‘জীবনে প্রায় সব উপদেশই এড়িয়ে গেছি’
Published: 23rd, January 2025 GMT
মার্কিন সাংবাদিক র্যাচেল মার্টিনের সঞ্চালনায় ন্যাশনাল পাবলিক রেডিওতে অনুষ্ঠিত ওয়াইল্ড কার্ড পডকাস্টে ২০২৪ সালের ৬ অক্টোবর অতিথি হন প্রথিতযশা কানাডীয় কথাসাহিত্যিক মার্গারেট অ্যাটউড। ওয়াইল্ড কার্ড পডকাস্ট পরিচালিত সাক্ষাৎকারের বিশেষ ধরনটি কৌতূহলোদ্দীপক। সামনে কিছু কার্ড থাকে আর তাতে কিছু প্রশ্ন লেখা থাকে। কার্ডগুলো অতিথিদের দিকে এগিয়ে দেওয়া হয়, অতিথিরা সে অনুযায়ী উত্তর করেন। ওয়াইল্ড কার্ড পডকাস্ট থেকে উল্লেখযোগ্য অংশবিশেষ পত্রস্থ হলো।
র্যাচেল মার্টিন: কোন উপদেশ আপনি অনায়াসে এড়িয়ে যাবেন?
অ্যাটউড: আসলে আমি কোথা থেকে শুরু করব, জীবনে প্রায় সব উপদেশই আমি এড়িয়ে গেছি। শুধু আমার কাছে অর্থবহ বিষয়গুলো নিজের মধ্যে নিতে চেয়েছি। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় উপদেশ-পরামর্শের জন্য আলাদাভাবে দেওয়ার জন্য আমাদের শিক্ষক দেওয়া হতো। জীবনে কোন দিকে যেতে চাই, শিক্ষক সে জন্য পরামর্শ দিতেন। সে সময়ে আমি নিয়মিত লিখছি এবং আমার কবিতা প্রকাশিত হচ্ছিল। তখন আমি একটা গ্র্যাজুয়েট স্টুডেন্ট স্কলারশিপও পেয়েছিলাম। কিন্তু আমার যিনি উপদেষ্টা, তিনি বললেন, ‘এসব লেখালেখি বাদ দাও, গ্র্যাজুয়েশন কর আর তারপর একজন ভালো মানুষ দেখে বিয়ে করে ফেল।’ সেটা ১৯৬১ সালের কথা। এমনকি সেসব সময়ের জন্যও কথাটা একটু চরমই ছিল। তো যেসব উপদেশের সঙ্গে আমি সহমত দেখাতে পারতাম না, সে ক্ষেত্রে আমার প্রতিক্রিয়ায় আমার ভেতর থেকে একটি স্বর যেন তার উদ্দেশ্যে বলতে থাকত, ‘তুমি একটি গর্দভ’।
lআপনি কি এই ভেতরের স্বরটাকে নিজের ভেতরেই রেখেছেন, নাকি মুখ ফুটে বের করেছেন?
llআমার মনে হয়, আমি বের করে ফেলেছি কখনও কখনও। যদিও এসব স্বর নিজের ভেতরে রেখে দেওয়াই উচিত কিন্তু ঠিক ওই সময়েই ওই স্বরটি মনের ভেতর চলে এসেছে, আর কখনও কখনও বোধহয় আমি বলেও ফেলেছি, ‘তুমি একটা গর্দভ’। খুব বিরক্ত হয়ে বলতাম, এসব কথাবার্তা কি শেষ হয়েছে? অনেক ধন্যবাদ। বিদায় নিচ্ছি।
lভালো উপদেশগুলো কি ভালো বন্ধুদের কাছ থেকেই এসেছে?
llআমি ওই সময় তখনকার লোকদের থেকে একেবারেই ভিন্ন ছিলাম, তাই আমার বন্ধুরা আমাকে নিয়ে বেশি মাথা ঘামাত না। কিন্তু আমাদের ফ্যাকাল্টিতে যে মানুষটি আমাকে ভালো উপদেশ দিতেন সে কথাটি কী ছিল, আমি তা আপনাকে বলেছি। আমার মনে হয়েছিল বিশ্ববিদ্যালয়ে শিল্পকলার ছাত্রী হিসেবে এই অস্তিত্ববাদের যুগে আমি ফ্রান্সে যাব, রেস্তোরাঁয় কাজ করব, চিলেকোঠায় থাকব, ধূমপান করব, মাস্টারপিস লিখব এবং ‘লা বোহেমি’ নাটকের নায়িকার মতো কাশতে কাশতে মারা যাব। যদিও আমি এসব বিষয়ের পুরো ভাবনা আমার উপদেষ্টার সঙ্গে শেয়ার করিনি। তবু যেটুকু করেছিলাম তাতে তিনি বললেন, তুমি যদি গ্র্যাজুয়েট স্কুলে যাও, তাহলে লেখালেখিতে ভালো করবে। এবং তাদের সেই কথা ঠিক ছিল।
lঈর্ষান্বিত হন?
llআমি কোনো প্রকার ঈর্ষা অনুভব করি না। (একটু হেসে) যারা আমার চেয়ে লম্বা তাদের প্রতি ছাড়া।
lঅন্য লোকেরা আপনাকে ঈর্ষা করছে, তেমনটা কি ঘটে?
llহ্যাঁ, সেটা অবশ্যই ঘটে। যখন নতুন তরুণ লেখক-লেখিকার মধ্যে সাফল্য আসে, আমি তাদের বলেছি, ‘যখন তুমি সফল হবে তার দুই বছরের মধ্যেই তুমি তিনটি জঘন্য ব্যক্তিগত আক্রমণের শিকার হবে এমন কিছু লোকের কাছ থেকে, যাদের তুমি চেনো না। এটা অবশ্যই ঘটবে, বিশেষ করে তাদের ক্ষেত্রে, যারা লেখক হিসেবে তরুণ। যদি তুমি তরুণই হও, তুমি তোমার বয়সের লেখকদের একটি দল দেখবে। যদি সফল হও, তোমার বন্ধুরা বিভক্ত হবে লোহিত সাগরের মতো। সেখানে দু’দল থাকবে, যারা ঈর্ষা নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে, আর যারা পারবে না। সেটা তুমি সহজেই খুঁজে পাবে।
lআপনার সফলতার প্রথমদিকে কী কী আক্রমণ এসেছে?
llকতগুলো ছিল খুব মজার। তার মধ্যে অনেকগুলো ছিল আমার চুল নিয়ে। ‘কোঁকড়ানো ডাইনির চুল’। একজন আবার আমাকে নিয়ে একটি কল্পকাহিনি লিখল– যেখানে দেখাল আমি পুরুষদের মাথা চিবিয়ে খাই আর সেই মাথা দিয়ে একটা স্তূপ তৈরি করছি এবং একটা অক্টোপাসে পরিণত হয়েছি।
lতাহলে আপনি ডাইনি-চুলের পুরুষবিদ্বেষী?
llহুম, ক্ষমতাপাগল ডাইনি।
lআমি আশ্চর্য হচ্ছি, আপনি এগুলো সামলান কীভাবে! শুনলেন আর কান দিয়ে বের করে দিলেন? নাকি কিছু কিছু আপনার চামড়ার ভেতরে ঢুকেও যায়?
llনা, আমি খুব প্রতিশোধপরায়ণ মানুষ।
lসত্যিই বলছেন!
llআমি সত্যিই খুব প্রতিশোধপরায়ণ। আমার এতে কিছু করার নেই। আমি যা, আমি তাই। আমি তাদের আমার গল্পের ভেতর নির্বোধ হিসেবে চরিত্র দাঁড় করাই।
lবিষাদ ঠেকান কীভাবে?
llআমি খুব বিষণ্ন মানুষ নই। মাঝে মাঝে খারাপ বিষয় ঘটে, কোনো কিছু করা গেল না বা নিরুৎসাহের বিষয় ও নানা রকম দুর্দশা দেখা দেয়। সার্বিকভাবে এটা বিষাদ নয়।
lতাহলে শব্দটিকে একটু বদলে আমি ‘দুঃখ’ বলছি। দুঃখ কীভাবে সামলান?
llওহ্ দুঃখ! খুব স্বাভাবিক ব্যাপার। আমার একজন বন্ধু ছিল সেই সময়ের, যখন মনোবিদরা মনে করত যে দুঃখের ভেতর দিয়ে যাওয়ার সময় ড্রাগস নিলে দুঃখ অনুভব করা যায় না। সমস্যা হলো, ড্রাগস থেকে বের হওয়া যায় না। যখন ড্রাগস থাকে না তখন আবার একই ব্যাপার ঘটে। তাই ড্রাগসের ধারণাটা ভুল ধারণা। আমি এখন বিধবাদের রাজ্যে বসবাস করি। প্রায়ই অনেকে প্রশ্ন করে, কী করে এই অপার দুঃখ থেকে বের হয়ে আসব? এর বিরুদ্ধে আসলে কোনো প্রতিরক্ষা নেই। প্রতিরক্ষা মানে, তুমি বলছ যে দরজা দিয়ে তাকে ঢুকতে দেবে না। এটা ভুয়া কথা। মানুষের জীবনে দুঃখ তার জীবনেরই অংশ। দুঃখ আছে, স্বাভাবিক, আর এর মধ্যেই তুমি জীবনযাপন করছ।
lকখনও কি এমন হয়েছে যে, কোনো আশঙ্কা আপনি করেছেন আর তা সত্যি হয়েছে?
llহুম, হয়েছে। ৮৪-তে যখন ‘হ্যান্ডমেইডস টেইল’ লিখলাম, তখন সমালোচনাগুলোয় কিছু কথা উঠে এলো, যেমন- ইংল্যান্ডে অলিভার ক্রমওয়েলের সময় যে সর্বগ্রাসী ধর্মীয় শাসন এলো, তারা জানত যে এই একই জিনিস আর করবে না। তাই তারা বিষয়টাকে গল্পের ধারণা বলে উড়িয়ে দিয়েছে। কানাডার ক্ষেত্রে তারা সব সময় প্রশ্ন করে, ঘটনাগুলো কি এখানে ঘটতে পারে? যুক্তরাষ্ট্রে এটি দুই ভাগে বিভক্ত। এক দল বলে, এখানে সর্বগ্রাসী কিছু কখনও ঘটবে না। কারণ, আমরা হচ্ছি বিশ্বে নেতৃত্বদানকারী উদার গণতন্ত্রের দেশ। পৃথিবীর সব দেশের আশার প্রদীপ। অন্য পক্ষ বলে যে, পশ্চিম উপকূলে যা কিছু শুরু হচ্ছে তা আমরা কতদিন সহ্য করব? আশির দশকের প্রথমদিকে, যখন নারী অধিকারের বিষয়টি এলো, তখন একটা বিরাট সম্ভাবনা ছিল সত্যি হওয়ার। তারপর শীতল যুদ্ধ শেষ হলো ৮৯-৯০ সালে। মানুষ তখন ভুলভাবে বলতে শুরু করল, “উদার গণতন্ত্র এখন সর্বত্র চালু হবে। সব সংঘাত শেষ হয়েছে। এখন আমরা আনন্দে শপিং করব।” আমিও ভাবলাম, যাক নিপীড়নের বিষয়টি তাহলে শেষ হয়েছে। কিন্তু তুমি দেখতে পাচ্ছ, তা আবার ফিরে এসেছে।
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: উপদ শ
এছাড়াও পড়ুন:
অলসতা মোকাবিলার আধ্যাত্মিক কৌশল
সকাল হয়েছে, কিন্তু বিছানা ছাড়তে মন চাইছে না—এমন দিন কি আপনারও আসে? হয়তো ঘুম থেকে ওঠার আগেই মনে হচ্ছে শরীরটা একেবারে নিস্তেজ। জোর করে বাথরুম পর্যন্ত যাচ্ছেন, আর ক্যালেন্ডার বা কাজের তালিকা দেখার কথা মনে আসতেই আবার লেপের নিচে সেঁধিয়ে যেতে ইচ্ছা করছে। ইচ্ছে করে শুয়ে থাকি, আর কিছুই না করি।
এই অনুভূতিটার সঙ্গে আমরা প্রায় সবাই পরিচিত।
যাদের আমরা অত্যন্ত কর্মঠ বা ‘প্রোডাক্টিভ মুসলিম’ বলে মনে করি, তাদের জীবনেও এমন দিন আসে। আমরা এর আগে আলাপ করেছিলাম, অক্ষমতা নিয়ে। অর্থাৎ, সেই অনুভূতি—যখন আপনি ভালো কিছু করতে চান, কিন্তু কাজ করার ক্ষমতাটুকু অনুভব করেন না। মানে ‘আমি চাই, কিন্তু পারছি না’। আজ আলোচনা করব তার নিকটাত্মীয় আলস্য নিয়ে। একে আরবিতে বলে ‘কাস্ল’। মানে ‘আমি চাই, কিন্তু আমার মন সায় দিচ্ছে না’ বা ‘আমার করতে ইচ্ছে করছে না’।
আলস্য কেবল একটি শারীরিক বা মানসিক জড়তা নয়; এর গভীরে থাকে বেশ কিছু কারণ, যার মধ্যে আধ্যাত্মিক কারণও রয়েছে। আলস্যকে জয় করতে হলে প্রথমে এর উৎসটি জানা জরুরি। কারণ, সব আলস্য এক ধরনের হয় না এবং এর সমাধানও উৎসভেদে ভিন্ন।
আলস্যের উৎস কোথায়আলস্য মোকাবিলা করার আগে বুঝতে হবে, এটি ঠিক কোথা থেকে আসছে। আলস্যের মূল কারণের ওপর নির্ভর করে এর প্রতিকার:
১. এটি কি সাময়িক ক্লান্তি
কখনও কখনও আলস্য কেবলই আমাদের শরীর ও আত্মার একটি সহজ বার্তা, “এখন বিশ্রাম প্রয়োজন।” আপনি হয়তো একটানা খুব বেশি পরিশ্রম করেছেন, দু’দিক থেকে মোমবাতি জ্বালিয়েছেন (অর্থাৎ, অতিরিক্ত পরিশ্রম করেছেন), আর এখন আপনার ভেতরের শক্তিভাণ্ডার প্রায় শূন্য।
এই ধরনের আলস্য আসলে আপনার ফিতরাত বা প্রাকৃতিক প্রবণতা। এটি আপনাকে মাত্রাতিরিক্ত পরিশ্রম থেকে রক্ষা করে এবং শরীরকে পুনরুদ্ধার হওয়ার সুযোগ দেয়। এক রাতের ভালো ঘুম বা স্বল্প সময়ের বিশ্রামেই এই আলস্য দূর হতে পারে।
আল্লাহর রাসুল (সা.) বলেছেন, “নিশ্চয় তোমার শরীরের তোমার ওপর অধিকার রয়েছে।” (সহিহ বুখারি, হাদিস: ১৯৬৮)
এই হাদিসটি স্পষ্টভাবে নির্দেশ করে যে, পরিশ্রমের মধ্যে বিশ্রাম নেওয়া এবং শরীরের যত্ন নেওয়া ইসলামের একটি গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা।
২. এটি কি গভীর ক্লান্তি (বার্নআউট)
যদি আপনার আলস্য সপ্তাহের পর সপ্তাহ বা মাসের পর মাস ধরে চলতে থাকে, তবে আপনি সম্ভবত সম্পূর্ণ অবসাদ (Burnout) বা গভীর ক্লান্তির শিকার। এই ধরনের ক্লান্তি কেবল এক রাতের ঘুমে দূর হয় না। এর জন্য প্রয়োজন হয় আপনার দৈনন্দিন রুটিন, অগ্রাধিকার এবং সম্ভবত আপনার পরিবেশের একটি মৌলিক ও সামগ্রিক পরিবর্তন।
গভীর ক্লান্তির আরেকটি মূল কারণ হলো, জীবনের চালকশক্তি হিসেবে সুস্পষ্ট মহৎ উদ্দেশ্য না থাকা। যখন আপনার কোনো বড়, অর্থপূর্ণ লক্ষ্য থাকে না যা আপনাকে বিছানা থেকে ওঠাবে, তখন মস্তিষ্ক সহজেই আলস্যকে গ্রহণ করে নেয়। জীবনের উদ্দেশ্য অস্পষ্ট হলে, শক্তি হারিয়ে যাওয়া স্বাভাবিক।
আরও পড়ুনশত্রুদের বিবরণ আছে সুরা মুনাফিকুনে ০৮ অক্টোবর ২০২৪৩. এটি কি আধ্যাত্মিক
আলস্যের মূল কখনও কখনও আমাদের ধারণার চেয়েও গভীরে প্রোথিত থাকে। স্বয়ং নবী মুহাম্মদ (সা.) আমাদের শিখিয়েছেন,
“যখন তোমাদের কেউ ঘুমিয়ে পড়ে, শয়তান তার মাথার পেছনে তিনটি গিঁট দেয়। প্রতি গিঁটে সে বলে, তোমার রাত অনেক দীর্ঘ, সুতরাং ঘুমাও। অতঃপর যদি সে ঘুম থেকে জেগে আল্লাহকে স্মরণ করে, তবে একটি গিঁট খুলে যায়; যদি সে অজু করে, তবে দু’টি গিঁট খুলে যায়; আর যদি সে নামাজ আদায় করে, তবে সব গিঁট খুলে যায়। এভাবে সে সকালে প্রফুল্ল মন ও সতেজ শরীর নিয়ে ওঠে; অন্যথায় সে সকালে খারাপ মন ও অলসতা নিয়ে ওঠে।” (সহিহ মুসলিম, হাদিস: ৭৭৬)
এই হাদিস থেকে বোঝা যায়, আমাদের আলস্য অনেক সময় আধ্যাত্মিক গিঁটের ফল হতে পারে, যা জিকির (আল্লাহর স্মরণ), অজু এবং নামাজের মাধ্যমে খোলা হয়নি।
তবে অলসতার আরও একটি সূক্ষ্ম আধ্যাত্মিক দিক রয়েছে। আপনি কি কখনও লক্ষ্য করেছেন, যখনই আপনি কোনো অর্থপূর্ণ কাজ শুরু করতে যান—যেমন একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প শুরু করা, কোরআন মুখস্থ করা বা কোনো সামাজিক উদ্যোগ নেওয়া—ঠিক তখনই আলস্য যেন সবচেয়ে কঠিনভাবে আঘাত করে? এটি কোনো কাকতালীয় ঘটনা নয়।
শয়তানের সবচেয়ে কার্যকর হাতিয়ার সবসময় প্রলোভন নয়; কখনও কখনও এটি নিছক আলস্যের মাধ্যমে কাজকে স্থগিত করে দেওয়া বা শিথিলতা ঘটানো। আপনি যত বড় ও অর্থপূর্ণ কাজের কাছাকাছি পৌঁছান, এই আধ্যাত্মিক প্রতিরোধ তত শক্তিশালী হয়। মনে হয় যেন কোনো অদৃশ্য শক্তি আপনার ভালো উদ্দেশ্যগুলোর বিরুদ্ধে কাজ করছে, যার ফলে সামান্য কাজও পাহাড়ের মতো কঠিন মনে হচ্ছে।
অলসতা মোকাবিলার কৌশলঅলসতার উৎস যেটাই হোক না কেন, এটিকে স্থায়ী হতে দেওয়া চলবে না। এর মোকাবিলায় কিছু সুনির্দিষ্ট কৌশল অবলম্বন করা যেতে পারে:
১. বিশ্রামের মাধ্যমে সাময়িক আলস্য দূর করা
যদি আপনার অলসতা সাময়িক হয় এবং আপনি দীর্ঘ সময় ধরে পরিশ্রম করে থাকেন, তবে শক্তিশালীভাবে ফিরে আসার অভিপ্রায় নিয়ে একটি বিরতি নিন। আপনার এই বিশ্রাম যেন ফলপ্রসূ হয়: পর্যাপ্ত ঘুমান, পুষ্টিকর খাবার খান এবং পরিবার ও বন্ধুদের সঙ্গে মানসম্পন্ন সময় কাটান। একটি নির্দিষ্ট সময়সীমা নির্ধারণ করুন এবং তারপর আবার খেলায় ফিরে আসুন।
বস্তুত, বিশ্রাম একটি শক্তি সঞ্চয়ের প্রক্রিয়া, আলস্যকে লালন করার অজুহাত নয়। (দেখুন: আল-গাজালি, ইহয়াউ উলুমিদ্দিন, ৪/৩৫১, দারুল ফিকর, বৈরুত, ১৯৯৬)
২. নামাজের মাধ্যমে আলস্যের ধারা ভেঙে দেওয়া
যখন আপনি আলস্যের চক্রে ঘুরপাক খাচ্ছেন বলে মনে হয়, তখন নামাজের মাধ্যমে সেই চক্রটি ভেঙে দিন। উপরে বর্ণিত তিনটি গিঁটের হাদিসটি মনে করুন। ইবাদতের প্রতিটি কাজ (জিকির, অজু, নামাজ) আপনাকে আধ্যাত্মিক দৃষ্টিকোণ থেকে সতেজ করবে এবং আলস্য মোকাবিলায় সাহায্য করবে। নামাজ হলো আল্লাহর সঙ্গে সরাসরি সংযোগ, যা মন ও আত্মাকে তাৎক্ষণিক শক্তি ও নির্দেশনা দেয়।
আরও পড়ুনঅলসতা দূর করার জন্য নবীজির শেখানো দোয়া২১ অক্টোবর ২০২৫৩. পরিবেশ পরিবর্তন করা
আপনি যদি ডেস্কে বসে জড়তা অনুভব করেন, তবে আপনার কাজের স্থান পরিবর্তন করুন। কাজ নিয়ে কোনো কফি শপ বা লাইব্রেরিতে যান। কখনও কখনও পরিবেশের একটি সাধারণ পরিবর্তন অলসতার চক্রটি ভেঙে দিতে পারে। নতুন পরিবেশ মস্তিষ্কে নতুন উদ্দীপনা সৃষ্টি করে, যা আলস্যকে পিছনে ফেলে কাজ শুরু করতে সাহায্য করে।
৪. সামাজিক শক্তি কাজে লাগানো
আমরা যখন অলস অনুভব করি, তখন প্রায়শই একা থাকতে পছন্দ করি। কিন্তু সামাজিক শক্তি হলো সেই অনন্য শক্তি, যা অন্যের উপস্থিতির মাধ্যমে জন্ম নেয়। আপনার দলের সদস্যদের সঙ্গে পুনরায় যুক্ত হোন, একজন জবাবদিহি সঙ্গী (Accountability Partner) খুঁজুন বা মসজিদে গিয়ে অন্যদের সঙ্গে মিলিত হোন। আপনি ব্যক্তিগতভাবে যে শক্তির অভাব বোধ করছেন, তা অনেক সময় সামষ্টিক চেতনায় (Collective Spirit) মধ্য দিয়ে ফিরে আসতে পারে। এটি মানুষকে দায়িত্বশীল ও সক্রিয় থাকতে সাহায্য করে।
৫. আল্লাহর সাহায্য চাওয়া
কাসালের বিরুদ্ধে সবচেয়ে শক্তিশালী হাতিয়ার হলো সেই দোয়াটি, যা মহানবী (সা.) আমাদের শিখিয়েছেন, “হে আল্লাহ, আমি তোমার কাছে আশ্রয় চাই উদ্বেগ ও পেরেশানি থেকে, অক্ষমতা ও আলস্য থেকে, ভীরুতা ও কৃপণতা থেকে, ঋণের বোঝা ও মানুষের চাপ থেকে।” (সহিহ বুখারি, হাদিস: ৬৩৬৮)
তবে কেবল যান্ত্রিকভাবে এই দোয়াটি পাঠ করবেন না। যখন আপনি বলেন, “আমি তোমার কাছে আশ্রয় চাই অক্ষমতা ও আলস্য থেকে”, তখন নিজেকে এই সমস্ত বন্ধন থেকে মুক্ত হচ্ছেন বলে কল্পনা করুন। আপনার ওপর থেকে আলস্যের ভার সরে যাচ্ছে—তা অনুভব করুন।
বিশ্বাস রাখুন যে আল্লাহ আপনাকে এমনভাবে সতেজ করতে পারেন, যা পৃথিবীর অন্য কোনো উদ্দীপক (যেমন কফি) দিতে পারে না। দোয়া হলো আলস্যকে আল্লাহর কাছে হস্তান্তর করে তাঁর শক্তিকে নিজের মধ্যে আনার প্রক্রিয়া।
আলস্য সর্বদা খারাপ নয়। কখনও কখনও এটি একটি সংকেত, কখনও কখনও এটি মানবীয় প্রকৃতির অংশ। আবার কখনও কখনও এটি একটি আধ্যাত্মিক আক্রমণ, যার চিকিৎসা প্রয়োজন। গুরুত্বপূর্ণ হলো আলস্যকে আপনার জীবনের স্থায়ী অংশ হতে না দেওয়া। এর উৎস কোথায় তা বুঝুন, মূল কারণকে মোকাবিলা করুন এবং আল্লাহর সাহায্যে এটিকে জয় করুন।
আল্লাহ আমাদের সকলকে অলসতা থেকে রক্ষা করুন। আমিন।
আরও পড়ুনইসলামে কলবের মর্যাদা ও গুরুত্ব১২ নভেম্বর ২০২৫