অন্তর্বর্তী সরকারের ৬ মাস: শেখ হাসিনাসহ ১২৯ প্রভাবশালীর বিরুদ্ধে দুদকের মামলা
Published: 9th, February 2025 GMT
আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তাঁর পরিবারের সদস্যসহ ১২৯ প্রভাবশালী ব্যক্তির বিরুদ্ধে মামলা করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। গত ছয় মাসে এসব মামলা করা হয়। দুদকের সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
প্রকল্পের টাকা আত্মসাৎ ও প্লট জালিয়াতির ঘটনায় ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, তাঁর বোন শেখ রেহানা ও তাঁদের পরিবারের সদস্যের বিরুদ্ধে জানুয়ারি মাসে নয়টি মামলা করেছে দুদক। এ ছাড়া জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জন, বিদেশে টাকা পাচার, টাকা আত্মসাৎ ও জালজালিয়াতির ঘটনায় শেখ হাসিনার উপদেষ্টা, সংসদ সদস্য, আমলা ও পুলিশ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ১২০টি মামলা করা হয়।
৫ আগস্ট ছাত্র–জনতার অভ্যুত্থানের মুখে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান শেখ হাসিনা। এরপর তাঁর পরিবার ও তাঁর শাসনামলের সাবেক মন্ত্রী, সংসদ সদস্যসহ ২৪৯ প্রভাবশালী ব্যক্তির বিরুদ্ধে অনুসন্ধান শুরু হয়। অনুসন্ধান শেষে ১২৯ জনের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়।
দুদক সূত্র জানায়, অনুসন্ধান ও মামলা ছাড়াও দুদক বিতর্কিত ব্যবসায় গ্রুপ এস আলম, বেক্সিমকোসহ বেশ কিছু প্রভাবশালী প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তির সম্পদ জব্দ করেছে। গ্রেপ্তার করেছে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর সিতাংশু কুমার (এস কে) সুরসহ পাঁচজন প্রভাবশালী ব্যক্তিকে।
দুদকের মহাপরিচালক (প্রতিরোধ) আক্তার হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, শেখ হাসিনাসহ আড়াই শতাধিক প্রভাবশালী ব্যক্তির বিরুদ্ধে দুদকের অনুসন্ধান চলছে। অনুসন্ধান শেষে অনেকের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে।
হাসিনা ও তাঁর পরিবারের বিরুদ্ধে মামলা–অনুসন্ধানতথ্য গোপন ও ক্ষমতার অপব্যবহারের মাধ্যমে ঢাকার পূর্বাচল নতুন শহর প্রকল্পে ১০ কাঠা করে মোট ২০ কাঠার প্লট বরাদ্দ নেওয়ার অভিযোগে শেখ হাসিনা ও তাঁর ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়ের বিরুদ্ধে গত ১৪ জানুয়ারি পৃথক দুটি মামলা করেছে দুদক। একই অভিযোগে শেখ রেহানা ও তাঁর মেয়ে আজমিনা সিদ্দিক (রূপন্তী) এবং ছেলে রাদওয়ান মুজিব সিদ্দিকের (ববি) বিরুদ্ধে পৃথক তিনটি মামলা করা হয়। এই তিন মামলায় রেহানার আরেক মেয়ে ব্রিটিশ পার্লামেন্টের সদস্য টিউলিপ রিজওয়ানা সিদ্দিক এবং রেহানার বোন ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে আসামি করা হয়।
তিনটি বিমানবন্দরের চার প্রকল্পে ৮১২ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে শেখ হাসিনার সামরিক উপদেষ্টা তারিক আহমেদ সিদ্দিকসহ ১৯ জনের বিরুদ্ধে চারটি মামলা করা হয়।
ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী ও তাঁর পরিবারের দুর্নীতির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়াটা জনগণ প্রত্যাশা করে। কাউকে ছাড় না দিয়ে দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা নিতে হবে। ইফতেখারুজ্জামান, নির্বাহী পরিচালক, টিআইবিক্ষমতার অপব্যবহার করে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া অঞ্চলের পরিচালক হয়েছিলেন সায়মা ওয়াজেদ পুতুল। এই অভিযোগের অনুসন্ধান শুরু হয়েছে। এ ছাড়া তাঁর সূচনা ফাউন্ডেশন ও আওয়ামী লীগের গবেষণাপ্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর রিসার্চ অ্যান্ড ইনফরমেশনের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান শুরু হয়েছে। পাশাপাশি গাজীপুরে শেখ হাসিনা ও তাঁর পরিবারের বাগানবাড়ি নিয়েও অনুসন্ধান শুরু হয়েছে।
দুদক সূত্র জানায়, গত ১৫ বছরে বড় প্রকল্পে দুর্নীতি হয়েছে। এসব দুর্নীতিতে শেখ হাসিনা ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের নাম এসেছে।
মন্ত্রী, এমপি, আমলা ও পুলিশের বিরুদ্ধে মামলাদুদক সূত্র জানায়, আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর দুদক প্রথম মামলা করে সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধে। ঘুষ গ্রহণ ও দুর্নীতির অভিযোগে গত ৯ অক্টোবর তাঁদের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়।
অনিয়ম–দুর্নীতি, ক্ষমতার অপব্যবহারের অভিযোগে সর্বশেষ বুধবার সাবেক শ্রম ও কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী মন্নুজান সুফিয়ানের বিরুদ্ধে মামলা করেছে দুদক। এর আগে ২ ফেব্রুয়ারি সাবেক নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খানের বিরুদ্ধে ১১ কোটি ৩৬ লাখ ৫১ হাজার টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে মামলা হয়।
জ্ঞাত আয়বহির্ভূত প্রায় ৯ কোটি টাকার সম্পদ অর্জনের অভিযোগে ৩ জানুয়ারি সাবেক সমাজকল্যাণমন্ত্রী নুরুজ্জামান আহমেদ ও তাঁর স্ত্রী মোছা.
সাবেক মন্ত্রী, সংসদ সদস্য ছাড়াও সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব কবির বিন আনোয়ার ও পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বেনজীর আহমেদসহ একাধিক আমলা ও পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধ মামলা করেছে দুদক।
১৬ হাজার ব্যক্তির বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগদুদকের সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, গত বছর প্রায় ১৬ হাজার ব্যক্তির বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ পেয়েছে দুদক। এর মধ্যে ৮০ ভাগ অভিযোগ এসেছে আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর। এসব থেকে ১ হাজার ৮৯৪টি অভিযোগ অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত হয়। অনুসন্ধান শেষে মামলা হয়েছে ৩৩৭টি। মামলা তদন্ত শেষে আদালতে ১৪৬টি অভিযোগপত্র দাখিল করা হয়েছে।
দুদকের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, আওয়ামী লীগ সরকারের প্রভাবশালী সাবেক মন্ত্রী, সংসদ সদস্য ছাড়া আমলা, পুলিশ, বিভিন্ন সরকারি দপ্তর, অধিদপ্তরের শীর্ষ কর্মকর্তা, বড় বড় প্রকল্পের পরিচালকদের দুর্নীতির অভিযোগ পাওয়া গেছে।
জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগে মামলাদুদক সূত্র জানায়, গত এক বছরে বিভিন্ন অভিযোগে ৩৩৭টি মামলা হয়েছে। এসব মামলায় আসামি করা হয়েছে চাকরিজীবী, ব্যবসায়ী, রাজনীতিবিদ ও জনপ্রতিনিধিসহ ৪৪৯ জনকে। সবচেয়ে বেশি ১৮২টি মামলা হয়েছে জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগে। আত্মসাতের অভিযোগে মামলা হয়েছে ১২৭টি। মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইনে মামলা হয়েছে ৩৬টি, জালিয়াতির ঘটনায় মামলা হয়েছে ২১টি।
দুদক বলছে, তদন্ত শেষে গত বছর ৩৫৪টি মামলায় অভিযোগপত্র দেওয়া হয়েছে। চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেওয়া হয়েছে ৪৮টি মামলায়।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী ও তাঁর পরিবারের দুর্নীতির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়াটা জনগণ প্রত্যাশা করে। কাউকে ছাড় না দিয়ে দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা নিতে হবে। যদি দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা নেওয়া না হয়, তাহলে দুদক নিয়ে আবার মানুষের হতাশা বাড়বে।
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: জ ঞ ত আয়বহ র ভ ত র পর ব র র সদস য স ব ক মন ত র ল গ সরক র প রকল প ব যবস থ আওয় ম
এছাড়াও পড়ুন:
জ্ঞাত আয়বহির্ভূত ৫ কোটি টাকার সম্পদ অর্জনের অভিযোগে আসাদুজ্জামান নূরের বিরুদ্ধে দুদকের মামলা
জ্ঞাত আয়বহির্ভূত প্রায় সাড়ে পাঁচ কোটি টাকার সম্পদ অর্জন ও দেড় শ কোটি টাকার সন্দেহজনক লেনদেনের অভিযোগে সাবেক সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রী ও অভিনেতা আসাদুজ্জামান নূরের বিরুদ্ধে মামলা করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।
আজ বুধবার দুদকের ঢাকা সমন্বিত জেলা কার্যালয়ে সংস্থার উপপরিচালক মো. আজিজুল হক বাদী হয়ে মামলাটি করেন। দুদকের উপপরিচালক (জনসংযোগ) মো. আকতারুল ইসলাম প্রথম আলোকে এ তথ্য নিশ্চিত করেন।
মামলার এজাহারে বলা হয়েছে, আসাদুজ্জামান নূর ক্ষমতার অপব্যবহার করে ৫ কোটি ৩৭ লাখ ১ হাজার ১৯০ টাকার জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জন করেছেন এবং তা নিজের দখলে রেখেছেন। এ ছাড়া আসাদুজ্জামান নূরের নামে থাকা বিভিন্ন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ১৯টি হিসাবে ১৫৮ কোটি ৭৮ লাখ ৪৭ হাজার ৮৯৮ টাকার সন্দেহজনক লেনদেন হয়েছে। এই লেনদেনের মাধ্যমে অর্থ স্থানান্তর, রূপান্তর ও হস্তান্তরের অভিযোগ আনা হয়েছে, যা মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন ও দুদক আইনে শাস্তিযোগ্য অপরাধ।
দুদকের অনুসন্ধানে আরও জানা যায়, ২০০৩-০৪ করবর্ষ থেকে ২০২৩-২৪ করবর্ষ পর্যন্ত আসাদুজ্জামান নূরের বৈধ আয় ছিল ৩২ কোটি ৯৬ লাখ ৮৩ হাজার ৬৮৮ টাকা। এ সময়ে তাঁর পারিবারিক ব্যয় ছিল ৯ কোটি ৩২ লাখ ২৫ হাজার ৭৬১ টাকা। সে অনুযায়ী নিট সঞ্চয় দাঁড়ায় ২৩ কোটি ৬৪ লাখ ৫৭ হাজার ৯২৭ টাকা। অথচ তাঁর অর্জিত স্থাবর ও অস্থাবর সম্পদের পরিমাণ ২৯ কোটি ১ লাখ ৫৯ হাজার ১১৭ টাকা। এতে ৫ কোটি ৩৭ লাখ টাকার উৎস পাওয়া যায়নি বলে দুদক জানিয়েছে।
এজাহারে আরও বলা হয়েছে, আসাদুজ্জামান নূরের বিভিন্ন ব্যাংক হিসাবে ৮৫ কোটি ৭২ লাখ ৬৬ হাজার ৫৯৩ টাকা জমা এবং ৭৩ কোটি ৫ লাখ ৮১ হাজার ৩০৫ টাকা উত্তোলন হয়েছে। এসব লেনদেনের উৎস অস্পষ্ট।
২০০১ সালে নীলফামারী-২ আসন থেকে আওয়ামী লীগের মনোনয়নে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন আসাদুজ্জামান নূর। এরপর ২০০৮, ২০১৪, ২০১৮ ও সর্বশেষ ২০২৪ সালের দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও তিনি নির্বাচিত হন। ২০১৪ সালে দশম সংসদ নির্বাচনের পর সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রীর দায়িত্ব পান তিনি।
২০২৪ সালের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর সাবেক মন্ত্রী ও এমপিদের বিরুদ্ধে একে একে মামলা ও গ্রেপ্তার শুরু করে দুদক ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থাগুলো। তারই ধারাবাহিকতায় গত ১৫ সেপ্টেম্বর রাতে রাজধানীর বেইলী রোডে নিজ বাসা থেকে আসাদুজ্জামান নূরকে গ্রেপ্তার করা হয়।