চোখে নেই আলো, হাতে সাদাছড়ি। চাকরির দাবিতে রাস্তায় বসা প্রতিবন্ধী তরুণ-তরুণীদের চোখেমুখে ক্লান্তি আর ক্ষোভ। দাবিদাওয়া না মানা শুধু নয়, এবার আন্দোলনরত প্রতিবন্ধী চাকরিপ্রার্থীদের ওপর হামলার অভিযোগ উঠেছে পুলিশ ও বহিরাগত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে।

চাকরিপ্রত্যাশী প্রতিবন্ধীরা জানান, ৫ দফা দাবিতে ১৯ অক্টোবর থেকে তাঁরা রাজধানীর শাহবাগে অবস্থান কর্মসূচি পালন করছেন। এর আগে প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে গেলেও বারবার পুলিশি বাধার মুখে পড়তে হয়েছে। গতকাল রোববার দুপুরে শাহবাগে পুলিশি ব্যারিকেডের ভেতরে অবস্থান নেওয়ার সময় হঠাৎ বহিরাগত কয়েকজন এসে তাঁদের ওপর হামলা চালায়। হামলার পর আহত ব্যক্তিদের কেউ কেউ ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে প্রাথমিক চিকিৎসা নিয়ে আবারও আন্দোলনের স্থানে ফিরে আসেন।

দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী মাসুদুর রহমানের ভাষ্য, ‘প্রথমে কিছু বহিরাগত এসে আমাদের মারধর করে। পুলিশ দাঁড়িয়ে দেখে। পরে তিনজন পুলিশ আমাকে ধরে থানায় নিয়ে যায়। সেখানে আমাকে মেরেছে, শার্ট ছিঁড়ে দিয়েছে। পথচলার প্রধান মাধ্যম সাদাছড়ি ভেঙে ফেলেছে। পানি চাইলে দেয়নি।’

আরেক আন্দোলনকারী গোলাম কিবরিয়া বলেন, ‘পুলিশ আমাকে সরে যেতে বলেছিল। আমি উঠতেই একজন পা দিয়ে পেটের নিচে আঘাত করে। প্রচণ্ড ব্যথায় কুঁকড়ে উঠি, রাস্তায় পড়ে যাই, বমি করি।’ তাঁর দাবি, তাঁরা শান্তিপূর্ণভাবে দাঁড়িয়েছিলেন, কিন্তু পুলিশ ও বহিরাগত ব্যক্তিরা বর্বরোচিত হামলা করছে।

আন্দোলনকারীরা জানান, হামলায় আহত হয়েছেন অন্তত পাঁচজন প্রতিবন্ধী। তাঁদের মধ্যে দুজন দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী ও একজন হুইলচেয়ার ব্যবহারকারী বলে জানা গেছে।

আরও পড়ুনচাকরির পাশাপাশি যে পাঁচটি কাজ আপনার আয় বাড়াবে২৬ অক্টোবর ২০২৫পুলিশের দাবি, ‘সব মিথ্যা’

এদিকে চাকরিপ্রত্যাশী প্রতিবন্ধীদের অভিযোগ অস্বীকার করেছে পুলিশ। শাহবাগ থানা ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ খালিদ মনসুর প্রথম আলোকে বলেন, ‘থানায় কাউকে মারধর করা হয়নি। এগুলো নির্জলা মিথ্যা। তারা রাস্তায় বসে যানজট তৈরি করেছিল। এতে অ্যাম্বুলেন্সের রোগীর স্বজনসহ পথচারীরা ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন। উত্তেজিত জনতা হয়তো হামলা করেছে।’

তবে আন্দোলনকারীদের দাবি, হামলার সময় পুলিশ উপস্থিত ছিল এবং কারও বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়নি।

আরও পড়ুনকানাডায় টিউশন ফি ছাড়াই স্কলারশিপ, ৭০০টির বেশি প্রোগ্রাম১১ ঘণ্টা আগেসংবাদ সম্মেলনে বিচার দাবি

হামলার প্রতিবাদে আজ সোমবার বিকেল চারটায় রাজু ভাস্কর্যের সামনে সংবাদ সম্মেলন করে প্রতিবন্ধী গ্র্যাজুয়েট পরিষদ। পরিষদের আহ্বায়ক আলী হোসাইন বলেন, ‘৯ দিন ধরে রাস্তায় আছি, সরকার কোনো উত্তর দিচ্ছে না। উল্টো হামলা হচ্ছে। থানায় নিয়ে মারধর করা হয়েছে। দোষী পুলিশ সদস্য ও সন্ত্রাসীদের বিচার করতে হবে।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমরা কোনো আশ্বাস শুনতে চাই না। অবিলম্বে প্রজ্ঞাপন জারি করে চাকরির ব্যবস্থা করতে হবে।’

সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক শিমুল কুম্ভকার আন্দোলনকারীদের প্রতি সংহতি জানান এবং হামলার দায়ী ব্যক্তিদের শাস্তি দাবি করেন।

প্রতিবন্ধী গ্র্যাজুয়েটরা সংবাদ সম্মেলন থেকে পাঁচ দফা দাবি জানান। তাঁদের প্রধান দাবিগুলো হলো প্রতিবন্ধী প্রার্থীদের জন্য বিশেষ নিয়োগপ্রক্রিয়া চালু করা; মৌখিক পরীক্ষা ছাড়াই নিয়োগের সুযোগ দেওয়া; চাকরিতে যোগদানের বয়সসীমা শিথিল করা এবং চলমান আন্দোলনে হামলার বিচার করা।

আন্দোলনকারীরা বলছেন, দাবি পূরণ না হওয়া পর্যন্ত তাঁরা আন্দোলন চালিয়ে যাবেন। অন্যদিকে পুলিশের বক্তব্য, ব্যস্ত রাস্তায় অবস্থানের কারণে জনদুর্ভোগ সৃষ্টি হচ্ছে।

আরও পড়ুনকাস্টমস, এক্সাইজ ও ভ্যাট কমিশনারেটে বড় নিয়োগ, পদসংখ্যা ৯৯২৫ অক্টোবর ২০২৫আরও পড়ুনসরকারি চাকরিতে কোটাসহ ৫ দফা দাবিতে প্রতিবন্ধী গ্র্যাজুয়েটদের অবস্থান কর্মসূচি২৫ অক্টোবর ২০২৫.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: চ কর প র অবস থ ন

এছাড়াও পড়ুন:

ঐকমত্য কমিশনের শেষ বৈঠক অনুষ্ঠিত, সুপারিশ পেশ মঙ্গলবার

সরকারের কাছে জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়নের উপায় সম্পর্কিত সুপারিশ দিতে যাচ্ছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। মঙ্গলবার (২৮ অক্টোবর) উপদেষ্টা পরিষদের সদস্যদের উপস্থিতিতে আনুষ্ঠানিকভাবে এই সুপারিশ হস্তান্তর করা হবে।

সোমবার (২৭ অক্টোবর) বিকেলে রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সভাপতিত্বে কমিশনের সমাপনী বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে।

আরো পড়ুন:

জাতিসংঘকে সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে হবে: অধ্যাপক ইউনূস

অগ্নিনিরাপত্তা পরিদর্শন সপ্তাহ পালনের নির্দেশ প্রধান উপদেষ্টার

এতে উপস্থিত ছিলেন ঐকমত্য কমিশনের সহ-সভাপতি প্রফেসর আলী রীয়াজ, কমিশন সদস্য বিচারপতি মো. এমদাদুল হক, ড. ইফতেখারুজ্জামান, ড. বদিউল আলম মজুমদার, সফর রাজ হোসেন, ড. মো. আইয়ুব মিয়া এবং প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মনির হায়দার।

সমাপনী বৈঠকে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন গঠনের পর থেকে চূড়ান্ত সুপারিশ প্রদান পর্যন্ত সমস্ত ডকুমেন্ট, আলোচনার ভিডিও, অডিও ও ছবি সংরক্ষণের ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন প্রধান উপদেষ্টা।

তিনি বলেন, “এগুলো মহামূল্যবান সম্পদ। জাতি হিসেবে আমরা কোন প্রেক্ষাপটে কী প্রক্রিয়ায় কোন সিদ্ধান্তে পৌঁছালাম, তা সকলের জন্য দীর্ঘমেয়াদে সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা এবং উন্মুক্ত থাকা দরকার। যত বৈঠক হয়েছে সেগুলোর ছবি ও ভিডিও, যত চিঠি চালাচালি হয়েছে সমস্ত ডকুমেন্ট সংরক্ষণ করতে হবে এবং ক্যাটাগরি করে রাখতে হবে। টেলিভিশনে যেসব আলোচনা লাইভ প্রচার হয়েছে, সেগুলো খণ্ড খণ্ড আকারে সংরক্ষণ করতে হবে। কারণ, এগুলো হবে ইতিহাসের চিরজীবন্ত দলিল। যারা গবেষণা করতে চায়, তারা যেন এগুলো দেখে কাজে লাগাতে পারে। প্রজন্মের পর প্রজন্মে এই ডকুমেন্ট থেকে যাবে। এই দলিলগুলোই ভবিষ্যতের রাজনৈতিক আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে থাকবে।”

এ সময় রাজনৈতিক দল, ঐকমত্য কমিশনের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারী, গবেষক ও গণমাধ্যমকর্মীদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানান প্রধান উপদেষ্টা।

সমাপনী বৈঠকে জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়নের রূপরেখা চূড়ান্ত করার পাশাপাশি অন্য সংস্কার কমিশনগুলোর সুপারিশ বাস্তবায়নেও সরকারকে পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন কমিশন সদস্যরা।

‘জাতীয় ঐকমত্য কমিশন বাংলাদেশে একটি স্থায়ী জবাবদিহিমূলক রাষ্ট্রের ভিত্তি স্থাপনের জন্য কাজ করেছে’ উল্লেখ করে কমিশনের সহ-সভাপতি প্রফেসর আলী রীয়াজ বলেন, “রাজনৈতিক দলের পাশাপাশি আইন বিশেষজ্ঞ, বিচারপতি, শিক্ষাবিদসহ নাগরিক সমাজের বিশিষ্টজনের সাথে আলোচনার ভিত্তিতে জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়নের সুপারিশ চূড়ান্ত করা হয়েছে।”

তিনি আরো বলেন, “চব্বিশের জুলাই গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে গঠিত অন্তর্বর্তী সরকারের তিনটি মূল দায়িত্বের (বিচার, সংস্কার, নির্বাচন) একটি কাঠামোগত সংস্কার। জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের প্রধান দায়িত্ব ছিল সংস্কারের একটি রূপরেখা তৈরি করা। মিল-অমিল সত্ত্বেও রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যেও সংস্কারের আকাঙ্ক্ষা দৃশ্যমান ছিল। তারা বরাবরই আমাদের সব ধরনের সহযোগিতা করেছেন। দিনের পর দিন অত্যন্ত ধৈর্য ও বিচক্ষণতার সাথে সংলাপে অংশ নিয়েছেন।”

প্রফেসর আলী রীয়াজ বলেন, “চব্বিশে ছাত্র-শ্রমিক-জনতার গণ-অভ্যুত্থান আমাদের যে সুযোগ দিয়েছে, সেটা যেন হারিয়ে না ফেলি। কমিশন সংস্কারকেই অগ্রাধিকার দিয়েছে, যাতে ভবিষ্যতে জনগণ কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তন দেখতে পারে। কমিশন দায়িত্ব শেষ করল। আনুষ্ঠানিকভাবে হস্তান্তর হবে। কমিশনের মেয়াদ শেষ হবে ৩১ অক্টোবর। এরপরেও সরকারের প্রয়োজন হলে এ দেশের নাগরিক হিসেবে আমরা ব্যক্তিগতভাবে সহযোগিতা প্রদানের চেষ্টা করব।”

নির্বাচন সংস্কার কমিশনের প্রধান ও কমিশন সদস্য ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, “জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়নে সবাই সরকারের নিবিষ্টতা ও সাহসিকতা প্রত্যাশা করে। গণঅভ্যুত্থানে এত তাজা প্রাণ ঝরে গেল, এত মানুষ আহত হলো—এটা স্মরণে রেখে প্রয়োজনীয় সংস্কার যাতে নিশ্চিত হয়। এই সুযোগ যেন না হারাই।”

কমিশন সদস্য বিচারপতি এমদাদুল হক বলেন, “গণঅভ্যুত্থানে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে যে ঐক্য ছিল, একইরকম আন্তরিকতার প্রতিফলন ছিল কমিশনের বৈঠকগুলোতে। এটা খুবই ইতিবাচক দিক।”

পুলিশ সংস্কার কমিশনের প্রধান ও কমিশন সদস্য সফর রাজ হোসেন বলেন, “প্রথমবারের মতো রাজনৈতিক দলগুলো বসে ধৈর্যের সাথে আলোচনা করেছে। ভবিষ্যতেও যেন এ ধরনের সৌহার্দ্যতা থাকে, এটাই আমাদের প্রত্যাশা।”

দুর্নীতি দমন কমিশন সংস্কার কমিশনের প্রধান ও কমিশন সদস্য ড. ইফতেখারুজ্জামান জুলাই সনদ বাস্তবায়নের পাশাপাশি দুদক সংস্কারেও সরকারকে দৃঢ় পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানান।

প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মনির হায়দার বলেন, “যতগুলো শহীদ পরিবারের সাথে আমরা কথা বলেছি, তারা প্রত্যেকে আমাদের জানিয়েছে সংস্কার নিশ্চিত করা না হলে তাদের সন্তানদের জীবন উৎসর্গ করা বৃথা যাবে বলে তারা মনে করেন। যারা জুলাইয়ে জীবন দিল তারাই এর মূল ভিত্তি।”

মঙ্গলবার দুপুর ১২টায় রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় আনুষ্ঠানিকভাবে অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়নের উপায় সম্পর্কিত সুপারিশ হস্তান্তর করবে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন।

ঢাকা/আসাদ/সাইফ

সম্পর্কিত নিবন্ধ