গাজা গণহত্যা বন্ধে ব্যর্থতার দায় নিয়েই বিদায় বাইডেনের
Published: 21st, January 2025 GMT
বয়সের কারণে নির্বাচনে প্রার্থিতা থেকে সরে দাঁড়াতে হয়েছিল জো বাইডেনকে। তাঁর প্রশাসনের ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলা হ্যারিসকে করা হয় প্রার্থী। প্রতিদ্বন্দ্বী ডোনাল্ড ট্রাম্প বিজয়ী হন বড় ব্যবধানে। বাইডেনের প্রেসিডেন্ট মেয়াদে শুরু হয় গাজা যুদ্ধ, যা প্রাণ কেড়ে নেয় ৪৬ হাজারের বেশি মানুষের। আহত হন ১ লাখ ১০ হাজারের বেশি মানুষ। গাজা উপত্যকা পরিণত হয় ধ্বংসস্তূপে। এমন গণহত্যা-ধ্বংসযজ্ঞ ঠেকাতে না পারার অভিযোগ নিয়েই হোয়াইট হাউস ছেড়েছেন জো বাইডেন। তাঁর সময়ে রক্তক্ষয়ী ইউক্রন যুদ্ধেরও সূত্রপাত।
মেয়াদের শেষদিকে বাইডেনের জনপ্রিয়তা তলানিতে গিয়ে ঠেকে। ইসরায়েলকে অস্ত্র ও অর্থ সহযোগিতা দেওয়া এবং যুদ্ধ থামাতে ব্যর্থ হওয়ায় বিশ্বজুড়ে তাঁর সমালোচনা শুরু হয়। নিজ দেশে আরব মার্কিনিদের কাছে তিনি অজনপ্রিয় হয়ে ওঠেন। জনপ্রিয়তা হারায় তাঁর দল ডেমোক্রেটিক পার্টি। এর প্রতিফলন দেখা গেছে কমলা হ্যারিসের হারের মধ্য দিয়ে। যুক্তরাষ্ট্রের দোদুল্যমান অঙ্গরাজ্যগুলোতে বড় জয় পান রিপাবলিকান প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্প। ঐতিহ্যগতভাবে ডেমোক্রেটিক পার্টির ভোটার মুসলিম ও আরব মার্কিনিরা এবার সমর্থন করেন ট্রাম্পকে। এসব কিছুর পেছনে গাজায় নজিরবিহীন নৃশংসতাকে দায়ী করছেন বিশেষজ্ঞরা।
সিএনএনের এক জরিপে দেখা গেছে, বাইডেন মাত্র ৩৬ শতাংশ জনপ্রিয়তা নিয়ে প্রেসিডেন্ট পদ ছেড়েছেন। অথচ তিনি যখন প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব নেন, তখন তাঁর অনুমোদনের হার ছিল ৬০ শতাংশ। গণমাধ্যমটি লিখেছে, বাইডেনের চার বছরের মেয়াদে মার্কিনিরা সফলতার চেয়ে ব্যর্থতাকেই বড় করে দেখছে।
গত সপ্তাহে গাজায় যুদ্ধবিরতি চুক্তি হয় কাতারের রাজধানী দোহায়। ওই চুক্তি সম্পাদনে ট্রাম্পের মধ্যপ্রাচ্যবিষয়ক বিশেষ দূত স্টিভেন উইটকফ বড় ভূমিকা রাখেন। কিন্তু পরে বাইডেন ও তাঁর পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিংকেন চুক্তির কৃতিত্ব দাবি করে সংবাদ সম্মেলন করেন। যেসব শর্তে চুক্তি হয়েছে, তা গত বছরের মে মাসেই নির্ধারিত ছিল। ১৫ মাস চুক্তি করতে ব্যর্থ বাইডেনকে ‘অকৃতজ্ঞ’ বলেও বর্ণনা করেছেন ট্রাম্প। বিদায়ী সংবাদ সম্মেলনে তুমুল সমালোচনার মুখে পড়েন ব্লিংকেনও। তাঁকে ‘অপরাধী’ এবং ‘গণহত্যার সহযোগী’র মতো শব্দও শুনতে হয়।
বাইডেন যে পশ্চিমা পাটাতনে দাঁড়িয়ে ছিলেন, সেটিও আর বেশিদিন টিকছে না। এরই মধ্যে ব্রিটেনে রক্ষণশীল ঋষি সুনাক সরকারের পতন হয়েছে। পদত্যাগ করেছেন কানাডার জাস্টিন ট্রুডো। জার্মানিতে ওলাফ শোলৎজের মসনদ কাঁপছে। একই অবস্থা ফ্রান্সের ইমানুয়েল মাখোঁর।
যুক্তরাষ্ট্রে মূল্যস্ফীতি বেড়েছে, যা বাইডেনের জনপ্রিয়তার ওপর প্রভাব ফেলেছে। সে সঙ্গে বেড়েছে ধনী-গরিবের বৈষম্য। ব্লুমবার্গের সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে বলা হয়, জো বাইডেনের মেয়াদে ধনকুবের মার্কিনিরা সবচেয়ে বেশি উপকৃত হয়েছে, যদিও সমাপনী ভাষণে তিনি ‘অলিগার্ক’দের নিয়ে সতর্ক করে গেছেন। গত চার বছরে ১০০ জন মার্কিন ধনকুবের অতিরিক্ত দেড় ট্রিলিয়ন ডলারের মালিক হয়েছেন।
বাইডেনের মেয়াদেই ইউক্রেনে আগ্রাসন চালায় রাশিয়া। ওই যুদ্ধ এখনও চলছে। এসব কিছু মিলিয়ে আপাতত ‘মানবতাবাদী’ বাইডেন ইতিহাসের অন্যতম ‘যুদ্ধবাজ প্রেসিডেন্ট’ হিসেবেই স্মরণীয় হয়ে থাকবেন। তাঁকে স্মরণ করা হবে গাজা আগ্রাসনে ইসরায়েলের গণহত্যার সহযোগী হিসেবে।
ফৌসিসহ বেশ কয়েকজনকে আগাম ক্ষমা
ফৌজদারি মামলার হুমকিতে থাকা বেশ কয়েকজনকে আগাম ক্ষমা করেছেন সদ্য সাবেক প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। তাদের মধ্যে ড.
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: গণহত য
এছাড়াও পড়ুন:
যে ‘ধর্মীয় অনুপ্রেরণায়’ ইরানে এই হামলা চালাল ইসরায়েল
ইসরায়েল আবারও ইরানে বড় রকমের হামলা করেছে। হামলায় ইরানের বেশ কয়েকজন উচ্চপদস্থ সামরিক কর্মকর্তা ও পরমাণুবিজ্ঞানী নিহত হয়েছেন। হামলা হয়েছে গুরুত্বপূর্ণ সামরিক ঘাঁটি ও আবাসিক এলাকায়। একদিন পর পাল্টা হামলা চালায় ইরান। এতে কয়েকজন ইসরায়েলি নিহত হয়। ধ্বংস হয় তেলআবিবের কিছু গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা।
ইসরায়েল তার ইরানবিরোধী এ হামলার নাম দিয়েছে ‘রাইজিং লায়ন’। এ নাম রাখা হয়েছে হিব্রু বাইবেলের একটি চরণ থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে। যে নাম ইসরায়েলের একটি শক্তিশালী ও বিজয়দীপ্ত ভবিষ্যতের প্রতিশ্রুতি দেয়।
ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু বৃহস্পতিবার ইহুদিদের সবচেয়ে পবিত্র উপাসনাস্থল জেরুজালেমের ওয়েস্টার্ন ওয়ালের একটি ফাটলে হাতে লেখা একটি চিরকুট রেখে আসার সময় ছবি তোলেন। এটি ছিল মূলত ইরানে ইসরায়েলের হামলার ইঙ্গিত।
শুক্রবার তার অফিস থেকে সেই চিরকুটে একটি ছবি প্রকাশ করা হয়। সেখানে লেখা ছিল: ‘জনগণ সিংহের মতো উঠে দাঁড়াবে।’
এই বাক্যাংশটি হিব্রু বাইবেলের গ্রন্থ বুক অব নাম্বারস (গণনা পুস্তক) ২৩:২৪ পদ থেকে এসেছে। যেখানে বলা হয়েছে: ‘দেখো, এই জাতি একটি মহান সিংহের মতো উঠে দাঁড়াবে এবং একটি তরুণ সিংহের মতো নিজেকে উদ্দীপ্ত করবে; সে শিকার না খাওয়া পর্যন্ত বিশ্রাম নেবে না এবং নিহতদের রক্ত না পান করা পর্যন্ত থামবে না।’
এই চরণটি হিব্রু বাইবেলের অ-ইসরায়েলীয় একজন নবী ও ভবিষ্যদ্বক্তা বালামের প্রথম ভবিষ্যদ্বাণীর অংশ। সেখানে তিনি ইসরায়েলের শক্তি ও ক্ষমতার কথা বলেন। তাদের এমন এক সিংহের সঙ্গে তুলনা করেন যে নিজের ক্ষুধা না মেটানো পর্যন্ত বিশ্রামে যায় না।
অনেকেই মনে করেন, এই অভিযানের নাম ইরানের শেষ শাহ-এর পুত্রের প্রতি ইঙ্গিত হতে পারে। কারণ পারস্য রাজপরিবারের প্রতীক হিসেবেও সিংহ ব্যবহৃত হতো।
ইসরায়েলের ঐশ্বরিক অধিকারের দাবিইসরায়েল প্রায়শই তার সামরিক অভিযানের নাম হিব্রু বাইবেল বা ওল্ড টেস্টেমেন্ট থেকে নেয় বা ধর্মীয় অনুপ্রেরণা থেকে গ্রহণ করে। ফিলিস্তিনি ভূমির উপর ইহুদিদের তথাকথিত ঐশ্বরিক অধিকারের দাবি এবং মধ্যপ্রাচ্যে তাদের যুদ্ধকে ন্যায্যতা দিতে ইসরায়েল এসব ধর্মীয় বিষয় ব্যবহৃত করে বলে অনেকে মনে করে থাকেন।
উদাহরণস্বরূপ, ইসরায়েলি সেনাবাহিনী সিরিয়ার সামরিক স্থাপনা লক্ষ্য করে চালানো এক অভিযানের নাম দিয়েছিল, ‘অ্যারো অব বাশান।’ ‘বাশান’ শব্দটি ইসরায়েলিদের ধর্মগ্রন্থ ওল্ড টেস্টামেন্টে ব্যবহৃত হয়েছে। এটি দিয়ে মূলত সিরিয়ার দক্ষিণ ও জর্ডান নদীর পূর্বে অবস্থিত একটি অঞ্চলকে নির্দেশ করা হয়। বাশানের রাজাকে পরাজিত করে ইসরায়েলিরা সেই অঞ্চলকে দখল করেছিল।
গাজা উপত্যকার ওপর হামলা চালাতেও অস্ত্র ও অভিযানের জন্য হিব্রু বাইবেলীয় প্রতীক বা অনুষঙ্গ ব্যবহার করছে ইসরায়েল। নেতানিয়াহু অন্তত তিনবার গাজায় আক্রমণের জন্য হিব্রু বাইবেলীয় আমালেক কাহিনি ব্যবহার করেছেন।
২০২৩ সালের ২৮ অক্টোবর এক বিবৃতিতে নেতানিয়াহু হিব্রু বাইবেল ও ওল্ড টেস্টামেন্টের গ্রন্থ ‘বুক অব ডিউটেরনমি’(২৫:১৭) এর থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে বলেন:
‘আমালেক তোমার সঙ্গে যা করেছিল তা মনে রেখো, আমরা মনে রাখি এবং আমরা যুদ্ধ করি।’
এর মধ্য দিয়ে গাজাবাসীদের উপর পূর্ণাঙ্গ হামলা করা উচিত বলে নেতানিয়াহু ইঙ্গিত করেন। কারণ ডিউটেরনমির এই উদ্ধৃতি বাইবেলের স্যামুয়েল গ্রন্থে বর্ণিত আমালেকীয়দের বিরুদ্ধে সম্পূর্ণ ধ্বংসের আহ্বান হিসেবে বিবেচিত হয়।
বাইবেলের এ কাহিনিতে ইসরায়েলিদের ওপর আক্রমণকারীদের সম্পূর্ণরূপে নির্মূল করার আহ্বান জানানো হয়েছে। গাজার গোটা জনসংখ্যাকে সম্পূর্ণরূপে নিশ্চিহ্ন করে দিতে বাইবেলের এ কাহিনিকে হাজির করেছেন নেতানিয়াহু।
গণহত্যার মামলায় নেতানিয়াহুর বক্তব্যইসরায়েলের বিরুদ্ধে দক্ষিণ আফ্রিকার দায়ের করা গণহত্যার মামলায় আন্তর্জাতিক বিচার আদালতের (আইসিজে) প্রথম শুনানিতে দক্ষিণ আফ্রিকার পক্ষের আইনজীবী হিব্রু বাইবেলের উদ্ধৃতির মাধ্যমে নেতানিয়াহুর এই বক্তব্যকে গাজার জনগণের বিরুদ্ধে গণহত্যায় প্ররোচনা হিসেবে তুলে ধরেন।
আইনজীবী আরও জানান, নেতানিয়াহু ৩ নভেম্বর সেনাদের উদ্দেশ্যে লেখা আরেকটি চিঠিতে একই আমালেকীয় গল্প পুনরাবৃত্তি করেন।
ধর্মীয় নাম ব্যবহার করে সামরিক প্রযুক্তিইসরায়েলি সেনাবাহিনীর যে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রযুক্তি গাজায় বোমাবর্ষণে সহায়তা করছে, তাদের নাম ‘ল্যাভেন্ডার’ এবং ‘দ্য গসপেল’, যা উভয়ই হিব্রু বাইবেলীয় ধর্মগ্রন্থে উল্লেখ রয়েছে।
টিআরটি ওয়ার্ল্ডের বিশ্লেষক রাভালে মহিদিনের মতে, প্রায়ই ধর্মীয় ধর্মগ্রন্থ থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে ইসরায়েলের অস্ত্রের নামকরণ করা হয়। যেমন, স্যামসন রিমোট কন্ট্রোলড ওয়েপন স্টেশন।
জেরিকো ব্যালিস্টিক মিসাইল-এর নাম রাখা হয়েছে জেরিকো শহরের নামে। হিব্রু বাইবেল ও ওল্ড টেস্টামেন্টের একটি গ্রন্থ ‘বুক অব যশুয়া’ অনুসারে ইসরায়েলিরা এই শহর ফিলিস্তিনিদের কাছ দখল করেছিল।
ডেভিড’স স্লিং নামক আরেকটি ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থার নাম রাখা হয়েছে বাইবেলের মেষপালক ডেভিড ও বিশাল যোদ্ধা গোলিয়াথের মধ্যকার বিখ্যাত সেই লড়াইয়ের স্মরণে, যেখানে ডেভিডের বিজয় হয়েছিল। এই কাহিনী আছে হিব্রু বাইবেল ও ওল্ট টেস্টামেন্টের একটি গ্রন্থ ‘বুক অব স্যামুয়েল’-এ।
*দ্য নিউ আরব, মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকা বিষয়ক লন্ডনভিত্তিক সংবাদমাধ্যম। টিআরটি ওয়ার্ল্ডের বিশ্লেষক ও হার্ভার্ডের গবেষক রাভালে মহিদিনের একটি লেখার অবলম্বনে দ্য নিউ আরব এ বিশ্লেষণটি প্রকাশ করেছে। অনুবাদ করেছেন: রাফসান গালিব