খেতের আলু তোলার আগেই হিমাগারে সংরক্ষণের স্লিপ শেষ, বিপাকে কৃষক
Published: 16th, February 2025 GMT
গত মৌসুমে আলুর দাম ভালোই পেয়েছেন ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলার বড়গাঁও গ্রামের কৃষক মোহাম্মদ আলম। আর এতেই এবার আরও দুই একর বেশি জমিতে আলু আবাদ করেছেন তিনি। কয়েক দিনের মধ্যেই সেই আলু তোলার উপযোগী হবে। কিন্তু বাজারে এখন দাম কম থাকায় খেতের আলু হিমাগারে সংরক্ষণের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তিনি। তাই আগাম স্লিপের আশায় একের পর এক হিমাগারে হন্যে হয়ে ঘুরে বেড়িয়েছেন। কিন্তু কোথাও স্লিপ পাননি। উপায়ন্তর না দেখে আলু সংরক্ষণের হাল ছেড়ে দিয়েছেন আলম। এই কৃষকের দাবি, হিমাগার কর্তৃপক্ষের যোগসাজশে মজুতকারীরা আলু সংরক্ষণের স্লিপ আগেভাগেই হাতিয়ে নিয়েছেন। ফলে সাধারণ আলুচাষিরা বঞ্চিত হচ্ছেন।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর ঠাকুরগাঁও কার্যালয় সূত্রমতে, চলতি মৌসুমে জেলায় ২৭ হাজার ৫০০ হেক্টর (১ হেক্টর সমান ২ দশমিক ৪৭ একর) জমিতে আলু আবাদের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়। কিন্তু আবাদ হয়েছে ৩৪ হাজার ৭২৫ হেক্টরের বেশি জমিতে। আর এ থেকে পাওয়া যাবে ৮ লাখ ৬৮ হাজার ১২৫ টন আলু। অন্যদিকে আলু সংরক্ষণের জন্য জেলায় ১৭টি হিমাগার রয়েছে। এসব হিমাগারের ১ লাখ ৪৫ হাজার ৫৩২ টন আলু সংরক্ষণ করা যায়। ফলে চাষিদের উৎপাদিত অধিকাংশ আলুই থেকে যাচ্ছে সংরক্ষণের বাইরে। সংরক্ষণের সুযোগ না পেয়ে কৃষক তাঁদের খেতের আলু বাজারে বিক্রি করে দেন। আর এতেই বাজারে আলুর দাম আরও কমে যাবে।
হিমাগারে আলু রাখার জন্য দুই রকমের বুকিং পদ্ধতি রয়েছে—‘লুজ বুকিং’ ও ‘পেইড বুকিং’। লুজ বুকিং হলো আলু বিক্রি করে হিমাগারের মালিককে ভাড়া শোধ করতে হয়। এবার লুজ বুকিংয়ের রেট হচ্ছে ৫০ কেজি ওজনের এক বস্তা আলু ৪০০ টাকা (প্রতি কেজি আলুর জন্য ৮ টাকা)। তবে জেলার কোনো হিমাগার পেইড বুকিং নেয় না। আলু সংরক্ষণ করতে হিমাগার কর্তৃপক্ষ আগাম স্লিপ বিতরণ করে। এসব স্লিপ নিতে প্রতি বস্তা আলুর বিপরীতে কৃষককে ৫০ থেকে ১০০ টাকা আগাম গুনতে হচ্ছে।
সদর উপজেলার হিমাদ্রী, হাওলাদার, শাহীসহ কয়েকটি হিমাগারে সরেজমিন দেখা যায়, আলু সংরক্ষণের স্লিপ সংগ্রহ করতে একের পর এক কৃষকেরা আসছেন। কিন্তু স্লিপ না পেয়ে তাঁরা ফিরে যাচ্ছেন। কৃষকদের অভিযোগ, প্রকৃত কৃষকেরা আলু সংরক্ষণের স্লিপ সংগ্রহ করতে পারেননি। আর এতে কৃষকেরা তাঁদের উৎপাদিত আলু খেত থেকে তোলার সঙ্গে সঙ্গে বিক্রি করে দিতে বাধ্য হবেন। তাঁরা আগামী মৌসুমের জন্য বীজ আলুও সংরক্ষণ করতে পারবেন না।
বালিয়াডাঙ্গী উপজেলার সাহবাজপুর গ্রামের কৃষক লুৎফর রহমান এবার ছয় একর জমিতে আলু আবাদ করেছেন। আলু সংরক্ষণের স্লিপের সংকটের খবর পেয়ে শহরের কয়েকটি হিমাগার কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। কিন্তু কোনো স্লিপের ব্যবস্থা করতে পারেননি। আজ রোববার সকালে তিনি অভিযোগ করে বলেন, হিমাগার কর্তৃপক্ষ প্রকৃত চাষিদের নয়, কেবল মজুতদার ও ব্যবসায়ীদের কাছে আলু রাখার স্লিপ বিক্রি করেছেন। ফলে এলাকার চাষিরা হিমাগারে আলু রাখার সুযোগ পাচ্ছেন না। এতে আলু আবাদ করে এবার তাঁরা ব্যাপক লোকসানের মুখে পড়বেন।
সদর উপজেলার বালিয়া গ্রামের কৃষক শুকানু রায় বলেন, ‘কুনো স্টোরত (হিমাগারে) যাওনি কহো? কুনঠেই স্লিপ পাওনি। স্লিপ পাওয়া না গেইলে আলুলা কম দামতেই বিকাবা (বিক্রি) হবে। লসের কথা ভাবিয়া মাথাখান অ্যালাই নষ্ট হয়া যাছে।’ বালিয়াডাঙ্গী উপজেলার মহাজনপাড়া গ্রামের আলুচাষি আবদুর বাসেদ বলেন, ‘খেত থাকিয়া আলুই উঠিলনি, অ্যালাই স্টোরের স্লিপ নাই। এইখান কথা হইল? এর পেছনত স্টোরের মালিকলার কারসাজি আছে।’
গতকাল শনিবার ঠাকুরগাঁও-পঞ্চগড় মহাসড়কের উত্তরবঙ্গ হিমাগারের সামনে গিয়ে দেখা যায়, সেখানে আলুর আগাম স্লিপ নিতে পঞ্চগড়ের আটোয়ারীর সুবল রায়, আবদুল খলিল, বোদার শরিফুল ইসলাম, ঠাকুরগাঁও সদরের দেবীপুর গ্রামের রমজান আলী, বড়গাঁওয়ের আফাজউদ্দীন, গড়েয়ার কশিরুল হক ও ভুল্লীর নারায়ণ বর্মণসহ কয়েকজন আলুচাষি এসেছেন। সদরের দেবীপুর গ্রামের রমজান আলী বলেন, ‘এইঠেও (এই হিমাগারে) স্লিপ পানুনি। সবাই খালি হাতত ফিরে যাছে। স্টোরত আলুর বীজলা রাখিবা পারিলে তা–ও হয়। আলুর বীজলা রাখিবা না পারিলে বেশি দামে বীজ কিনিবা হবে। এতে আলু আবাদ করা কঠিন হয়া যাবে।’
গত বুধবার সদর উপজেলার আউলিয়াপুর এলাকার শাহী হিমাগারে আলু সংরক্ষণের স্লিপ সংগ্রহ করতে যান একদল কৃষক। স্লিপ না পেয়ে তাঁদের সঙ্গে হিমাগার কর্তৃপক্ষের বাগ্বিতণ্ডা হয়। একপর্যায়ে কৃষকেরা হিমাগারে হামলা চালান। সে সময় আলুচাষি আবদুস সাত্তার অভিযোগ করে বলেন, ‘এ বছর আলুর দাম নেই। তার ওপর আবার আলু রাখার রেট বাড়ানো হয়েছে। হিমাগারে আলু রেখে পরে বেশি দামে বিক্রি করব, সে উপায়ও নেই। হিমাগারের মালিকেরা কৃষকদের আগাম বুকিংয়ের স্লিপ দিচ্ছেন না।’
আজ দুপুরে সদর উপজেলার দৌলতপুর এলাকায় আমানত হিমাগারে গিয়ে দেখা যায়, কয়েকজন কৃষক অপেক্ষা করছেন। এ সময় হিমাগারের ব্যবস্থাপক শান্তনু মজুমদার বলেন, ‘আলু সংরক্ষণে আমরা আগাম স্লিপ ছাড়িনি। যাঁরা আগে আসবেন, তাঁরাই আলু সংরক্ষণে সুযোগ পাবেন। এই হিমাগারে দুই লাখ বস্তা আলু সংরক্ষণ করা যায়। ৭০ হাজার বস্তা বীজ উৎপাদন কোম্পানির জন্য বরাদ্দ রেখে বাকিটা ২৫ ফেব্রুয়ারি কৃষকের জন্য ছেড়ে দেওয়া হবে।’
এ বিষয়ে সেলিম রেজা গ্রুপের (শাহী হিমাগার লিমিটেড) ব্যবস্থাপনা পরিচালক দেলোয়ার হোসেন জানান, ঠাকুরগাঁও জেলায় তাঁদের প্রতিষ্ঠানের চারটি হিমাগার রয়েছে। সব হিমাগারেই আগাম বুকিংয়ের স্লিপ শেষ হয়ে গেছে। যেসব কৃষক বছরের পর বছর আলু সংরক্ষণ করেন, তাঁদের অগ্রাধিকার দেওয়া হয়। গত মৌসুমের তুলনায় চলতি মৌসুমে ব্যাপক কৃষক জমিতে আলু আবাদ করেছেন। উৎপাদিত আলুর তুলনায় ধারণক্ষমতা কম হওয়ায় হিমাগারগুলোয় জায়গার সংকট দেখা দিতে পারে।
এ বিষয়ে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর ঠাকুরগাঁও কার্যালয়ের উপপরিচালক সিরাজুল ইসলাম জানান, আলু আবাদের ক্ষেত্রে হিমাগারের জায়গাসংকট একটি মারাত্মক সমস্যা। বীজ আলু সংরক্ষণের জন্য কৃষকদের সুবিধা দিতে হবে। কৃষকেরা তাঁদের বীজ আলু হিমাগারে সংরক্ষণে ব্যবস্থা করতে না পারলে পরের মৌসুমে আলুর আবাদ কমে যাওয়ার আশঙ্কা আছে।
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: সদর উপজ ল র ব যবস থ আল চ ষ র জন য কর ছ ন উৎপ দ
এছাড়াও পড়ুন:
শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস আজ
‘উদয়ের পথে শুনি কার বাণী/ ভয় নাই ওরে ভয় নাই/ নিঃশেষে প্রাণ যে করিবে দান/ ক্ষয় নাই তার ক্ষয় নাই’। তাঁদের নিঃশেষে প্রাণদানের স্মৃতি আজ গভীর বেদনায় স্মরণ করবে জাতি। আজ থেকে ৫৪ বছর আগে দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তান বুদ্ধিজীবীরা হানাদার পাকিস্তান সেনাবাহিনীর নীলনকশার শিকার হয়ে নির্মম হত্যার শিকার হয়েছিলেন।
অমিত বিক্রম বাঙালির জীবনপণ যুদ্ধে হানাদার পাকিস্তানি বাহিনীর চূড়ান্ত পরাজয় তখন ছিল কেবল দিনগণনার বিষয়। সেই অনিবার্য পরাজয়ের প্রাক্কালে মরণকামড় দেওয়ার চেষ্টা করেছিল ঘাতক বাহিনী। স্বাধীনতা অর্জন করলেও বাঙালি জাতি যেন মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে না পারে, সেই চক্রান্ত করেছিল তারা। দেশের সেরা বুদ্ধিজীবীদের তালিকা করে তাঁদের বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে গিয়ে নির্মম নির্যাতন করে হত্যা করা হয়েছিল। এ কাজে পাকিস্তানি সেনাদের সরাসরি সহায়তা করেছিল তাদের মিত্র এ দেশি রাজাকার, আলবদর বাহিনী। এরাই ঘাতক সেনাদের নিয়ে গিয়ে চিনিয়ে দিয়েছে বুদ্ধিজীবীদের বাড়ি। চিনিয়ে দিয়েছে সেই নিরীহ মানুষগুলোকে।
মহান মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ে পরে মিরপুরে রায়েরবাজার পরিত্যক্ত ইটখোলা ও মিরপুরে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে যাওয়া সেসব বুদ্ধিবৃত্তিক পেশায় যুক্ত মানুষের মরদেহগুলো উদ্ধার করা হয়। তাঁদের অনেকের ছিল পিছমোড়া করে হাত ও চোখ বাঁধা। ভয়ানক নির্যাতনের চিহ্ন ছিল শরীরে। তাঁদের মরদেহ উদ্ধার হওয়ার মধ্য দিয়ে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বুদ্ধিজীবী হত্যার গভীর ষড়যন্ত্র প্রকাশ হয়ে পড়ে। এর পর থেকেই শহীদ বুদ্ধিজীবীদের প্রতি শ্রদ্ধা ও শোক প্রকাশ করে ১৪ ডিসেম্বর শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস পালিত হয়ে আসছে।
শুধু ঢাকাতেই নয়, সারা দেশেই বুদ্ধিবৃত্তিক কাজে যুক্ত মানুষদের হত্যা করেছিল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী। এই হত্যাকাণ্ডের ছিল দুটি পর্যায়। ‘অপারেশন সার্চলাইট’ নামে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে হানাদার সেনারা রাজধানীতে গণহত্যা শুরু করেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও আশপাশের এলাকায় সাধারণ নিরীহ জনসাধারণের পাশাপাশি শিক্ষক, চিকিৎসকদেরও হত্যা করে। এরপর থেকে হানাদাররা সারা দেশের শিক্ষক, চিকিৎসক, প্রকৌশলী, আইনজীবী, শিল্পী, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, গবেষক, সংস্কৃতিসেবীসহ মেধা মনন সৃজনশীল কাজে যুক্ত মানুষদের বেছে বেছে হত্যা করতে থাকে। মুক্তিযুদ্ধে শেষ পর্যায় তারা এই বুদ্ধিবৃত্তিক মানুষদের নিঃশেষ করে দেওয়ার জন্য তালিকা করে হত্যা চালাতে থাকে। তাঁদের মধ্যে যেমন প্রবীণ প্রাজ্ঞজনেরা ছিলেন, তেমনি ছিলেন উদিত যৌবনের বহু সম্ভাবনাময় তরতাজা প্রাণ। আজ তাঁদের স্মৃতির স্মরণ করা হবে সারা দেশে।
শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন ও প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস পৃথক বাণী দিয়েছেন।
কর্মসূচিশহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস পালন উপলক্ষে অনুষ্ঠিত আন্তমন্ত্রণালয়ের সভায় জানানো হয়েছে, আজ রোববার সকাল ৭টা ৫ মিনিটে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন এবং ৭টা ৬ মিনিটে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস মিরপুর শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধে পুষ্পস্তবক অর্পণ করবেন। তাঁরা জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানিয়ে সেখানে নীরবে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকবেন। এ সময় বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর একটি চৌকস দল রাষ্ট্রপতি ও প্রধান উপদেষ্টাকে রাষ্ট্রীয় স্যালুট প্রদান করবে।
রাষ্ট্রপতি ও প্রধান উপদেষ্টার পুষ্পস্তবক অর্পণের পর মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক উপদেষ্টা ফারুক-ই-আজম, মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয়ের সচিব ইসরাত চৌধুরী, শহীদ বুদ্ধিজীবী পরিবারের সদস্য এবং হুইলচেয়ারধারী যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধারা মিরপুর শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধে পুষ্পস্তবক অর্পণ করবেন।