সংস্কার ও নির্বাচনের মধ্যে দ্বন্দ্ব নেই: বদিউল আলম মজুমদার
Published: 17th, February 2025 GMT
সংস্কার এবং নির্বাচনের মধ্যে কোনো ধরনের দ্বন্দ্ব নেই বলে মনে করেন জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সদস্য ও সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার।
তিনি বলেছেন, সাম্প্রতিক সময়ে নির্বাচন হবে নাকি সংস্কার হবে– তা নিয়ে আলাপ–আলোচনা হচ্ছে। এই দুটি বিষয়ের মধ্যে কোনো দ্বন্দ্ব দেখছি না। একটার বিপরীতে আরেকটা নয়। দুটোই দরকার। নির্বাচন হতে হবে, সেইসঙ্গে সংস্কার হতে হবে। আমাদের নির্বাচন সুষ্ঠু এবং নিরপেক্ষ হতে হবে।
সোমবার দুপুরে রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে আয়োজিত এক ‘সম্প্রীতি সংলাপে’ তিনি এসব কথা বলেন। ‘দি হাঙ্গার প্রজেক্ট’ এর আয়োজন করে। সার্বিক সহযোগিতায় ছিল ‘ইউকেএইড’।
এই নির্বাচনকে গ্রহণযোগ্য করতে এবং সবার ভোটাধিকার নিশ্চিত করতে সংস্কার দরকার। কেননা যে পদ্ধতি ভেঙে পড়েছে, তা জোড়া লাগাতে হবে। তাই সংস্কার ছাড়া নির্বাচন হলে তা গ্রহণযোগ্য হবে না, গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া টেকসই হবে না।
অনুষ্ঠানে বদিউল আলম মজুমদার বলেন, আমরা নতুন বাংলাদেশের দ্বিতীয় পর্বে আমরা অবস্থান করছি। আমরা কতগুলো সংস্কার প্রস্তাব দিয়েছি। এসব প্রস্তাব বাস্তবায়ন করতে হবে। আমাদের রাষ্ট্র ভঙ্গুর হয়ে গেছে। চারদিকে অনেক অসংগতি। এদেশের নির্বাচনী সংস্কৃতি ভেঙে গেছে। এদেশের নির্বাচনী ও রাজনৈতিক অঙ্গন পরিচ্ছন্ন করতে হবে। টাকার খেলা বন্ধ করতে হবে। রাষ্ট্রীয় ও সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে কার্যকর করতে হবে। ভোটের অধিকারকে নিশ্চিত করতে হবে।
তিনি আরো বলেন, বর্তমানে আমাদের দেশের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অপপ্রচার চালানো হচ্ছে। কিন্তু আমরা যদি জাতি, ধর্ম, বর্ণ সবাই মিলে ঐক্যবদ্ধ থাকি, তাহলে আমরা শক্তিশালী হবো, কোনো অপপ্রচার চালিয়ে আমাদেরকে পিছিয়ে রাখা যাবে না।
অনুষ্ঠানে অন্যদের মধ্যে বক্তব্য দেন হাঙ্গার প্রজেক্টের ইন্টেরিম কান্ট্রি ডিরেক্টর প্রশান্ত ত্রিপুরা, ইসলামিক ফাউন্ডেশনের পরিচালক মুহাম্মদ রফিক-উল ইসলাম, চার্চ অব ইংল্যান্ডের পলিসি অ্যাডভাইজার ড.
এছাড়া দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে আগত বিভিন্ন ধর্মীয় নেতৃত্ব, নাগরিক সমাজের প্রতিনিধি এবং তরুণদের প্রতিনিধিবৃন্দ আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন। অনুষ্ঠানটি উপস্থাপনা করেন হাঙ্গার প্রজেক্ট বাংলাদেশের সিনিয়র প্রোগ্রাম ম্যানেজার শশাঙ্ক বরণ রায়।
অনুষ্ঠানের শেষভাগে সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠায় তরুণদের সফলতার গল্প নিয়ে প্রকাশিত ‘ঐকতান’ নামের একটি প্রকাশনার মোড়ক উন্মোচন করা হয়।
ইউকেএইডের সহযোগিতায় ও দি হাঙ্গার প্রজেক্টের আয়োজনে বাংলাদেশে সম্প্রীতির সুদীর্ঘ ঐতিহ্য বিস্তৃত করতে নাগরিক সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে ‘এজেন্ট অব চেঞ্জ: এ বাংলাদেশ ফ্রিডম অব রিজিয়ন অর বিলিভ লিডারশিপ ইনিশিয়েটিভ’ কর্মসূচি পরিচালনা করা হয়েছে। এরই অংশ হিসেবে দেশের আটটি জেলায় ধর্ম ও বিশ্বাসের স্বাধীনতা এবং সামাজিক সম্প্রীতি সুরক্ষায় তরুণ স্বেচ্ছাব্রতীদের উদ্যোগে বিভিন্ন কর্মসূচি পরিচালিত হচ্ছে।
উৎস: Samakal
এছাড়াও পড়ুন:
সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের দায়িত্ব সবার
প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এ এম এম নাসির উদ্দীন গতকাল বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করেছেন। আগামী ১২ ফেব্রুয়ারি জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সঙ্গে গণভোটও অনুষ্ঠিত হবে। সিইসির তফসিল ঘোষণার মধ্য দিয়ে জাতি আনুষ্ঠানিকভাবে নির্বাচনী যাত্রায় প্রবেশ করল।
চব্বিশের ছাত্র-জনতার আত্মত্যাগ স্বৈরতান্ত্রিক শাসনের জোয়াল ভেঙে দেশকে গণতান্ত্রিক পথে নিয়ে যাওয়ার যে বড় সুযোগ তৈরি করে দিয়েছে, সেই পরিপ্রেক্ষিতে এই নির্বাচন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণের প্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরই হবে অন্তর্বর্তী সরকার ও নির্বাচন কমিশনের সবচেয়ে বড় দায়িত্ব ও চ্যালেঞ্জ।
প্রধান নির্বাচন কমিশনার তাঁর ভাষণে একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের জন্য রাজনৈতিক দল, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্তব্য স্মরণ করিয়ে দেন। প্রার্থীদের আচরণবিধি মেনে চলার আহ্বান জানান। নির্বাচনের যে রোডম্যাপ তিনি ঘোষণা করেছেন, সে অনুযায়ী, ২৯ ডিসেম্বর মনোনয়নপত্র দাখিলের শেষ দিন। এরপর মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার, বাছাই, আপিল নিষ্পত্তি শেষে চূড়ান্ত প্রার্থী তালিকা প্রকাশ ও প্রতীক বরাদ্দ করা হবে আগামী ২১ জানুয়ারি। প্রার্থীরা নির্বাচনী প্রচারণা চালাতে পারবেন ২২ জানুয়ারি থেকে ১০ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত।
জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার আগে রেওয়াজ অনুযায়ী বুধবার দুপুরে বঙ্গভবনে নির্বাচন কমিশনাররা রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। তফসিল ঘোষণার আগেই নির্বাচন কমিশন এরই মধ্যে ভোটার তালিকা চূড়ান্ত করা, সংসদীয় আসনের পুনর্বিন্যাস, আইনবিধি সংস্কার, অংশীজনদের সঙ্গে সংলাপ, নতুন রাজনৈতিক দলের নিবন্ধনসহ গুরুত্বপূর্ণ ও বড় কাজগুলো শেষ করেছে। এ ছাড়া নির্বাচনসংক্রান্ত কেনাকাটা, পর্যবেক্ষক সংস্থাগুলোর নিবন্ধন শেষ করেছে। বর্তমানে নির্বাচনী কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ ও প্রবাসীদের পোস্টাল ব্যালটে ভোট দেওয়ার জন্য নিবন্ধনের কাজ চলছে।
ইতিমধ্যে প্রশাসন ও পুলিশে বড় রদবদল হয়েছে। সব মিলিয়ে তফসিল–পূর্ব ইসির প্রস্তুতিকে সন্তোষজনকই বলা যায়। তবে আমাদের নির্বাচনী ইতিহাস বলে, তফসিল ঘোষণার পরই মূল চ্যালেঞ্জটা দেখা যায়। এবার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখাটা আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে আরও বেশি চ্যালেঞ্জের। এ ছাড়া সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অপতথ্য নিয়ন্ত্রণও আরেকটি বড় চ্যালেঞ্জ।
চব্বিশের গণ–অভ্যুত্থানের সময় পুলিশি ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছিল। পুলিশ এখনো পুরোপুরি আগের সক্রিয়তায় ফিরতে পারেনি। যদিও তফসিল ঘোষণার পর নির্বাচনী পরিবেশ নিশ্চিতে সশস্ত্র বাহিনীসহ সব কটি বাহিনীর প্রায় ৯ লাখ সদস্য নিয়োজিত থাকবেন। এ সংখ্যা নিশ্চিত করেই বিপুল কিন্তু আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় তাঁরা কতটা সক্রিয় ও কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারবেন, তা অনেকখানি নির্ভর করবে নির্বাচন কমিশন ও অন্তর্বর্তী সরকারের বিচক্ষণ ও বাস্তব পরিস্থিতি অনুযায়ী নেওয়া সিদ্ধান্তের ওপর। ইতিমধ্যে গণপ্রতিনিধিত্ব আইনে (আরপিও) সংশোধন আনা হয়েছে, নির্বাচন কমিশন আগের চেয়ে ক্ষমতায়িত হয়েছে। আমরা আশা করি, সবার জন্য সমান সুযোগ তৈরি করার ক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশন তার ক্ষমতা প্রয়োগে সাহসী ও নিরপেক্ষ থাকবে।
জাতি আরেকটি জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দ্বারপ্রান্তে এসে পৌঁছালেও যাত্রাটা মোটেই সহজ ছিল না। পরপর তিনটি জালিয়াতির নির্বাচন ও কর্তৃত্ববাদী শাসনে শেখ হাসিনা সরকারের গ্রহণযোগ্যতা তলানিতে নেমেছিল। গত বছরের জুলাই ও আগস্টে প্রায় দেড় হাজার ছাত্র-জনতার আত্মত্যাগের মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হয়, দায়িত্ব নেয় অন্তর্বর্তী সরকার। সংস্কার, বিচার ও নির্বাচন—এই তিন লক্ষ্য নিয়ে যাত্রা শুরু করে অধ্যাপক ইউনূসের নেতৃত্বাধীন সরকার। অন্তর্বর্তী সরকার, বিভিন্ন সংস্কার কমিশন, ঐকমত্য কমিশন, নির্বাচন কমিশন ও রাজনৈতিক দলগুলোর সম্মিলিত প্রচেষ্টায় দেশ নির্বাচনী যাত্রায় প্রবেশ করল। তাদের সবাইকে ধন্যবাদ জানাই।
অর্থনীতি, বিনিয়োগ, জাতীয় নিরাপত্তা, অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা সবকিছুর বিবেচনায় ফেব্রুয়ারির নির্বাচন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। নির্বাচনের সুষ্ঠু পরিবেশ নিশ্চিতের দায়িত্ব যেমন অন্তর্বর্তী সরকার ও নির্বাচন কমিশনের, একই সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর। সশস্ত্র বাহিনীরও এ ক্ষেত্রে গুরুদায়িত্ব রয়েছে বলে আমরা মনে করি।