএনপি নেতাকে মারধর: খুলনা সদর থানার সাবেক ওসি কারাগারে
খুলনা মহানগর বিএনপির সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক ফখরুল আলমের করা মামলায় সদর থানার সাবেক ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) হাসান আল মামুনকে কারাগারে পাঠানো হয়েছে।
রোববার আদালতে আত্মসমর্পণ করে জামিনের আবেদন করেন হাসান আল মামুন। খুলনা মহানগর দায়রা জজ মো. শরীফ হোসেন হায়দার তার জামিন বাতিল করে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন।
এদিকে আদালত চত্বরে থাকা বিএনপি নেতাকর্মীরা মামুনকে লক্ষ্য করে ডিম ও পচা আম নিক্ষেপ করেন। তার শাস্তির দাবিতে বিভিন্ন স্লোগান দেন তারা। পরে নেতাকর্মীদের সরিয়ে দেন সেনা সদস্যরা।
মহানগর দায়রা জজ আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) এ কে এম শহিদুল আলম বলেন, মামলাটিতে উচ্চ আদালতের জামিনে ছিলেন হাসান আল মামুন। উচ্চ আদালতের নির্দেশে রোববার খুলনা মহানগর দায়রা জজ আদালতে তিনি আত্মসমর্পণ করেন। এ সময় তার আইনজীবীরা জামিনের আবেদন করেন। আমরা জামিনের বিরোধিতা করি। আদালত জামিনের আবেদন নামঞ্জুর করে তাকে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন।
মামলার এজাহার থেকে জানা যায়, ২০২২ সালের ৫ জানুয়ারি কে ডি ঘোষ রোডের দলীয় কার্যালয়ের সামনে বিএনপির সমাবেশে লাঠিচার্জ করে পুলিশ। এ সময় তৎকালীন ওসি মামুন নিজেই
ফখরুল আলমকে বেদম মারধর করেন। লাঠির আঘাতে ফখরুল আলমের একটি চোখ নষ্ট হয়ে যায়। এ ঘটনায় ২০২৪ সালের ১৯ আগস্ট মামুনের বিরুদ্ধে নির্যাতন ও হত্যাচেষ্টার অভিযোগে আদালতে মামলা করেন ফখরুল।