বাংলাদেশের মানুষের জন্য দুঃখটা অধিক দুঃসহ। কারণ এখানকার মানুষ মুক্তির জন্য সংগ্রাম করেছেন, গণঅভ্যুত্থান করেছেন, প্রাণ দিয়েছেন এবং আশা করেছেন মুক্তি আসবে বলে। কিন্তু মুক্তির বদলে যন্ত্রণা ও দুঃখই প্রধান সত্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। এর কারণটাও আমাদের অজানা নয়। অল্প কথায় বলতে গেলে ঘটনাটি হচ্ছে রাষ্ট্র ও সরকারে পুঁজিবাদের জেঁকে বসা। পুঁজিবাদ এখন বিশ্বব্যাপী ফ্যাসিবাদী রূপ নিয়েছে। তার গায়ে যত আবরণ ছিল; শোষণের বৃদ্ধি এবং অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বে সেসব ছিন্নভিন্ন হয়ে গেছে। নগ্ন ও লজ্জাহীনভাবে সে তার ধ্বংসলীলাই চালিয়ে যাচ্ছে না শুধু; মাত্রাও বাড়িয়ে তুলেছে। যেমন বাংলাদেশে, তেমনি বিভিন্ন দেশে। 

পলাশীর তথাকথিত যুদ্ধে বণিক ইংরেজ জয়ী হয়েছে এবং তার সঙ্গে দেশি বণিক ও রাজপ্রাসাদের আমলারা ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছিল; ব্যক্তিগত স্বার্থে। অভিন্ন ঘটনা ঘটেছে বাংলাদেশেও। বাণিজ্য নিয়ে যুদ্ধ এখন সারা পৃথিবীর প্রধান ঘটনা। সমাজতান্ত্রিক চীনের নেতারা পর্যন্ত এখন বাণিজ্য ছাড়া অন্য কিছু বোঝেন না। এবং চীনের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী এখন যে আমেরিকা, তার রাষ্ট্রপ্রধানের আসল পরিচয় একজন সফল বণিকেরই। বণিক হওয়ার ফলেই তিনি রাজনীতিক হতে পেরেছেন এবং দুর্দমনীয় ক্ষমতাপ্রাপ্ত একজন রাষ্ট্রপ্রধানের পক্ষে যত প্রকার অনাচার করা সম্ভব, সেগুলোর প্রায় কোনোটিই করা থেকে বিরত না থেকে এবং অপরাধের জন্য শাস্তি পেয়েও, দ্বিতীয়বার রাষ্ট্রপ্রধান নির্বাচিত হয়েছেন। তাঁর জোরটা ছিল টাকা এবং গণমাধ্যমের ওপর কর্তৃত্বের। জোর আরও একটা ছিল, সেটা এই আশ্বাস– ক্ষমতা পেলে তিনি ধনীদের তো অবশ্যই গরিবদেরও ধনবান করে তুলবেন। তাঁর নিকটতম সঙ্গী ও পরামর্শদাতা ছিলেন যে-ব্যক্তি, তিনি বিশ্বের শীর্ষ ধনবান হিসেবে পরিচিত। ভোটদাতারা ভেবেছেন, এরাই হচ্ছেন আদর্শ, এরাই বাপের বেটা। এদের পথেই চলা ভালো, তাহলে তারাও হয়তো ছিটেফোঁটা কিছু পেয়ে যাবেন। ইতোমধ্যে ধনবান ব্যক্তিটি ট্রাম্পের স্বেচ্ছাচারিতায় পদত্যাগ করেছেন। এক ঘরে দুই বাঘের সহাবস্থান যে সম্ভব নয়– এটি তারই প্রমাণ। 

বঞ্চিত মানুষরা তো হালে পানি পাবেনই না, তাদের জন্য টিকে থাকাই কঠিন। তবে যারা শাসক-শোষক, সেই বুর্জোয়াদের হালেও পানির অভাব। তারা এখন উদারনীতির মুখোশকে আর ধরে রাখতে পারছেন না। সরাসরি ফ্যাসিবাদী নির্যাতনের পথ ধরেছেন। কোথাও ভেক ধরেছেন জাতীয়তাবাদীর, কোথাও তারা বর্ণবাদী; ধর্মবাদীও সাজছেন এবং চুটিয়ে ব্যবসা করছেন সমরাস্ত্র, মাদক ও পর্নোগ্রাফির। লুণ্ঠন চালিয়েছেন প্রায় সকল ক্ষেত্রেই। 
পুঁজিবাদী ব্যবস্থা মানুষের মোটামুটি চেনা হয়ে যাচ্ছে, যদিও তাদের পক্ষে তা স্পষ্ট করে বলা কঠিন। প্রকাশের সব মাধ্যমই এখন ক্ষমতাবানদের দখলে বা নিয়ন্ত্রণে। নানা রঙের ছটা দিয়ে চারদিকে এমন অবস্থা তৈরি করে রাখা হয়েছে; বঞ্চিতরা মোহগ্রস্ত, অনেকাংশে বোধশক্তিও অসাড়। 

পুঁজিবাদকে বিদায় করা না গেলে এ অবস্থার পরিবর্তন আশা করা যায় না। শুধু শাসকের বদল দিয়ে এ পরিবর্তন সম্ভব নয়; সংস্কার দিয়েও নয়। ছাত্র-জনতার সফল অভ্যুত্থান রাষ্ট্র ও সমাজে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে বলে যে আশা জেগে উঠেছিল, নানা ঘটনা তাকে মলিন করে দিয়েছে। নিষ্প্রাণ হয়ে পড়েছে খোদ গণঅভ্যুত্থানটিই। আন্দোলনের কেন্দ্রে থাকা ছাত্রনেতারা রাজনৈতিক দলগুলোকে দক্ষতার সঙ্গে আন্দোলনে সম্পৃক্ত করেছিলেন; এখন তারাই রাজত্ব করছেন দেশজুড়ে। তা করতে গিয়ে সবকিছু লেজেগোবরে করে ফেলছেন; স্তরে স্তরে ছড়িয়ে দিচ্ছেন হতাশা। 
তাই পুঁজিবাদকে হটানোর জন্য চাই সামাজিক বিপ্লব, যার ভিত্তি হবে ব্যক্তিমালিকানার জায়গায় সামাজিক মালিকানা প্রতিষ্ঠার আন্দোলন। সে আন্দোলন এগোলে সংস্কার এমনিতেই আসতে থাকবে। কিন্তু সমস্যা হলো, এই বিপ্লবে যে সমাজতন্ত্রীদের নেতৃত্ব দেওয়ার কথা, তারা ঐক্যবদ্ধ নন। অন্য সব দেশের মতো বাংলাদেশেও তারা বিভক্ত, পরস্পরবিচ্ছিন্ন; এমনকি বিভ্রান্তও। 
এখানে সামাজিক বিপ্লবীদের তৎপরতা শুরু হয়েছে সেই বিশ শতকের প্রথম দিকে। ইতোমধ্যে দুইশ বছর কেটে গেছে; ঐক্যবদ্ধ, সুসংগঠিত কোনো বিপ্লবী পার্টি গড়ে ওঠেনি। এখানে রুশপন্থি, চীনপন্থি বিভাজন ঘটেছে। চীনপন্থিরা বিভিন্ন দল ও উপদল গঠন করেছেন। রুশপন্থিদের মধ্যেও বিভাজন ঘটেছিল। তারা বিভক্ত হয়েছিলেন বিলোপবাদী ও বিলোপবিরোধী দুই শিবিরে। বিলোপবাদীরা বহু আগেই সম্মান বাঁচিয়ে বিদায় নিয়েছেন; বিলোপবিরোধীরাও শুনছি এক থাকতে পারছেন না। একই পার্টির ছাতার নিচে তারা দুটি উপদলে বিভক্ত।
যে মুহূর্তে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন বুর্জোয়াদের দুঃশাসন, লুণ্ঠন, প্রতারণা ও সম্পদ পাচারের বিরুদ্ধে বিকল্প রাজনৈতিক আন্দোলন গড়ে তোলা; ঠিক সে মুহূর্তেই সামাজিক বিপ্লবীরা আরও ভাঙনের দিকে যাচ্ছেন।

বুর্জোয়াদের যে দুই পক্ষ সেক্যুলার ও নন-সেক্যুলার বা প্রগতিশীল ও রক্ষণশীল বলে পরিচিত, ছলচাতুরীতে ক্ষমতায় স্থায়ীভাবে টিকে থাকাই যাদের সব কাজের লক্ষ্য; এ উভয় পক্ষেরই বিরুদ্ধে বিকল্প পক্ষ তৈরি জরুরি হয়ে পড়েছে। এই বিকল্পের লক্ষ্য হবে সামাজিক বিপ্লবের মাধ্যমে এমন এক ব্যবস্থা গড়ে তোলা, যেখানে মানুষের সঙ্গে মানুষের অধিকার ও সুযোগের সাম্য প্রতিষ্ঠিত হবে এবং সুযোগের সাম্যকে আরও এগিয়ে নিয়ে সব মানুষের জন্য মুক্তি অর্জন সম্ভব হয়ে উঠবে। এ মুহূর্তে যারা এ কাজের জন্য নিজেরা প্রস্তুত বলে মনে করছেন, তাদের পক্ষে একটি দল হয়ে ওঠা হয়তো সম্ভবপর নয়, নিঃসন্দেহে; তেমন কথা বললে হয়তো দলগুলো আবারও ভাঙনের মুখে পড়বে। প্রকৃত সংগ্রামের মধ্য দিয়ে ঐক্যের শর্ত তৈরি না হলে বরং পরস্পর সন্দেহ-সংশয় বাড়তে পারে। তাই সমাজবিপ্লবীদের যুক্তফ্রন্ট গঠনই হতে পারে বাস্তবসম্মত এক পদক্ষেপ। এই যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে অংশ নেবে রণকৌশল হিসেবে। এই যুক্তফ্রন্টের অবশ্যই জানা থাকবে যে নির্বাচনে সরকার বদলাতে পারে, কিন্তু ব্যবস্থা বদলাবে না; ব্যবস্থা বদলের জন্য নানা পদক্ষেপ ও বিভিন্ন কৌশলের প্রয়োজন হবে। এবং চূড়ান্ত পদক্ষেপটি হবে সমাজবিপ্লব। 
মানুষ সমাজবিপ্লবীদের এই ঐক্যের জন্য অপেক্ষা করছে। এমন হলে যে সমাজেও এক জাগরণ সৃষ্টি হবে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

.

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: র জন ত ব যবস থ কর ছ ন র জন য ক ষমত

এছাড়াও পড়ুন:

মাঠে পড়ে ছিল স্ত্রীর মরদেহ, গাছে ঝুলছিল স্বামীর লাশ

যশোরের বেনাপোলে এক দম্পতির মরদেহ উদ্ধার হয়েছে। শনিবার (১৪ জুন) সকালে তাদের মরদেহ সীমান্তবর্তী রঘুনাথপুর গ্রাম থেকে উদ্ধার করে পুলিশ।

এলাকাবাসী ও পুলিশের ধারণা, পারিবারিক দ্বন্দ্বের জেরে স্ত্রীকে হত্যার পর স্বামী আত্মহত্যা করেছেন।

মারা যাওয়া মনিরুজ্জামান (৫২) রঘুনাথপুর গ্রামের মৃত আব্দুর রাজ্জাকের ছেলে। নিহত রেহেনা খাতুন (৪৫) মনিরুজ্জামানের স্ত্রী।

আরো পড়ুন:

পটুয়াখালীতে সৎ মা ও দাদিকে গলাকেটে হত্যা

ঈদের ছুটি কাটিয়ে কর্মস্থলে ফেরা হলো না খোকনের

এলাকাবাসী জানান, দীর্ঘদিন ধরে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে পারিবারিক দ্বন্দ্ব ছিল। এই দ্বন্দ্বের জেরে মনিরুজ্জামান তার স্ত্রী রেহেনা খাতুনকে গলাটিপে হত্যা করে মরদেহ বাড়ির পাশের মাঠে ফেলে রাখেন। পরে তিনি নিজে গাছের সঙ্গে গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেছেন। 

বেনাপোল পোর্ট থানার ওসি রাসেল মিয়া জানান, ঘটনাস্থল থেকে মরদেহ দুইটি উদ্ধার করে ময়নাতদন্তের জন্য যশোর সদর হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে। স্থানীয়দের কাছ থেকে শুনে প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে, পারিবারিক দ্বন্দ্বের জেরে স্ত্রীকে হত্যার পর স্বামী আত্মহত্যা করেছেন। অন্য কোনো বিষয় আছে কিনা তদন্ত শেষে জানা যাবে।

ঢাকা/রিটন/মাসুদ

সম্পর্কিত নিবন্ধ