‘আমার সোনার থালার মতো জমি কাটছে ওরা’
Published: 1st, February 2025 GMT
মিরসরাইয়ের করেরহাট ইউনিয়নের ফেনী নদী দক্ষিণ পাড়ের বিভিন্ন এলাকায় রাতের আঁধারে চরের ফসলি জমি কেটে অবৈধ বালু তোলা হচ্ছে। প্রতিদিন বিকট শব্দে প্রায় ৩০-৪০টি ড্রেজার দিয়ে বালু তোলা হয়। বালু উত্তোলনের আগে এলাকায় আতঙ্ক সৃষ্টি করতে অস্ত্রের মহড়া দেয় বালু দস্যুরা। চরের সহস্র একর ফসলি জমি হারিয়ে কাঁদছেন স্থানীয় কৃষকরা। অবৈধ বালু উত্তোলনে বিএনপির নেতাকর্মীরা জড়িত বলে কৃষকদের অভিযোগ।
মঙ্গলবার সরেজমিন ফেনী নদীয় দক্ষিণে পাড়ের করেরহাট ইউনিয়নের জয়পুর পূর্বজোয়ার, মোল্লার চর, জয় চাঁদপুর, পশ্চিম অলিনগর এলাকায় দেখা যায়, ভয়ানকভাবে কাটা হয়েছে নদীর চর। এতে ফুলকপি, বাঁধাকপি, মরিচ, লাউ, শিমসহ বিভিন্ন সবজি ক্ষেত ভেঙে নদীতে পড়ে যাচ্ছে। নদী ভাঙন রোধে বসানো ব্লকও নদীতে বিলীন হচ্ছে। ৩০-৪০টি ড্রেজার দিয়ে বালু তুলে তা লোহার তৈরি ইঞ্জিনচালিত নৌকায় করে কিনারায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। কয়েকটি ড্রেজার বালু খনন করছে একেবারে নদীয় তীরঘেঁষে। কৃষিজমির পাশে ১০০ ফুট গভীর করে বালু উত্তোলনের ফলে অন্তত প্রায় এক কিলোমিটার এলাকাজুড়ে নদীতে বিলীন হয়ে গেছে চরের কৃষিজমি। কয়েকজন কৃষককে দেখা গেছে, চাষ করা সবজির চারা তুলে নদীতে ফেলে দিতে।
তিলকের চর গ্রামের ৬৫ বছর বয়সী কৃষক আবুল কাশেম বলেন, ‘চরের জমিতে চাষাবাদ করে আমার সংসার চলে। কিন্তু সম্প্রতি রাতের আঁধারে ৫০-৬০টি ড্রেজার লাগিয়ে চরের জমিগুলো কেটে বালু উত্তোলন করছে প্রভাবশালী মহল। তারা অস্ত্রের মহড়া দেয়। গত কয়েকদিনে আমার প্রায় দুই একর জমি কেটে বালু তুলে নিয়ে গেছে।’ চোখের সামনে এভাবে ফসলি জমি হারিয়ে যেতে দেখে এলাকার প্রায় দুই শতাধিক কৃষক এখন পাগলপ্রায়। জয়পুর পূর্ব জোয়ার গ্রামের কৃষক রেজাউল করিম বলেন, ‘ফেনী নদীর তীরে মোল্লার চরে আমার দলিলভুক্ত এক একর ৬২ শতক কৃষিজমি আছে। কিছুদিন ধরে প্রভাবশালীদের অবৈধ বালু উত্তোলনের ফলে শীতকালীন সবজিসহ আমার ৪২ শতক জমি নদীতে বিলীন হয়ে গেছে। প্রতিবাদ করতে গিয়ে বালু উত্তোলনকারীদের হাতে লাঞ্ছিত হয়েছি। জীবনের ঝুঁকি জেনেও এখন প্রতিরাতে নদীর পাড়ে জমির পাশে গিয়ে বসে থাকি। চোখের সামনে আমার সোনার থালার মতো কৃষিজমি কেটে নিয়ে যাচ্ছে ওরা। জমির শোকে চোখে ঘুম আসে না। আমরা এলাকাবাসী তাদের কাছে খুব অসহায়। কার কাছে গেলে বিচার পাব। আমাদের জমি রক্ষায় কি কেউ এগিয়ে আসবে না!’
ফেনী নদীর মোল্লার চর এলাকায় অবৈধ বালু উত্তোলনে বিএনপির নেতাকর্মীরা জড়িত বলে কৃষকদের অভিযোগ। কৃষকরা বলছেন, ‘উপজেলা প্রশাসন ও পুলিশ অবৈধভাবে বালু উত্তোলনকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার আশ্বাসই দিয়েছে কেবল, কোনো কাজ করেনি।’
ভুক্তভোগী কৃষকরা জানান, মোল্লার চরের কৃষিজমি উপজেলার করেরহাট ইউনিয়নের বরইয়া মৌজায় অবস্থিত। ফেনী নদীর দক্ষিণ পাশ লাগোয়া এই চরের ভিটা ও নিচের দিকে মিলিয়ে প্রায় ৪০০ একর উর্বর কৃষিজমি রয়েছে। তিন ফসলি এসব জমিতে চাষাবাদ করেন আশপাশের তিন গ্রামের অন্তত এক হাজার ২০০ কৃষক। আগে ফেনী নদীর এই অংশে আওয়ামী লীগের স্থানীয় কয়েকজন নেতা নদী অংশের কিছু জায়গা ইজারা নিয়ে বালু উত্তোলন করতেন। ফেনী নদীর মোল্লাঘাট এলাকায় সরকার কিছু জায়গা বালু মহাল হিসেবে ইজারা দিলেও আওয়ামী লীগ নেতারা শর্ত লঙ্ঘন করে পুরো নদী এলাকা থেকে বালু উত্তোলন করেছেন। তখন এসব অবৈধ বালু উত্তোলনের বিরুদ্ধে মাঝে মধ্যে অভিযান পরিচালনা করত উপজেলা প্রশাসন। আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর বিএনপির স্থানীয় নেতারা বড় নেতাদের নাম ভাঙিয়ে নদী থেকে অবৈধ বালু উত্তোলন শুরু করেছে। রীতিমতো সশস্ত্র মহড়া দিয়ে কৃষকদের জিম্মি করে নদীপাড়ের কৃষিজমি কেটে বালু নিয়ে যাচ্ছেন তারা। প্রতিবাদ করলে কৃষকদের হুমকি-ধমকি ও নাজেহাল করা হচ্ছে। প্রভাবশালীদের বিরুদ্ধে নীরব উপজেলা প্রশাসন ও থানা পুলিশ।
এ বিষয়ে মিরসরাই উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক শাহীদুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, ‘বিএনপির নাম ভাঙিয়ে নদীতে অবৈধ বালু উত্তোলন করে কেউ কৃষকদের ফসলি জমি নষ্ট করলে প্রশাসন তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেবে। আমরা অন্যায়কারী কারো জন্য সুপারিশ করব না। বরং প্রশাসন চাইলে আমরা সব ধরনের সহযোগিতা করব। জনস্বার্থ হানিকর ও পরিবেশবিধ্বংসী কোন কাজ বিএনপি সমর্থন করে না।’
ফসলি জমি কেটে নদী থেকে অবৈধ বালু উত্তোলনের বিষয়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মাহফুজা জেরিন বলেন, ‘কিছুদিন আগেও সেখানে অভিযান চালিয়ে নদী থেকে অবৈধভাবে বালু তোলার কাজে ব্যবহার করা ৩৭ টি বড় শ্যালো মেশিন জব্দ করেছি। বেশকিছু মেশিন নষ্ট করে দেয়া হয়েছিল। এ অবস্থা চলতে থাকলে ট্রাস্কফোর্স গঠন করে বড় ধরনের অভিযান পরিচালণা করা হবে। নদীর পাড়ে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন করে কৃষকের জমি নষ্ট করলে কাউকে ছাড় দেয়া হবে না।’
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: অব ধ ব ল ক ষকদ র ব এনপ র এল ক য় ব দ কর উপজ ল
এছাড়াও পড়ুন:
নভেম্বরে বৃষ্টি ফসলের জন্য কতটা ক্ষতির
বাড়ির সামনে ১৫ শতক জমিতে সবজি আবাদ করেছেন ময়মনসিংহ সদর উপজেলার বয়রা গ্রামের কৃষক শাম্মত আলী (৬০)। পালংশাক, মুলা, ডাঁটা ও মরিচের বীজ বুনেছেন তিনি। মরিচের বীজ বোনার দুই দিন পর বৃষ্টি শুরু হয়। বৃষ্টিতে বীজ পচে গেছে। নভেম্বরে অসময়ের বৃষ্টিতে তিনি ক্ষতির মুখে পড়েছেন।
ইতিমধ্যে ময়মনসিংহের বিভিন্ন এলাকায় আমন ধান কাটতে শুরু করেন কৃষকেরা। এ ছাড়া শীত মৌসুমকে সামনে রেখে কৃষকেরা সবজি চাষ শুরু করেছেন। ব্রহ্মপুত্র নদের চরাঞ্চলগুলোতে বিপুল পরিমাণ সবজির আবাদ হয়। তবে নভেম্বরের শুরুতে টানা বৃষ্টি এসব ফসলের ওপর প্রভাব পড়বে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। এর প্রভাব বাজারেও পড়তে পারে।
কৃষি বিভাগ জানিয়েছে, জেলার ১৩টি উপজেলায় চলতি আমন মৌসুমে ২ লাখ ৬৮ হাজার ১১০ হেক্টর জমিতে ধানের আবাদ করা হয়েছে। এবার শর্ষে চাষের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৪১ হাজার ৬৫০ হেক্টর জমিতে। কিন্তু বৃষ্টির কারণে শর্ষে আবাদ করা যাচ্ছে না। ২১ হাজার ৬০০ হেক্টর জমিতে শাকসবজি আবাদের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। ইতিমধ্যে ৫ হাজার হেক্টর জমিতে সবজি আবাদ হয়েছে। বৃষ্টির কারণে বাঁধাকপি, ফুলকপি, করলা, চিচিঙ্গা, মিষ্টিকুমড়া, চালকুমড়ার কিছুটা সমস্যা হতে পারে। বৃষ্টি দীর্ঘায়িত হলে ক্ষতির পরিমাণ বাড়তে পারে।
নভেম্বরের বৃষ্টি ফসলের জন্য কতটা ক্ষতির জানতে চাইলে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষিতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক মো. পারভেজ আনোয়ার বলেন, নিম্নচাপের কারণে প্রচুর বৃষ্টি হয়েছে। নভেম্বরে এমন বৃষ্টি অপ্রত্যাশিত। ইতিমধ্যে আমন ধান কাটা শুরু হয়েছে। কৃষকেরা ধান শুকাতে সমস্যায় পড়বেন। যাঁরা কাটতে পারেননি, তাঁদের জমিতে পানি ওঠায় ধানের অপচয় বেশি হবে। রবি ফসলের ক্ষেত্রে ভুট্টা, ডাল-জাতীয় শস্য ও শর্ষে লাগানো দেরি হয়ে যাবে। ফসল লাগাতে দেরি হলে পরে বোরো ফসল লাগাতেও দেরি হয়ে যাবে।
অধ্যাপক পারভেজ আনোয়ার প্রথম আলোকে বলেন, শীতকালীন সবজি যাঁরা দেরিতে লাগাচ্ছেন, তাঁদের চারা নষ্ট হয়ে যাবে। আগাম যাঁরা আবাদ করেছেন, অতিবৃষ্টির কারণে পচে যাবে এবং রোগবালাই ও পোকার আক্রমণও বাড়বে। সব মিলিয়ে ধান, রবি শস্য ও শীতকালীন সবজি—সবকিছুই ক্ষতিগ্রস্ত হবে অসময়ের বৃষ্টির কারণে।
কৃষক শাম্মত আলী বলেন, ‘কয়েক দিন আগে মরিচ বুনছিলাম। বৃষ্টিতে সব পইচ্চা গেছে। আমার সব ফসল নষ্ট হয়ে গেছে। সব গাইব হয়ে গেছে। আষাঢ় মাসেও এমন বৃষ্টি হয় না, যে বৃষ্টি হইছে। এমন বৃষ্টি হওয়ার কোনো সম্ভাবনা আছিন না। এমন সময়ে ছিডাছাডা বৃষ্টি হইলেও এমন বৃষ্টি আর কখনো হয় নাই।’
গতকাল শনিবার রাত আড়াইটা থেকে রোববার সকাল ৬টা ২০ মিনিট পর্যন্ত ময়মনসিংহ জেলায় ৬৪ মিলিমিটার বৃষ্টি রেকর্ড করা হয়েছে। ময়মনসিংহ আবহাওয়া কার্যালয়ের উচ্চ পর্যবেক্ষক মনিরুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, নিম্নচাপের প্রভাবে বৃষ্টি হচ্ছে। গত শুক্রবার দিবাগত রাত ৪টা ২৫ মিনিট থেকে বৃষ্টি শুরু হয়। আগামী মঙ্গলবার পর্যন্ত হালকা থেকে মাঝারি বৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এরপর বৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে।
ময়মনসিংহ শহরের দীঘারকান্দা এলাকার লাল মিয়া বলেন, ‘২ কাডা জমিতে শাকসবজি করছিলাম। বৃষ্টিতে সব ক্ষতি হইয়া গেছে। এমন টাইমে তো বৃষ্টি হয় না।’
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের ময়মনসিংহ কার্যালয়ের উপপরিচালক মো. এনামুল হক প্রথম আলোকে বলেন, নভেম্বর মাসের শুরুতে বৃষ্টি হওয়ায় সবজি লাগানো কিছুটা পিছিয়ে যেতে পারে। শর্ষে আবাদের যে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে, বৃষ্টির কারণে লাগাতে দেরি হলে অর্জন কিছুটা কম হবে। এখন শর্ষে আবাদের ভালো সময়। এ সময় শর্ষের বীজ বুনতে না পারলে আবাদ কমে যাবে। বৃষ্টি কয়েক দিনের মধ্যে থেমে গেলে তেমন ক্ষতি হবে না।