ময়মনসিংহের অভিবাসী কর্মী হাফিজ (ছদ্মনাম) ২০২৪ সালের ডিসেম্বরে সৌদি আরব যান আর্থিক অবস্থা পরিবর্তনের স্বপ্ন নিয়ে। তিনি এক সৌদি কোম্পানির সঙ্গে চুক্তি করেছিলেন, যেখানে তাঁকে প্রতি মাসে ১ হাজার ৮০০ রিয়াল বেতন এবং খাবারের জন্য অতিরিক্ত ২০০ রিয়াল দেওয়ার কথা। চুক্তি অনুযায়ী তিনি বিএমইটি স্মার্টকার্ডও সংগ্রহ করেন, যা আইনসম্মত অভিবাসনের জন্য প্রয়োজনীয়। তবে সৌদি আরবে পৌঁছানোর পরপরই তিনি নতুন এক চুক্তিতে স্বাক্ষর করতে বাধ্য হন, যেখানে তাঁর বেতন কমিয়ে মাত্র ৮০০ রিয়াল করা হয় এবং তাঁকে জোরপূর্বক খাবার সরবরাহকারী ড্রাইভার নিয়োগ করা হয়। এই প্রতারণার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করলে তাঁকে দেশে ফেরত পাঠানোর হুমকি দেওয়া হয়। 

হাফিজের গল্প কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। তাঁর মতো অসংখ্য বাংলাদেশি কর্মী প্রতারণার শিকার হন। তারা বিদেশে যাওয়ার জন্য প্রায় ৪ লাখ টাকা বিনিয়োগ করেও সেখানে গিয়ে প্রতারণার জালে আটকা পড়েন। তাদের স্বপ্ন মুহূর্তেই ভেঙে যায় এবং শুরু হয় প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ, মজুরি চুরি এবং নির্মম শোষণের দুঃস্বপ্ন।
অভিবাসী কর্মীদের শোষণ বাস্তবে দেশের মাটিতেই শুরু হয়। অসাধু রিক্রুটমেন্ট এজেন্সি ও দালালরা বিদেশে চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে সহজ-সরল মানুষদের প্রতারণার ফাঁদে ফেলে। অধিকাংশ কর্মী অভিবাসন ব্যয় সংগ্রহ করতে তাদের জমিজমা বিক্রি করেন অথবা উচ্চ সুদে ঋণ নেন। ফলে বিদেশে পা রাখার আগেই তারা কঠোর ঋণের ফাঁদে পড়ে যান।

এ শোষণের কেন্দ্রবিন্দু হলো ‘কাফালা’ নামে স্পন্সরশিপ ব্যবস্থা, যা অনেক গালফ কো-অপারেশন কাউন্সিলভুক্ত (জিসিসি) দেশ মেনে চলে। এ কাঠামোর অধীনে অভিবাসী কর্মীরা তাদের নিয়োগকর্তার অধীনে আইনিভাবে দায়বদ্ধ থাকেন এবং তাদের ভিসা ও বসবাসের অনুমতি সম্পূর্ণ নিয়োগকর্তার নিয়ন্ত্রণে। এর ফলে কর্মীরা চরম নির্ভরশীল হয়ে পড়েন এবং সহজেই শোষণের শিকার হন।
কাফালা ব্যবস্থার কারণে অনেক মালিক কর্মীদের পাসপোর্ট বাজেয়াপ্ত করেন; ছুটির দিন বা স্বাস্থ্যসেবা থেকে বঞ্চিত করেন এবং অনেক ক্ষেত্রে মানসিক ও শারীরিক নির্যাতন চালান।
নারী গৃহকর্মীদের জন্য পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ। রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্টস রিসার্চ ইউনিটের (রামরু) গবেষণা অনুসারে, উপসাগরীয় দেশগুলোতে থাকা বাংলাদেশি নারীরা যৌন নিপীড়ন ও শারীরিক নির্যাতনের উচ্চ ঝুঁকির মধ্যে থাকেন। আইনি সহায়তাবিহীন এবং সম্পূর্ণ একাকী অবস্থায় কাজ করতে বাধ্য হওয়ায় তাদের অবস্থা আরও শোচনীয় হয়ে ওঠে।
অনেক কর্মীকে অত্যন্ত অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে থাকতে হয়। কর্মীদের ক্যাম্পগুলোতে অপর্যাপ্ত বিদ্যুৎ, বিশুদ্ধ পানি ও পয়ঃনিষ্কাশনের অভাব প্রকট। কর্মস্থলে পরিস্থিতি আরও খারাপ– দীর্ঘ কর্মঘণ্টা, বিপজ্জনক কর্মপরিবেশ, স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তার প্রতি কোনো গুরুত্ব না দেওয়া। নির্মাণ শ্রমিক, কারখানা কর্মী এবং গৃহকর্মীরা অতিরিক্ত গরমের মধ্যে ভয়াবহ অবস্থায় কাজ করেন। অথচ কোনো অভিযোগ করার সুযোগ পান না।

এই মানবাধিকার লঙ্ঘনের দায় শুধু অভিবাসী কর্মী গ্রহণকারী দেশগুলোর নয়; বাংলাদেশ সরকারও সমানভাবে দায়ী। বাংলাদেশের সরকার রেমিট্যান্সের ওপর নির্ভরশীল হলেও রিক্রুটমেন্ট এজেন্সিগুলোর কার্যক্রম যথাযথভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে ব্যর্থ; কর্মীদের উপযুক্ত প্রশিক্ষণ ও আইনি সুরক্ষা প্রদানেও ব্যর্থ। এ ছাড়া দূতাবাসগুলোর পর্যাপ্ত জনবল ও সহায়তা ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে পারেনি।
অনেক অভিবাসী কর্মী অভিযোগ করেন, বাংলাদেশ দূতাবাস সমস্যার সমাধান তো দূরের কথা, তাদের প্রতি একটু সহানুভূতিও দেখায় না। বাংলাদেশি অভিবাসী কর্মীদের অবস্থা উন্নত করতে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সমন্বিত উদ্যোগ প্রয়োজন। হিউম্যান রাইটস ওয়াচ ও মাইগ্র্যান্ট ফোরাম ইন এশিয়া (এমএফএ) দীর্ঘদিন ধরেই কাফালা ব্যবস্থার বিলুপ্তি ও কঠোর শ্রম আইন বাস্তবায়নের দাবি জানিয়ে এলেও তার বাস্তবায়ন এখনও ধীরগতিসম্পন্ন।

বাংলাদেশ সরকারকে রিক্রুটমেন্ট এজেন্সিগুলোর ওপর কঠোর নজরদারির সঙ্গে কর্মীদের জন্য বিশদ প্রশিক্ষণ কর্মসূচি চালু করতে হবে, যেখানে তাদের আইন, অধিকার ও ভিন্ন সংস্কৃতি সম্পর্কে সচেতন করা হবে। দূতাবাসগুলোতে পর্যাপ্ত জনবল ও তহবিল বরাদ্দ করতে হবে, যাতে কর্মীরা তাৎক্ষণিক সহায়তা পেতে পারেন। প্রবাসী কর্মীদের সুরক্ষার জন্য শক্তিশালী দ্বিপক্ষীয় চুক্তি স্বাক্ষর করতে হবে, বাংলাদেশে প্রবাসী কর্মীদের প্রতারণা থেকে সচেতন করতে প্রচার-প্রচারণা চালাতে হবে।
বাংলাদেশি অভিবাসী কর্মীদের শোষণের বিষয় যেমন একটি অর্থনৈতিক সমস্যা, তেমনি গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনও বটে। এই শোষণের চক্র ভাঙতে হলে সরকার, নাগরিক সমাজ ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর সম্মিলিত প্রচেষ্টা প্রয়োজন।

পারভেজ আলম: মানবাধিকারকর্মী

.

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: কর ম দ র ব যবস থ র জন য কর ম র অবস থ সরক র

এছাড়াও পড়ুন:

শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস আজ

‘উদয়ের পথে শুনি কার বাণী/ ভয় নাই ওরে ভয় নাই/ নিঃশেষে প্রাণ যে করিবে দান/ ক্ষয় নাই তার ক্ষয় নাই’। তাঁদের নিঃশেষে প্রাণদানের স্মৃতি আজ গভীর বেদনায় স্মরণ করবে জাতি। আজ থেকে ৫৪ বছর আগে দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তান বুদ্ধিজীবীরা হানাদার পাকিস্তান সেনাবাহিনীর নীলনকশার শিকার হয়ে নির্মম হত্যার শিকার হয়েছিলেন।

অমিত বিক্রম বাঙালির জীবনপণ যুদ্ধে হানাদার পাকিস্তানি বাহিনীর চূড়ান্ত পরাজয় তখন ছিল কেবল দিনগণনার বিষয়। সেই অনিবার্য পরাজয়ের প্রাক্কালে মরণকামড় দেওয়ার চেষ্টা করেছিল ঘাতক বাহিনী। স্বাধীনতা অর্জন করলেও বাঙালি জাতি যেন মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে না পারে, সেই চক্রান্ত করেছিল তারা। দেশের সেরা বুদ্ধিজীবীদের তালিকা করে তাঁদের বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে গিয়ে নির্মম নির্যাতন করে হত্যা করা হয়েছিল। এ কাজে পাকিস্তানি সেনাদের সরাসরি সহায়তা করেছিল তাদের মিত্র এ দেশি রাজাকার, আলবদর বাহিনী। এরাই ঘাতক সেনাদের নিয়ে গিয়ে চিনিয়ে দিয়েছে বুদ্ধিজীবীদের বাড়ি। চিনিয়ে দিয়েছে সেই নিরীহ মানুষগুলোকে।

মহান মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ে পরে মিরপুরে রায়েরবাজার পরিত্যক্ত ইটখোলা ও মিরপুরে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে যাওয়া সেসব বুদ্ধিবৃত্তিক পেশায় যুক্ত মানুষের মরদেহগুলো উদ্ধার করা হয়। তাঁদের অনেকের ছিল পিছমোড়া করে হাত ও চোখ বাঁধা। ভয়ানক নির্যাতনের চিহ্ন ছিল শরীরে। তাঁদের মরদেহ উদ্ধার হওয়ার মধ্য দিয়ে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বুদ্ধিজীবী হত্যার গভীর ষড়যন্ত্র প্রকাশ হয়ে পড়ে। এর পর থেকেই শহীদ বুদ্ধিজীবীদের প্রতি শ্রদ্ধা ও শোক প্রকাশ করে ১৪ ডিসেম্বর শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস পালিত হয়ে আসছে।

শুধু ঢাকাতেই নয়, সারা দেশেই বুদ্ধিবৃত্তিক কাজে যুক্ত মানুষদের হত্যা করেছিল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী। এই হত্যাকাণ্ডের ছিল দুটি পর্যায়। ‘অপারেশন সার্চলাইট’ নামে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে হানাদার সেনারা রাজধানীতে গণহত্যা শুরু করেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও আশপাশের এলাকায় সাধারণ নিরীহ জনসাধারণের পাশাপাশি শিক্ষক, চিকিৎসকদেরও হত্যা করে। এরপর থেকে হানাদাররা সারা দেশের শিক্ষক, চিকিৎসক, প্রকৌশলী, আইনজীবী, শিল্পী, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, গবেষক, সংস্কৃতিসেবীসহ মেধা মনন সৃজনশীল কাজে যুক্ত মানুষদের বেছে বেছে হত্যা করতে থাকে। মুক্তিযুদ্ধে শেষ পর্যায় তারা এই বুদ্ধিবৃত্তিক মানুষদের নিঃশেষ করে দেওয়ার জন্য তালিকা করে হত্যা চালাতে থাকে। তাঁদের মধ্যে যেমন প্রবীণ প্রাজ্ঞজনেরা ছিলেন, তেমনি ছিলেন উদিত যৌবনের বহু সম্ভাবনাময় তরতাজা প্রাণ। আজ তাঁদের স্মৃতির স্মরণ করা হবে সারা দেশে।

শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন ও প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস পৃথক বাণী দিয়েছেন।

কর্মসূচি

শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস পালন উপলক্ষে অনুষ্ঠিত আন্তমন্ত্রণালয়ের সভায় জানানো হয়েছে, আজ রোববার সকাল ৭টা ৫ মিনিটে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন এবং ৭টা ৬ মিনিটে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস মিরপুর শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধে পুষ্পস্তবক অর্পণ করবেন। তাঁরা জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানিয়ে সেখানে নীরবে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকবেন। এ সময় বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর একটি চৌকস দল রাষ্ট্রপতি ও প্রধান উপদেষ্টাকে রাষ্ট্রীয় স্যালুট প্রদান করবে।

রাষ্ট্রপতি ও প্রধান উপদেষ্টার পুষ্পস্তবক অর্পণের পর মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক উপদেষ্টা ফারুক-ই-আজম, মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয়ের সচিব ইসরাত চৌধুরী, শহীদ বুদ্ধিজীবী পরিবারের সদস্য এবং হুইলচেয়ারধারী যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধারা মিরপুর শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধে পুষ্পস্তবক অর্পণ করবেন।

সম্পর্কিত নিবন্ধ