মার্কিন সাংবাদিক র‌্যাচেল মার্টিনের সঞ্চালনায় ন্যাশনাল পাবলিক রেডিওতে অনুষ্ঠিত ওয়াইল্ড কার্ড পডকাস্টে ২০২৪ সালের ৬ অক্টোবর অতিথি হন প্রথিতযশা কানাডীয় কথাসাহিত্যিক মার্গারেট অ্যাটউড।  ওয়াইল্ড কার্ড পডকাস্ট পরিচালিত সাক্ষাৎকারের বিশেষ ধরনটি কৌতূহলোদ্দীপক। সামনে কিছু কার্ড থাকে আর তাতে কিছু প্রশ্ন লেখা থাকে। কার্ডগুলো অতিথিদের দিকে এগিয়ে দেওয়া হয়, অতিথিরা সে অনুযায়ী উত্তর করেন। ওয়াইল্ড কার্ড পডকাস্ট থেকে উল্লেখযোগ্য অংশবিশেষ পত্রস্থ হলো। 

র‌্যাচেল মার্টিন: কোন উপদেশ আপনি অনায়াসে এড়িয়ে যাবেন?
অ্যাটউড: আসলে আমি কোথা থেকে শুরু করব, জীবনে প্রায় সব উপদেশই আমি এড়িয়ে গেছি। শুধু আমার কাছে অর্থবহ বিষয়গুলো নিজের মধ্যে নিতে চেয়েছি। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় উপদেশ-পরামর্শের জন্য আলাদাভাবে দেওয়ার জন্য আমাদের শিক্ষক দেওয়া হতো। জীবনে কোন দিকে যেতে চাই, শিক্ষক সে জন্য পরামর্শ দিতেন। সে সময়ে আমি নিয়মিত লিখছি এবং আমার কবিতা প্রকাশিত হচ্ছিল। তখন আমি একটা গ্র্যাজুয়েট স্টুডেন্ট স্কলারশিপও পেয়েছিলাম। কিন্তু আমার যিনি উপদেষ্টা, তিনি বললেন, ‘এসব লেখালেখি বাদ দাও, গ্র্যাজুয়েশন কর আর তারপর একজন ভালো মানুষ দেখে বিয়ে করে ফেল।’ সেটা ১৯৬১ সালের কথা। এমনকি সেসব সময়ের জন্যও কথাটা একটু চরমই ছিল। তো যেসব উপদেশের সঙ্গে আমি সহমত দেখাতে পারতাম না, সে ক্ষেত্রে আমার প্রতিক্রিয়ায় আমার ভেতর থেকে একটি স্বর যেন তার উদ্দেশ্যে বলতে থাকত, ‘তুমি একটি গর্দভ’।
lআপনি কি এই ভেতরের স্বরটাকে নিজের ভেতরেই রেখেছেন, নাকি মুখ ফুটে বের করেছেন?
llআমার মনে হয়, আমি বের করে ফেলেছি কখনও কখনও। যদিও এসব স্বর নিজের ভেতরে রেখে দেওয়াই উচিত কিন্তু ঠিক ওই সময়েই ওই স্বরটি মনের ভেতর চলে এসেছে, আর কখনও কখনও বোধহয় আমি বলেও ফেলেছি, ‘তুমি একটা গর্দভ’। খুব বিরক্ত হয়ে বলতাম, এসব কথাবার্তা কি শেষ হয়েছে? অনেক ধন্যবাদ। বিদায় নিচ্ছি।
lভালো উপদেশগুলো কি ভালো বন্ধুদের কাছ থেকেই এসেছে?
llআমি ওই সময় তখনকার লোকদের থেকে একেবারেই ভিন্ন ছিলাম, তাই আমার বন্ধুরা আমাকে নিয়ে বেশি মাথা ঘামাত না। কিন্তু আমাদের ফ্যাকাল্টিতে যে মানুষটি আমাকে ভালো উপদেশ দিতেন সে কথাটি কী ছিল, আমি তা আপনাকে বলেছি। আমার মনে হয়েছিল বিশ্ববিদ্যালয়ে শিল্পকলার ছাত্রী হিসেবে এই অস্তিত্ববাদের যুগে আমি ফ্রান্সে যাব, রেস্তোরাঁয় কাজ করব, চিলেকোঠায় থাকব, ধূমপান করব, মাস্টারপিস লিখব এবং ‘লা বোহেমি’ নাটকের নায়িকার মতো কাশতে কাশতে মারা যাব। যদিও আমি এসব বিষয়ের পুরো ভাবনা আমার উপদেষ্টার সঙ্গে শেয়ার করিনি। তবু যেটুকু করেছিলাম তাতে তিনি বললেন, তুমি যদি গ্র্যাজুয়েট স্কুলে যাও, তাহলে লেখালেখিতে ভালো করবে। এবং তাদের সেই কথা ঠিক ছিল।
lঈর্ষান্বিত হন?
llআমি কোনো প্রকার ঈর্ষা অনুভব করি না। (একটু হেসে) যারা আমার চেয়ে লম্বা তাদের প্রতি ছাড়া।
lঅন্য লোকেরা আপনাকে ঈর্ষা করছে, তেমনটা কি ঘটে?
llহ্যাঁ, সেটা অবশ্যই ঘটে। যখন নতুন তরুণ লেখক-লেখিকার মধ্যে সাফল্য আসে, আমি তাদের বলেছি, ‘যখন তুমি সফল হবে তার দুই বছরের মধ্যেই তুমি তিনটি জঘন্য ব্যক্তিগত আক্রমণের শিকার হবে এমন কিছু লোকের কাছ থেকে, যাদের তুমি চেনো না। এটা অবশ্যই ঘটবে, বিশেষ করে তাদের ক্ষেত্রে, যারা লেখক হিসেবে তরুণ। যদি তুমি তরুণই হও, তুমি তোমার বয়সের লেখকদের একটি দল দেখবে। যদি সফল হও, তোমার বন্ধুরা বিভক্ত হবে লোহিত সাগরের মতো। সেখানে দু’দল থাকবে, যারা ঈর্ষা নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে, আর যারা পারবে না। সেটা তুমি সহজেই খুঁজে পাবে।
lআপনার সফলতার প্রথমদিকে কী কী আক্রমণ এসেছে?
llকতগুলো ছিল খুব মজার। তার মধ্যে অনেকগুলো ছিল আমার চুল নিয়ে। ‘কোঁকড়ানো ডাইনির চুল’। একজন আবার আমাকে নিয়ে একটি কল্পকাহিনি লিখল– যেখানে দেখাল আমি পুরুষদের মাথা চিবিয়ে খাই আর সেই মাথা দিয়ে একটা স্তূপ তৈরি করছি এবং একটা অক্টোপাসে পরিণত হয়েছি। 
lতাহলে আপনি ডাইনি-চুলের পুরুষবিদ্বেষী?
llহুম, ক্ষমতাপাগল ডাইনি। 
lআমি আশ্চর্য হচ্ছি, আপনি এগুলো সামলান কীভাবে! শুনলেন আর কান দিয়ে বের করে দিলেন? নাকি কিছু কিছু আপনার চামড়ার ভেতরে ঢুকেও যায়?
llনা, আমি খুব প্রতিশোধপরায়ণ মানুষ।
lসত্যিই বলছেন!
llআমি সত্যিই খুব প্রতিশোধপরায়ণ। আমার এতে কিছু করার নেই। আমি যা, আমি তাই। আমি তাদের আমার গল্পের ভেতর নির্বোধ হিসেবে চরিত্র দাঁড় করাই।

lবিষাদ ঠেকান কীভাবে?
llআমি খুব বিষণ্ন মানুষ নই। মাঝে মাঝে খারাপ বিষয় ঘটে, কোনো কিছু করা গেল না বা নিরুৎসাহের বিষয় ও নানা রকম দুর্দশা দেখা দেয়। সার্বিকভাবে এটা বিষাদ নয়। 
lতাহলে শব্দটিকে একটু বদলে আমি ‘দুঃখ’ বলছি। দুঃখ কীভাবে সামলান?
llওহ্ দুঃখ! খুব স্বাভাবিক ব্যাপার। আমার একজন বন্ধু ছিল সেই সময়ের, যখন মনোবিদরা মনে করত যে দুঃখের ভেতর দিয়ে যাওয়ার সময় ড্রাগস নিলে দুঃখ অনুভব করা যায় না। সমস্যা হলো, ড্রাগস থেকে বের হওয়া যায় না। যখন ড্রাগস থাকে না তখন আবার একই ব্যাপার ঘটে। তাই ড্রাগসের ধারণাটা ভুল ধারণা। আমি এখন বিধবাদের রাজ্যে বসবাস করি। প্রায়ই অনেকে প্রশ্ন করে, কী করে এই অপার দুঃখ থেকে বের হয়ে আসব? এর বিরুদ্ধে আসলে কোনো প্রতিরক্ষা নেই। প্রতিরক্ষা মানে, তুমি বলছ যে দরজা দিয়ে তাকে ঢুকতে দেবে না। এটা ভুয়া কথা। মানুষের জীবনে দুঃখ তার জীবনেরই অংশ। দুঃখ আছে, স্বাভাবিক, আর এর মধ্যেই তুমি জীবনযাপন করছ।
lকখনও কি এমন হয়েছে যে, কোনো আশঙ্কা আপনি করেছেন আর তা সত্যি হয়েছে?
llহুম, হয়েছে। ৮৪-তে যখন ‘হ্যান্ডমেইডস টেইল’ লিখলাম, তখন সমালোচনাগুলোয় কিছু কথা উঠে এলো, যেমন- ইংল্যান্ডে অলিভার ক্রমওয়েলের সময় যে সর্বগ্রাসী ধর্মীয় শাসন এলো, তারা জানত যে এই একই জিনিস আর করবে না। তাই তারা বিষয়টাকে গল্পের ধারণা বলে উড়িয়ে দিয়েছে। কানাডার ক্ষেত্রে তারা সব সময় প্রশ্ন করে, ঘটনাগুলো কি এখানে ঘটতে পারে? যুক্তরাষ্ট্রে এটি দুই ভাগে বিভক্ত। এক দল বলে, এখানে সর্বগ্রাসী কিছু কখনও ঘটবে না। কারণ, আমরা হচ্ছি বিশ্বে নেতৃত্বদানকারী উদার গণতন্ত্রের দেশ। পৃথিবীর সব দেশের আশার প্রদীপ। অন্য পক্ষ বলে যে, পশ্চিম উপকূলে যা কিছু শুরু হচ্ছে তা আমরা কতদিন সহ্য করব? আশির দশকের প্রথমদিকে, যখন নারী অধিকারের বিষয়টি এলো, তখন একটা বিরাট সম্ভাবনা ছিল সত্যি হওয়ার। তারপর শীতল যুদ্ধ শেষ হলো ৮৯-৯০ সালে। মানুষ তখন ভুলভাবে বলতে শুরু করল, “উদার গণতন্ত্র এখন সর্বত্র চালু হবে। সব সংঘাত শেষ হয়েছে। এখন আমরা আনন্দে শপিং করব।” আমিও ভাবলাম, যাক নিপীড়নের বিষয়টি তাহলে শেষ হয়েছে। কিন্তু তুমি দেখতে পাচ্ছ, তা আবার ফিরে এসেছে। 

.

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: উপদ শ

এছাড়াও পড়ুন:

টেলিযোগাযোগ বিভাগের প্রতিবাদ ও প্রতিবেদকের বক্তব্য

‘কেনাকাটা আটকে দিয়েছিলেন নাহিদ, তোড়জোড় ফয়েজের’ শিরোনামে ২৭ জুলাই প্রথম আলোতে প্রকাশিত সংবাদের প্রতিবাদ জানিয়েছে ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়। বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ কোম্পানি লিমিটেডের (বিটিসিএল) ‘৫-জি উপযোগীকরণে বিটিসিএলের অপটিক্যাল ফাইবার ট্রান্সমিশন নেটওয়ার্ক উন্নয়ন’ শিরোনামের প্রকল্প নিয়ে প্রতিবেদনটির প্রতিবাদ পাঠানো হয় ২৮ জুলাই।

প্রতিবাদপত্রে বলা হয়, প্রকল্পটি নিয়ে করা প্রতিবেদনে প্রধান উপদেষ্টার ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত বিশেষ সহকারী ফয়েজ আহমদ তৈয়্যবকে জড়িয়ে যে ‘অভিযোগ ও ব্যাখ্যাহীন অনুমানমূলক’ মন্তব্য করা হয়েছে, তা পুরোপুরি বিভ্রান্তিকর, একপক্ষীয় এবং ভিত্তিহীন। এতে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয়ে বিকৃত তথ্য উপস্থাপন করে ফয়েজ আহমদের মানহানি করার চেষ্টা করা হয়েছে, যা সাংবাদিকতার নৈতিকতা বিরুদ্ধ।

টেলিযোগাযোগ বিভাগ প্রতিবাদপত্রে সুনির্দিষ্ট কয়েকটি বিষয়ে বক্তব্য দিয়েছে। নিচে সেই সুনির্দিষ্ট বিষয়গুলো উল্লেখ করে প্রতিবেদকের বক্তব্য তুলে ধরা হলো।

আরও পড়ুনদুর্নীতির অভিযোগে কেনাকাটা আটকে দিয়েছিলেন নাহিদ, তোড়জোড় ফয়েজ আহমদের২৭ জুলাই ২০২৫

এক. প্রতিবাদপত্রে বলা হয়, প্রথম আলোর প্রতিবেদনে ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে যে ফয়েজ আহমদ দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) অনুসন্ধানাধীন একটি প্রকল্পের কার্যক্রম ‘এগিয়ে নিতে’ বিশেষ কৌশল অবলম্বন করেছেন। বাস্তবতা হলো, বিটিসিএলের ৫–জি রেডিনেস প্রকল্পে ২৯০ কোটি টাকার ঋণপত্র (এলসি) পূর্ববর্তী সরকারের আমলে চূড়ান্ত হয়েছে। সেই টাকা ফেরত পাওয়ার আর কোনো বাস্তবসম্মত পথ নেই। এবং এসব যন্ত্রপাতি গ্রহণ না করলে সম্পূর্ণ অর্থই রাষ্ট্রের অপচয়ে পরিণত হবে।

টেলিযোগাযোগ বিভাগ আরও বলেছে, ফয়েজ আহমদ শুধু অর্থনৈতিক বাস্তবতা বিবেচনায় নিয়ে, আইনি কাঠামোর ভেতরে থেকে দুদকের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক যোগাযোগ করেছেন, যেখানে দুর্নীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের শাস্তির দাবিও তিনি তুলে ধরেছেন। এটি দুর্নীতির ‘সহযোগিতা’ নয়, বরং রাষ্ট্রীয় স্বার্থ রক্ষায় দায়িত্বশীল পদক্ষেপ।

প্রতিবেদকের বক্তব্য: প্রকল্পের কাজ এগিয়ে নিতে বিটিসিএল একটি বেসরকারি আইনি পরামর্শক প্রতিষ্ঠানকে দিয়ে দুদকের অনুসন্ধানাধীন প্রকল্পের বাকি কাজ এগিয়ে দিতে আইনগত মতামত নেয় (২৭ মার্চ, ২০২৫)। যদিও এ ধরনের আইনগত মতামত দেওয়ার জন্য বিটিসিএলের নিজস্ব আইনজীবী প্যানেল রয়েছে। বেসরকারি আইনি পরামর্শক প্রতিষ্ঠান প্রথমে ইতিবাচক মতামত দিলেও পরে (৮ এপ্রিল, ২০২৫) দুর্নীতির অভিযোগ সম্পর্কে জানতে পেরে সতর্ক করে দেয় যে তদন্তাধীন প্রকল্পে কেনাকাটার ক্ষেত্রে আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার সুযোগ রয়েছে।

দুদক চিঠি দিয়ে বিটিসিএলকে স্পষ্ট জানিয়ে দেয় (১৮ জুন, ২০২৫) যে তাদের প্রাথমিক অনুসন্ধানে ক্রয় আইনের লঙ্ঘন পাওয়া গেছে। তাই কেনাকাটার কার্যক্রম এগিয়ে নিলে আইনের ব্যত্যয় হবে এবং অর্থ ব্যয় আইনসিদ্ধ হবে না। দুদক তাদের মতামত জানানোর পরও ফয়েজ আহমদ আবার (২২ জুন) সংস্থাটির চেয়ারম্যানকে চিঠি দেন এবং তাঁর ব্যক্তিগত মনোযোগ ও আন্তরিক সহযোগিতা কামনা করেন।

দুদকের নেতিবাচক মতামতের পরও কেনাকাটার কার্যক্রম এগিয়ে নিয়ে যাওয়া টেলিযোগাযোগ বিভাগের (প্রতিবাদপত্রে উল্লেখ করা) দাবিকে সমর্থন করে না। ফয়েজ আহমদ দুদককে দ্রুত অনুসন্ধান শেষ করার অনুরোধ করতে পারতেন। অনুসন্ধান শেষ হলে সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে পারতেন। বিটিসিএলের ওই প্রকল্পে দুদক গত ৯ জানুয়ারি অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নেয়। এই অনুসন্ধান নিশ্চয়ই বছরের পর বছর চলবে না। কেনাকাটায় আর কিছুদিন দেরি হলে রাষ্ট্রের বিপুল ক্ষতি হয়ে যাবে, এ দাবি যৌক্তিক নয়।

‘দুর্নীতি সহায়ক’ বক্তব্যটি ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামানের মতামত, প্রথম আলোর নয়।

দুই. প্রতিবাদপত্রে বলা হয়েছে, প্রয়োজনের চেয়ে ৫ গুণ সক্ষমতার যন্ত্রপাতি কেনার উদ্যোগ নিয়ে অর্থ অপচয়ের চেষ্টার অভিযোগ অসত্য। প্রতিবাদপত্রে কারিগরি বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত তুলে ধরে বলা হয়, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) সমীক্ষায় বিভিন্ন ধরনের চাহিদা বিবেচনা করা হয়নি। সেসব বিবেচনায় নেওয়া হলে যন্ত্রপাতির সক্ষমতা ২৬ টিবিপিএস (টেরাবাইট পার সেকেন্ড) নয়, ১২৬ টিবিপিএসের প্রয়োজন হবে। ফাইভ-জি প্রকল্পে ১২৬ টেরাবাইট ক্ষমতা ‘রিডান্ডেন্ট’সহ নিশ্চিতকরণের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। এখানে কোনো যন্ত্রপাতি বা সক্ষমতা অব্যবহৃত থাকার সুযোগ নেই।

প্রতিবাদপত্রে আরও বলা হয়, বুয়েটের বিশেষজ্ঞ দল ২০২১ সালে প্রণীত বিটিসিএলের ফাইভ-জি প্রকল্পের একটি সমীক্ষায় মতামত দেয় যে শুধু আন্তর্জাতিক ইন্টারনেট ব্যান্ডউইডথ যদি ২৬ টিবিপিএস হয়, তাহলে সব মিলিয়ে ‘সিস্টেমের লাইন ক্যাপাসিটি’ ১২৬ টিবিপিএস প্রয়োজন হবে।

প্রতিবেদকের বক্তব্য: এই প্রকল্প নিয়ে দুদকের অনুসন্ধানের বিষয়বস্তুই হলো ‘দরপত্রের শর্তানুযায়ী দরদাতাদের মূল্যায়ন না করে সংশ্লিষ্ট আইন ও বিধি লঙ্ঘনপূর্বক শুধু প্রকল্প পরিচালকের বক্তব্যের ভিত্তিতে তিনজন দরদাতাকেই কারিগরিভাবে রেসপনসিভ (যোগ্য) ঘোষণা করাসহ নন-রেসপনসিভ দরদাতাদের কাছ থেকে প্রয়োজনীয় সক্ষমতার পাঁচ গুণ বেশি যন্ত্রপাতি ও সরঞ্জামাদি ক্রয় করে বিপুল পরিমাণ রাষ্ট্রীয় অর্থের ক্ষতিসাধনের অভিযোগ।’ প্রথম আলোর প্রতিবেদনে এ ‘অভিযোগ’ই শুধু তুলে ধরা হয়েছে।

তা ছাড়া ২০৩০ সাল পর্যন্ত যে ২৬ টিবিপিএস চাহিদা নিরূপিত হয়েছিল, কিন্তু কেনা হচ্ছে ১২৬ টেরাবাইট—এটা ২০২৩ সালের ২৪ জুলাই অনুষ্ঠিত বিটিসিএলের ২১৩তম পর্ষদ সভার কার্যবিবরণীতে রয়েছে। পাশাপাশি তৎকালীন ব্যবস্থাপনা পরিচালক আসাদুজ্জামান লিখিতভাবে জানিয়েছিলেন যে প্রযুক্তিগত অগ্রগতির কারণে টেলিকম যন্ত্রপাতিও অতি দ্রুত পরিবর্তনশীল। এ কারণে দীর্ঘ সময় যন্ত্রপাতির খুচরা যন্ত্রাংশ সহজলভ্য থাকে না। সাধারণভাবে টেলিকম যন্ত্রপাতির সর্বোচ্চ ব্যবহারযোগ্য আয়ুষ্কাল সাত বছর ধরা হয়। এই দরপত্রের ক্ষেত্রেও কারিগরি নির্দেশে যন্ত্রপাতির আয়ুষ্কাল সাত বছর নির্ধারিত রয়েছে। তিনি সাবধান করেছিলেন যে ২০৪০ সাল পর্যন্ত চাহিদা পূরণে বেশি সক্ষমতার যন্ত্রপাতি চাওয়া হলেও বাস্তবে তা সচল থাকার নিশ্চয়তা ২০৩০ সাল পর্যন্ত। অর্থাৎ যে পরিমাণ যন্ত্রপাতি কেনা হবে, তার একটি বড় অংশই ২০৩০ সাল পর্যন্ত ব্যবহৃত হবে না এবং ব্যবহারের পূর্বেই মেয়াদ শেষ হয়ে যাবে।

বিগত সরকারের সময় অতিরিক্ত সক্ষমতার যন্ত্র কেনার অনুমোদন না দেওয়ার কারণেই আসাদুজ্জামানকে ব্যবস্থাপনা পরিচালকের পদ থেকে অপসারণ করা হয় এবং নতুন ব্যবস্থাপনা পরিচালক নিয়োগ করে কার্যাদেশ দেওয়া হয়।

তিন. প্রতিবাদপত্রে টেলিযোগাযোগ বিভাগ বলেছে, দুদকের ওপর প্রভাব বিস্তারের দাবি তথ্যভিত্তিক নয়। দুদকের চেয়ারম্যানের সঙ্গে দেখা করা এবং চিঠি পাঠানো একটি প্রাতিষ্ঠানিক, নীতিগত এবং স্বচ্ছ প্রক্রিয়ার অংশ। এর মধ্য দিয়ে কোনোভাবেই সংস্থাটির ওপর ‘প্রভাব বিস্তার’ করা হয়নি; বরং তদন্তকাজ চলমান রাখতে এবং যন্ত্রপাতি গ্রহণের অর্থনৈতিক যৌক্তিকতা ব্যাখ্যা করতে একটি প্রাসঙ্গিক ও প্রয়োজনীয় দৃষ্টিভঙ্গি উপস্থাপন করা হয়েছে। তা ছাড়া বিশেষ সহকারীর দুদকে প্রেরিত আধা সরকারি পত্রের বক্তব্যকে প্রকল্পের কেনাকাটা করতে বিশেষ কৌশলের আশ্রয় নেওয়ার অভিযোগ বলে প্রচার করা হয়েছে, যা জনমনে বিভ্রান্তি তৈরি করেছে। এটা অপসংবাদিকতা ছাড়া আর কিছু নয়।

প্রতিবেদকের বক্তব্য: টেলিযোগাযোগ বিভাগের এক নম্বর পয়েন্টেও একই বিষয়ে বলা হয়েছে। সেখানেই প্রতিবেদকের বক্তব্য দেওয়া হয়েছে। স্বচ্ছতার স্বার্থে টেলিযোগাযোগ বিভাগের এই বক্তব্য আবার উল্লেখ করা হলো। এখানে বলে রাখা দরকার, দুদকের স্পষ্ট মতামত পাওয়ার পরও চেয়ারম্যানকে দ্বিতীয় দফা চিঠি দেওয়া এবং অভিযোগকে ‘সত্য নয়’ বলে দাবি করা স্বাধীন সংস্থাটিকে প্রভাবিত করারই চেষ্টা। দুদকের মতামত যাতে কেনাকাটার পক্ষে পরিবর্তিত হয়, সে জন্যই ফয়েজ আহমদ দ্বিতীয় দফা আধা সরকারি পত্র দিয়েছিলেন এবং তিনি সেখানে দুদক চেয়ারম্যানের ‘ব্যক্তিগত মনোযোগ ও আন্তরিক সহযোগিতা’ কামনা করেন।

চার. প্রতিবাদপত্রে টেলিযোগাযোগ বিভাগ বলেছে, প্রথম আলোর প্রতিবেদনে কারখানা পরিদর্শন ও জিও (সরকারি আদেশ) জারির প্রেক্ষাপট চেপে রাখা হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে, প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় থেকেই জিও অনুমোদন না হওয়ায় চীনে কারখানা পরিদর্শনের জন্য প্রতিনিধিদল পাঠানো সম্ভব হয়নি। সরকারের নির্ধারিত বিধি অনুযায়ী, যখন কারখানা পরিদর্শন সম্ভব নয়, তখন পণ্য সরবরাহ চুক্তির শর্ত অনুযায়ী জাহাজীকরণ করা যেতে পারে—বিষয়টি সচেতনভাবে উপেক্ষা করা হয়েছে।

প্রতিবেদকের বক্তব্য: প্রথম আলোর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দরপত্রের নিয়মানুযায়ী কারখানা পরিদর্শনে যাওয়ার কথা বিটিসিএলের চারজন প্রকৌশলীর। সেখানে নিয়মবহির্ভূতভাবে চারজনের জায়গায় পাঁচজনকে কারখানা পরিদর্শনে পাঠানোর জন্য জিও জারির অনুরোধ করা হয়। নতুন দলে বিটিসিএলের প্রকৌশলী রাখা হয় দুজন আর টেলিযোগাযোগ বিভাগের তিনজন। তদন্ত–সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, টেলিযোগাযোগ বিভাগের কর্মকর্তাদের খুশি রাখতে তাঁদের চীন সফরে অন্তর্ভুক্ত করার সুযোগ করে দেওয়া হয়। যদিও তাঁদের চীনে যাওয়া হয়নি। কারণ, প্রধান উপদেষ্টার দপ্তর থেকে জিও (সরকারি আদেশ) জারির বিষয়টি আটকে দেওয়া হয়েছে।

উল্লেখ্য, প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় থেকে গত ৯ ডিসেম্বর বিদেশ ভ্রমণসংক্রান্ত একটি পরিপত্র জারি করা হয়। সেখানে সাধারণভাবে বিদেশ ভ্রমণ নিরুৎসাহিত করা হয়। তবে নির্দেশনার ৯ নম্বরে কেনাকাটা, জাহাজীকরণের আগে কারখানা পরিদর্শন ইত্যাদি ক্ষেত্রে কেবল সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞ প্রেরণের বিষয় বিবেচনা করতে বলা হয়েছে। অর্থাৎ ‘ফ্যাক্টরি একসেপটেন্সের’ জন্য বিদেশ ভ্রমণ নিষিদ্ধ নয়। আরও উল্লেখ্য যে এই কেনাকাটার জন্য কারখানায় যন্ত্রপাতি পরীক্ষা-নিরীক্ষার জিও গত বছরের ১ সেপ্টেম্বর জারি করা হয়েছিল। কিন্তু পরে ২৪ সেপ্টেম্বর তা বাতিল করা হয়। ২৪ অক্টোবর (২০২৪) বিটিসিএলের পরিচালনা পর্ষদ প্রকল্প নিয়ে তদন্তের সিদ্ধান্ত নেয় এবং এ বছরের ৬ জানুয়ারি সেই তদন্ত প্রতিবেদন দুদকে পাঠাতে বলে।  

পাঁচ. প্রতিবাদপত্রে টেলিযোগাযোগ বিভাগ বলেছে, প্রথম আলোর প্রতিবেদনে ফয়েজ আহমদের চীন সফর নিয়ে বিভ্রান্তি ছড়ানো হয়েছে। এতে চীন সফরের ব্যাখ্যা এবং এর সরকার অনুমোদিত বৈধতা সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে এটিকে ‘অপরিচিত সংস্থার অর্থে’ পরিচালিত বলে উপস্থাপন করা হয়েছে। অথচ এটি ছিল সরকারি অনুমোদিত সফর, যার উদ্দেশ্য ছিল তথ্যপ্রযুক্তি খাতে আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতা অর্জন ও অবকাঠামোগত সক্ষমতা পর্যালোচনা।

প্রতিবেদকের বক্তব্য: এ সফর সরকারের অনুমোদনহীন, তা প্রথম আলোর প্রতিবেদনের কোথাও বলা হয়নি। বলা হয়েছে, জিওতে উল্লিখিত ‘চায়নিজ এন্টারপ্রাইজেস অ্যাসোসিয়েশন মেম্বারস ইন বাংলাদেশ’ নামের সংগঠনটি অপরিচিত। তবে ‘চায়নিজ এন্টারপ্রাইজেস অ্যাসোসিয়েশন ইন বাংলাদেশ’ নামের একটি সংগঠন রয়েছে। উল্লেখ্য, ওই সফরে বিশেষ সহকারীর একান্ত সচিব সফরসঙ্গী ছিলেন, যা সরকারের বিদেশ ভ্রমণবিষয়ক নির্দেশনার সঙ্গে সাংঘর্ষিক। এ নির্দেশনায় একান্ত সচিবদের জরুরি প্রয়োজন ব্যতীত সঙ্গে নেওয়া পরিহার করতে বলা হয়েছে।

ছয়. প্রতিবাদপত্রে টেলিযোগাযোগ বিভাগ বলেছে, একটি জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পের আর্থিক ও প্রযুক্তিগত বাস্তবতা বিশ্লেষণ না করে শুধু প্রাক্তন আমলাদের বক্তব্য, বাতিল হওয়া দরপত্র এবং অনুমাননির্ভর ব্যাখ্যা দিয়ে ফয়েজ আহমদের কার্যক্রমকে প্রশ্নবিদ্ধ করা হয়েছে। তিনি এ বিষয়ে প্রেস কনফারেন্সের মাধ্যমে নিজের অবস্থান গণমাধ্যমে ব্যাখ্যা দিয়েছেন, যার কিছু অংশ প্রতিবেদনে উল্লেখ থাকলেও প্রথম আলোর প্রতিনিধিদের সুনির্দিষ্ট প্রশ্নের প্রতি উত্তরের অনুপস্থিতিকে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে।

প্রতিবেদকের বক্তব্য: বক্তব্য জানতে প্রথম আলোর পক্ষ থেকে ১৬ জুলাই ফয়েজ আহমদ এবং ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগের জনসংযোগ কর্মকর্তাকে ই-মেইলে প্রশ্ন পাঠানো হয়। পরে ফয়েজ আহমদকে ফোন করা হয় এবং খুদে বার্তা পাঠানো হয়। তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি (আইসিটি) বিভাগের জনসংযোগ কর্মকর্তাকে ফোনে বিষয়টি জানানো হয়। ২০ জুলাই আইসিটি বিভাগে গেলে অভ্যর্থনা কক্ষ থেকে জানানো হয়, ফয়েজ আহমদ অফিসে উপস্থিত নেই। তখন আইসিটি বিভাগের জনসংযোগ কর্মকর্তা মুহম্মদ জসীম উদ্দিনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি লিখিত বক্তব্য পাঠাবেন বলে জানান। তিনি পাঠাননি। পরে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, বিষয়টি নিয়ে ৭ জুলাই ফয়েজ আহমদ সংবাদ সম্মেলন করেছিলেন। সেটাই তাঁর বক্তব্য। উল্লেখ্য, ফয়েজ আহমদের আগের বক্তব্যের চুম্বক অংশ প্রতিবেদনে রয়েছে। পাশাপাশি ৭ জুলাই তা প্রথম আলোতে প্রকাশিত হয়েছিল। প্রথম আলোর প্রতিবেদনে অনুমাননির্ভর কোনো ব্যাখ্যা দেওয়া হয়নি।

সাত. টেলিযোগাযোগ বিভাগ জানিয়েছে, ইতিমধ্যে দুজন কারিগরি ও দুজন ক্রয় বিশেষজ্ঞের সমন্বয়ে ‘কস্ট-বেনিফিট অ্যানালাইসিস’ (ব্যয়ের বিপরীতে সুফল পর্যালোচনা) কমিটি গঠন করা হয়েছে।

প্রতিবেদকের বক্তব্য: ‘কস্ট-বেনিফিট অ্যানালাইসিস’ করা হয়েছে কি না, সেটা প্রথম আলোকে দেওয়া বক্তব্যে জানতে চেয়েছিলেন টিআইবির ইফতেখারুজ্জামান।

আমরা দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলছি, প্রথম আলোর প্রতিবেদন মোটেও ‘ব্যাখ্যাহীন অনুমানমূলক’ নয়, এটা ‘বিভ্রান্তিকর, একপক্ষীয় এবং ভিত্তিহীন’ও নয়; বরং প্রথম আলোর প্রতিবেদন সঠিক এবং সংশ্লিষ্ট নথিপত্র প্রথম আলোর কাছে আছে।

সম্পর্কিত নিবন্ধ