কয়েক দিন পরপর সংবাদমাধ্যমে খবর হয়, ঢাকা আজ বিশ্বের প্রথম কিংবা দ্বিতীয় বায়ুদূষিত নগরী। কখনও কখনও ঢাকাকে পাল্লা দিতে হয় কাম্পালা (উগান্ডা), দিল্লি কিংবা বেইজিংয়ের সঙ্গে। সুইজারল্যান্ডে অবস্থিত আন্তর্জাতিক বায়ুমান প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান (আইকিউএয়ার) বায়ুদূষণের ওপর নিয়মিত ‘এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্স স্কোর’ প্রকাশ করে। এই স্কোরের ওপর ভিত্তি করে সবচেয়ে অস্বাস্থ্যকর, স্বাস্থ্যকর কিংবা অধিক স্বাস্থ্যকর শ্রেণির নগরীর তথ্য প্রকাশ করা হয়। খবরজুড়ে শুধু স্কোরগুলোর এক ধরনের ব্যবচ্ছেদ করা হয়। আমার মতে, স্কোরগুলোর ব্যবচ্ছেদ না ছাপিয়ে শুধু ঢাকার অবস্থান জানালেই চলে। 
ঢাকার বায়ুদূষণের একটি বড় অংশ আসে যানবাহন, শিল্পকারখানা ও নির্মাণকাজ থেকে। ডিজেল ও কয়লার মতো জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহারের ফলে বিপুল পরিমাণ কার্বন ও উদ্বায়ী জৈব যৌগ নির্গত হয়, যা যানবাহন ও কলকারখানা থেকে আসে। একই সঙ্গে খোলা জায়গায় বর্জ্য পোড়ানোর ফলে অপরিপূর্ণ দহন হয়। যার ফল বড় মাত্রায় কালো কার্বন। এ ছাড়া ইটভাটা বিপুল পরিমাণ ধোঁয়া ও কুয়াশা সৃষ্টি করে, যা কার্বন মনোক্সাইড ও ওজোন নির্গত করে। অপরিকল্পিত নির্মাণকাজ থেকে ছড়িয়ে পড়ে ধুলাবালি, বিশেষ করে সূক্ষ্ম কণা (যেমন সিলিকা ধুলা, মাটি ও পাথরের সূক্ষ্ম কণা)। ঢাকার রাস্তায় প্রতিদিন ডিজেল কিংবা তেলচালিত ১৫ লক্ষাধিক যানবাহন চলাচল করে। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণায় বলা হয়েছে, ঢাকার বায়ুদূষণের ২৫-৩০ শতাংশ উৎস যানবাহন থেকে নির্গত ধোঁয়া। ঢাকার আশপাশে ৭ সহস্রাধিক ইটভাটা থেকে নির্গত কার্বন ডাইঅক্সাইড, সালফার ডাইঅক্সাইড, নাইট্রোজেন অক্সাইড বাতাসের প্রধান দূষক।

পরিবেশ অধিদপ্তরের তথ্যানুযায়ী, বাংলাদেশে ৩৫-৪০ শতাংশ বায়ুদূষণের জন্য দায়ী ইটভাটা। তা ছাড়া ঢাকার বিভিন্ন শিল্প এলাকা যেমন– সাভার, টঙ্গী, নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুরে নির্মাণসামগ্রী এবং রাসায়নিক বর্জ্য থেকে ভয়াবহ দূষণ তৈরি হচ্ছে।

ঢাকায় প্রতিবছর গড়ে দুই থেকে তিন হাজার নতুন বাসাবাড়ি-প্রতিষ্ঠানের নির্মাণকাজ চলে। ঢাকা দক্ষিণ ও উত্তর সিটি করপোরেশনের তথ্যানুসারে, শহরের ১৫-২০ শতাংশ বায়ুদূষণের জন্য দায়ী নির্মাণকাজ। সিটি করপোরেশনের বাইরেও আশপাশের প্রায় প্রতিটি অঞ্চলে এসবের ব্যাপকভিত্তিক কর্মযজ্ঞ চলে। নির্মাণ সাইটগুলোতে সিমেন্ট, বালি, ইটের গুঁড়ো এবং রাস্তার ধুলাবালি বাতাসে ছড়িয়ে পড়ে, যা ফুসফুসের জন্য ভয়াবহ ক্ষতিকর। ঢাকায় প্রতিদিন গড়ে ৬ হাজার টন বর্জ্য উৎপন্ন হয়। এর একটি বড় অংশ খোলা জায়গায় পোড়ানো হয়। 
২০২৩ সালে ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের বাসযোগ্যতা সূচকে ঢাকা বিশ্বের ১৪০টি শহরের মধ্যে ১৩৭তম স্থানে রয়েছে। ক্রমবর্ধমান দূষণের কারণে ভবিষ্যতে বাসযোগ্যতার অবনতি ঘটবে, যা নগর পরিকল্পনার জন্য উদ্বেগজনক। বিশ্বব্যাংকের ২০২২ সালের রিপোর্ট অনুযায়ী, বায়ুদূষণের কারণে বাংলাদেশের বার্ষিক ৪ বিলিয়ন ডলারের ক্ষতি হচ্ছে।
পরিবেশবান্ধব গণপরিবহন বৃদ্ধির ওপর গুরুত্ব আরোপ করা দরকার। ইলেকট্রিক বাস, মেট্রোরেল এবং আধুনিক সিএনজি যানবাহনের সংখ্যা বাড়ালে জ্বালানির অপচয় কম হবে এবং ধোঁয়া ও দূষণ কমাবে। বিভিন্ন গবেষণামতে, ইলেকট্রিক যানবাহন প্রচলন করলে বায়ুদূষণ ২০-৩০ শতাংশ হ্রাস পেতে পারে। নির্মাণস্থলে ধুলা নিয়ন্ত্রণে দীর্ঘস্থায়ী পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন দরকার। উন্নত প্রযুক্তি যেমন– জলীয় স্প্রে, অস্থায়ী ঢাকনা ব্যবহার নিশ্চিত এবং নির্মাণের সময় কঠোর নিয়ম প্রয়োগ করা। বিশ্বব্যাংকের রিপোর্ট অনুযায়ী, নিয়ন্ত্রিত নির্মাণ সাইট পরিচালনার মাধ্যমে ধুলাবালির পরিমাণ ২৫ শতাংশ কমানো সম্ভব।
ইটভাটার বিকল্প ব্যবস্থাপনার ওপর গুরুত্ব দেওয়া দরকার। অটোক্লেভ্ড অ্যারেটেড কংক্রিট প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়ানো, যা ইটের বিকল্প হিসেবে পরিবেশবান্ধব, সেই সঙ্গে দূষণ কমায়।
বৈজ্ঞানিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কৌশল এবং বাস্তবায়ন দ্রুত গ্রহণ করা দরকার। খোলা জায়গায় আবর্জনা পোড়ানো সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ এবং আধুনিক ও সম্পূর্ণ বৈজ্ঞানিক বর্জ্য পুনঃপ্রক্রিয়াকরণ প্রযুক্তি চালু করা দরকার। 

সবুজায়ন প্রকল্প চালু করা জরুরি। শহরের প্রতিটি ফাঁকা জায়গায় বৃক্ষরোপণ প্রকল্প চালু হলে তা কার্বন শোষণের মাধ্যমে বায়ুর মান উন্নত করবে। বিজ্ঞানীদের মতে, শহরের ১০ শতাংশ বেশি গাছ লাগালে বাতাসে কণা ২০-২৫ শতাংশ কমানো সম্ভব। পরিবেশ আইন কঠোরভাবে প্রয়োগ করা দরকার। বিদ্যমান বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণ আইন কঠোরভাবে বাস্তবায়ন এবং দূষণকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। বিশ্বব্যাংকের গবেষণামতে, শক্তিশালী পরিবেশনীতি প্রয়োগের মাধ্যমে বায়ুদূষণ ৩০ শতাংশ পর্যন্ত হ্রাস করা সম্ভব।
বর্তমানে বিশ্বের অন্যতম দূষিত ঢাকার বাতাস। এটি শুধু স্বাস্থ্য নয়; অর্থনীতি এবং বাসযোগ্যতার ওপর ভয়াবহ প্রভাব ফেলছে। সরকারের উচিত দূষণ নিয়ন্ত্রণে কঠোর আইন বাস্তবায়ন এবং নাগরিকদের আরও সচেতন করা। পরিবেশ রক্ষায় সক্রিয় ভূমিকা নিতে হবে সরকারকেই। তবেই ভবিষ্যৎ প্রজন্ম একটি সুস্থ ও বাসযোগ্য ঢাকা পাওয়ার স্বপ্ন দেখতে পারবে। 
 
ড.

হাসিনুর রহমান খান: অধ্যাপক, ফলিত পরিসংখ্যান এবং ডেটা সায়েন্স, পরিসংখ্যান
গবেষণা ও শিক্ষণ ইনস্টিটিউট,
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
[email protected]

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: পর ব শ বর জ য ন র গত পর ব শ র জন য ক র বন শহর র র ওপর দরক র ইটভ ট

এছাড়াও পড়ুন:

শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস আজ

‘উদয়ের পথে শুনি কার বাণী/ ভয় নাই ওরে ভয় নাই/ নিঃশেষে প্রাণ যে করিবে দান/ ক্ষয় নাই তার ক্ষয় নাই’। তাঁদের নিঃশেষে প্রাণদানের স্মৃতি আজ গভীর বেদনায় স্মরণ করবে জাতি। আজ থেকে ৫৪ বছর আগে দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তান বুদ্ধিজীবীরা হানাদার পাকিস্তান সেনাবাহিনীর নীলনকশার শিকার হয়ে নির্মম হত্যার শিকার হয়েছিলেন।

অমিত বিক্রম বাঙালির জীবনপণ যুদ্ধে হানাদার পাকিস্তানি বাহিনীর চূড়ান্ত পরাজয় তখন ছিল কেবল দিনগণনার বিষয়। সেই অনিবার্য পরাজয়ের প্রাক্কালে মরণকামড় দেওয়ার চেষ্টা করেছিল ঘাতক বাহিনী। স্বাধীনতা অর্জন করলেও বাঙালি জাতি যেন মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে না পারে, সেই চক্রান্ত করেছিল তারা। দেশের সেরা বুদ্ধিজীবীদের তালিকা করে তাঁদের বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে গিয়ে নির্মম নির্যাতন করে হত্যা করা হয়েছিল। এ কাজে পাকিস্তানি সেনাদের সরাসরি সহায়তা করেছিল তাদের মিত্র এ দেশি রাজাকার, আলবদর বাহিনী। এরাই ঘাতক সেনাদের নিয়ে গিয়ে চিনিয়ে দিয়েছে বুদ্ধিজীবীদের বাড়ি। চিনিয়ে দিয়েছে সেই নিরীহ মানুষগুলোকে।

মহান মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ে পরে মিরপুরে রায়েরবাজার পরিত্যক্ত ইটখোলা ও মিরপুরে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে যাওয়া সেসব বুদ্ধিবৃত্তিক পেশায় যুক্ত মানুষের মরদেহগুলো উদ্ধার করা হয়। তাঁদের অনেকের ছিল পিছমোড়া করে হাত ও চোখ বাঁধা। ভয়ানক নির্যাতনের চিহ্ন ছিল শরীরে। তাঁদের মরদেহ উদ্ধার হওয়ার মধ্য দিয়ে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বুদ্ধিজীবী হত্যার গভীর ষড়যন্ত্র প্রকাশ হয়ে পড়ে। এর পর থেকেই শহীদ বুদ্ধিজীবীদের প্রতি শ্রদ্ধা ও শোক প্রকাশ করে ১৪ ডিসেম্বর শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস পালিত হয়ে আসছে।

শুধু ঢাকাতেই নয়, সারা দেশেই বুদ্ধিবৃত্তিক কাজে যুক্ত মানুষদের হত্যা করেছিল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী। এই হত্যাকাণ্ডের ছিল দুটি পর্যায়। ‘অপারেশন সার্চলাইট’ নামে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে হানাদার সেনারা রাজধানীতে গণহত্যা শুরু করেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও আশপাশের এলাকায় সাধারণ নিরীহ জনসাধারণের পাশাপাশি শিক্ষক, চিকিৎসকদেরও হত্যা করে। এরপর থেকে হানাদাররা সারা দেশের শিক্ষক, চিকিৎসক, প্রকৌশলী, আইনজীবী, শিল্পী, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, গবেষক, সংস্কৃতিসেবীসহ মেধা মনন সৃজনশীল কাজে যুক্ত মানুষদের বেছে বেছে হত্যা করতে থাকে। মুক্তিযুদ্ধে শেষ পর্যায় তারা এই বুদ্ধিবৃত্তিক মানুষদের নিঃশেষ করে দেওয়ার জন্য তালিকা করে হত্যা চালাতে থাকে। তাঁদের মধ্যে যেমন প্রবীণ প্রাজ্ঞজনেরা ছিলেন, তেমনি ছিলেন উদিত যৌবনের বহু সম্ভাবনাময় তরতাজা প্রাণ। আজ তাঁদের স্মৃতির স্মরণ করা হবে সারা দেশে।

শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন ও প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস পৃথক বাণী দিয়েছেন।

কর্মসূচি

শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস পালন উপলক্ষে অনুষ্ঠিত আন্তমন্ত্রণালয়ের সভায় জানানো হয়েছে, আজ রোববার সকাল ৭টা ৫ মিনিটে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন এবং ৭টা ৬ মিনিটে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস মিরপুর শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধে পুষ্পস্তবক অর্পণ করবেন। তাঁরা জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানিয়ে সেখানে নীরবে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকবেন। এ সময় বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর একটি চৌকস দল রাষ্ট্রপতি ও প্রধান উপদেষ্টাকে রাষ্ট্রীয় স্যালুট প্রদান করবে।

রাষ্ট্রপতি ও প্রধান উপদেষ্টার পুষ্পস্তবক অর্পণের পর মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক উপদেষ্টা ফারুক-ই-আজম, মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয়ের সচিব ইসরাত চৌধুরী, শহীদ বুদ্ধিজীবী পরিবারের সদস্য এবং হুইলচেয়ারধারী যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধারা মিরপুর শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধে পুষ্পস্তবক অর্পণ করবেন।

সম্পর্কিত নিবন্ধ