‘জীবনে প্রায় সব উপদেশই এড়িয়ে গেছি’
Published: 23rd, January 2025 GMT
মার্কিন সাংবাদিক র্যাচেল মার্টিনের সঞ্চালনায় ন্যাশনাল পাবলিক রেডিওতে অনুষ্ঠিত ওয়াইল্ড কার্ড পডকাস্টে ২০২৪ সালের ৬ অক্টোবর অতিথি হন প্রথিতযশা কানাডীয় কথাসাহিত্যিক মার্গারেট অ্যাটউড। ওয়াইল্ড কার্ড পডকাস্ট পরিচালিত সাক্ষাৎকারের বিশেষ ধরনটি কৌতূহলোদ্দীপক। সামনে কিছু কার্ড থাকে আর তাতে কিছু প্রশ্ন লেখা থাকে। কার্ডগুলো অতিথিদের দিকে এগিয়ে দেওয়া হয়, অতিথিরা সে অনুযায়ী উত্তর করেন। ওয়াইল্ড কার্ড পডকাস্ট থেকে উল্লেখযোগ্য অংশবিশেষ পত্রস্থ হলো।
র্যাচেল মার্টিন: কোন উপদেশ আপনি অনায়াসে এড়িয়ে যাবেন?
অ্যাটউড: আসলে আমি কোথা থেকে শুরু করব, জীবনে প্রায় সব উপদেশই আমি এড়িয়ে গেছি। শুধু আমার কাছে অর্থবহ বিষয়গুলো নিজের মধ্যে নিতে চেয়েছি। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় উপদেশ-পরামর্শের জন্য আলাদাভাবে দেওয়ার জন্য আমাদের শিক্ষক দেওয়া হতো। জীবনে কোন দিকে যেতে চাই, শিক্ষক সে জন্য পরামর্শ দিতেন। সে সময়ে আমি নিয়মিত লিখছি এবং আমার কবিতা প্রকাশিত হচ্ছিল। তখন আমি একটা গ্র্যাজুয়েট স্টুডেন্ট স্কলারশিপও পেয়েছিলাম। কিন্তু আমার যিনি উপদেষ্টা, তিনি বললেন, ‘এসব লেখালেখি বাদ দাও, গ্র্যাজুয়েশন কর আর তারপর একজন ভালো মানুষ দেখে বিয়ে করে ফেল।’ সেটা ১৯৬১ সালের কথা। এমনকি সেসব সময়ের জন্যও কথাটা একটু চরমই ছিল। তো যেসব উপদেশের সঙ্গে আমি সহমত দেখাতে পারতাম না, সে ক্ষেত্রে আমার প্রতিক্রিয়ায় আমার ভেতর থেকে একটি স্বর যেন তার উদ্দেশ্যে বলতে থাকত, ‘তুমি একটি গর্দভ’।
lআপনি কি এই ভেতরের স্বরটাকে নিজের ভেতরেই রেখেছেন, নাকি মুখ ফুটে বের করেছেন?
llআমার মনে হয়, আমি বের করে ফেলেছি কখনও কখনও। যদিও এসব স্বর নিজের ভেতরে রেখে দেওয়াই উচিত কিন্তু ঠিক ওই সময়েই ওই স্বরটি মনের ভেতর চলে এসেছে, আর কখনও কখনও বোধহয় আমি বলেও ফেলেছি, ‘তুমি একটা গর্দভ’। খুব বিরক্ত হয়ে বলতাম, এসব কথাবার্তা কি শেষ হয়েছে? অনেক ধন্যবাদ। বিদায় নিচ্ছি।
lভালো উপদেশগুলো কি ভালো বন্ধুদের কাছ থেকেই এসেছে?
llআমি ওই সময় তখনকার লোকদের থেকে একেবারেই ভিন্ন ছিলাম, তাই আমার বন্ধুরা আমাকে নিয়ে বেশি মাথা ঘামাত না। কিন্তু আমাদের ফ্যাকাল্টিতে যে মানুষটি আমাকে ভালো উপদেশ দিতেন সে কথাটি কী ছিল, আমি তা আপনাকে বলেছি। আমার মনে হয়েছিল বিশ্ববিদ্যালয়ে শিল্পকলার ছাত্রী হিসেবে এই অস্তিত্ববাদের যুগে আমি ফ্রান্সে যাব, রেস্তোরাঁয় কাজ করব, চিলেকোঠায় থাকব, ধূমপান করব, মাস্টারপিস লিখব এবং ‘লা বোহেমি’ নাটকের নায়িকার মতো কাশতে কাশতে মারা যাব। যদিও আমি এসব বিষয়ের পুরো ভাবনা আমার উপদেষ্টার সঙ্গে শেয়ার করিনি। তবু যেটুকু করেছিলাম তাতে তিনি বললেন, তুমি যদি গ্র্যাজুয়েট স্কুলে যাও, তাহলে লেখালেখিতে ভালো করবে। এবং তাদের সেই কথা ঠিক ছিল।
lঈর্ষান্বিত হন?
llআমি কোনো প্রকার ঈর্ষা অনুভব করি না। (একটু হেসে) যারা আমার চেয়ে লম্বা তাদের প্রতি ছাড়া।
lঅন্য লোকেরা আপনাকে ঈর্ষা করছে, তেমনটা কি ঘটে?
llহ্যাঁ, সেটা অবশ্যই ঘটে। যখন নতুন তরুণ লেখক-লেখিকার মধ্যে সাফল্য আসে, আমি তাদের বলেছি, ‘যখন তুমি সফল হবে তার দুই বছরের মধ্যেই তুমি তিনটি জঘন্য ব্যক্তিগত আক্রমণের শিকার হবে এমন কিছু লোকের কাছ থেকে, যাদের তুমি চেনো না। এটা অবশ্যই ঘটবে, বিশেষ করে তাদের ক্ষেত্রে, যারা লেখক হিসেবে তরুণ। যদি তুমি তরুণই হও, তুমি তোমার বয়সের লেখকদের একটি দল দেখবে। যদি সফল হও, তোমার বন্ধুরা বিভক্ত হবে লোহিত সাগরের মতো। সেখানে দু’দল থাকবে, যারা ঈর্ষা নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে, আর যারা পারবে না। সেটা তুমি সহজেই খুঁজে পাবে।
lআপনার সফলতার প্রথমদিকে কী কী আক্রমণ এসেছে?
llকতগুলো ছিল খুব মজার। তার মধ্যে অনেকগুলো ছিল আমার চুল নিয়ে। ‘কোঁকড়ানো ডাইনির চুল’। একজন আবার আমাকে নিয়ে একটি কল্পকাহিনি লিখল– যেখানে দেখাল আমি পুরুষদের মাথা চিবিয়ে খাই আর সেই মাথা দিয়ে একটা স্তূপ তৈরি করছি এবং একটা অক্টোপাসে পরিণত হয়েছি।
lতাহলে আপনি ডাইনি-চুলের পুরুষবিদ্বেষী?
llহুম, ক্ষমতাপাগল ডাইনি।
lআমি আশ্চর্য হচ্ছি, আপনি এগুলো সামলান কীভাবে! শুনলেন আর কান দিয়ে বের করে দিলেন? নাকি কিছু কিছু আপনার চামড়ার ভেতরে ঢুকেও যায়?
llনা, আমি খুব প্রতিশোধপরায়ণ মানুষ।
lসত্যিই বলছেন!
llআমি সত্যিই খুব প্রতিশোধপরায়ণ। আমার এতে কিছু করার নেই। আমি যা, আমি তাই। আমি তাদের আমার গল্পের ভেতর নির্বোধ হিসেবে চরিত্র দাঁড় করাই।
lবিষাদ ঠেকান কীভাবে?
llআমি খুব বিষণ্ন মানুষ নই। মাঝে মাঝে খারাপ বিষয় ঘটে, কোনো কিছু করা গেল না বা নিরুৎসাহের বিষয় ও নানা রকম দুর্দশা দেখা দেয়। সার্বিকভাবে এটা বিষাদ নয়।
lতাহলে শব্দটিকে একটু বদলে আমি ‘দুঃখ’ বলছি। দুঃখ কীভাবে সামলান?
llওহ্ দুঃখ! খুব স্বাভাবিক ব্যাপার। আমার একজন বন্ধু ছিল সেই সময়ের, যখন মনোবিদরা মনে করত যে দুঃখের ভেতর দিয়ে যাওয়ার সময় ড্রাগস নিলে দুঃখ অনুভব করা যায় না। সমস্যা হলো, ড্রাগস থেকে বের হওয়া যায় না। যখন ড্রাগস থাকে না তখন আবার একই ব্যাপার ঘটে। তাই ড্রাগসের ধারণাটা ভুল ধারণা। আমি এখন বিধবাদের রাজ্যে বসবাস করি। প্রায়ই অনেকে প্রশ্ন করে, কী করে এই অপার দুঃখ থেকে বের হয়ে আসব? এর বিরুদ্ধে আসলে কোনো প্রতিরক্ষা নেই। প্রতিরক্ষা মানে, তুমি বলছ যে দরজা দিয়ে তাকে ঢুকতে দেবে না। এটা ভুয়া কথা। মানুষের জীবনে দুঃখ তার জীবনেরই অংশ। দুঃখ আছে, স্বাভাবিক, আর এর মধ্যেই তুমি জীবনযাপন করছ।
lকখনও কি এমন হয়েছে যে, কোনো আশঙ্কা আপনি করেছেন আর তা সত্যি হয়েছে?
llহুম, হয়েছে। ৮৪-তে যখন ‘হ্যান্ডমেইডস টেইল’ লিখলাম, তখন সমালোচনাগুলোয় কিছু কথা উঠে এলো, যেমন- ইংল্যান্ডে অলিভার ক্রমওয়েলের সময় যে সর্বগ্রাসী ধর্মীয় শাসন এলো, তারা জানত যে এই একই জিনিস আর করবে না। তাই তারা বিষয়টাকে গল্পের ধারণা বলে উড়িয়ে দিয়েছে। কানাডার ক্ষেত্রে তারা সব সময় প্রশ্ন করে, ঘটনাগুলো কি এখানে ঘটতে পারে? যুক্তরাষ্ট্রে এটি দুই ভাগে বিভক্ত। এক দল বলে, এখানে সর্বগ্রাসী কিছু কখনও ঘটবে না। কারণ, আমরা হচ্ছি বিশ্বে নেতৃত্বদানকারী উদার গণতন্ত্রের দেশ। পৃথিবীর সব দেশের আশার প্রদীপ। অন্য পক্ষ বলে যে, পশ্চিম উপকূলে যা কিছু শুরু হচ্ছে তা আমরা কতদিন সহ্য করব? আশির দশকের প্রথমদিকে, যখন নারী অধিকারের বিষয়টি এলো, তখন একটা বিরাট সম্ভাবনা ছিল সত্যি হওয়ার। তারপর শীতল যুদ্ধ শেষ হলো ৮৯-৯০ সালে। মানুষ তখন ভুলভাবে বলতে শুরু করল, “উদার গণতন্ত্র এখন সর্বত্র চালু হবে। সব সংঘাত শেষ হয়েছে। এখন আমরা আনন্দে শপিং করব।” আমিও ভাবলাম, যাক নিপীড়নের বিষয়টি তাহলে শেষ হয়েছে। কিন্তু তুমি দেখতে পাচ্ছ, তা আবার ফিরে এসেছে।
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: উপদ শ
এছাড়াও পড়ুন:
প্রস্থেটিক মেকআপ আর্টে সোনালী মিতুয়ার বাজিমাত
বাংলাদেশের মেকআপ আর্ট জগতে নীরবে নতুনত্ব যোগ করে যাচ্ছেন সোনালী মিতুয়া। তার শৈল্পিক ইলিউশন এবং বডি পেইন্টিংগুলো আন্তর্জাতিক মানের, যা দেখে চোখ ফেরানো দায়। বর্তমানে ফিনল্যান্ডে মেকআপের ওপর উচ্চশিক্ষা নিচ্ছেন এই শিল্পী, যার ক্যানভাসে শৈশবের প্রথম গন্ধ ছিল তেল রং আর থিনারের তীব্রতা। মেকআপ ব্যবহার করে তিনি যে ক্যানভাস তৈরি করেন-তা এক কথায় অনন্য, অসাধারণ।
সোনালী মিতুয়া কখনও তার মুখে ফুটে ওঠে ফাটল ধরা পৃথিবী, যেখান থেকে গজিয়ে ওঠে সবুজ লতা। কখনও দেখা যায় তার মুখটাই এক অর্ধেক যন্ত্র, অর্ধেক প্রকৃতি, যেন মানুষ আর মেশিনের মাঝের এক অদ্ভুত, কাব্যময় দ্বন্দ্ব।আর কখনও সেই মুখটাই অন্ধকারে মিলিয়ে যায়, শুধু দেখা যায় এক ভয়ঙ্কর কালো গহ্বর — যেন মানুষের শূন্য আত্মা। এগুলো কোনো সিনেমার দৃশ্য না।এগুলো এক তরুণী মেকআপ আর্টিস্টের সৃষ্ট জীবন্ত শিল্পকর্ম।
আরো পড়ুন:
একা বাস করতে পারে যে পাখি
কেউ কটূক্তি করলে কী করবেন?
সোনালী মিতুয়ার মেকআপে একটা গল্প, একটা দর্শন, একটা গভীর বার্তা লুকিয়ে থাকে। যেখানে অধিকাংশ মানুষ মেকআপকে শুধু প্রসাধনের জগতে দেখে, সে সেখানে মেকআপকে তুলেছে এক উচ্চমাত্রার শিল্প হিসেবে। তার হাতে রঙ মানে—চামড়ার ওপরে নয়, বরং আত্মার ভাষা প্রকাশের এক মাধ্যম।
তার কাজে দেখা যায় প্রস্থেটিক মেকআপের প্রভাব— যেখানে মুখ বদলে যায়, গড়ে ওঠে নতুন রূপ, নতুন চরিত্র। এমন কৌশল একদিন তাকে সিনেমার পর্দায় প্রস্থেটিক আর্টিস্ট হিসেবে বড় জায়গায় নিয়ে যাবে—
এ কথা বলার জন্য বিশেষজ্ঞও হতে হয় না।
এই মেয়েটির সবচেয়ে বড় শক্তি তার কল্পনাশক্তি। সে মুখের ভেতরেই ফুটিয়ে তোলে গল্প—একদিকে প্রকৃতি, ফুল, প্রজাপতি; অন্যদিকে প্রযুক্তি, ধ্বংস আর শূন্যতা। দেখলে মনে হয়, এই দুইয়ের টানাপোড়েনেই গড়ে উঠেছে তার শিল্পজগৎ।
বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্মের জন্য এই মেয়েটি এক অনুপ্রেরণা। সে প্রমাণ করছে—শিল্পের ভাষা যদি শক্ত হয়, তাহলে দেশের সীমা পেরিয়ে বিশ্বেও পৌঁছানো যায়। যেখানে মেকআপকে এখনো অনেকেই কেবল সাজের কাজ মনে করেন, এই মেয়েটি সেখানে দেখিয়েছে — মেকআপও হতে পারে দর্শন, প্রতিবাদ আর সৃষ্টির ক্যানভাস।
তিনি জানেন, প্রস্থেটিক আর্টে (বিশেষত কৃত্রিম অঙ্গ, ক্ষত বা ফ্যান্টাসি চরিত্র তৈরি) করা যায় দক্ষতার সাথে। বর্তমানে বাংলাদেশের সিনেমায় যেখানে প্রস্থেটিকের ব্যবহার খুবই সীমিত, সেখানে সোনালী মিতুয়ার মতো একজন আন্তর্জাতিক প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শিল্পী আছেন, তার হাতেই তৈরি হতে পারে বাংলাদেশের ইতিহাসের চরিত্রদের নিখুঁত রূপ, অথবা আমাদের ফ্যান্টাসি সিনেমার ভিনগ্রহের প্রাণী।
সোনালী মিতুয়ার কাজগুলো দেখলেই বোঝা যায়, তিনি মেকআপকে স্রেফ সৌন্দর্যবর্ধনের মাধ্যম হিসেবে দেখেন না, বরং এটিকে একটি শক্তিশালী গল্প বলার হাতিয়ার মনে করেন।
একটা ছবিতে দেখা যাচ্ছে একজন মানুষ প্রকৃতির মাঝে ফাটল ধরা পাথরের মতো এক রূপ ধারণ করেছেন। সবুজ, হলুদ ও লালের মিশ্রণে চোখের অংশটি গভীর এবং রহস্যময়, আর ফাটলের ভেতর দিয়ে বেরিয়ে আসা লতা-পাতা জীবনের ইঙ্গিত দিচ্ছে। এটি তার পরিবেশ-সচেতনতা এবং ফ্যান্টাসি আর্টের দক্ষতা প্রমাণ করে।
সাদাকালো স্কেচের মতো দেখতে এই মেকআপটি অত্যন্ত কঠিন এবং চোখে পড়ার মতো। মুখের প্রতিটি অংশে পেন্সিল বা চারকোল দিয়ে আঁকা হ্যাচিংয়ের মতো স্ট্রোকগুলো ত্রিমাত্রিক চেহারাটিকে দ্বিমাত্রিক কমিক-বুক বা নয়ার চলচ্চিত্রের চরিত্র হিসেবে ফুটিয়ে তুলেছে।
চোখ ও মুখের চারপাশে মাকড়সার জাল এবং ফুলা, রক্তবর্ণ চোখের পাপড়ি ভীতি ও কষ্টের এক শক্তিশালী অনুভূতি জাগায়। এটি বিশেষ করে হ্যালোইন বা হরর থিমের জন্য পারফেক্ট।
গভীর অন্ধকারে তোলা এই ছবিটি ‘অন্ধকার গহ্বর’ বা ‘কৃষ্ঞগহ্বর’ থিমের একটি চমকপ্রদ ইলিউশন মেকআপ। নিখুঁত কনট্যুরিং এবং রঙের ব্যবহারে মুখের এক অংশে যেন সত্যিই একটি ফাঁকা, গর্তের সৃষ্টি হয়েছে।
ঢাকা/লিপি