ছাত্রলীগের নির্মমতার নিরব সাক্ষী গল্প শোনালেন শিক্ষার্থীরা
Published: 29th, January 2025 GMT
বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে (বাকৃবি) বিভিন্ন সময়ে শাখা ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের দ্বারা নির্যাতনের শিকার হয়েছেন সাধারণ শিক্ষার্থীরা। আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় থাকায় বাকৃবি ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগের দৌরাত্ম্য ছিল সীমাহীন।
তাদের ক্ষমতার একচ্ছত্র আধিপত্ব্যের কারণে নির্যাতনের শিকার হওয়া শিক্ষার্থীরা ভয়ে মুখ খুলতে পারতেন না। কিন্তু ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর মুখ খুলতে শুরু করেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্যাতিত শিক্ষার্থীরা।
সম্প্রতি শিক্ষার্থীদের নির্যাতনের মর্মান্তিক এসব কালো স্মৃতি স্মরণে বাকৃবির আশরাফুল হক হলে সাময়িকভাবে নির্মিত হয়েছে ‘টর্চার কর্নার’। এতে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের দ্বারা নির্যাতনের শিকার হওয়া শিক্ষার্থীদের শরীরের জখমের চিত্র প্রদর্শিত হচ্ছে।
বুধবার (২৯ জানুয়ারি) রাইজিংবিডির কাছে নির্যাতনের এসব বর্ণনা তুলে ধরেন আশরাফুল হক হলের কয়েকজন ভুক্তভোগী শিক্ষার্থী।
আশরাফুল হক হলের আবাসিক ছাত্র রিফাত বিন শায়েকুজ্জামান বলেন, ‘২০২২ সালের ১৩ ডিসেম্বর বিকেলে ক্লাস করে হল থেকে জিনিসপত্র নিয়ে বের হচ্ছিলাম। হঠাৎ এক সিনিয়র আমাকে গেস্টরুমে নেওয়ার পর আমার সঙ্গে শুরু হয় অমানবিক নির্যাতন। একের পর এক লেভেলের ভাইরা ঢুকে, কেনো আমি হল ছেড়েছি, তা জিজ্ঞেস করছে আর লাথি, থাপ্পড় মারে। প্রথম দফা মারের পর দুই ঘণ্টা পর সন্ধ্যা ৭টায় আমাকে হলের তৃতীয় তলায় বিশেষ এক পলিটিক্যাল রুমে নিয়ে আরেক দফা মারধর করা হয়।”
তিনি বলেন, “এক পর্যায়ে আমাকে হকিস্টিক দিয়ে পেটানো হয়, প্লাস দিয়ে আঙুল চেপে ধরা হয়। থাপ্পরের এক পর্যায়ে আমার কানের পর্দা ফেটে গিয়ে নাক মুখ দিয়ে রক্ত পড়ছিল। ওই অবস্থাতেই আমার পরিবারকে কল করতে বলা হয় এবং সামনের নির্বাচনে কাকে ভোট দিবে জিজ্ঞেস করতে বলা হয়। দীর্ঘ ৬ ঘণ্টা অমানবিক নির্যাতনের পর সিদ্ধান্ত নেয়, আমাকে হলে রাখা যাবে না। অজ্ঞাত কারণে অ্যাম্বুলেন্স খবর দেওয়া হলেও পরে আর আনা হয়নি।”
কৃষি অনুষদের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী মো.
তিনি বলেন, “তারা আমার ফোন চেক করে ছাত্রদলের মিথ্যা ট্যাগ দেয়। কার্যত আমি কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলাম না। শারীরিক নির্যাতনে আমার শ্বাসকষ্ট শুরু হয়, আমি বমি করি। পরে আমাকে দুই ডোজ ওষুধ খাওয়ার পর আবারো আমাকে ১০-১২ জন থাপ্পড় ও রডের বাড়ি দিয়ে শারীরিক নির্যাতন করতে থাকে। আমি হেলথ কেয়ারে চিকিৎসার জন্য গেলে অবস্থা বেগতিক দেখে চিকিৎসকরা আমাকে ময়মনসিংহ মেডিকেলে পাঠায়।”
বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেটেরিনারি অনুষদের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী মো. হাবিবুর রহমান বলেন, “২০২২ সালের ১৩ ডিসেম্বর ক্লাস শেষে আবাসিক আশরাফুল হক হলে ফেরার পর ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা আমাকে গেস্টরুমে ডেকে নিয়ে মোবাইল তল্লাশি করে। তল্লাশির পর ছাত্রদলের লোকজন আমার ফ্রেন্ডলিস্টে আছে কেন এবং রেটিনা কোচিংয়ের পেজে লাইক দেওয়ার কারণ দেখিয়ে শিবিরের সদস্য বলে চিহ্নিত করে। পরে আমাকে সালমান ভাইয়ের রুমে (২৩৬ নম্বর) নিয়ে ছাত্রলীগ নেতা সৌরভ, আল মামুন এবং দুর্জয় শারীরিকভাবে আঘাত করতে শুরু করে। এ ছাড়াও নুহাশ, অন্তর, মিনহাজুল, অন্তর চৌধুরী গিয়ে পাশবিক নির্যাতন করে।”
তিনি বলেন, “পরে সালমান কয়েকটি থাপ্পড় দেওয়ার পর আজহার রড দিয়ে পেটাতে থাকে। একপর্যায়ে আমার দুই কানের টিমপ্যানিক মেমব্রেন ফেটে যায়। সাত দিনের মতো বিছানায় শুয়ে থাকতে হয়। কানের অবস্থা এতই খারাপ ছিল, আমাকে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি হয়ে অপারেশন করাতে হয়। আমি ঘটনার সুস্থ বিচার চাই এবং জড়িতদের বিরুদ্ধে আইন অনু্যায়ী ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানাই।”
ঢাকা/লিখন/মেহেদী
উৎস: Risingbd
এছাড়াও পড়ুন:
ভিটামিনসমৃদ্ধ নিরাপদ ভোজ্যতেল প্রাপ্তির বাধা দূর করতে হবে
দেশে রোগমুক্ত সুস্থ প্রজন্ম গড়ে তুলতে ভিটামিনসমৃদ্ধ নিরাপদ ভোজ্যতেল প্রাপ্তি নিশ্চিত করা প্রয়োজন। এক্ষেত্রে ড্রামে খোলা ভোজ্যতেল বাজারজাতকরণ একটি বড় বাধা। একইসাথে ভোজ্যতেলে ভিটামিন ‘ডি’ সমৃদ্ধকরণ ও গুণগত প্যাকেজিং অত্যন্ত জরুরি।
রাজধানীর বিআইপি কনফারেন্স রুমে সোমবার (২৮ এপ্রিল) অনুষ্ঠিত “সবার জন্য ভিটামিন সমৃদ্ধ নিরাপদ ভোজ্যতেল: অগ্রগতি, বাধা ও করণীয়” শীর্ষক সাংবাদিক কর্মশালায় এসব বিষয় তুলে ধরেন বিশেষজ্ঞরা।
গবেষণা ও অ্যাডভোকেসি প্রতিষ্ঠান প্রজ্ঞা (প্রগতির জন্য জ্ঞান) এবং ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন অব বাংলাদেশ আয়োজিত এই কর্মশালায় প্রিন্ট, টেলিভিশন এবং অনলাইন মিডিয়ায় কর্মরত ২৬ জন সাংবাদিক অংশ নেন।
কর্মশালায় জানানো হয়, জাতীয় মাইক্রোনিউট্রিয়েন্ট জরিপ ২০১১-১২ অনুযায়ী, প্রাক্-বিদ্যালয়গামী প্রতি পাঁচজন শিশুর মধ্যে একজন ভিটামিন ‘এ’ এবং দুইজন শিশু ভিটামিন ডি-এর ঘাটতিতে ভুগছে। ভোজ্যতেলে ভিটামিন ‘এ’ সমৃদ্ধকরণ আইন, ২০১৩ অনুযায়ী ভিটামিন ‘এ’ সমৃদ্ধকরণ ব্যতীত ভোজ্যতেল বাজারজাত করা নিষিদ্ধ। আইসিডিডিআর,বি-এর এক গবেষণায় দেখা গেছে, বাজারে মোট ভোজ্যতেলের ৬৫ শতাংশই ড্রামে বিক্রি হয়। এর মধ্যে ৫৯ শতাংশ তেলে কোনো ভিটামিন ‘এ’ নেই, আর ৩৪ শতাংশ তেলে রয়েছে প্রয়োজনের চেয়ে কম মাত্রায়। মাত্র ৭ শতাংশ ড্রামের খোলা তেলে আইন অনুসারে ভিটামিন ‘এ’–এর নির্ধারিত পরিমাণ পাওয়া গেছে। ফলে সাধারণ মানুষ আইনটির সুফল থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।
কর্মশালায় জানানো হয়, নন-ফুড গ্রেড উপকরণে তৈরি ড্রাম দিয়ে ভোজ্যতেল পরিবহন করা হয়-যেগুলো আগে কেমিক্যাল, লুব্রিকেন্ট/মবিল বা অন্যান্য শিল্পপণ্য সংরক্ষণে ব্যবহৃত হয়েছে। এ ধরনের ড্রামে সংরক্ষিত খোলা ভোজ্যতেল জনস্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ, পাশাপাশি এতে ভেজাল মেশানোর আশঙ্কাও থাকে। এই পুরোনো ড্রামগুলোতে কোনো লেবেল বা উৎস সম্পর্কিত তথ্য না থাকায় তেলের উৎপত্তিস্থল বা সরবরাহকারীকে শনাক্ত করা যায় না। তাই খোলা ড্রামে ভোজ্যতেল বাজারজাতকরণ আইন বাস্তবায়নে বড় অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
কর্মশালায় জানানো হয়, জুলাই ২০২২ এর পর থেকে ড্রামে খোলা সয়াবিন তেল এবং ডিসেম্বর ২০২২ এর পর থেকে খোলা পাম তেল বাজারজাতকরণ বন্ধে শিল্প মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা থাকা সত্ত্বেও বাস্তবে এর প্রতিফলন দেখা যায়নি। তাই নিরাপদ ভোজ্যতেল ভোক্তার হাতে পৌঁছাতে শিল্প মন্ত্রণালয়, বিএসটিআই, জাতীয় ভোক্তা-অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর, নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষসহ সংশ্লিষ্ট সকল সংস্থার সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণ প্রয়োজন।
ভিটামিন ‘এ’-এর ঘাটতি অন্ধত্ব, গর্ভকালীন মাতৃমৃত্যুসহ নানা শারীরিক সমস্যার কারণ হতে পারে। অন্যদিকে, ভিটামিন ‘ডি’-এর অভাব রিকেটস ও হাড় ক্ষয়ের পাশাপাশি হৃদরোগ, উচ্চ রক্তচাপ ও ডায়াবেটিসের মতো অসংক্রামক রোগের ঝুঁকি বাড়ায়। এ প্রেক্ষাপটে, ভোজ্যতেলে ভিটামিন ‘এ’ ও ‘ডি’ সমৃদ্ধকরণ একটি সাশ্রয়ী ও কার্যকর পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। এতে সাধারণ মানুষ প্রতিদিনের খাবারের মাধ্যমে সহজেই এই দুটি গুরুত্বপূর্ণ ভিটামিন পেতে পারে।
এছাড়াও কর্মশালায় ভোজ্যতেলে গুণগতমানের প্যাকেজিং নিশ্চিতের উপরও জোর দেওয়া হয়। সাধারণত সূর্যরশ্মিসহ যেকোন আলোর সংস্পর্শে ভিটামিন ‘এ’ নষ্ট হতে থাকে এবং একপর্যায়ে অদৃশ্য হয়ে যায়। ভোজ্যতেল বাজারজাত হয় যেসব বোতলে সেগুলোর অধিকাংশই আলো প্রতিরোধী না হওয়ায় ভোজ্যতেলের গুণগত ও পুষ্টিমান হ্রাস পায়। সে কারণে ভোজ্যতেলের প্যাকেজিংয়ের জন্য আলো প্রতিরোধী অস্বচ্ছ উপাদান ব্যবহার করার পরামর্শ দেওয়া হয়।
কর্মশালায় আলোচক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন জাতীয় ভোক্তা-অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর-এর কার্যক্রম ও গবেষণাগার বিভাগের পরিচালক (উপসচিব) ফকির মুহাম্মদ মুনাওয়ার হোসেন; ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন অব বাংলাদেশের কনসালটেন্ট সাবেক অতিরিক্ত সচিব মুশতাক হাসান মুহ. ইফতিখার; ব্র্যাক জেমস পি গ্রান্টস স্কুল অব পাবলিক হেলথ-এর অ্যাসোসিয়েট সায়েন্টিস্ট আবু আহমেদ শামীম; দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড-এর ডেপুটি এডিটর সাজ্জাদুর রহমান এবং প্রজ্ঞা’র নির্বাহী পরিচালক এবিএম জুবায়ের।
কর্মশালায় গণমাধ্যমকর্মীদের সামনে বিষয়ভিত্তিক উপস্থাপনা তুলে ধরেন ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশনের লার্জ স্কেল ফুড ফর্টিফিকেশন কান্ট্রি এডভোকেসি বাংলাদেশ-এর প্রোগ্রাম ম্যানেজার ডা. রীনা রাণী পাল এবং প্রজ্ঞা'র কর্মসূচি প্রধান হাসান শাহরিয়ার।
ঢাকা/হাসান/সাইফ