দরিদ্র পরিবারে জন্ম নিলেও মহাকাশে যাওয়া প্রথম মানব তিনি
Published: 9th, March 2025 GMT
রোমাঞ্চকর এক যাত্রা। বেঁচে ফিরে আসা যাবে কি যাবে না, তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। মহাশূন্যের উদ্দেশে যাত্রা করার আগে সোভিয়েত নভোচারী ইউরি গ্যাগারিনের মাথায়ও হয়তো সেসব চিন্তা খেলা করেছিল। তারই আঁচ পাওয়া যায় স্ত্রী ভ্যালেন্তিনাকে লেখা গ্যাগারিনের একটি চিঠিতে। সেখানে তিনি লিখেছিলেন, অভিযান যদি ব্যর্থ হয়, তবে ভ্যালেন্তিনা যেন তাঁদের মেয়েদের ‘ছোট রাজকন্যার মতো নয়, বরং প্রকৃত মানুষ হিসেবে’ গড়ে তোলেন। বেঁচে ফিরতে না পারলে স্ত্রীও যেন বিয়ে করতে দ্বিধাবোধ না করেন।
তবে শেষ পর্যন্ত অভিযানটি সফলভাবে শেষ করেছিলেন ২৭ বছর বয়সী গ্যাগারিন। পৃথিবীর কক্ষপথে একবার ভ্রমণের মাধ্যমে মানবজাতির মহাকাশযাত্রার সূচনা করেছিলেন এ নভোচারী। তবে ঐতিহাসিক সেই সাফল্য পেতে গ্যাগারিনকে বেশ বড় ঝুঁকি নিতে হয়েছিল। তিনি এমন একটি ছোট নভোযানে চড়ে রওনা দিয়েছিলেন, যেখানে কোনো বিপদ ঘটলে রক্ষা পাওয়ার বিন্দুমাত্র উপায় ছিল না। ভস্তক–১ নামের ওই নভোযানটির ব্যাসার্ধ ছিল মাত্র দুই মিটার। নভোযানের ভেতর কোনো যন্ত্রপাতি ছোঁয়ার অধিকার পাইলটের ছিল না।
পৃথিবীর নিয়ন্ত্রণকক্ষে বসে নভোযানটির নিয়ন্ত্রণ যাঁরা করছিলেন, তাঁদের সঙ্গে গ্যাগারিনের যে কথোপকথন হয়েছিল, তা থেকে জানা যায়, ক্যাপসুলের মতো ছোট ওই নভোযানের জানালা দিয়ে মহাকাশ থেকে পৃথিবীর ‘সৌন্দর্যে’ দেখে মুগ্ধ হয়েছিলেন তিনি। ভূপৃষ্ঠের ওপর মেঘের ছায়া তাঁকে বিস্মিত করেছিল।
দরিদ্র পরিবারে জন্ম
মস্কোর নিকটবর্তী ক্লুশিনো গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন গ্যাগারিন। তাঁর বাবা ছিলেন একজন কাঠমিস্ত্রি। আর মা একটি দুগ্ধ খামারে কাজ করতেন। অন্য অনেকের মতো তাঁর পরিবারও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় নাৎসিদের হাতে নির্যাতনের শিকার হয়েছিল। গ্যাগারিনের পরিবারকে বাড়ি থেকে উচ্ছেদ করা হয়েছিল। এরপর তাঁরা কাছের একটি এলাকায় ছোট একটি মাটির ঘরে থাকতেন। ইউরির ভাই ভ্যালেন্তিন এবং তাঁর বোন জোয়াকে পোল্যান্ডে শ্রমিকদের শিবিরে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল।
ইউরি গ্যাগারিনের বয়স যখন ১৩ বছর, তখন তিনি তাঁর পরিবারের সঙ্গে জাৎস্ক শহরে চলে যান। ক্লুশিনোর বাড়িটি ভেঙেচুরে তাঁর বাবা জাৎস্ক শহরে নিয়ে আসেন এবং বাড়িটি নতুন করে গড়ে তোলেন।
শুরুতে গ্যাগারিন একটি কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে ঢালাইবিদ্যায় স্নাতক করেন। এরপর তিনি সারাতোভ টেকনিক্যাল কলেজে ভর্তি হন। সেখানে পড়াশোনার সময় গ্যাগারিন স্থানীয় অ্যারো ক্লাব থেকে উড়োজাহাজ চালানো শেখেন।
‘যখন তিনি (গ্যাগারিন) সারাতোভ টেকনিক্যাল কলেজের ছাত্র ছিলেন, তখন তাঁর কাছে খুব বেশি টাকাপয়সা ছিল না এবং কিছু অতিরিক্ত অর্থ উপার্জনের জন্য তাঁকে ভোলগা নদীতে ডক শ্রমিক হিসেবে খণ্ডকালীন কাজ করতে হতো। তিনি সেই টাকা দিয়ে তাঁর পরিবারের জন্য উপহার কিনতেন’—তাঁর ভাগনি তামারা ফিলাতোভা বিবিসি নিউজকে বলেন।
গ্যাগারিনের ভাতিজি তামারা ফিলাতোভা ২০১১ সালে বিবিসিকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘তিনি (গ্যাগারিন) সারাতোভ টেকনিক্যাল কলেজের শিক্ষার্থী থাকাকালে তাঁর কাছে খুব বেশি অর্থকড়ি ছিল না। অতিরিক্ত কিছু অর্থ উপার্জনের জন্য তাঁকে ভলগা নদীতে ডক শ্রমিক হিসেবে খণ্ডকালীন কাজ করতে হয়েছিল। পরিবারের সদস্যদের জন্য উপহার কিনতে এই অর্থ ব্যয় করেছিলেন তিনি।’
১৯৫৫ সালে ইউরি গ্যাগারিন ওরেনবুর্গ পাইলট স্কুলে ভর্তি হন এবং সেখান থেকে স্নাতক শেষ করার পর সোভিয়েত বিমানবাহিনীতে লেফটেন্যান্ট হিসেবে যোগ দেন। আর এখানেই ভ্যালেন্তিনার (স্ত্রী) সঙ্গে তাঁর পরিচয় হয়। ভ্যালেন্তিনা ওরেনবুর্গ মেডিকেল স্কুলের স্নাতক ছিলেন। দুজনের বিয়ের পর গ্যাগারিন যুদ্ধবিমানের পাইলট হিসেবে কাজ শুরু করেন।
১৯৬০ সালে সোভিয়েত মহাকাশ কর্মসূচির অংশ হিসেবে মহাকাশে পাঠানোর জন্য সম্ভাব্য প্রার্থী হিসেবে গ্যাগারিনসহ ২০ জনকে বেছে নেওয়া হয়। তাঁদের মধ্য থেকে পরে আবার চূড়ান্তভাবে দুজনকে বাছাই করা হয়। এর মধ্যে একজন গ্যাগারিন এবং অপরজন গিরমান তিতোভ। এবার একজনকে বেছে নেওয়ার পালা। কয়েকজন তখন অপেক্ষাকৃত নম্র স্বভাবের গ্যাগারিনকে বাছাই করার পক্ষে মত দেন। চূড়ান্তভাবে তাঁকেই নির্বাচিত করা হয়।
সফল অভিযান ও খ্যাতি
১৯৬১ সালের ১২ এপ্রিল। ২৭ বছর বয়সী গ্যাগারিন কাজাখস্তানের রকেট উৎক্ষেপনকেন্দ্রে ৩০ মিটার উঁচু রকেটে বসে অপেক্ষা করছিলেন। মস্কোর সময় সকাল ৯টা ৭ মিনিটে মহাকাশের উদ্দেশে গ্যাগারিনের সে রোমাঞ্চকর যাত্রা শুরু হয়। যাত্রার সময় তিনি চিৎকার করে বলে ওঠেন—পোয়েখালি, যার অর্থ হলো ‘আমরা চললাম’। পৃথিবীর কক্ষপথে তাঁর ভ্রমণটি ১০৮ মিনিট ধরে স্থায়ী হয়েছিল। ঐতিহাসিক এ ভ্রমণের সময় গ্যাগারিন টিউব থেকে টিপে টিপে খাবার খেতে পেরেছিলেন। উচ্চ ফ্রিকোয়েন্সির একটি রেডিও এবং একটি টেলিগ্রাফ কি ব্যবহার করে পৃথিবীতে নিয়ন্ত্রণকক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলেন তিনি। আর এভাবে নিয়ন্ত্রণকক্ষকে সর্বশেষ অবস্থা সম্পর্কে জানাতে পেরেছিলেন।
অবশ্য অভিযানটি ভয়াবহ রকমের বিপর্যয়ের কাছাকাছি চলে গিয়েছিল। অভিযান শেষ করে পৃথিবীতে ফিরে আসার সময় এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। নভোযানের মূল ক্যাপসুলকে যে তারটি সার্ভিস ক্যাপসুলের সঙ্গে যুক্ত করে রাখে, সেটি আলগা হচ্ছিল না। এতে পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে ঢোকার সময় নভোযানটিতে তীব্র কম্পন দেখা দেয়। তবে ক্যাপসুলটি মাটিতে পড়ার আগেই গ্যাগারিন হঠাৎ করেই ভেতর থেকে বেরিয়ে আসেন এবং প্যারাশুটে করে ভলগা নদীর কাছে নিরাপদে অবতরণ করেন।
গ্যাগারিন যে সময়ে মহাকাশে যান, ওই সময় রকেট থেকে শুরু করে নভোযান এবং নিয়ন্ত্রণব্যবস্থার কার্যকারিতা নিয়ে কেউই শতভাগ নিশ্চিত ছিলেন না। এমনকি মহাশূন্যে পৌঁছাতে পারলেও ভেতরের মানুষটি বাঁচবে কি না, তা–ও ছিল অজানা।
ইউরি গ্যাগারিনকে ফুল দিয়ে শুভেচ্ছা জানাচ্ছেন নিকিতা ক্রুশ্চেভ.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: কর ছ ল ন র পর ব র হয় ছ ল র জন য র সময়
এছাড়াও পড়ুন:
শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস আজ
‘উদয়ের পথে শুনি কার বাণী/ ভয় নাই ওরে ভয় নাই/ নিঃশেষে প্রাণ যে করিবে দান/ ক্ষয় নাই তার ক্ষয় নাই’। তাঁদের নিঃশেষে প্রাণদানের স্মৃতি আজ গভীর বেদনায় স্মরণ করবে জাতি। আজ থেকে ৫৪ বছর আগে দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তান বুদ্ধিজীবীরা হানাদার পাকিস্তান সেনাবাহিনীর নীলনকশার শিকার হয়ে নির্মম হত্যার শিকার হয়েছিলেন।
অমিত বিক্রম বাঙালির জীবনপণ যুদ্ধে হানাদার পাকিস্তানি বাহিনীর চূড়ান্ত পরাজয় তখন ছিল কেবল দিনগণনার বিষয়। সেই অনিবার্য পরাজয়ের প্রাক্কালে মরণকামড় দেওয়ার চেষ্টা করেছিল ঘাতক বাহিনী। স্বাধীনতা অর্জন করলেও বাঙালি জাতি যেন মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে না পারে, সেই চক্রান্ত করেছিল তারা। দেশের সেরা বুদ্ধিজীবীদের তালিকা করে তাঁদের বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে গিয়ে নির্মম নির্যাতন করে হত্যা করা হয়েছিল। এ কাজে পাকিস্তানি সেনাদের সরাসরি সহায়তা করেছিল তাদের মিত্র এ দেশি রাজাকার, আলবদর বাহিনী। এরাই ঘাতক সেনাদের নিয়ে গিয়ে চিনিয়ে দিয়েছে বুদ্ধিজীবীদের বাড়ি। চিনিয়ে দিয়েছে সেই নিরীহ মানুষগুলোকে।
মহান মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ে পরে মিরপুরে রায়েরবাজার পরিত্যক্ত ইটখোলা ও মিরপুরে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে যাওয়া সেসব বুদ্ধিবৃত্তিক পেশায় যুক্ত মানুষের মরদেহগুলো উদ্ধার করা হয়। তাঁদের অনেকের ছিল পিছমোড়া করে হাত ও চোখ বাঁধা। ভয়ানক নির্যাতনের চিহ্ন ছিল শরীরে। তাঁদের মরদেহ উদ্ধার হওয়ার মধ্য দিয়ে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বুদ্ধিজীবী হত্যার গভীর ষড়যন্ত্র প্রকাশ হয়ে পড়ে। এর পর থেকেই শহীদ বুদ্ধিজীবীদের প্রতি শ্রদ্ধা ও শোক প্রকাশ করে ১৪ ডিসেম্বর শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস পালিত হয়ে আসছে।
শুধু ঢাকাতেই নয়, সারা দেশেই বুদ্ধিবৃত্তিক কাজে যুক্ত মানুষদের হত্যা করেছিল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী। এই হত্যাকাণ্ডের ছিল দুটি পর্যায়। ‘অপারেশন সার্চলাইট’ নামে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে হানাদার সেনারা রাজধানীতে গণহত্যা শুরু করেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও আশপাশের এলাকায় সাধারণ নিরীহ জনসাধারণের পাশাপাশি শিক্ষক, চিকিৎসকদেরও হত্যা করে। এরপর থেকে হানাদাররা সারা দেশের শিক্ষক, চিকিৎসক, প্রকৌশলী, আইনজীবী, শিল্পী, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, গবেষক, সংস্কৃতিসেবীসহ মেধা মনন সৃজনশীল কাজে যুক্ত মানুষদের বেছে বেছে হত্যা করতে থাকে। মুক্তিযুদ্ধে শেষ পর্যায় তারা এই বুদ্ধিবৃত্তিক মানুষদের নিঃশেষ করে দেওয়ার জন্য তালিকা করে হত্যা চালাতে থাকে। তাঁদের মধ্যে যেমন প্রবীণ প্রাজ্ঞজনেরা ছিলেন, তেমনি ছিলেন উদিত যৌবনের বহু সম্ভাবনাময় তরতাজা প্রাণ। আজ তাঁদের স্মৃতির স্মরণ করা হবে সারা দেশে।
শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন ও প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস পৃথক বাণী দিয়েছেন।
কর্মসূচিশহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস পালন উপলক্ষে অনুষ্ঠিত আন্তমন্ত্রণালয়ের সভায় জানানো হয়েছে, আজ রোববার সকাল ৭টা ৫ মিনিটে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন এবং ৭টা ৬ মিনিটে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস মিরপুর শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধে পুষ্পস্তবক অর্পণ করবেন। তাঁরা জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানিয়ে সেখানে নীরবে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকবেন। এ সময় বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর একটি চৌকস দল রাষ্ট্রপতি ও প্রধান উপদেষ্টাকে রাষ্ট্রীয় স্যালুট প্রদান করবে।
রাষ্ট্রপতি ও প্রধান উপদেষ্টার পুষ্পস্তবক অর্পণের পর মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক উপদেষ্টা ফারুক-ই-আজম, মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয়ের সচিব ইসরাত চৌধুরী, শহীদ বুদ্ধিজীবী পরিবারের সদস্য এবং হুইলচেয়ারধারী যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধারা মিরপুর শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধে পুষ্পস্তবক অর্পণ করবেন।