ডোনাল্ড ট্রাম্প মুরুব্বি মানুষ। অতি উচ্চ বংশের লোক। একে তো আমেরিকার প্রেসিডেন্ট; তার ওপর পয়সাকড়ির অভাব নাই। জমি জমার তেজারতি আছে, দালান কোঠা, ফ্ল্যাট-বাড়ির ব্যবসা আছে। ক্যাসিনোর কারবার আছে। আরও কীসব ব্যবসাপাতি আছে। অ্যামাজনের জেফ বেজোস, এক্স-এর ইলন মাস্ক, মেটার জাকারবার্গ, ওপেন এআইয়ের স্যাম অল্টম্যানের মতো টাকার কুমির তাঁর চারপাশে ঘুরঘুর করে। এই লোককে ভয়-ভক্তি না করে উপায় আছে?

অথচ কপাল খারাপ, ট্রাম্পের ওপর থেকে শ্রদ্ধা হারালাম। গেল শুক্কুরবার ওই রকমের একজন কোটিপতি বড়লোক ভরা হাটে সামান্য দুটো টাকার জন্য যেভাবে ছোট মনের পরিচয় দিলেন; ভাবতেই গলা ঠেলে ফেসবুকে ভাইরাল হওয়া ‘ছিঃ, ছিঃ, ছিঃ রে ননী ছিঃ’ গানটা বেরিয়ে আসছে।

মোটামুটি সবাই জানেন, ট্রাম্প গভর্নরদের ওয়ার্কিং সেশনে বক্তব্য দিচ্ছিলেন। হোয়াইট হাউসের ইউটিউব চ্যানেলে সে ভিডিও ছাড়া হয়েছে। ভিডিওতে দেখা গেছে, ট্রাম্প বলছেন, বাংলাদেশের রাজনীতি জোরদার করতে আমেরিকার কাছ থেকে ২৯ মিলিয়ন ডলার বাংলাদেশের এমন এক সংস্থার কাছে গেছে, যার নামই আগে কেউ শোনেনি।

বাংলাদেশি ওই সংস্থার কর্মীর সংখ্যা মাত্র দুজন। তিনি বলেছেন, ‘একটা ছোট্ট সংস্থা; যারা এখান থেকে ১০ হাজার ডলার, সেখান থেকে ১০ হাজার ডলার পায়। আর আমেরিকার সরকারের কাছ থেকে পেয়ে গেছে ২৯ মিলিয়ন ডলার! আপনারা ভাবতে পারে! আমার তো মনে হচ্ছে, তারা বিরাট খুশি হয়ে গেছে। তারা কোটিপতি হয়ে গেছে। এই বাটপারির জন্য তারা শিগগিরই ভালো কোনো বিজনেস ম্যাগাজিনে জায়গা করে নেবে।’

আর আপনি ‘লাগে টাকা দেবে গৌরীসেন’-এর দেশের লোককে মাত্র ২৯ মিলিয়ন ডলারের গান শুনিয়ে বলছেন—‘উনত্রিশ মিলিয়ন ডলার! আপনারা ভাবতে পারেন!’

পরদিন শনিবার ওয়াশিংটনে কনজারভেটিভ পলিটিক্যাল অ্যাকশন কনফারেন্সে (সিপিএসি) আবার তিনি সেই ২৯ মিলিয়ন ডলারের খোঁটা দিয়েছেন। সেখানে ট্রাম্প টেনে টেনে যেভাবে ‘টোয়ে.

..ন্টি মি...লি...য়...ন ডওলারস!’ বলে আহাজারি করলেন, তাতে তাঁর জন্য মায়াই লাগল। কারণ উনি জানেন না, আমরা ২৯ মিলিয়ন ডলার; মানে ২ কোটি ৯০ লাখ ডলার; মানে প্রায় তিন শ কোটি টাকাকে অনেক আগে থেকেই গোনায় ধরা ছেড়ে দিয়েছি।

ট্রাম্প জানেন না, আমাদের কারওয়ানবাজারে মজমা জমিয়ে যে লোক মলম বেচেন, তিনিও লেকচারের মাঝে একটু পর পর নিজের ঊরুতে শশব্দ থাপ্পড় মেরে ‘মানি ইজ ডাস্ট!’ বলে চেঁচিয়ে ওঠেন। ‘টাকা পয়সা হাতের ময়লা’—এই কথা আমরা এমনি এমনি বলি না।

আমাদের কাছে তিন শ কোটি টাকা যে কোনো টাকাই না, তা বাংলাদেশের গত কয়েক বছরের পত্রিকার পাতা ওল্টালে ট্রাম্প বুঝতে পারতেন। আমাদের বহু হেজিপেজি হগামগা নেতা কিছুদিন আগেও ওয়ান-টুর মধ্যে তিন শ কোটি টাকা ঘচাৎ করে বের করে দিতে পারতেন। মাঝারি লেভেলের বহু পুলিশ কর্মকর্তার কাছে তিন শ কোটি টাকা তেমন কোনো বড় ব্যাপার ছিল না।

এই গত মাসের ২২ তারিখেও বাংলাদেশ ব্যাংকের ভল্টের লকারে তল্লাশি করে ব্যাংকটির সাবেক ডেপুটি গভর্নর সিতাংশু কুমার (এস কে) সুর চৌধুরীর রাখা ৫৫ হাজার ইউরো, ১ লাখ ৬৯ হাজার ৩০০ মার্কিন ডলার জব্দ করা হয়েছে। পাশাপাশি ৭০ লাখ টাকার এফডিআর ও প্রায় ১ কোটি ২০ লাখ টাকা মূল্যের এক কেজি (প্রায় ৮৬ ভরি) সোনার অলংকার জব্দ করা হয়েছে।

দ্য গার্ডিয়ান এর প্রতিবেদন থেকে জানি, লন্ডনের মেফেয়ার, গ্রোসভেনর স্কয়ারের মতো এলাকায় সাতটি বিলাসবহুল অ্যাপার্টমেন্ট কিনে বসে আছেন সালমান এফ রহমানের পরিবার ৷

সালমান এফ রহমানের ছেলে আহমেদ শায়ান রহমান ২০২২ সালের মার্চে এই এলাকায় দুই কোটি ৬৭ লাখ ৫০ হাজার পাউন্ডে একটি অ্যাপার্টমেন্ট কেনেন। এখানে তার একটি ফ্ল্যাটও রয়েছে যার দাম তিন কোটি ৫৫ লাখ পাউন্ড। লন্ডনে শায়ানের এই বাড়িতেই বিনা ভাড়ায় থাকতেন শেখ হাসিনার বোন শেখ রেহানা। শেখ হাসিনা বলেছিলেন, তাঁর কাজের লোকও চার শ কোটি টাকার মালিক।

এই ধরনের তিন চার শ কোটি টাকার মালিকদের হিসাব দিতে গেলে দিন পার হয়ে যাবে। শুধু মুরুব্বি হিসেবে ট্রাম্পের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে বলি, বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাব অনুযায়ী, গত ১৫ বছরে আমরা বাংলাদেশ থেকে ২৮ লাখ কোটি টাকা বিদেশে পাচার তথা রপ্তানি করেছি।

আর আপনি ‘লাগে টাকা দেবে গৌরীসেন’-এর দেশের লোককে মাত্র ২৯ মিলিয়ন ডলারের গান শুনিয়ে বলছেন—‘উনত্রিশ মিলিয়ন ডলার! আপনারা ভাবতে পারেন!’
ছিঃ প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প! আপনি আমাদের এত আন্ডারএস্টিমেট করতে পারলেন!

সারফুদ্দিন আহমেদ প্রথম আলোর সহকারী সম্পাদক
sarfuddin 2003 @gmail. com

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: আম দ র

এছাড়াও পড়ুন:

বাণিজ্যবিরোধ: ভারত কেন ট্রাম্পের নিশানায়

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প গতকাল বৃহস্পতিবার ভারতের বাণিজ্যনীতির তীব্র সমালোচনা করেছেন। ভারতীয় পণ্যের ওপর হোয়াইট হাউসের শুল্ক বৃদ্ধির প্রস্তুতি নেওয়ার পর থেকেই এ আক্রমণের মাত্রা বেড়েছে।  

ট্রাম্প জানিয়েছেন, তাঁর প্রশাসন আজ শুক্রবার (১ আগস্ট) থেকে ভারতের রপ্তানি পণ্যের ওপর ২৫ শতাংশ হারে শুল্ক আরোপ করছে এবং এর পাশাপাশি অতিরিক্ত শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে। ট্রাম্প যখন বিশ্বের বহু দেশের ওপর নতুন শুল্ক আরোপের পরিকল্পনা করছিলেন, তখনই ভারতকে উদ্দেশ করে তাঁর এমন কঠোর অবস্থান সামনে উঠে আসে।

হোয়াইট হাউসের অভিযোগ, ভারত মার্কিন পণ্যকে বাজারে ঠেকাতে অতিমাত্রায় শুল্ক আরোপ করছে। সম্প্রতি রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ চলাকালে ভারত রুশ জ্বালানি কেনা অব্যাহত রাখায় ট্রাম্প প্রকাশ্যে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন।

‘ভারতের শুল্ক বিশ্বে অন্যতম সর্বোচ্চ’, গত বুধবার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এমন মন্তব্য করেন ট্রাম্প। জবাবে ভারত সরকার জানিয়েছে, তারা ট্রাম্পের বক্তব্য ‘লক্ষ্য করেছে’ এবং এর ‘প্রভাব মূল্যায়ন’ করবে।

যুক্তরাষ্ট্র-ভারত বাণিজ্যবিরোধ: পরিস্থিতি কোথায় দাঁড়িয়ে

আজ থেকে ভারতীয় পণ্যের ওপর ট্রাম্পের ধার্য করা ২৫ শতাংশ পাল্টা শুল্ক গত ২ এপ্রিল হোয়াইট হাউসের রোজ গার্ডেনে ঘোষিত সম্ভাব্য শুল্ক থেকে মাত্র ১ শতাংশ কম।

এ হার ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) ও জাপানের ওপর আরোপিত ১৫ শতাংশ শুল্কের চেয়ে বেশি। তবে গত মে মাসে  চীনের ওপর আরোপিত ৩০ শতাংশ শুল্কের চেয়ে কিছুটা কম।

হোয়াইট হাউসের অভিযোগ, ভারত মার্কিন পণ্যকে বাজারে ঠেকাতে অতিমাত্রায় শুল্ক আরোপ করছে। সম্প্রতি রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ চলাকালে ভারত রুশ জ্বালানি কেনা অব্যাহত রাখায় ট্রাম্প প্রকাশ্যে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন।

এ শুল্ক ভারতের সঙ্গে চলমান বাণিজ্য আলোচনা আরও জটিল করে তুলতে পারে। একাধিক দফা আলোচনার মধ্য দিয়ে উভয় পক্ষ একটি চুক্তিতে পৌঁছানোর চেষ্টা করছে।

যুক্তরাষ্ট্রের ১২তম বৃহৎ বাণিজ্য অংশীদার ভারত। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে চীন থেকে উৎপাদন সরিয়ে নেওয়া অনেক কোম্পানির নতুন গন্তব্য হয়েছে দেশটি। মে মাসে অ্যাপলের সিইও টিম কুক জানান, যুক্তরাষ্ট্রে বিক্রির জন্য আইফোন এখন ভারতে উৎপাদিত হচ্ছে; যাতে উচ্চ শুল্ক এড়ানো যায়।

যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য প্রতিনিধি কার্যালয়ের (ওটিআর) তথ্যমতে, গত বছর ভারত-যুক্তরাষ্ট্রের পণ্য বাণিজ্যের মোট পরিমাণ ছিল প্রায় ১২৯ বিলিয়ন (১২ হাজার ৯০০ কোটি) ডলার। ভারতের রপ্তানি পণ্যের মধ্যে রয়েছে পোশাক, রাসায়নিক, যন্ত্রপাতি ও কৃষিপণ্য।

ট্রাম্প কেন ভারতকে নিশানা করছেন

সম্প্রতি ট্রাম্প একাধিকবার বিভিন্ন পণ্যের ওপর ভারতের ‘অতি উচ্চ’ শুল্ক আরোপের সমালোচনা করেছেন। এর মধ্যে কৃষিপণ্য ও দুগ্ধজাত পণ্যও রয়েছে।

বুধবার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ট্রাম্প লেখেন, ‘বছরের পর বছর আমরা ভারতের সঙ্গে তুলনামূলকভাবে খুব কম ব্যবসা করেছি। কারণ, তাদের শুল্ক অত্যন্ত বেশি।’

এ মুহূর্তে যখন সবাই চায় ইউক্রেনে হত্যা বন্ধ হোক, তখন ভারত চীনের সঙ্গে রাশিয়ার জ্বালানির সর্ববৃহৎ ক্রেতা।ডোনাল্ড ট্রাম্প, মার্কিন প্রেসিডেন্ট

দেশীয় শিল্পকে রক্ষা করতে ভারত কিছু পণ্যের ওপর ১০০ শতাংশের বেশি শুল্ক আরোপ করেছে।

ওটিআরের হিসাব অনুযায়ী, ২০২৪ সালে যুক্তরাষ্ট্র ভারতের সঙ্গে পণ্যবাণিজ্যে প্রায় ৪৫ বিলিয়ন (৪ হাজার ৫০০ কোটি) ডলারের ঘাটতি দেখেছে। এটি আগের বছরের তুলনায় ৫ দশমিক ৪ শতাংশ বেশি। তুলনামূলকভাবে গত বছর যুক্তরাষ্ট্র চীনের সঙ্গে প্রায় ২৯৫ বিলিয়ন (২৯ হাজার ৫০০ কোটি) ডলারের বাণিজ্যঘাটতিতে ছিল।

আরও পড়ুনভারতের ৬ প্রতিষ্ঠানের ওপর ট্রাম্পের নিষেধাজ্ঞা, ইরানের পণ্যের বাণিজ্যে জড়িত থাকার অভিযোগ ৩১ জুলাই ২০২৫

ট্রাম্প আরও ক্ষুব্ধ যে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ চলাকালে ভারত রুশ তেল কেনা অব্যাহত রেখেছে।

‘এ মুহূর্তে যখন সবাই চায় ইউক্রেনে হত্যা বন্ধ হোক, তখন ভারত চীনের সঙ্গে রাশিয়ার জ্বালানির সর্ববৃহৎ ক্রেতা’, বুধবার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে লিখেছেন ট্রাম্প।

ভারতের প্রতিক্রিয়া

এ সপ্তাহে প্রকাশিত এক বিবৃতিতে ভারত সরকার ট্রাম্পের ওই বক্তব্যে তুলনামূলকভাবে মৃদু, তবে শক্ত প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে।

ভারতের ওপর ধার্য করা শুল্কহার ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) ও জাপানের ওপর আরোপিত ১৫ শতাংশের চেয়ে বেশি। তবে গত মে মাসে চীনের ওপর আরোপিত ৩০ শতাংশের চেয়ে কিছুটা কম।

বুধবার দেওয়া এ বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ‘কয়েক মাস ধরে ভারত ও যুক্তরাষ্ট্র একটি ন্যায্য, ভারসাম্যপূর্ণ ও পারস্পরিকভাবে লাভজনক দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য চুক্তির লক্ষ্যে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে। আমরা সেই লক্ষ্য অর্জনে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।’ বিবৃতিতে আরও বলা হয়, ‘সরকার জাতীয় স্বার্থ রক্ষায় প্রয়োজনীয় সব ব্যবস্থা নেবে।’

আগস্টের শেষ দিকে দুই দেশের মধ্যে আরেক দফা বাণিজ্য আলোচনা অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে।

আরও পড়ুনভারতের পণ্যে ২৫ শতাংশ শুল্ক আরোপের ঘোষণা ট্রাম্পের, রাশিয়ার সঙ্গে বাণিজ্যের জন্য আলাদা ‘দণ্ড’৩০ জুলাই ২০২৫আরও পড়ুনট্রাম্পের ২৫ শতাংশ শুল্কে ভারতের অর্থনীতি কতটা ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে, কী বলছেন অর্থনীতিবিদেরা১৪ ঘণ্টা আগে

সম্পর্কিত নিবন্ধ