ফুটবলের নতুন জোয়ার কি কাজে লাগাতে পারবে বাফুফে
Published: 15th, June 2025 GMT
ফুটবলের মরা গাঙে কি তাহলে জোয়ার এসেছে! তা তো কিছুটা এসেছেই। সিঙ্গাপুরের বিপক্ষে ম্যাচ নিয়ে যে তুলকালাম কাণ্ড হলো, এমন কিছু বাংলাদেশের ফুটবল অনেক দিন দেখেনি। অনেক দিন বলতে অনেক অনেক বছর।
মনে করতে পারেন, সর্বশেষ কবে কোন ফুটবল ম্যাচের জন্য বাংলাদেশের এমন অধীর অপেক্ষায় দিন কেটেছে! সর্বশেষ কবে দেখেছেন টিকিট নিয়ে এমন কাড়াকাড়ি, গ্যালারি উপচে পড়া দর্শক, সারা দেশের মানুষের ওই ৯০ মিনিটে বুঁদ হয়ে থাকা.
সেই ম্যাচে যে বাংলাদেশ হেরে গেছে, এটিকে আপনি অ্যান্টি ক্লাইমেক্স বলতে পারেন। তবে ম্যাচ শেষ হয়ে যাওয়ার চার/পাঁচ দিন পরও সেটির রেশ থেকে যাওয়াটাও তো বাংলাদেশের ফুটবলের জন্য ব্যতিক্রমী ঘটনা। এর আগে বাংলাদেশ দলের কোনো ফুটবল ম্যাচের এমন আলোড়ন তোলার স্মৃতিতে প্রায় ২২ বছরের ধুলো জমেছে। সেই ধুলো ঝেড়েমুছে পেছনে তাকালে আপনি দেখতে পাবেন ২০০৩ সালের সাফ ফুটবল চ্যাম্পিয়নশিপ। ঢাকার এই জাতীয় স্টেডিয়ামেই যেটির ফাইনালে মালদ্বীপকে হারিয়ে চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল বাংলাদেশ। এর আগে সেমিফাইনালে হারিয়েছিল ভারতকে। বাংলাদেশের ফুটবল নিয়ে গণমানুষের উন্মাদনার সর্বশেষ উদাহরণের সঙ্গে মিলে যাচ্ছে ফুটবলে বাংলাদেশের সর্বশেষ বড় কোনো সাফল্যও।
এত বছর পর আবারও এ দেশের মানুষের মুখে মুখে ফুটবল ফেরার একটি কারণ বলতে হলে তা অবশ্যই হামজা চৌধুরী নামের পরশপাথর। ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগে খেলেছেন, খেলেছেন ইংল্যান্ড অনূর্ধ্ব-২১ দলেও। ইংল্যান্ড জাতীয় দলে খেলার স্বপ্ন পূরণ হওয়ার নয় জেনে বাংলাদেশের জার্সি গায়ে তোলার সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর থেকেই হামজাকে বরণ করে নিতে অপেক্ষায় ছিল বাংলাদেশ। সেই বরণ করে নেওয়াটাও রীতিমতো ঢেউ তুলেছে এ দেশের ক্রীড়াঙ্গনে। গত মার্চে ভারতের বিপক্ষে এশিয়ান বাছাইপর্বের ম্যাচ খেলতে হামজার বাংলাদেশে আগমন নিয়ে যা হয়েছিল, সেটিও বাংলাদেশের ফুটবলে অভূতপূর্বই। হয়তো বাংলাদেশের ক্রীড়া ইতিহাসেও। সেই ম্যাচ হয়েছে ভারতে, যাতে হামজাই ছিলেন মূল আকর্ষণ।
সিঙ্গাপুরের বিপক্ষে ম্যাচেও তা-ই। তবে পার্শ্বনায়ক ছিলেন বেশ কজন। কানাডা প্রবাসী আরেক বাংলাদেশি ফুটবলার শমিত সোমের এই ম্যাচেই বাংলাদেশের পক্ষে অভিষেক হয়েছে, যোগ হয়েছেন ইতালির চতুর্থ বিভাগে খেলা ফাহামিদুল ইসলামও। ডেনমার্ক আর ফিনল্যান্ডে বেড়ে ওঠা জামাল ভুঁইয়া আর তারিক কাজী অনেক আগে থেকেই ছিলেন এত দিনে বলে অনেকটা ‘ঘরের ছেলে’ হয়ে গেছেন। মাঝখানে কানাডা থেকে এসেছেন কাজেম শাহও। এই প্রবাসী ফুটবলারদের নিয়ে বাংলাদেশ দলের নতুন রূপে দেখা দেওয়াই এ দেশের মানুষের মনে লুকিয়ে থাকা ফুটবলপ্রেমে নতুন করে আন্দোলন তুলেছে। যা আসলে সব সময়ই সুপ্ত হয়ে ছিল। মাঝখানে বাংলাদেশের ফুটবল থেকে এ দেশের মানুষ মুখ ফিরিয়ে থাকতে পারেন, কিন্তু তাদের ফুটবলপ্রেম নিয়ে সংশয় জাগেনি কখনোই। ইউরোপিয়ান ফুটবল নিয়ে মাতামাতিই তা মনে করিয়ে দিত। বিশ্বকাপ তো আরও বেশি।
বিশ্বকাপের সময়কার বাংলাদেশ তো এখন ফুটবল বিশ্বেই বিস্ময় জাগায়। কৌতূহলও। ফিফা র্যাঙ্কিংয়ের তলানিতে পড়ে থাকা একটা দেশে ফুটবল নিয়ে এমন মাতামাতি যে অনেকের বিশ্বাসই হতে চায় না। সেই অবিশ্বাসের মাত্রাটা এমনই যে, বিশ্বকাপ ফুটবল কাভার করতে গিয়ে ইউরোপ-লাতিন আমেরিকার সাংবাদিকদের কাছে তা ব্যাখ্যা করতে হয়। তাঁরা অবিশ্বাসে চোখ বড় করে তা শোনেন। ২০১৪ সালে ব্রাজিল বিশ্বকাপ কাভার করতে গিয়ে যেমন সত্যি সত্যিই মনে হলো, বাংলাদেশে এই মুহূর্তে ব্রাজিলের চেয়ে বেশি ব্রাজিলিয়ান পতাকা উড়ছে। ব্রাজিলিয়ান সাংবাদিকেরা প্রথমে ভেবেছিলেন, আমি রসিকতা করছি। ২০২২ বিশ্বকাপের স্মৃতি তো মোটামুটি টাটকাই। আর্জেন্টিনা দলের কোচ লিওনেল স্কালোনির সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশ নিয়ে প্রশ্ন হচ্ছে। ধন্যবাদকেও যথেষ্ট মনে না করে তিনি কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছেন বাংলাদেশের সমর্থকদের।
বিশ্বকাপে বাংলাদেশে যা হয়, তা হয়তো একটু বেশি বেশিই। তবে ফুটবল যে বিশ্বের জনপ্রিয়তম খেলা, এটা প্রমাণের দায়িত্ব কখনোই বাংলাদেশের ওপর পড়েনি। এই অবিসংবাদী সত্যি কখনো চ্যালেঞ্জের মুখে পড়লে তো!
হামজা-শমিতদের কল্যাণে বাংলাদেশের ফুটবল নিয়ে নতুন করে যে আগ্রহ জেগেছে, তা নিয়ে তৃপ্তির ঢেকুর না তুলে বাফুফের কর্তাব্যক্তিদের বরং উচিত এটাকে কাজে লাগাতে ঝাঁপিয়ে পড়া। এমন সুযোগ বারবার আসে না, হয়তো আর কখনো আসবেই না।হামজা-শমিতদের মতো প্রবাসী বাংলাদেশিদের খেলিয়ে বাংলাদেশের ফুটবলের সত্যিকার কোনো উন্নতি হবে কি না, এই আলোচনাও হচ্ছে। সাবেক খেলোয়াড়েরা দ্বিধাবিভক্ত। বিপক্ষের মতটাই বেশি জোরালো শোনাচ্ছে। যদিও বাফুফে যা করছে, তা মোটেই নতুন কিছু নয়। অন্য অনেক দেশ অনেক আগেই এই পথে হেঁটেছে।
গত বিশ্বকাপে এমন ১৩০ জন ফুটবলার ছিলেন, যাঁরা যে দেশে জন্ম হয়েছে, সেই দেশের বদলে অন্য দেশের হয়ে খেলেছেন। সেই বিশ্বকাপের আলোড়ন মরক্কো দলের খেলোয়াড়দের কার কোন দেশে জন্ম—তা দেখতে গিয়ে মনে হয়েছিল, এ তো রীতিমতো’ জাতিসংঘ’!
এমন উদাহরণ আরও আছে। তবে সম্প্রতি সবকিছুকে ছাড়িয়ে গেছে ইন্দোনেশিয়া। তিন শ বছরের বেশি ডাচ উপনিবেশ ছিল এই দেশ। নাম ছিল ডাচ ইস্ট ইন্ডিজ। এই পরিচয়ে খেলেছে ১৯৩৮ বিশ্বকাপেও। আবার বিশ্বকাপে খেলার স্বপ্ন পূরণে এই ঔপনিবেশিক ইতিহাসকেই কাজে লাগাচ্ছে ইন্দোনেশিয়া। ফুটবলের প্রথম বিশ্বের দেশ নেদারল্যান্ডসে ইন্দোনেশিয়ান কানেকশন আছে, এমন ফুটবলার অসংখ্য। তাঁদেরকে ডেকে আনা হয়েছে জাতীয় দলে। ডাচ ঘরানার ফুটবল খেলে বেড়ে ওঠা খেলোয়াড়দের জন্য ডাচ কোচ হলেই ভালো—এই চিন্তা থেকে কোচ হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে ডাচ কিংবদন্তি প্যাট্রিক ক্লাইভার্টকে। অবস্থাটা এমন হয়েছে যে, মাঠে নেমে প্রতিপক্ষ দলগুলো ধন্দে পড়ে যাচ্ছে, ইন্দোনেশিয়ার সঙ্গে খেলছি না কোনো ডাচ দলের সঙ্গে!
বাংলাদেশ দলেও হামজা-শমিতদের মতো আরও অনেকে আসবেন বলে শোনা যাচ্ছে। তা আসুন। তবে ইন্দোনেশিয়ার যে উদাহরণটা দিলাম, তাতে পুরোটা বলা হয়নি। জাতীয় দল প্রবাসী ফুটবলার দিয়ে ভরিয়ে দেওয়ার পাশাপাশি সেই দেশের ফেডারেশন আরও জরুরি কিছু কাজ করেছে। সে দেশের ফুটবল নিয়ে নেওয়া হয়েছে নানা পরিকল্পনা। তাতে ‘এখনই করতে হবে’ এমন স্বল্পমেয়াদি কাজ যেমন আছে, তেমনি আছে মধ্যমেয়াদি ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনাও। বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের কাছ থেকে এমন কিছু আমরা অতীতেও শুনিনি, এখনো শোনা যাচ্ছে না।
প্রবাসী ফুটবলারদের জাতীয় দলে এনে এ দেশের ফুটবল নিয়ে মানুষের আগ্রহটা হয়তো জাগিয়ে তোলা গেছে, যেটিকে ফুটবলের নবজাগরণও বলছেন অনেকে। কিন্তু সেই জাগরণকে কাজে লাগাতে সারা দেশের ফুটবলকেও জাগিয়ে তুলতে হবে। নইলে তা বুদ্বুদের মতো মিলিয়ে যেতে সময় লাগবে না। একাডেমি করতে হবে। নজর দিতে হবে তৃণমূলে। জেলায় জেলায় নিয়মিত লিগ আয়োজন নিশ্চিত করতে হবে। দেশের শীর্ষ লিগও তো জীর্ণ-শীর্ণ। নামেই যা পেশাদার লিগ, কাজে মোটেই নয়। বছর কয়েক আগে প্রথম আলোতে বাংলাদেশের পেশাদার লিগের ক্লাবগুলো নিয়ে একটা ধারাবাহিক প্রতিবেদন ছাপা হয়েছিল। যাতে বেরিয়ে এসেছিল এই দেশের ফুটবলের কঙ্কালসার চেহারা। পেশাদার ফুটবল ক্লাবের জন্য অপরিহার্য বেশির ভাগ শর্তই পূরণ করতে ব্যর্থ ক্লাবগুলো। সেই শর্তগুলোও এমন বড় কিছু নয়, বরং বলতে পারেন পেশাদার ফুটবলের একেবারে প্রাথমিক সব ব্যাপার-স্যাপার। মাঠ নেই, জিম নেই, বয়সভিত্তিক দল নেই, . . শুধু নেই আর নেই।
আর এটা কে না জানে যে, ফুটবল ক্লাবনির্ভর খেলা। সেখানেই খেলোয়াড় তৈরি হয়, দর্শক-সমর্থকও। বাংলাদেশের ফুটবলের হারিয়ে যাওয়া যে স্বর্ণালি সময়ের কথা মনে করে আমরা দীর্ঘশ্বাস ফেলি, সেই সময়টা মনে করে দেখুন। জাতীয় দল কী এমন হাতিঘোড়া করেছে তখন! দক্ষিণ এশিয়ার শ্রেষ্ঠত্বের স্মারক সাফ গেমসে ফুটবলের সোনাও তো জিততে পারেনি। সে জন্য অপেক্ষা করতে হয়েছে ১৯৯৯ সাল পর্যন্ত। স্বর্ণালি সময় বলুন বা স্বর্ণযুগ, তা তত দিনে অস্তমিত।
আশির দশক থেকে নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি পর্যন্ত সময়টাকে যদি সেই স্বর্ণযুগ ধরি, ফুটবল তখন এ দেশের মানুষের এমন জীবনাচরণের অংশ হয়ে ছিল মূলত ক্লাব ফুটবল নিয়ে উন্মাদনার কারণে। তা হারিয়ে যাওয়ার মূলে মাঝখানে অনিয়মিত লিগ, আবাহনী-মোহামেডান প্রতিদ্বন্দ্বিতা নেই হয়ে যাওয়ার মতো অনেক কারণ। সঙ্গে ক্রিকেটের উত্থানেরও অবশ্যই বড় ভূমিকা। যে কারণে নতুন প্রজন্ম বাংলাদেশের ফুটবল নিয়ে আগ্রহই বোধ করেনি, মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে একসময় নিয়মিত মাঠে যাওয়াটাকে অভ্যাস বানিয়ে ফেলা দর্শকও।
হামজা-শমিতদের কল্যাণে বাংলাদেশের ফুটবল নিয়ে নতুন করে যে আগ্রহ জেগেছে, তা নিয়ে তৃপ্তির ঢেকুর না তুলে বাফুফের কর্তাব্যক্তিদের বরং উচিত এটাকে কাজে লাগাতে ঝাঁপিয়ে পড়া। এমন সুযোগ বারবার আসে না, হয়তো আর কখনো আসবেই না।
● উৎপল শুভ্র প্রথম আলোর প্রধান ক্রীড়া সম্পাদক
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ল দ শ র ফ টবল ন য় দ শ র ফ টবল র ইন দ ন শ য় ব শ বক প জ ত য় দল ন ফ টবল নত ন ক স বর ণ দ র মত হয় ছ ল প রব স র জন য প রথম
এছাড়াও পড়ুন:
দুনিয়ায় প্রত্যেক মুসলিমকে যেসব পরীক্ষার মধ্য দিয়ে যেতে হবে
জীবন একটি পরীক্ষার ময়দান, যেখানে আমরা বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ ও কষ্টের মুখোমুখি হই। পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে, ‘আমি অবশ্যই তোমাদের পরীক্ষা করব কিছু ভয়, ক্ষুধা, সম্পদের ক্ষতি, জীবন ও ফসলের ক্ষতি দিয়ে। আর যারা ধৈর্য ধরে, তাদের সুসংবাদ দাও।’ (সুরা বাকারা, আয়াত: ১৫৫)
এই পরীক্ষাগুলো প্রায়ই আমাদের হতাশ বা বিমর্ষ করে তুলতে পারে, কিন্তু ইসলাম আমাদের শেখায় যে এই কষ্টগুলো আল্লাহর নৈকট্য লাভের মাধ্যম এবং পরকালে চিরস্থায়ী সুখের পথ প্রশস্ত করে। পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে, ‘এই দুনিয়ার জীবন তো কেবল ক্ষণস্থায়ী ভোগ, আর পরকালই হলো চিরস্থায়ী আবাস।’ (সুরা গাফির, আয়াত: ৩৯)
পরীক্ষার উদ্দেশ্যইসলামে পরীক্ষা বা কষ্টকে আল্লাহর রহমতের অংশ হিসেবে দেখা হয়। এগুলো আমাদের পাপ থেকে মুক্তি, আল্লাহর ওপর নির্ভরতা বৃদ্ধি, নিজেকে নম্র করা এবং তাঁর নৈকট্য লাভের মাধ্যম।
আমি অবশ্যই তোমাদের পরীক্ষা করব কিছু ভয়, ক্ষুধা, সম্পদের ক্ষতি, জীবন ও ফসলের ক্ষতি দিয়ে। আর যারা ধৈর্য ধরে, তাদের সুসংবাদ দাও।সুরা বাকারা, আয়াত: ১৫৫পরীক্ষা আমাদের ধৈর্য ও বিশ্বাস যাচাই করে এবং এর মাধ্যমে আমরা আল্লাহর কাছে উচ্চ মর্যাদা লাভ করতে পারি। নবীজি (সা.) বলেছেন, ‘যখনই তুমি আল্লাহর জন্য কিছু ত্যাগ করবে, আল্লাহ তা তোমার জন্য আরও উত্তম কিছু দিয়ে প্রতিস্থাপন করবেন।’ (মুসনাদে আহমদ, হাদিস: ২৩,০৭৪)
আরও পড়ুনযে ৪টি পরীক্ষা নবীজি (সা.)–এর জীবনকে দৃঢ়তা দিয়েছে২২ জুলাই ২০২৫পরীক্ষার মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্যদুনিয়ার জীবন সাময়িক এবং এর কষ্টগুলো ক্ষণস্থায়ী। আমরা প্রায়ই দুনিয়ার সমস্যায়, যেমন অর্থনৈতিক সংকট, সম্পর্কের জটিলতা বা সামাজিক চাপ, এতটাই মগ্ন হয়ে পড়ি যে আমাদের মূল উদ্দেশ্য ভুলে যাই। পবিত্র কোরআন আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়, ‘কিন্তু যে ব্যক্তি তার প্রভুর সামনে দাঁড়ানোর ভয় করেছে এবং নিজের নফসকে অবৈধ কামনা থেকে বিরত রেখেছে, তার জন্য জান্নাতই হবে আশ্রয়।’ (সুরা নাজিয়াত, আয়াত: ৪০–৪১)
ইবন কাইয়্যিম (রহ.) বলেছেন, ‘যদি আল্লাহ তাঁর বান্দার জন্য পর্দা তুলে দিতেন এবং তাকে দেখাতেন, কীভাবে তিনি তার জন্য সবকিছু পরিচালনা করেন, তবে তার হৃদয় আল্লাহর প্রতি ভালোবাসায় গলে যেত এবং কৃতজ্ঞতায় টুকরা টুকরা হয়ে যেত। তাই যদি দুনিয়ার কষ্ট তোমাকে ক্লান্ত করে, তবে দুঃখ করো না। হয়তো আল্লাহ তোমার দোয়ার কণ্ঠ শুনতে চান।’ (ইবন কাইয়্যিম, আল–ফাওয়ায়িদ, পৃষ্ঠা ১২৮, বৈরুত: দারুল কুতুব আল–ইলমিয়্যাহ, ১৯৯৬)
পরীক্ষা আমাদের ধৈর্য ও বিশ্বাস যাচাই করে এবং এর মাধ্যমে আমরা আল্লাহর কাছে উচ্চ মর্যাদা লাভ করতে পারি।পরীক্ষা আমাদের আল্লাহর কাছাকাছি নিয়ে যায়। এটি আমাদের নম্র করে, আমাদের পাপমুক্তি ঘটায় এবং আল্লাহর ওপর নির্ভরতা বাড়ায়। নবীজি (সা.) বলেছেন, ‘দুনিয়ায় যে ব্যক্তি সবচেয়ে বেশি কষ্ট ও পরীক্ষার মধ্য দিয়ে গেছে, তাকে জান্নাতে একবার ডুবিয়ে দেওয়া হবে এবং জিজ্ঞাসা করা হবে, ‘হে আদম সন্তান, তুমি কি কখনো কোনো কষ্ট দেখেছিলে? তুমি কি কখনো দুঃখ অনুভব করেছিলে?’ সে বলবে, ‘না, হে আমার রব! আমি কখনো কোনো কষ্ট দেখিনি, কখনো কোনো দুঃখ অনুভব করিনি।’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস নম্বর–২৮০৭)
আরও পড়ুনবালকের ঈমানের পরীক্ষা ও বাদশাহের নির্মম পরিণতি০৪ মে ২০২৪আল্লাহর পরিকল্পনায় ভরসাপরীক্ষার সময় মনে রাখতে হবে যে আল্লাহর পরিকল্পনা আমাদের পরিকল্পনার চেয়ে উত্তম। পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে, ‘হয়তো তোমরা এমন কিছু অপছন্দ করো, যা তোমাদের জন্য কল্যাণকর। আর এমন কিছু পছন্দ করো, যা তোমাদের জন্য ক্ষতিকর। আল্লাহ জানেন, আর তোমরা জানো না।’ (সুরা বাকারা, আয়াত: ২১৬)
এই আয়াত আমাদের শেখায় যে কষ্টের পেছনে আল্লাহর একটি বৃহত্তর উদ্দেশ্য রয়েছে।
হয়তো তোমরা এমন কিছু অপছন্দ করো, যা তোমাদের জন্য কল্যাণকর। আর এমন কিছু পছন্দ করো, যা তোমাদের জন্য ক্ষতিকর। আল্লাহ জানেন, আর তোমরা জানো না।সুরা বাকারা, আয়াত: ২১৬আরেকটি হাদিসে বলা হয়েছে, ‘যে ব্যক্তি পরকালের জন্য চিন্তিত থাকে, আল্লাহ তার বিষয়গুলো সহজ করে দেবেন, তার হৃদয়ে তৃপ্তি দেবেন এবং দুনিয়া তার কাছে আসবে, যদিও সে তা অপছন্দ করে।’ (ইবন মাজাহ, হাদিস: ৪১০৫)
পরীক্ষায় ধৈর্য ও দোয়াপরীক্ষার সময় ধৈর্য ধরা এবং আল্লাহর কাছে দোয়া করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে, ‘যে ব্যক্তি আল্লাহর ওপর ভরসা করে, তিনি তার জন্য যথেষ্ট।’ (সুরা তালাক, আয়াত: ৩) দোয়ার মাধ্যমে আমরা আমাদের হৃদয়ের কথা আল্লাহর কাছে প্রকাশ করি এবং তাঁর রহমতের জন্য আশ্রয় প্রার্থনা করি।
ইবন কাইয়্যিম (রহ.) বলেছেন, ‘যদি দুনিয়ার কষ্ট তোমাকে ক্লান্ত করে, তবে সিজদায় তোমার আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ করো এবং জেনে রাখো, আল্লাহ কখনো ভোলেন না।’ (আল–ফাওয়ায়িদ, পৃষ্ঠা ১৩০, বৈরুত: দারুল কুতুব আল–ইলমিয়্যাহ, ১৯৯৬)
আমরা যদি আল্লাহকে আমাদের হৃদয়ের কেন্দ্রে রাখি, তবে কোনো পরীক্ষাই আমাদের ভেঙে দিতে পারবে না।জীবনের পরীক্ষাগুলো আমাদের আল্লাহর কাছাকাছি নিয়ে যায়, আমাদের হৃদয়কে বিশুদ্ধ করে এবং পরকালে জান্নাত লাভের পথ প্রশস্ত করে। দুনিয়ার কষ্ট ক্ষণস্থায়ী, কিন্তু আল্লাহর ভালোবাসা ও রহমত চিরস্থায়ী।
আমরা যদি আল্লাহকে আমাদের হৃদয়ের কেন্দ্রে রাখি, তবে কোনো পরীক্ষাই আমাদের ভেঙে দিতে পারবে না; বরং নবীজি (সা.)–এর শিক্ষা ও ধৈর্য, দোয়া এবং আল্লাহর ওপর ভরসার মাধ্যমে আমরা জীবনের প্রতিটি পরীক্ষায় বিজয়ী হতে পারব।
আরও পড়ুনত্যাগের পরীক্ষা, সফলতার উদ্যাপন০১ আগস্ট ২০২০