বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের পথে বৈদেশিক বিনিয়োগ একটি গুরুত্বপূর্ণ চালিকা শক্তি। বর্তমানে দেশে প্রায় ৬৩৪ টির বেশি বিদেশি মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান পরিচালিত হলেও, শ্রমিক অসন্তোষ, রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং আইন-শৃঙ্খলার অবনতির কারণে এই বিনিয়োগ প্রবাহ বারবার হুমকির মুখে পড়ছে, যা একটি বিনিয়োগ বান্ধব পরিবেশ তৈরিতে বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা দিচ্ছে। বিশেষ করে ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম সাত মাসে এই সংকটগুলো বৈদেশিক বিনিয়োগে দৃশ্যমান প্রভাব ফেলেছে। নিরাপদ ও স্থিতিশীল পরিবেশের অভাবে অনেক বিদেশি বিনিয়োগকারী নতুন বিনিয়োগ থেকে পিছিয়ে যাচ্ছেন, যা দেশের শিল্পায়ন ও কর্মসংস্থান সৃষ্টির গতিকে শ্লথ করে দিচ্ছে। 


শ্রমিক অসন্তোষের প্রধান কারণগুলো বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, সময়মতো বেতন ও বোনাস না পাওয়া, ন্যায্য মজুরি কাঠামো বাস্তবায়নের অভাব, বৈষম্যমূলক আচরণ, অতিরিক্ত কাজের চাপ এবং অভিযোগ নিষ্পত্তিতে গাফিলতি। এছাড়াও নিরাপদ কর্মপরিবেশের অভাব, অগ্নি নিরাপত্তা ও সুরক্ষামূলক সরঞ্জামের ঘাটতিও শ্রমিকদের উদ্বেগ বাড়ায়। ট্রেড ইউনিয়নে অংশগ্রহণে সীমাবদ্ধতা, জীবনমানের দুরবস্থা, প্রশিক্ষণের অভাব, অর্থনৈতিক চাপ, স্থানীয় প্রভাবশালীদের হস্তক্ষেপ এবং রাজনৈতিক অস্থিরতাও অসন্তোষকে ত্বরান্বিত করে। এসব উপাদান শ্রমিকদের মধ্যে ক্ষোভ তৈরি করে, যা শেষ পর্যন্ত আন্দোলনে রূপ নেয়।


২০২৪ সালের জুলাই মাসে দেশের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর শ্রমিকদের মধ্যে নতুন প্রত্যাশা ও চাপ তৈরি হয়। একই সঙ্গে ভারত-চীন-মালয়েশিয়ার ভূরাজনৈতিক প্রতিযোগিতা বাংলাদেশের শিল্প স্থিতিশীলতাকে জটিল করে তোলে। অনেক সময় পরিকল্পিতভাবে অস্থিরতা তৈরি করে গার্মেন্টস সেক্টরের অর্ডার প্রতিদ্বন্দ্বী দেশের দিকে সরিয়ে নেওয়ার প্রচেষ্টা চালানো হয়, যা শিল্পখাতকে দুর্বল করে, বিনিয়োগকারীদের আস্থায় আঘাত হানে এবং শ্রমিক অসন্তোষকে ত্বরান্বিত করে তোলে।
শ্রমিক অসন্তোষ বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আস্থা কমছে। অনেকেই নিরাপত্তাহীনতার কারণে ব্যবসা গুটিয়ে নেওয়ার চিন্তা করছেন বা নতুন বিনিয়োগে পিছিয়ে যাচ্ছেন। ২০২৪ সালের অক্টোবর-ডিসেম্বরে কিছু জাপানি কোম্পানি উৎপাদন বন্ধ করে দিয়েছে। ২০১৩ সালের রানা প্লাজা দুর্ঘটনার পর বিদেশি ব্র্যান্ড অনেক ক্ষেত্রে উৎপাদন ভিয়েতনাম, ইথিওপিয়া ও মিয়ানমারে স্থানান্তরিত করেছে।


বর্তমান শিল্প পরিবেশে একটি নেতিবাচক প্রবণতা লক্ষণীয়—আমরা প্রতিক্রিয়া নির্ভর পদক্ষেপ নিচ্ছি, প্রতিরোধমূলক নয়। কোনো অসন্তোষ শুরু হলে তখন আলোচনা, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর হস্তক্ষেপ, ও কখনো কখনো শিল্প পুলিশ, র‍্যাব বা সেনাবাহিনী মোতায়েন করা হয়। কিন্তু এসব হচ্ছে তাৎক্ষণিক সমাধান; দীর্ঘমেয়াদী ও কাঠামোগত পরিবর্তন হচ্ছে না।


এই প্রেক্ষাপটে, বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি পদ্ধতি তুলনামূলকভাবে একটি কার্যকর সমাধান হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। যদি বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি পদ্ধতি বাধ্যতামূলক করা হয়, তবে অনেক শ্রমিক অসন্তোষ উৎপত্তির আগেই তার মীমাংসা সম্ভব হবে। শ্রীলঙ্কা, ভারত, ফিলিপাইন এবং ইন্দোনেশিয়া সহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এ ধরনের ব্যবস্থার মাধ্যমে শিল্প পরিবেশ অনেক বেশি স্থিতিশীল রাখা সম্ভব হয়েছে। এছাড়া বাংলাদেশে ইপিজেড অঞ্চলে শ্রমিক অসন্তোষ নিরসনে বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি পদ্ধতি সম্পূর্ণভাবে প্রয়োগের ফলে শ্রমিকদের অধিকার রক্ষা ও শ্রমিক অসন্তোষ নিরসনে তুলনামূলকভাবে সফল ফলাফল পাওয়া গেছে।
শুধু আইন প্রণয়ন নয়, তার যথাযথ বাস্তবায়ন ও তদারকি জরুরি। শ্রম আইন ২০০৬ , সংশোধনী ২০১৩, ২০১৮, বাংলাদেশ ইপিজেড শ্রম আইন, ২০১৯ , ইপিজেড শ্রমবিধিমালা ২০২২ -এর নানা ধারা বাস্তবিক পরিপ্রেক্ষিতে উপযোগী করে তোলা এবং বাস্তবায়ন করতে হবে। শ্রম আদালতের কার্যকারিতা বাড়াতে হলে দক্ষ বিচারক, শ্রম আইনে পারদর্শী আইনজীবী এবং দ্রুত রায় কার্যকর করার ব্যবস্থা থাকতে হবে। শ্রম মন্ত্রণালয়ের অধীন কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তর শ্রম পরিদর্শকদের পরিদর্শন কার্যক্রম আরও দক্ষ ও কার্যকর করতে হবে। পরিদর্শনকালীন সময়ে অভিযোগ নিষ্পত্তিতে সক্রিয় ভূমিকা পালন করলে বড় ধরনের শ্রমিক অসন্তোষ সহজেই প্রতিরোধ করা সম্ভব।


বিদেশি বিনিয়োগকারীরা যখন একটি দেশে পুঁজি বিনিয়োগ করেন, তখন তারা শুধু উৎপাদন খরচ, কর অব্যাহতি বা বাজার বিবেচনাই করেন না বরং, শ্রম পরিস্থিতি ও শ্রম অসন্তোষ একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি বিবেচ্য বিষয়। বিশ্বব্যাংক ও আঙ্কটাডের রিপোর্টে দেখা গেছে, শ্রম অস্থিরতা বিনিয়োগ সিদ্ধান্তকে প্রভাবিত করতে পারে। জাপান এক্সটারনাল ট্রেড অর্গানাইজেশন ২০২৩ সালের একটি জরিপে জানায়, শ্রম অস্থিরতা ও রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা বাংলাদেশে বিনিয়োগে প্রধান প্রতিবন্ধক হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।


শ্রমিক অসন্তোষ নিরসনে মালিকদের দায়িত্বশীল ভূমিকা জরুরি। অনেক মালিক অভিযোগ ব্যবস্থাপনাকে গুরুত্ব না দিয়ে শ্রমিকদের সঙ্গে নিয়মিত সভা করেন না এবং কল্যাণ কার্যক্রমে অংশগ্রহণ থেকে বিরত থাকেন। এতে শ্রমিকদের মধ্যে অবিশ্বাস ও অসন্তোষ তৈরি হয়, যা দ্রুত বিক্ষোভে রূপ নিতে পারে। লাইন লিডার ও সুপারভাইজাররা অভিযোগের তাৎক্ষণিক সমাধান না করে বরং বকাঝকা করলে পরিস্থিতি আরও জটিল হয়। তাই প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে গ্রিভেন্স রিড্রেস সিস্টেম (জিআরএস) চালু ও নিয়মিত পর্যালোচনা অত্যাবশ্যক, যাতে শান্তিপূর্ণ কর্মপরিবেশ বজায় থাকে যেকোনো শ্রমিক অসন্তোষের সূচনালগ্নে শিল্প পুলিশ উপস্থিত হয়ে শ্রমিকদের সঙ্গে সরাসরি কথা বলে পরিস্থিতি শান্ত করার চেষ্টা করে। তবে এ ক্ষেত্রেও শ্রম আইন, শ্রমিকদের মনস্তত্ত্ব এবং অসন্তোষ নিরসনের কৌশল নিয়ে শিল্প পুলিশের আরও গভীর জ্ঞান ও দক্ষতা অর্জনের প্রয়োজন রয়েছে। যদি তাদের এ বিষয়ে বিশেষায়িত প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয় এবং তারা কৌশলীভাবে বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি পদ্ধতি প্রয়োগ করতে সক্ষম হয়, তাহলে শ্রমিক অসন্তোষ দ্রুত, শান্তিপূর্ণ ও কার্যকরভাবে নিরসন করা সম্ভব হবে।


শ্রমিকদের মধ্যে শিল্পবান্ধব মনোভাব গড়ে তুলতে প্রেষণা, সচেতনতা এবং মোটিভেশনাল প্রচার কার্যক্রম গ্রহণ জরুরি। এর মাধ্যমে তাদের দায়িত্ববোধ ও কাজে আগ্রহ বাড়ানো সম্ভব, যা শিল্পের স্থিতিশীলতা এবং কর্মসংস্থানের নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে। পাশাপাশি, বন্ধ বা অচল কারখানার বিক্রয় ও পুনরুজ্জীবন প্রক্রিয়া সহজ ও কার্যকর করতে বিদ্যমান আইনগত জটিলতা দূর করে একটি স্বচ্ছ, দ্রুত ও বাস্তবমুখী ব্যবস্থা গড়ে তোলা প্রয়োজন, যাতে মালিক, বিনিয়োগকারী ও শ্রমিক—সবারই স্বার্থ রক্ষা হয়। সেইসাথে, যারা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে গুজব রটিয়ে বা নাশকতার মাধ্যমে শ্রমিক অসন্তোষ সৃষ্টি করে, তাদের দ্রুত আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। এই সব পদক্ষেপ বাস্তবায়নের মাধ্যমেই শিল্পখাতে টেকসই শান্তি ও স্থায়ী উন্নয়ন সম্ভব।


শ্রমিক অসন্তোষ বাংলাদেশের শিল্প ও বৈদেশিক বিনিয়োগের অগ্রগতিতে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই বাধা মোকাবেলায় কেবল তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া নয়, প্রয়োজন দীর্ঘমেয়াদি, কাঠামোগত ও অংশীদারিত্বমূলক সমাধান। শ্রমিক, মালিক, সরকার ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সমন্বিত প্রচেষ্টার মাধ্যমে শ্রমিকদের প্রেষণা, নিরাপত্তা ও ন্যায্যতার নিশ্চয়তা দেওয়া গেলে বিনিয়োগবান্ধব, স্থিতিশীল ও শান্তিপূর্ণ শিল্প পরিবেশ গড়ে তোলা সম্ভব। এই পথেই বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও বৈদেশিক বিনিয়োগ নিশ্চিত হবে।


ড.

সোহেল মিয়া: শ্রম সম্পর্ক বিশেষজ্ঞ
 

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: র জন ত ক ক র যকর ব যবস থ পর ব শ

এছাড়াও পড়ুন:

খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে এমবিএ ও এক্সিকিউটিভ এমবিএ প্রোগ্রামে ভর্তির সুযোগ

খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজনেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন ডিসিপ্লিনে ২০২৪-২৫ সেশনে দ্বিতীয় ব্যাচে ইভিনিং এমবিএ ও এক্সিকিউটিভ এমবিএ প্রোগ্রামে ভর্তি প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে।

ইভিনিং ও এক্সিকিউটিভ এমবিএ প্রোগ্রামের বিস্তারিত

ইভিনিং এমবিএ ২০২৪-২৫ (২য় ব্যাচ):

১. যোগ্যতা: ৪ বছরের ব্যাচেলর ডিগ্রি।

২. আসনসংখ্যা ৪৫।

৩. ক্লাসের সময়: ছুটির দিন সন্ধ্যায়।

৪. আবেদন ফি লাগবে: ১ হাজার ৫০০ টাকা।

আরও পড়ুনযুক্তরাষ্ট্র-যুক্তরাজ্যের পরিবর্তে উচ্চশিক্ষায় ভারতীয়রা কেন ঝুঁকছেন বাংলাদেশ–সিঙ্গাপুর–উজবেকিস্তান–রাশিয়ার দিকে০২ আগস্ট ২০২৫

এক্সিকিউটিভ এমবিএ ২০২৪-২৫ (২য় ব্যাচ) :

১. যোগ্যতা: তিন বা চার বছরের ব্যাচেলর ডিগ্রি, কমপক্ষে দুই বা তিন বছরের কাজের অভিজ্ঞতা গ্র্যাজুয়েশনের পর।

২. আসনসংখ্যা ৩৫।

৩. ক্লাসের সময়: শুধু শুক্রবার।

৪. আবেদন ফি লাগবে: ২০০০ টাকা।

আবেদনের শেষ তারিখ

১. ইভিনিং এমবিএ: ৪ আগস্ট ২০২৫।

২. এক্সিকিউটিভ এমবিএ: ১৭ আগস্ট ২০২৫।

আরও পড়ুনসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষকের ৩৪০০০ শূন্য পদ পূরণে উদ্যোগ২৯ জুলাই ২০২৫নির্বাচিত প্রার্থীদের তালিকা প্রকাশ

১. ইভিনিং এমবিএ: ৪ আগস্ট ২০২৫।

২. এক্সিকিউটিভ এমবিএ: ১৯ আগস্ট ২০২৫।

ভর্তি পরীক্ষা হবে

১. ইভিনিং এমবিএ: ৯ আগস্ট, সকাল ১০টা।

২.এক্সিকিউটিভ এমবিএ: ২২ আগস্ট, সকাল ১০টা।

# বিস্তারিত তথ্য জানতে ওয়েবসাইট

আরও পড়ুনফিনল্যান্ড কীভাবে গড়েছে বিশ্বসেরা শিক্ষাব্যবস্থা, সাফল্যের ৬ কারণ৮ ঘণ্টা আগে

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • জুলাই মাসে প্রবাসী আয় বেড়েছে ২৯%
  • জুলাইয়ে রেমিট্যান্স এসেছে ২৪৮ কোটি ডলার
  • ইসলামী কমার্শিয়াল ইনস্যুরেন্সের ১০ শতাংশ লভ্যাংশ ঘোষণা
  • এখন আমার মোবাইলে ওর কোনো ফোন আসে না
  • খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে এমবিএ ও এক্সিকিউটিভ এমবিএ প্রোগ্রামে ভর্তির সুযোগ
  • ইসরায়েলকে অস্ত্র দেবে না কানাডা
  • গৃহপরিচারিকাকে ধর্ষণের মামলায় দেবগৌড়ার নাতি সাবেক এমপি প্রজ্বলের যাবজ্জীবন
  • লিপস্টিক ইফেক্ট: মন্দায় প্রসাধনীর চাহিদা কেন বাড়ে?
  • ইসলামী কমার্শিয়াল ইন্স্যুরেন্সের বার্ষিক সাধারণ সভা অনুষ্ঠিত
  • পিডিবির ভুলে ২৪৫ কোটি টাকা জরিমানা দিতে হলো বাংলাদেশকে