রোমাঞ্চকর এক যাত্রা। বেঁচে ফিরে আসা যাবে কি যাবে না, তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। মহাশূন্যের উদ্দেশে যাত্রা করার আগে সোভিয়েত নভোচারী ইউরি গ্যাগারিনের মাথায়ও হয়তো সেসব চিন্তা খেলা করেছিল। তারই আঁচ পাওয়া যায় স্ত্রী ভ্যালেন্তিনাকে লেখা গ্যাগারিনের একটি চিঠিতে। সেখানে তিনি লিখেছিলেন, অভিযান যদি ব্যর্থ হয়, তবে ভ্যালেন্তিনা যেন তাঁদের মেয়েদের ‘ছোট রাজকন্যার মতো নয়, বরং প্রকৃত মানুষ হিসেবে’ গড়ে তোলেন। বেঁচে ফিরতে না পারলে স্ত্রীও যেন বিয়ে করতে দ্বিধাবোধ না করেন।

তবে শেষ পর্যন্ত অভিযানটি সফলভাবে শেষ করেছিলেন ২৭ বছর বয়সী গ্যাগারিন। পৃথিবীর কক্ষপথে একবার ভ্রমণের মাধ্যমে মানবজাতির মহাকাশযাত্রার সূচনা করেছিলেন এ নভোচারী। তবে ঐতিহাসিক সেই সাফল্য পেতে গ্যাগারিনকে বেশ বড় ঝুঁকি নিতে হয়েছিল। তিনি এমন একটি ছোট নভোযানে চড়ে রওনা দিয়েছিলেন, যেখানে কোনো বিপদ ঘটলে রক্ষা পাওয়ার বিন্দুমাত্র উপায় ছিল না। ভস্তক–১ নামের ওই নভোযানটির ব্যাসার্ধ ছিল মাত্র দুই মিটার। নভোযানের ভেতর কোনো যন্ত্রপাতি ছোঁয়ার অধিকার পাইলটের ছিল না।

পৃথিবীর নিয়ন্ত্রণকক্ষে বসে নভোযানটির নিয়ন্ত্রণ যাঁরা করছিলেন, তাঁদের সঙ্গে গ্যাগারিনের যে কথোপকথন হয়েছিল, তা থেকে জানা যায়, ক্যাপসুলের মতো ছোট ওই নভোযানের জানালা দিয়ে মহাকাশ থেকে পৃথিবীর ‘সৌন্দর্যে’ দেখে মুগ্ধ হয়েছিলেন তিনি। ভূপৃষ্ঠের ওপর মেঘের ছায়া তাঁকে বিস্মিত করেছিল।

দরিদ্র পরিবারে জন্ম

মস্কোর নিকটবর্তী ক্লুশিনো গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন গ্যাগারিন। তাঁর বাবা ছিলেন একজন কাঠমিস্ত্রি। আর মা একটি দুগ্ধ খামারে কাজ করতেন। অন্য অনেকের মতো তাঁর পরিবারও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় নাৎসিদের হাতে নির্যাতনের শিকার হয়েছিল। গ্যাগারিনের পরিবারকে বাড়ি থেকে উচ্ছেদ করা হয়েছিল। এরপর তাঁরা কাছের একটি এলাকায় ছোট একটি মাটির ঘরে থাকতেন। ইউরির ভাই ভ্যালেন্তিন এবং তাঁর বোন জোয়াকে পোল্যান্ডে শ্রমিকদের শিবিরে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল।

ইউরি গ্যাগারিনের বয়স যখন ১৩ বছর, তখন তিনি তাঁর পরিবারের সঙ্গে জাৎস্ক শহরে চলে যান। ক্লুশিনোর বাড়িটি ভেঙেচুরে তাঁর বাবা জাৎস্ক শহরে নিয়ে আসেন এবং বাড়িটি নতুন করে গড়ে তোলেন।

শুরুতে গ্যাগারিন একটি কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে ঢালাইবিদ্যায় স্নাতক করেন। এরপর তিনি সারাতোভ টেকনিক্যাল কলেজে ভর্তি হন। সেখানে পড়াশোনার সময় গ্যাগারিন স্থানীয় অ্যারো ক্লাব থেকে উড়োজাহাজ চালানো শেখেন।

‘যখন তিনি (গ্যাগারিন) সারাতোভ টেকনিক্যাল কলেজের ছাত্র ছিলেন, তখন তাঁর কাছে খুব বেশি টাকাপয়সা ছিল না এবং কিছু অতিরিক্ত অর্থ উপার্জনের জন্য তাঁকে ভোলগা নদীতে ডক শ্রমিক হিসেবে খণ্ডকালীন কাজ করতে হতো। তিনি সেই টাকা দিয়ে তাঁর পরিবারের জন্য উপহার কিনতেন’—তাঁর ভাগনি তামারা ফিলাতোভা বিবিসি নিউজকে বলেন।

গ্যাগারিনের ভাতিজি তামারা ফিলাতোভা ২০১১ সালে বিবিসিকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘তিনি (গ্যাগারিন) সারাতোভ টেকনিক্যাল কলেজের শিক্ষার্থী থাকাকালে তাঁর কাছে খুব বেশি অর্থকড়ি ছিল না। অতিরিক্ত কিছু অর্থ উপার্জনের জন্য তাঁকে ভলগা নদীতে ডক শ্রমিক হিসেবে খণ্ডকালীন কাজ করতে হয়েছিল। পরিবারের সদস্যদের জন্য উপহার কিনতে এই অর্থ ব্যয় করেছিলেন তিনি।’

১৯৫৫ সালে ইউরি গ্যাগারিন ওরেনবুর্গ পাইলট স্কুলে ভর্তি হন এবং সেখান থেকে স্নাতক শেষ করার পর সোভিয়েত বিমানবাহিনীতে লেফটেন্যান্ট হিসেবে যোগ দেন। আর এখানেই ভ্যালেন্তিনার (স্ত্রী) সঙ্গে তাঁর পরিচয় হয়। ভ্যালেন্তিনা ওরেনবুর্গ মেডিকেল স্কুলের স্নাতক ছিলেন। দুজনের বিয়ের পর গ্যাগারিন যুদ্ধবিমানের পাইলট হিসেবে কাজ শুরু করেন।

১৯৬০ সালে সোভিয়েত মহাকাশ কর্মসূচির অংশ হিসেবে মহাকাশে পাঠানোর জন্য সম্ভাব্য প্রার্থী হিসেবে গ্যাগারিনসহ ২০ জনকে বেছে নেওয়া হয়। তাঁদের মধ্য থেকে পরে আবার চূড়ান্তভাবে দুজনকে বাছাই করা হয়। এর মধ্যে একজন গ্যাগারিন এবং অপরজন গিরমান তিতোভ। এবার একজনকে বেছে নেওয়ার পালা। কয়েকজন তখন অপেক্ষাকৃত নম্র স্বভাবের গ্যাগারিনকে বাছাই করার পক্ষে মত দেন। চূড়ান্তভাবে তাঁকেই নির্বাচিত করা হয়।

সফল অভিযান ও খ্যাতি

১৯৬১ সালের ১২ এপ্রিল। ২৭ বছর বয়সী গ্যাগারিন কাজাখস্তানের রকেট উৎক্ষেপনকেন্দ্রে ৩০ মিটার উঁচু রকেটে বসে অপেক্ষা করছিলেন। মস্কোর সময় সকাল ৯টা ৭ মিনিটে মহাকাশের উদ্দেশে গ্যাগারিনের সে রোমাঞ্চকর যাত্রা শুরু হয়। যাত্রার সময় তিনি চিৎকার করে বলে ওঠেন—পোয়েখালি, যার অর্থ হলো ‘আমরা চললাম’। পৃথিবীর কক্ষপথে তাঁর ভ্রমণটি ১০৮ মিনিট ধরে স্থায়ী হয়েছিল। ঐতিহাসিক এ ভ্রমণের সময় গ্যাগারিন টিউব থেকে টিপে টিপে খাবার খেতে পেরেছিলেন। উচ্চ ফ্রিকোয়েন্সির একটি রেডিও এবং একটি টেলিগ্রাফ কি ব্যবহার করে পৃথিবীতে নিয়ন্ত্রণকক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলেন তিনি। আর এভাবে নিয়ন্ত্রণকক্ষকে সর্বশেষ অবস্থা সম্পর্কে জানাতে পেরেছিলেন।

অবশ্য অভিযানটি ভয়াবহ রকমের বিপর্যয়ের কাছাকাছি চলে গিয়েছিল। অভিযান শেষ করে পৃথিবীতে ফিরে আসার সময় এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। নভোযানের মূল ক্যাপসুলকে যে তারটি সার্ভিস ক্যাপসুলের সঙ্গে যুক্ত করে রাখে, সেটি আলগা হচ্ছিল না। এতে পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে ঢোকার সময় নভোযানটিতে তীব্র কম্পন দেখা দেয়। তবে ক্যাপসুলটি মাটিতে পড়ার আগেই গ্যাগারিন হঠাৎ করেই ভেতর থেকে বেরিয়ে আসেন এবং প্যারাশুটে করে ভলগা নদীর কাছে নিরাপদে অবতরণ করেন।

গ্যাগারিন যে সময়ে মহাকাশে যান, ওই সময় রকেট থেকে শুরু করে নভোযান এবং নিয়ন্ত্রণব্যবস্থার কার্যকারিতা নিয়ে কেউই শতভাগ নিশ্চিত ছিলেন না। এমনকি মহাশূন্যে পৌঁছাতে পারলেও ভেতরের মানুষটি বাঁচবে কি না, তা–ও ছিল অজানা।

ইউরি গ্যাগারিনকে ফুল দিয়ে শুভেচ্ছা জানাচ্ছেন নিকিতা ক্রুশ্চেভ.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: কর ছ ল ন র পর ব র হয় ছ ল র জন য র সময়

এছাড়াও পড়ুন:

এই সরকারও আমলাতন্ত্রের চাপে!

চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থান নতুন যে জন-আকাঙ্ক্ষা তৈরি করেছে, সেখানে নিশ্চিত করেই জনপ্রশাসন সংস্কারের প্রশ্নটি নাগরিকদের কেন্দ্রীয় একটি চাহিদা। কিন্তু অন্তর্বর্তী সরকার যেভাবে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের মতোই পদ ছাড়া পদোন্নতি দিচ্ছে, তাতে উদ্বিগ্ন না হওয়ার কোনো কারণ নেই। কেননা, আগের সরকার কর্তৃত্ববাদী ও স্বৈরাচারী হয়ে উঠেছিল যে কয়টা স্তম্ভের ওপর দাঁড়িয়ে, তার অন্যতম আমলাতন্ত্র।

জনপ্রশাসনকে রাজনীতিকরণের বৃত্ত ভেঙে জনবান্ধব করার একটা বড় সুযোগ এনে দিয়েছিল অভ্যুত্থান। কিন্তু শুরু থেকেই অন্তর্বর্তী সরকার আমলাতন্ত্রের ওপর অতিনির্ভরশীল হয়ে ওঠায় সেই সুযোগ অনেকটাই হাতছাড়া হয়েছে। সরকারি কর্মকর্তাদের বিরোধিতার কারণে জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের বড় কোনো সুপারিশ বাস্তবায়ন করতে পারেনি সরকার। অন্যদিকে বেতন বাড়াতে গঠন করা হয়েছে বেতন কমিশন। কিছু মুখকে সরিয়ে দেওয়া ছাড়া জনপ্রশাসনে সেই পুরোনো চর্চা অব্যাহত রয়েছে। বিশেষ করে পদ ছাড়া পদায়নের ক্ষেত্রে জনপ্রশাসনে যেভাবে আগের সরকারের চর্চার ধারাবাহিকতা বজায় রাখা হয়েছে, সেটা যারপরনাই দুঃখজনক।

প্রথম আলোর খবর জানাচ্ছে, উপসচিব স্তরে যেখানে আগে থেকেই পদের চেয়ে ৬০০ কর্মকর্তা বেশি রয়েছেন, সেখানে আগস্ট মাসে নতুন করে ২৬৮ জনকে এই পদে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে। অতিরিক্ত সচিব পদেও পদোন্নতির আলোচনা শুরু হয়েছে। রাজনৈতিক সরকারের আমলে জনপ্রশাসনে হরেদরে পদোন্নতি দেওয়ার অনেক নজির আছে। এর কারণ একটাই, আমলাতন্ত্রকে তুষ্ট রাখা। অন্তর্বর্তী সরকার এই চর্চায় ছেদ ঘটাতে পারবে, সেটাই সবাই প্রত্যাশা করেছিল।

পরিহাসের বিষয় হচ্ছে, জনপ্রশাসনে পদ ছাড়া পদোন্নতি দেওয়ার পর বেশির ভাগ কর্মকর্তাকে আগের জায়গাতেই রেখে দেওয়া হয়। এর মানে হচ্ছে তাঁরা আগের দায়িত্বই পালন করেন, কিন্তু মাঝখান থেকে বেতন-ভাতা বাড়ে। উপসচিব পর্যায়ের কর্মকর্তারা তিন বছর চাকরি পাওয়ার পর বিনা সুদে গাড়ি কেনার জন্য ঋণসুবিধা পান। অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে অবসরে যাওয়া সরকারি কর্মকর্তাদের যেভাবে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে, তার দৃষ্টান্তও খুব বেশি নেই। অবসরে যাওয়া প্রশাসন ক্যাডারের ‘বঞ্চিত’ ৭৬৪ জন কর্মকর্তাকে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে ও অন্য ক্যাডারের ‘বঞ্চিত’ ৭৮ জন অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে ভূতাপেক্ষ পদোন্নতির সুপারিশ করা হয়েছে।

জনপ্রশাসনের মেধাবী ও যোগ্য কর্মকর্তারা পদোন্নতি পেয়ে পরের ধাপে যাবেন, সেটা স্বাভাবিক বিষয়। কিন্তু পদ না থাকার পরও কেন পদায়ন করা হবে? এ ক্ষেত্রে সরকারকে পর্যালোচনা করে দেখা প্রয়োজন, জনপ্রশাসনের বিভিন্ন স্তরে পদ বাড়ানো যায় কি না। আবার যেখানে এমনিতেই পদের বিপরীতে নিয়োগপ্রাপ্ত কর্মকর্তার সংখ্যা বেশি, সেখানে অবসরে যাওয়া কর্মকর্তাদের নিয়োগ দেওয়া কতটা যৌক্তিক?

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকপ্রশাসন বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ও জনপ্রশাসনবিশেষজ্ঞ সালাউদ্দিন এম আমিনুজ্জামান বলেছেন, জনপ্রশাসনে পদ ছাড়া পদোন্নতি দেওয়া যায় না। তবে বিশেষ ক্ষেত্রে মেধাবীদের পদোন্নতি দেওয়ার সুযোগ রয়েছে। এরপরও কেন এমন পদোন্নতি—সেই ব্যাখ্যায় তিনি বলেছেন, সরকার সম্ভবত আমলাতন্ত্রের চাপে রয়েছে। এই ধারণা শুধু তাঁর একার নয়, নাগরিক পরিসরের
বিস্তৃত একটি ধারণাও। অন্তর্বর্তী সরকারকে অবশ্যই এর পরিষ্কার ব্যাখ্যা হাজির করা উচিত।

মাথাভারী আমলাতন্ত্র সরকারি সেবা নাগরিকের কাছে ঠিকভাবে পৌঁছানোর ক্ষেত্রে বড় একটা বাধা। অন্যদিকে সরকারকে এখানে বিশাল ব্যয়ের বোঝা বহন করতে হয়। ফলে মাঠ প্রশাসন থেকে শুরু করে সিনিয়র সচিব পর্যন্ত একটি সামঞ্জস্যপূর্ণ ও গতিশীল জনপ্রশাসনই সবাই প্রত্যাশা করে। জনপ্রশাসনের সব স্তরে পদোন্নতি রাজনৈতিক বিবেচনায় নয়, মেধার ভিত্তিতেই হতে হবে।

সম্পর্কিত নিবন্ধ