‘কোনো সীমানাই বৈধ নয়, যা পীড়িতদের কাছ থেকে সাহায্যকারীদের আলাদা করে।’

এই বৈপ্লবিক উক্তি ছিল মুক্তিযুদ্ধকালীন সুপরিচিত বিদেশি ত্রাণ সংস্থা ‘ওমেগা’র মূলমন্ত্র। তবে ১৯৭১ সালের গ্রীষ্মে লন্ডনে গঠিত ‘অপারেশন ওমেগা’ কোনো সাধারণ ত্রাণ সংস্থা ছিল না। তাদের কার্যক্রমের মনস্তাত্ত্বিক ভিত্তি তৈরি হয়েছিল ১৯৬০-এর দশকের শেষের দিকে নাইজেরিয়ার গৃহযুদ্ধ বা ‘বায়াফ্রা’ সংকটের অভিজ্ঞতার ওপর দাঁড়িয়ে। বায়াফ্রার যুদ্ধে বিশ্ব দেখেছিল কীভাবে রাজনৈতিক কারণে ত্রাণের অভাবে লাখ লাখ মানুষ অনাহারে মারা যায়। অপারেশন ওমেগার পেছনে মূল চালিকা শক্তি ছিলেন মার্কিন অ্যাকটিভিস্ট এলেন কনেট এবং ব্রিটেনের শান্তিবাদী পত্রিকা পিস নিউজ-এর সম্পাদক রজার মুডি। তাঁরা দুজনেই ছিলেন অভিজ্ঞ সংগঠক এবং রাষ্ট্র অনুমোদিত প্রথাগত ত্রাণ কার্যক্রমের ওপর বীতশ্রদ্ধ। ১৯৭১ সালের পূর্ব পাকিস্তানের সংকটকে তারা সেই ‘বায়াফ্রা ফ্রেম’ বা লেন্স দিয়ে দেখেছিলেন। তাঁদের ধারণা ছিল, বিশ্বনেতারা এবং প্রতিষ্ঠিত ত্রাণ সংস্থাগুলো আবারও রাজনৈতিক প্রটোকলের দোহাই দিয়ে একটি জনগোষ্ঠীর মৃত্যু দেখবে। এই অবিশ্বাস ও হতাশা থেকেই ওমেগা সিদ্ধান্ত নেয় যে তারা প্রচলিত কূটনৈতিক বা আইনি পথের ধার ধারবে না; বরং সরাসরি ভুক্তভোগীদের কাছে ত্রাণ পৌঁছে দেবে।

ওমেগার নামকরণের পেছনে একটি গভীর দার্শনিক ভিত্তি ছিল। ফরাসি ধর্মতাত্ত্বিক পিয়ের তেইয়ার দ্য শারদাঁ-র বিবর্তনবাদবিষয়ক তত্ত্ব ‘ওমেগা পয়েন্ট’ থেকে তাঁরা অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন, যা মানবজাতির চূড়ান্ত একতাকে নির্দেশ করে। এই দর্শনের ওপর ভিত্তি করে ওমেগা ঘোষণা করে যে মানুষের জীবন বাঁচানোর ক্ষেত্রে কোনো রাজনৈতিক সীমানা বা রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্ব বাধা হতে পারে না। ওমেগা সচেতনভাবে ‘মানবিকতা’ ও ‘রাজনীতি’র মধ্যবর্তী সীমারেখাটি মুছে ফেলেছিল। তাদের স্লোগান ছিল, ‘যন্ত্রণায় থাকা মানুষের কাছে সাহায্য পৌঁছে দেওয়ার জন্য কোনো অনুমতির প্রয়োজন নেই।’ তাই তারা পাকিস্তান সরকারের সার্বভৌমত্বকে সরাসরি চ্যালেঞ্জ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। তাদের এক প্রচারপত্রেও স্পষ্টভাবে বলা হয়, ‘পাকিস্তান বলে বাংলাদেশ একটি অভ্যন্তরীণ সমস্যা। ওমেগা বিশ্বাস করে, এটি মানবজাতির সমস্যা, আমাদের সমস্যা।’

১৯৭১ সালের গ্রীষ্মে লন্ডনে গঠিত ‘অপারেশন ওমেগা’ কোনো সাধারণ ত্রাণ সংস্থা ছিল না। তাদের কার্যক্রমের মনস্তাত্ত্বিক ভিত্তি তৈরি হয়েছিল ১৯৬০-এর দশকের শেষের দিকে নাইজেরিয়ার গৃহযুদ্ধ বা ‘বায়াফ্রা’ সংকটের অভিজ্ঞতার ওপর দাঁড়িয়ে।

ওমেগার ত্রাণ কার্যক্রমের মূল উদ্দেশ্য কেবল খাদ্য বা ওষুধ বিতরণ ছিল না; বরং তাদের প্রতিটি মিশন ছিল একধরনের রাজনৈতিক যোগাযোগের কৌশল। তারা জানত যে সীমিত সামর্থ্য দিয়ে বিশাল জনসংখ্যার ক্ষুধা মেটানো সম্ভব নয়। তাই তারা ‘উচ্চ প্রোফাইল ক্ষুদ্র দলের পদক্ষেপ’ (হাই প্রোফাইল স্মল গ্রুপ অ্যাকশন) কৌশল গ্রহণ করে। তাদের কৌশল ছিল ইচ্ছাকৃত ও অবৈধভাবে সীমান্ত অতিক্রম করা এবং পাকিস্তান সেনাবাহিনীর হাতে গ্রেপ্তার হওয়া। ব্রিটিশ পররাষ্ট্র ও কমনওয়েলথ অফিস বারবার ওমেগার সদস্যদের তাদের কার্যক্রমের ঝুঁকি সম্পর্কে সতর্ক করা সত্ত্বেও সংস্থাটি তাদের ‘দয়ার মিশন’ চালিয়ে যেতে বদ্ধপরিকর ছিল। পরিস্থিতি কঠিন হয়ে ওঠে ৪ অক্টোবর, যখন ওমেগার সদস্য আর্চিবল্ড গর্ডন স্লেভেন (ব্রিটিশ নাগরিক) এবং এলেন কনেট (মার্কিন) ত্রাণসামগ্রী বিতরণের জন্য সীমান্ত অতিক্রমের পর গ্রেপ্তার হন। ১১ অক্টোবর যশোরের একটি বেসামরিক আদালতে ফরেনার্স অ্যাক্ট, ১৯৪৬ (অবৈধ অনুপ্রবেশ) লঙ্ঘনের অভিযোগ আনা হলে তাঁরা দোষ স্বীকার করেন এবং প্রত্যেককে দুই বছরের কারাদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়। এই কঠোর শাস্তি ব্রিটিশ পার্লামেন্টে এবং জনগণের মধ্যে তীব্র উদ্বেগের সৃষ্টি করে। পর্দার আড়ালে কূটনৈতিক তৎপরতাও চলতে থাকে। ব্রিটিশ ও আমেরিকান কনস্যুলার প্রতিনিধিদের প্রচেষ্টায় জেলে তাঁদের অবস্থার উন্নতি হয় এবং তাঁদের ‘ক্লাস এ’ বন্দীর মর্যাদা দেওয়া হয়। এ সময়েই স্লেভেন ও কনেট তাঁদের কনস্যুলার অফিসারের মাধ্যমে ওমেগা সদর দপ্তরে একটি বার্তা পাঠান। সেই বার্তায় তাঁরা কার্যক্রমের পদ্ধতি পুনর্বিবেচনা করার অনুরোধ জানান, কারণ তাঁদের কাজের ফলে স্থানীয় সহায়তাকারী ও সহানুভূতিশীল ব্যক্তিরা হয়রানি ও জীবন বিপন্ন হওয়ার ঝুঁকিতে পড়ছিলেন। বিশেষত, তাঁদের আশ্রয় দেওয়া ক্যাথলিক মিশনের ইতালীয় ফাদারদের হয়রানি ও রাজাকার কর্তৃক তাঁদের এক কর্মচারীকে হত্যার মতো ঘটনা ঘটেছিল।

তাদের কৌশল ছিল ইচ্ছাকৃত ও অবৈধভাবে সীমান্ত অতিক্রম করা এবং পাকিস্তান সেনাবাহিনীর হাতে গ্রেপ্তার হওয়া। পরিস্থিতি কঠিন হয়ে ওঠে ৪ অক্টোবর, যখন ওমেগার সদস্য আর্চিবল্ড গর্ডন স্লেভেন (ব্রিটিশ নাগরিক) এবং এলেন কনেট (মার্কিন) ত্রাণসামগ্রী বিতরণের জন্য সীমান্ত অতিক্রমের পর গ্রেপ্তার হন।

নভেম্বরের শেষের দিকে ভারতের সামরিক অভিযান শুরু হলে যশোর একটি প্রধান যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত হওয়ায় জেলে থাকা স্লেভেন ও কনেটের নিরাপত্তা নিয়ে গুরুতর উদ্বেগ দেখা দেয়। ব্রিটিশ সংসদ সদস্যরা তাঁদের দ্রুত নিরাপদ স্থানে স্থানান্তরের জন্য সরকারের ওপর নতুন করে চাপ সৃষ্টি করেন। তবে ৩, ৪ ও ৫ ডিসেম্বর মিত্রবাহিনী ও মুক্তিযোদ্ধাদের প্রচণ্ড প্রতিরোধ এবং তুমুল যুদ্ধের মুখে পাকিস্তানি বাহিনী ৫ ডিসেম্বর রাত থেকে যশোর সেনানিবাস ছেড়ে পালাতে শুরু করে। অবশেষে ১৯৭১ সালের ৬ ডিসেম্বর, অগ্রসরমাণ ভারতীয় সামরিক বাহিনী ও মুক্তিবাহিনী যশোর দখল করে নেওয়ার পর স্লেভেন ও কনেটের মুক্তি মেলে। বাংলাদেশ ফোর্সেসের ৮ নম্বর সেক্টরের কমান্ডার মেজর এম এ মঞ্জুর একটি মুক্তি আদেশ জারি করেন, যেখানে উল্লেখ করা হয় যে স্লেভেনের বিরুদ্ধে ‘বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে কোনো অভিযোগ নেই’। মুক্তি পাওয়ার পর স্লেভেন ও কনেটকে কৃষ্ণনগরে নিয়ে যাওয়া হয় এবং তাঁরা নিরাপদে কলকাতায় ফিরে আসেন। এই মুক্তি কোনো কূটনৈতিক আলোচনার ফল ছিল না, বরং সামরিক বিজয়ের একটি প্রত্যক্ষ পরিণতি ছিল। এলেন কনেট যখন যশোর কারাগারে বন্দী ছিলেন, তখন তিনি অন্তঃসত্ত্বা। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালের মাঝামাঝি সময়ে তাঁর পুত্রসন্তান জন্ম নেয়। বাংলাদেশের স্বাধীনতা এবং সংগ্রামের প্রতি ভালোবাসা ও শ্রদ্ধার নিদর্শনস্বরূপ সন্তানের নাম রাখেন—পিটার উইলিয়াম মুজিব কনেট।

৮ নম্বর সেক্টর কমান্ডার মেজর এম এ মঞ্জুর স্বাক্ষরিত ওমেগার সদস্য স্লেভেনের মুক্তির আদেশ। সূত্র: এফসিও ৩৭/৯৬৯.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: ১৯৭১ স ল র র জন ত ক র জন য র একট র ওপর

এছাড়াও পড়ুন:

যুদ্ধ ছাড়াই ৭ আমিরাতকে কীভাবে একটি রাষ্ট্র বানিয়ে ফেললেন শেখ জায়েদ

বাংলাদেশ ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের (ইউএই) মধ্যে জন্মের ব্যবধান মাত্র ১৪ দিনের। তবে এশিয়ার দুই প্রান্তের এ দুই দেশের জন্ম হয়েছিল সম্পূর্ণ ভিন্নভাবে। বাংলাদেশের জন্ম যেখানে ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী স্বাধীনতাসংগ্রামের মাধ্যমে। অন্যদিকে সমমনা প্রতিবেশী সাতটি আমিরাতের নেতাদের ঐকমত্যের ভিত্তিতে সংযুক্ত দেশ হিসেবে যাত্রা শুরু করেছিল ইউএই।

অবশ্য শান্তিপূর্ণ এ সম্মিলনের জন্য আমিরাতগুলোর নেতাদের যথেষ্ট কাঠখড় পোড়াতে হয়েছিল। দীর্ঘ চার বছরের নিবিড় কূটনৈতিক প্রচেষ্টায় বিশ্বের মানচিত্রে ১৯৭১ সালের ২ ডিসেম্বর ইউএই নামের নতুন রাষ্ট্রটির অভ্যুদয় ঘটেছিল।

গত মঙ্গলবার ঈদ আল-ইত্তিহাদ বা জাতীয় একীভূত হওয়ার ৫৪তম বার্ষিকী উদ্‌যাপন করেছে ইউএই। এ উপলক্ষে বিশ্বের অন্যতম ধনী দেশটির জন্ম কীভাবে হলো, তা একনজরে দেখে নেওয়া যাক।

ট্রুসিয়াল স্টেটস এবং ব্রিটিশ সুরক্ষা

১৯৭১ সালে সংযুক্ত আরব আমিরাত প্রতিষ্ঠার আগে অঞ্চলটি ট্রুসিয়াল স্টেটস নামে পরিচিত ছিল। পারস্য (আরব) উপসাগরের তীরে অবস্থিত সাতটি স্বাধীন শেখরাজ্য বা আমিরাত নিয়ে এ ট্রুসিয়াল স্টেটস গঠিত হয়েছিল। শেখ রাজ্যগুলো হলো আবুধাবি, দুবাই, শারজা, আজমান, উম্ম আল কুওয়াইন, ফুজাইরাহ ও রাস আল খাইমাহ।

উনিশ শতকের শুরুতে শেখশাসিত রাজ্যগুলো ব্রিটিশদের প্রভাব বলয়ে আসার আগপর্যন্ত নিজেদের মতো করে মাছ ও মুক্তার আকর্ষণীয় শিল্প গড়ে তুলেছিল। কিন্তু ১৮১৯ সালে রাস আল খাইমাহ শেখরাজ্যের কাসিমি রাজবংশের বাহিনী ব্রিটিশ ও ভারতীয় নৌবাহিনীর সঙ্গে লড়াইয়ে পরাজিত হয়।

এর মধ্য দিয়ে অঞ্চলটিতে ব্রিটিশরা আধিপত্য বিস্তার করতে শুরু করে। এরপর বিভিন্ন সময়ে আবুধাবিসহ অঞ্চলটির অন্যান্য শেখরাজ্য ব্রিটিশদের সঙ্গে নানা চুক্তিতে আবদ্ধ হয়।

১৮৯২ সালে উল্লিখিত সাত শেখরাজ্য ব্রিটিশ সরকারের সঙ্গে ট্রুসিয়াল স্টেটস নামের একটি চুক্তি সই করে। এতে পারস্য উপসাগরের মতো গুরুত্বপূর্ণ একটি সমুদ্রপথে ব্রিটিশদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হয়। বিনিময়ে শেখরাজ্যগুলোকে প্রতিরক্ষা ও সামরিক সুরক্ষা দিতে সম্মত হয় তারা।

তবে শেখরাজ্যগুলোকে শর্ত দেওয়া হয়, ব্রিটিশদের অনুমতি ছাড়া তারা অন্য কোনো বিদেশি শক্তির কাছে নিজেদের ভূখণ্ড হস্তান্তর বা চুক্তি করতে পারবে না।

নববর্ষের অনুষ্ঠানে দুবাইয়ের বুর্জ খলিফা ভবনে আতশবাজি। ১ জানুয়ারি ২০২৫

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • মোড় ঘোরানো দুই দিনের সম্মেলন শিলিগুড়িতে 
  • মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে বিশ্ব জনমত তৈরি করেছিলেন ‘অঁদ্রে মালবো’
  • পাকিস্তানি বাহিনী পিছু হটে, মুক্তিকামীদের উল্লাস
  • রাধানগরে ৩৬ ঘণ্টার লড়াই, পিছু হটে পাকিস্তানি বাহিনী
  • যুদ্ধ ছাড়াই ৭ আমিরাতকে কীভাবে একটি রাষ্ট্র বানিয়ে ফেললেন শেখ জায়েদ
  •  ‘মোরা একটি ফুলকে বাঁচাবো বলে…’ 
  • আজ খোকসা মুক্ত দিবস
  • একটি কঙ্কাল