দেশে অস্বাস্থ্যকর খাবারের আগ্রাসী প্রচার-প্রচারণা চলছে। দেশের ৬২ শতাংশ শিশু অস্বাস্থ্যকর খাবার খায়। খাবারের কারণে প্রায় সব বয়সী মানুষের মধ্যে অপুষ্টির ঝুঁকি বাড়ছে। পরিস্থিতি সামাল দিতে সব পক্ষের ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টা জরুরি।

গতকাল মঙ্গলবার রাজধানীর কারওয়ান বাজারে প্রথম আলো কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত ‘অস্বাস্থ্যকর খাবারের পুষ্টি ও স্বাস্থ্যঝুঁকি: আমাদের করণীয়’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে দেশের শীর্ষস্থানীয় পুষ্টিবিদেরা এ কথাগুলো বলেন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) সহায়তায় প্রথম আলো এ গোলটেবিল বৈঠকের আয়োজন করে।

অনুষ্ঠানে দেশে অপুষ্টি পরিস্থিতি, খাদ্যাভ্যাস, বিধিবিধান—এসব নিয়ে আলোচনার পাশাপাশি করণীয় বিষয়ে সুপারিশ করা হয়।

বাংলাদেশ জাতীয় পুষ্টি পরিষদের পরিচালক মো.

মাহবুবুর রহমান বলেন, পুষ্টি শুধু স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের একার বিষয় নয়। অপুষ্টি দূর বা পুষ্টি পরিস্থিতির উন্নতি করতে ২২টি মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে কাজ করছে জাতীয় পুষ্টি পরিষদ। তিনি বলেন, পুষ্টির জন্য বাজেট বাড়াতে হবে, বরাদ্দ বাজেট কাজে লাগাতে হবে। নিশ্চিত করতে হবে নজরদারি ও জবাবদিহি।

গোলটেবিল বৈঠকের মূল উপস্থাপনায় সর্বশেষ জনমিতি ও স্বাস্থ্য জরিপের পরিসংখ্যান উদ্ধৃত করে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ন্যাশনাল প্রফেশনাল অফিসার (পুষ্টি) ফারিয়া শবনম বলেন, দেশের ৬ থেকে ২৩ মাস বয়সী ৬১ দশমিক ৮ শতাংশ শিশুকে অস্বাস্থ্যকর খাবার খাওয়ানো হয়। ১৮ থেকে ৬৯ বছর বয়সী ৩৭ দশমিক ২ শতাংশ মানুষ খাবারের সময় বাড়তি লবণ খান। একই বয়সী প্রায় ৩৫ শতাংশ নারী ও ২৩ শতাংশ পুরুষের ওজন অতিরিক্ত। পাশাপাশি দেখা যাচ্ছে, প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে ৫ জনে ১ জন ডায়াবেটিসে ও ১০ জনে ১ জন উচ্চ রক্তচাপে ভুগছেন।

খাদ্য ও পুষ্টি বিষয়ে একাধিক গবেষণার ফলাফল উদ্ধৃত করে বক্তব্য উপস্থাপন করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব নিউট্রিশন অ্যান্ড ফুড সায়েন্সেসের অধ্যাপক নাজমা শাহীন। তিনি বলেন, খাদ্যের দাম ও মানুষের আর্থিক সংগতির সঙ্গে মানুষের নিয়মিত খাবারের সম্পর্ক আছে। ২০২০ সালে দেখা গিয়েছিল প্রয়োজনীয় পুষ্টিমানসম্পন্ন খাবার খাওয়ার সংগতি আছে ৪১ শতাংশ পরিবারের। ২০২৪ সালে এ হার কমে দাঁড়ায় ৩৬ দশমিক ৬ শতাংশে। অর্থাৎ পরিস্থিতির অবনতি ঘটেছে।

নাজমা শাহীন বলেন, অস্বাস্থ্যকর খাবারকে ‘রিফরমুলেশন’ করে স্বাস্থ্যকর খাবারে পরিণত করা যায় এবং তা করতে হবে। তবে মানুষের স্বভাবে বা অভ্যাসে পরিবর্তন করা কঠিন। ক্ষতিকর জেনে মানুষ লবণ কম খেতে রাজি আছে, কিন্তু চিনির ক্ষেত্রে তা দেখা যায় না।

বৈঠকে একাধিক অংশগ্রহণকারী শিশুদের অপুষ্টি, খাদ্যাভ্যাস ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিশুরা কী খায়, কেন খায়—এসব নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেন।

বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের পাবলিক হেলথ অ্যান্ড ইনফরমেটিকস বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক খালেকুজ্জামান বলেন, ঢাকা শহরে একটি ছোট গবেষণায় সকালে ও বিকেলের পালায় স্কুলে আসা শিক্ষার্থীদের খাবারের তালিকায় দেখা গেছে, ৭ শতাংশ শিক্ষার্থী বাসা থেকে খাবার আনে, ৪০ শতাংশ শিক্ষার্থী খাবার কেনে। তালিকা পর্যালোচনায় দেখা গেছে, শিক্ষার্থীদের ৮০ শতাংশই অস্বাস্থ্যকর খাবার খায়। সকালে স্কুল করা শিক্ষার্থীদের খাবার বেশি খারাপ।

একই বিষয়ে আলোচনা করার সময় নিউট্রিশন ইন্টারন্যাশনালের ডেপুটি কান্ট্রি ডিরেক্টর আসফিয়া আজিম বলেন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানভিত্তিক খাদ্য নির্দেশিকা তৈরি করা জরুরি। বাংলা ভাষায় তৈরি করা এসব নির্দেশিকা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বিতরণের ব্যবস্থা করতে হবে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ক্যানটিনের জন্য নির্দেশিকা বানাতে হবে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে তথা ক্যানটিন কোন ধরনের খাবার দিচ্ছে, তা তদারকির দায়িত্ব দিতে হবে সিটি করপোরেশনকে। স্বাস্থ্যকর খাবারের বিষয়টি পাঠ্যসূচিতে অন্তর্ভুক্ত করার দাবি জানিয়ে তিনি বলেন, স্কুলে ও স্কুলের আশপাশে অস্বাস্থ্যকর খাদ্য বিক্রি এবং গণমাধ্যমে এসবের প্রচার-প্রচারণা বন্ধের উদ্যোগ নিতে হবে।

স্বাস্থ্যকর খাবারের জায়গা আশঙ্কাজনকভাবে দখল করে নিচ্ছে অস্বাস্থ্যকর খাবার বলে উল্লেখ করেন ইউনিসেফের পুষ্টি কর্মকর্তা মো. আজিজ খান। তিনি বলেন, অস্বাস্থ্যকর খাবারের আগ্রাসী প্রচার-প্রচারণা লক্ষ করা যাচ্ছে। এখন বিলবোর্ডের ১৩ শতাংশ এবং টেলিভিশন বিজ্ঞাপনের ১৯ শতাংশ বিজ্ঞাপন খাবারের। এসব খাবারের বাজার নাটকীয়ভাবে বাড়ছে। ইউনিসেফের এই পুষ্টি কর্মকর্তা বলেন, মেক্সিকো, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া এসব খাবারের ওপর কর বাড়িয়ে উপকার পেয়েছে। দেখা গেছে কর বাড়ালে খাবারের দাম বাড়ে, দাম বাড়লে ব্যবহার কমে।

বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের সদস্য (খাদ্য শিল্প ও উৎপাদন) মো. শোয়েব বলেন, প্রবিধান অনুযায়ী খাবারে লবণ, চিনি, সম্পৃক্ত চর্বির পরিমাণ কী আছে, তা দৃশ্যমান করে মোড়কের ওপর উল্লেখ করতে হয়। লেখা ১০০ মিলিমিটারের চেয়ে বড় হবে, লেখা সহজে চোখে পড়বে। উৎপাদনের ও খাবারের অনুপযোগী হওয়ার তারিখও তাতে উল্লেখ থাকবে। তিনি বলেন, বিষয়টি আরও আধুনিক, যুগোপযোগী করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

অতিরিক্ত চিনি ও লবণযুক্ত খাবার কেন ক্ষতিকর, তার স্পষ্ট ব্যাখ্যা থাকা দরকার বলে মত দেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব নিউট্রিশন অ্যান্ড ফুড সায়েন্সেসের অধ্যাপক খালেদা ইসলাম। তিনি বলেন, মায়ের বুকের দুধ মানুষকে উচ্চ রক্তচাপ ও ডায়াবেটিস থেকে সুরক্ষা দেয়—এই প্রচার বাড়ানোর এবং জন্মের পরপরই মায়ের দুধ খাওয়ানোর হার ১০০ শতাংশে উন্নীত করার উদ্যোগ দরকার।

খাদ্য মন্ত্রণালয়ের খাদ্য পরিকল্পনা ও পরিধারণ ইউনিটের গবেষণা পরিচালক (পুষ্টি) মোস্তফা ফারুক আল বান্না বলেন, অপুষ্টির দেশে খর্বকায় শিশুর হার বেশি। এ ক্ষেত্রে বৈষম্যও আছে। সবচেয়ে ধনিক শ্রেণির পাঁচ বছরের কম বয়সী ১৫ শতাংশ শিশু খর্বকায়। সবচেয়ে দরিদ্র শ্রেণিতে সেই হার ৩৪ শতাংশ। সরকারের পক্ষ থেকে নেওয়া সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিতে অপুষ্টি দূর করার উদ্যোগ আছে। ব্যক্তি পর্যায়ে নিজের জমিতে সবজি চাষ বা শহরে ছাদবাগান করেও অপুষ্টি দূর করার উদ্যোগ নেওয়া যায়।

জনস্বাস্থ্য পুষ্টি প্রতিষ্ঠানের সহকারী পরিচালক শ্যামল কুমার রায় বলেন, মানুষকে অস্বাস্থ্যকর খাবারের ব্যাপারে সচেতন করতে সব অংশীজনকে সম্পৃক্ত করতে হবে।

মানুষকে সচেতন করার দায়িত্ব আমাদের সবার বলে মন্তব্য করেন জাতীয় পুষ্টি কর্মসূচির সাবেক লাইন ডিরেক্টর আনজুমান আরা।

পোশাকশিল্পের শ্রমিকদের মধ্যে কাজ করার অভিজ্ঞতা বর্ণনা করে গেইনের প্রজেক্ট ম্যানেজার জি এম রেজা সুমন বলেন, শ্রমিকদের ২৬ শতাংশের ওজন অতিরিক্ত। এর কারণ তাঁরা অস্বাস্থ্যকর খাবারে অভ্যস্ত।

বৈঠকটি সঞ্চালনা করেন প্রথম আলোর সহকারী সম্পাদক ফিরোজ চৌধুরী।

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: স ব স থ যকর খ ব র র পর স থ ত ন বল ন

এছাড়াও পড়ুন:

ইতিবাচক মনে করছে এনসিপি

জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়নের উপায় নিয়ে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের জমা দেওয়া সুপারিশকে ইতিবাচকভাবে দেখছে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)।

এ বিষয়ে এনসিপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম আহ্বায়ক আরিফুল ইসলাম আদীব গতকাল রাতে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় প্রথম আলোকে বলেন, ‘গণভোটের ক্ষেত্রে নোট অব ডিসেন্টের (ভিন্নমত) কার্যকারিতা না রাখা, পুরো সনদকে “হ্যাঁ”, “না” ফরম্যাটে গণভোটে দেওয়া এবং গণ-অভ্যুত্থানের ভিত্তিতে আদেশ জারি করা—এ বিষয়গুলোকে আমরা ইতিবাচকভাবে দেখছি।’

এনসিপির এই নেতা আরও বলেন, ‘২৭০ দিনের জন্য সংবিধান সংস্কার পরিষদ রাখার বিষয়টিও ইতিবাচক। কিন্তু আদেশের পূর্ণাঙ্গ কপিটা আমরা এখনো পাইনি। তবে আমরা সংস্কারকৃত সংবিধানকে সংশোধিত সংবিধান, ২০২৬ নামকরণের কথা বলেছিলাম।’

ঐকমত্য কমিশনের জমা দেওয়া সুপারিশ নিয়ে বিএনপির অসন্তুষ্টি প্রসঙ্গে এনসিপির নেতা আরিফুল ইসলাম আদীবের মন্তব্য হচ্ছে, যে বিষয়গুলো বিএনপির বিপক্ষে যায়, তারা সেগুলোকে অনৈক্য প্রতিষ্ঠার চেষ্টা হিসেবে দেখে। জাতীয় ঐকমত্য কমিশনে অধিকাংশ দল যেসব বিষয়ে একমত হয়েছে, বিএনপি তার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। বিশেষ করে সংসদের উচ্চকক্ষে পিআর পদ্ধতির ক্ষেত্রে ২৫টি দল একমত, বিএনপি আর এনডিএম একমত হয়নি।

এনসিপির নেতা বলেন, মৌলিক সংস্কারের প্রশ্নে ৩০টি দলের মধ্যে ২৫ থেকে ২৮টি দল একমত হয়েছে, সেখানে বিএনপি ও তাদের সমমনা কয়েকটি দল দ্বিমত করেছে। তিনি বলেন, জুলাই সনদ নিয়ে গণভোট জাতীয় নির্বাচনের আগে হওয়াকে ইতিবাচক বলে আমরা মনে করি। কারণ, গণভোটের মাধ্যমে অনেকগুলো সিদ্ধান্ত ফয়সালা হয়ে যাবে। এরপরই সংস্কারের ভিত্তিতে নতুন বাংলাদেশের যাত্রা শুরু হবে।

আরিফুল ইসলাম আদীব জানান, আজকালের মধ্যে এনসিপির দলীয় সভা হতে পারে। সেখানে আলোচনা করে জুলাই সনদে স্বাক্ষরের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। এখনো এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়নি।

সম্পর্কিত নিবন্ধ