অর্থনীতিকে স্থিতিশীলতায় ফেরানো এবং দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণ ও কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে গুরুত্বপূর্ণ অনেক সংস্কারই শুরু করেনি অর্ন্তবর্তী সরকার। অগ্রাধিকার ভিত্তিক সংস্কার কার্যক্রম দ্রুতই শুরু করা দরকার। চলমান সংস্কার পদক্ষেপে অর্থনীতির পরিস্থিতি নিয়ে করা শ্বেতপত্রের সুপারিশ আমলে নিতে হবে। আগামী অর্থবছরের বাজেট প্রণয়নে এসব সুপারিশকে গুরুত্ব দিতে হবে। 

'শ্বেতপত্র ও অতঃপর: অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা, সংস্কার ও জাতীয় বাজেট' শিরোনামের এক সিম্পোজিয়ামে এসব কথা বলেছেন বক্তারা। শনিবার রাজধানীর বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে এ আয়োজন করে শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটি। এসডিজি বাস্তবায়নে নাগরিক প্ল্যাটফর্ম আয়োজনে সহায়তা দেয়। দিনব্যাপী পাঁচটি কর্মঅধিবেশনে রাজনৈতিক নেতা, সরকার-বেসরকারি খাতে প্রতিনিধি ও উন্নয়নসহ সহযোগী সংস্থার প্রতিনিধিরা অংশ নেন। 

আলোচনায় সিপিডির সম্মাননীয় ফেলো  এবং  অর্থনীতির অবস্থা নিয়ে শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটির প্রধান ড.

দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য  মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট) বাড়ানোর জন্য  সরকারের কঠোর সমালোচনা করে বলেন, 'আমরা বিস্মিত হয়েছি এটা দেখে যে, কীভাবে অবিবেচনাপ্রসূতভাবে মূল্য সংযোজন কর বাড়ানো হলো। প্রত্যক্ষ কর বাদ দিয়ে প্রথমে পরোক্ষ করের দিকে ঝুঁকেছে সরকার। বিষয়টি আমাদের উদ্বিগ্ন করে তুলেছে।’

ভ্যাট প্রসঙ্গে ড. দেবপ্রিয় আরও বলেন, কোনো দেশে সরকার যদি কার্যকরভাবে কর আদায় করতে চায়, তাহলে তাকে ধীরে ধীরে প্রত্যক্ষ করের দিকে নজর দিতে হবে । অথচ প্রত্যক্ষ কর আদায়ের কোনো পরিকল্পনা দেখা যাচ্ছে না।

তিনি বলেন, সংস্কার কার্যক্রম ত্বরান্বিত না করলে বাংলাদেশে সংস্কার পক্ষের মনোভাবের গুরুত্ব কমে যেতে পারে। এর মানে হলো, যারা এখন সংস্কারের পক্ষে, অর্থনৈতিক নিরাপত্তাহীনতার কারণে একপর্যায়ে তারা ভারসাম্যপূর্ণ সংস্কার থেকে সরে আসতে পারেন । 

তিনি বলেন, একটি সুষম ও অন্তর্ভুক্তিমূলক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্য বিস্তৃত পরিকল্পনার ঘাটতি রয়েছে। স্বল্পোন্নত দেশের এলডিসির কাতার থেকে উত্তীর্ণ হওয়ার মতো বিষয়গুলো সরকার কীভাবে মোকাবিলা করবে এবং পিছিয়ে পড়াদের মধ্যমেয়াদি সহায়তা দেবে— সে বিষয়ে স্পষ্টতা প্রয়োজন।

প্রথম অধিবেশনের প্রধান অতিথি ছিলেন বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন। টিসিবির পণ্য বিক্রির বিষয়ে তিনি বলেন,  দীর্ঘমেয়াদে ১৭৫ থেকে ১৮০ টাকায় ভোজ্যতেল কিনে ১০০ টাকায় বিক্রি করা সম্ভব নয়।  মূল্য সমন্বয় করে ১০০ টাকার বদলে ১২৫ থেকে ১৩০ টাকায় নিয়ে ১ কোটির জায়গায় দেড় কোটি বা ২ কোটি মানুষ পর্যন্ত এ সেবা প্রসারিত করা যায়।  

আলোচনায় শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটির সদস্য এবং বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক লিড ইকোনোমিস্ট ড. জাহিদ হোসেন বলেন, বহির্বিশ্বে মূল্যস্ফীতি কমলেও দেশে কমেনি।  

মূল্যস্ফীতি ব্যবস্থাপনার বিষয়টিকে ফায়ার সার্ভিসের সঙ্গে তুলনা  করে তিনি বলেন, আগুন নেভাতে ফায়ার ব্রিগেডকে দেরিতে ডাকা হয়েছে। তারা দেরিতে এসে পানির বদলে তেল ঢেলেছে। রিজার্ভ প্রতি মাসে ১০০ কোটি ডলার করে কমছিল। এ বিষয়ে নীতি নির্ধারকদের ঘন ঘন মেজাজ বদল হয়েছ। ব্যাংকিং খাতে অনিয়মে রাজনৈতিক সুবিধাপ্রাপ্ত গোষ্ঠীকে রক্ষা করা হয়েছ।  বিদেশি ঋণের ক্ষেত্রে ক্ষয়গুলো শনাক্ত করা হয়নি। ঋণের সুফল জাতি পায়নি। তা সুবিধাপ্রাপ্তদের পকেটে গেছে। 

পলিসি এক্সচেঞ্জ বাংলাদেশের চেয়ারম্যান ড. এম মাশরুর রিয়াজ বলেন, বিনিয়োগ পরিকল্পনায় উদ্যোক্তারা অগ্রাধিকার ভিত্তিতে সামষ্টিক অর্থনীতি, মূল্যস্ফীতি, রিজার্ভ এবং ব্যালেন্স অব পেমেন্ট পরিস্থিতি বিবেচনা করে থাকে। এসব বিষয়ে যা হয়েছে এডহক ভিত্তিতে হয়েছে। প্রকৃত অর্থে বিনিয়োগ আকর্ষণে তেমন  কোনো কৌশল নেই।

বিদেশি বিনিয়োগকারীদের সংগঠন এফআইসিসিআইর সভাপতি জাভেদ আক্তার বলেন, এ দেশে বিনিয়োগের জন্য উদ্যোক্তাদের আত্মবিশ্বাস মারাত্মক রকম কম। শুল্ক বাড়লে এ পরিস্থিতি আরও খারাপ হবে। দুর্নীতি হ্রাস এবং ব্যবসা ব্যয় কমাতে একটা রোডম্যাপ দাবি করেন তিনি।

এপেক্স ফুটওয়্যারের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ নাসিম মঞ্জুর বলেন, ‘অর্থনৈতিক অস্বস্তিতে নিরাপত্তার অভাব বোধ করেছেন তারা। অর্থনীতি আসলেই চাপে রয়েছে। মজুরি বৃদ্ধি, গ্যাস, বিদ্যুতের দর বৃদ্ধি, দক্ষ শ্রমিকের অভাবের সঙ্গে ব্যাংক ঋণের সুদ ২৫ শতাংশ হলে ব্যবসা বন্ধ হয়ে যাবে। রপ্তানিতে প্রণোদনা ২০২৯ সাল পর্যন্ত বহাল রাখার দাবি জানান তিনি।

বিডার নির্বাহী সভাপতি চৌধুরী আশিক মাহমুদ বিন হারুন বলেন, বিনিয়োগ সেবাকে প্রকৃতই একটি প্রতিষ্ঠানের অধীনে আনতে চান তারা। 

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মুখপাত্র উমামা ফাতেমা বলেন, ভারতের সঙ্গে কী কী চুক্তি ছিল তা প্রকাশের পাশাপাশি খতিয়ে দেখার সময় এসেছে৷

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য ড. সায়মা হক বিদিশা বলেন, আগামী বাজেটে বেসরকারি খাতকে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে। যাতে কর্মসংস্থান বাড়ানো যায়। 
 

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: শ ব তপত র ব যবস থ ক ষ কর সরক র

এছাড়াও পড়ুন:

আইন যেভাবে মানবাধিকার লঙ্ঘনের হাতিয়ার

এটা অনস্বীকার্য যে মানুষের অধিকার রক্ষার জন্য আইন তৈরি করা হয়, অন্যভাবে বললে মানুষের অধিকার সুরক্ষার জন্য একটি শক্তিশালী আইনি কাঠামোর ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তবে সেই আইনই মানুষের অধিকার লঙ্ঘনের সহযোগী উপাদান বা হাতিয়ার হিসেবে কাজ করতে পারে, বিশেষত আইন যখন এমনভাবে প্রণয়ন করা হয়, যাতে অতিবিস্তৃত, অস্পষ্ট এবং অসংগতিপূর্ণ ধারা থাকে কিংবা আইনের দুর্বল এবং ‘সিলেকটিভ’ প্রয়োগ হয়; আইনকে ইচ্ছাকৃতভাবে এমনভাবে ব্যবহার করা হয়, যা নির্বিচার আটকের ন্যায্যতা দেয়, মৌলিক স্বাধীনতাকে ক্ষুণ্ন করে এবং বৈষম্যমূলক চর্চাকে উৎসাহিত করে।

আইনকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা সবচেয়ে বেশি ঘটে সেসব দেশে, যেখানে আইনের শাসন ভঙ্গুর, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা সীমিত এবং গণতন্ত্রের ঘাটতি থাকে। বাংলাদেশ এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ।

২.

চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থান বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি নজিরবিহীন অধ্যায়, যেখানে মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন ঘটে। সরকারি চাকরিতে অন্যায্য কোটাব্যবস্থার যৌক্তিক সংস্কারের দাবিতে আন্দোলন শুরু হলেও তৎকালীন সরকারের ব্যাপক দমন-পীড়ন এবং সহিংস আক্রমণের ফলে পরবর্তীকালে তা গণ-আন্দোলনে রূপ নেয়। গণ-অভ্যুত্থানে সমাজের সব স্তরের মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশগ্রহণ করে এবং একটি স্বৈরাচারী বা কর্তৃত্ববাদী শাসনের পতন হয়।

জাতিসংঘের তথ্য অনুসন্ধানী মিশনের প্রতিবেদন অনুযায়ী, জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে ১ হাজার ৪০০ মানুষের প্রাণহানি ঘটেছে, যার মধ্যে আশঙ্কাজনকভাবে ১২-১৩ শতাংশ ছিল শিশু। আহত হয়েছেন হাজার হাজার মানুষ। প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, বাংলাদেশের বিগত সরকার এবং নিরাপত্তা ও গোয়েন্দা সংস্থা বিচারবহির্ভূত হত্যা, সহিংসতা, নির্বিচার আটক ও নির্যাতনের মতো গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনসহ মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটনে জড়িত ছিল।

আন্দোলন চলাকালীন হাজার হাজার আন্দোলনকারীকে নির্বিচার আটক করা হয়েছিল, যা বাংলাদেশের সংবিধান এবং আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনে স্বীকৃত ব্যক্তিস্বাধীনতার অধিকার এবং আটকের ক্ষেত্রে আইনের যথাযথ প্রক্রিয়া (ডিউ প্রসেস) অনুসরণের যে বিধান, তার সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। জাতিসংঘের প্রতিবেদনে দেখা গেছে, গণগ্রেপ্তার অভিযানের সময় আটক হওয়া প্রায় ৮৫ শতাংশ ছিল শিক্ষার্থী এবং সাধারণ নাগরিক আর ১৫ শতাংশ বিরোধী দলগুলোর সঙ্গে যুক্ত ছিল। হত্যা, নির্বিচার আটক এবং নির্যাতনের পাশাপাশি গণ-অভ্যুত্থানের সময় ইন্টারনেট বন্ধ করে মানুষের যোগাযোগের অধিকার, তথ্যপ্রাপ্তির অধিকার এবং শান্তিপূর্ণ সমাবেশের অধিকার ক্ষুণ্ন করা হয়েছে।

এসব মানবাধিকার লঙ্ঘনের ক্ষেত্রে জাতীয় নিরাপত্তা, জননিরাপত্তা, আত্মরক্ষায় বলপ্রয়োগ কিংবা জনস্বার্থের মতো ‘অস্পষ্ট’ বিষয়ের কথা বলা হয়েছে এবং রাষ্ট্রযন্ত্রকে নিপীড়ন, হয়রানি ও নির্যাতনের অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে। এসব ক্ষেত্রে আইন সহযোগী উপাদান বা অনুঘটক হিসেবে ভূমিকা রেখেছে। যেমন, কারফিউ জারি, প্রাণঘাতী অস্ত্রের ব্যবহার বা দেখামাত্রই গুলির নির্দেশকে ন্যায্যতা দিতে জননিরাপত্তা এবং জনস্বার্থের মতো বিষয়কে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করা হয়। এর মাধ্যমে মূলত আইন রাষ্ট্রের দমনমূলক কর্মকাণ্ডকে বৈধতা দিতে সহায়তা করেছে, যা মানবাধিকারের মানদণ্ডের সঙ্গে সাংঘর্ষিক।

৩.

জুলাইয়ের গণ-অভ্যুত্থানেই নয়, বছরের পর বছর ধরে দেশের শাসনব্যবস্থায় মানবাধিকার লঙ্ঘনের হাতিয়ার হিসেবে আইনকে ব্যবহার করা হয়েছে। যেমন বিগত সময়ে কিছু কঠোর ও দমনমূলক আইন প্রণয়ন করেছিল, যা স্পষ্টভাবে মানবাধিকারের পরিপন্থী। এই আইনগুলো ভিন্নমত দমন, নির্যাতন এবং নিপীড়ন করে কর্তৃতবাদী শাসন টিকিয়ে রাখতে সহায়ক ছিল। বহুল আলোচিত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন (ডিএসএ) ছিল এমন একটি আইন (যা পূর্ববর্তী আইসিটি আইনের বিতর্কিত এবং দমনমূলক ৫৭ ধারার একটি পদচিহ্ন)। এ আইন বাংলাদেশে ডিজিটাল কর্তৃত্ববাদ প্রতিষ্ঠা করেছিল, যার ভুক্তভোগী ছিলেন অসংখ্য রাজনৈতিক কর্মী, সাংবাদিক, শিক্ষার্থী, এমনকি সাধারণ নাগরিকও।

এই দমনমূলক ডিএসএ আইনটি এমনভাবে তৈরি করা হয়েছিল যে আইনের অপব্যবহারের প্রয়োজন ছিল না, বরং আইনটি ব্যবহার করেই অর্থাৎ আইনের মধ্যে থেকেই মানুষকে হয়রানি এবং নির্যাতন করা সম্ভব ছিল। ডিজিটাল আইনের অন্তর্নিহিত উদ্দেশ্য ছিল ভীতি এবং সেলফ-সেন্সরশিপের সংস্কৃতি তৈরি করে ভিন্নমতকে দমন করা, যা সংবিধান প্রদত্ত বাক্‌স্বাধীনতা, মতপ্রকাশ এবং সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা লঙ্ঘন করে। লক্ষণীয়, নিপীড়নমূলক ডিজিটাল আইন প্রণয়নে এবং প্রয়োগে বিগত সরকার ডিজিটাল মাধ্যমে মানবাধিকার রক্ষার চেয়ে রাজনৈতিক এজেন্ডাগুলোকে অগ্রাধিকার দিয়েছিল। বৈশ্বিক পরিমণ্ডলে যখন ডিজিটাল মাধ্যমে মানবাধিকারের ধারণা ক্রমাগত বিকশিত হচ্ছে, বাংলাদেশে দমনমূলক ডিজিটাল আইন মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে অপরাধ হিসেবে গণ্য করেছে এবং বিরোধী কণ্ঠ দমন করে কর্তৃত্ববাদী শাসনকে পাকাপোক্ত করতে সহায়তা করেছে।

বিগত সরকারের আমলে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন হয়ে উঠেছিল ভিন্নমত দমনের বড় অস্ত্র

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • আইন যেভাবে মানবাধিকার লঙ্ঘনের হাতিয়ার