৭০০ পাখি হত্যা, আমরা কবে মানুষ হব
Published: 13th, March 2025 GMT
হেমন্তের শেষ দিক। দিগন্তজোড়া পাকা ধান। পুরো গ্রাম কোলাহলমুখর। ধান কাটা হবে। তার আগে প্রায় প্রতিটি জমির এক কোনায় ছোট খুঁটি দিয়ে জাল পাতা হয়েছে। ধানের লোভে আসা ক্ষুদ্র পাখি বাড়ই ধরা পড়বে। আমরা প্রতীক্ষা করতাম, কখন ধান কাটা শেষ হবে। দিনের শেষে দেখতাম, জালে আটকা পড়া পাখিদের চেঁচামেচি। মুক্তির আশায় তাদের ডানা ঝাপটানো যত বাড়ত, আমাদের উল্লাস তত বাড়ত। কাটা ধানের সঙ্গে হেমন্তের বিকেলে জালে জড়ানো পাখি ঘরে নিয়ে আসার আনন্দটি ছিল উৎসবের মতো।
চট্টগ্রামের ভাষায় এই পাখির স্বাদ নিয়ে একটি ছড়া প্রচলিত আছে, ‘এক বাডই তেরো মুলা/তঅ বাডই তুলা তুলা।’ তার মানে একটা বাডই দিয়ে তেরোটি মুলা রাঁধলেও বাডইয়েরস্বাদ অতুলনীয়। সেই অতুলনীয় স্বাদ এখন শতগুণ তিক্ততা আর জ্বালা ছড়িয়েছে এখন স্মৃতির অঙ্গনে। কেননা সেই উল্লাস আর মাংস খাওয়ার লোভ একটা অতি ক্ষুদ্র প্রাণীর জীবনকে বিপন্ন করেছে। আমাদের পরিবেশকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দিয়েছে। এ ভাবনায় মনের মধ্যে অপরাধবোধ আসে। ভাবি, প্রকৃতি আমাদের এত বিপুলভাবে দিয়েছে, আমরা শুধু লুটেপুটে খেয়েছি, কোনো দিন ফিরতি দেওয়ার কথা ভাবিনি। আজ অনেক দিন পর পত্রিকায় একটি খবর পড়ে সেই অপরাধবোধ আবার জেগে উঠেছে মনে এবং তা তীব্র হয়ে মনটাকে বিষণ্ন করে তুলেছে। শুধু আমি নই, এ ঘটনায় হতাশ হয়েছে অনেক সচেতন মানুষ।
প্রথম আলোসহ বিভিন্ন পত্রিকায় এই খবরে আনোয়ারায় জবাই করা প্রায় ৭০০ পাখিসহ তিনজনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। এ উপজেলায় পাখিদের স্বর্গরাজ্য বলে খ্যাত বাঁকখাইন, কৈখাইন, মালিয়ারা, কেয়াগড়সহ শিকলবাহা খালের দুই পাশের ঝোপঝাড় ও জঙ্গল থেকে ধরে এসব পাখিকে হত্যা করা হয়েছে। সংঘবদ্ধ একটি চক্র জবাই করা ১৩৫টি শালিক, ৪২২টি চড়ুই এবং ১৪০টি বাবুই পাখি ভিন্ন নামে হোটেল বিক্রি করার জন্য নিয়ে যাচ্ছিল।
খবরে আরও জানলাম, চক্রটি বহুদিন ধরে অভয়ারণ্য, ঝোপঝাড় ও জলাশয় থেকে পাখি ধরে হত্যা করে বিক্রি করে আসছে। পাখি শিকার এবং ফাঁদ পেতে পাখি ধরার এই পুরোনো শখ (!) বিবর্তিত হয়ে ক্রমেই বীভৎস রূপে ব্যবসায় পরিণত হয়েছে। মানুষ পাখিসহ বন্য প্রাণী পাচার এবং হত্যা করছে। প্রথম আলোর খবরে আমরা দেখি, ২০২১ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত সারা দেশে ১ হাজার ৭১৭টি অভিযান পরিচালনা করে ১৯ হাজারের বেশি বন্য প্রাণী উদ্ধার করা হয়েছে। এর মধ্যে বিভিন্ন প্রজাতির পাখির সংখ্যা ৯ হাজার এবং বিভিন্ন প্রজাতির কাছিম ও কচ্ছপের সংখ্যা ৩ হাজারের বেশি। এর মধ্যে সুন্ধি কাছিম এক হাজারের বেশি ও কড়ি কাইট্টা (কচ্ছপ) ৯৫৫টি। মুনাফার লোভে মানুষ কত নিষ্ঠুর হতে পারে, কত বিচিত্র অপরাধে জড়িত হতে পারে, তার নজির আমাদের চোখের সামনে ঘটে যাচ্ছে। শুধু লোভ নয়, মানুষের উল্লাস, উৎসব, শখ, উন্নয়ন ইত্যাদি নানা কর্মকাণ্ড যে অন্য প্রাণীর জীবনকে বিপন্ন করে তুলছে, তা আমরা একবারও ভাবছি না।
গত বর্ষবরণের রাতে বিকট শব্দ ও বায়ুদূষণের কারণে আটটি জায়গায় শতাধিক পাখির মৃত্যু হয়েছে। বেশি মারা গেছে চড়ুই। কাক, বাতাসী ও ঘরবাতাসী পাখিরও মৃত্যু হয়েছে। সবচেয়ে বেশি মারা গেছে মিরপুর-১৪ নম্বর এলাকা, বোটানিক্যাল গার্ডেন ও জাতীয় চিড়িয়াখানা, তেজগাঁও সাতরাস্তা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা, পুরান ঢাকার গেন্ডারিয়া, ওয়ারী ও সদরঘাট এলাকায়। আর বিকট শব্দে বাসা থেকে বেশি পালিয়েছে টিয়া, লক্ষ্মীপ্যাঁচা, খঞ্জন ও শালিক পাখি।
ছোটবেলায় পড়েছি, আমরা পাখির ডাকে ঘুমিয়ে পড়ি, পাখির ডাকে জাগি। মনে হয়, এ কবিতার দিন শেষ হয়ে এসেছে। হাতে বিজ্ঞানসম্মত কোনো পরিসংখ্যান না থাকলেও আমরা চোখ বন্ধ করে বলতে পারি দিন দিন পাখিসহ অন্যান্য প্রাণীর সংখ্যা কমে আসছে। এমনকি কাকের সংখ্যাও কমে আসছে।
শুধু চট্টগ্রাম নয়, সারা বাংলাদেশের জীববৈচিত্র্যের করুণ দশা। অপরিকল্পিত নগরায়ণ, বন্য প্রাণী সংরক্ষণ আইন না মানা, মানুষের লোভ, বিভিন্ন ফসলি জমিতে কীটনাশক ব্যবহার, অরণ্য অঞ্চল সংকীর্ণ হয়ে যাওয়া, গাছ কর্তন, খাদ্যের অভাবসহ বহু কারণে মানুষ তাদের অন্য প্রতিবেশীদের হারাতে বসেছে। আমাদের প্রতিবেশ এতে যে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, সেটা আমরা বুঝেও বুঝতে পারছি না যেন। কিন্তু এর পরিণতি ভয়াবহ হবে। আমাদের প্রতিবেশ, পরিবেশকে রক্ষা করার জন্য আইন আছে, কিন্তু আইনের বাস্তবায়ন নেই।
বন্য প্রাণীর সুরক্ষার জন্যও ২০১২ সালে বন্য প্রাণী (সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা) আইন করা হয়। আইনের সংশোধিত তফসিলে প্রায় ১ হাজার ৩০০টি প্রজাতির পাখি, সরীসৃপ, উভচর, মাছ ইত্যাদিকে রক্ষিত ঘোষণা করা হয়েছে। ২০২১ সালের ২২ সেপ্টেম্বর আগের তফসিল সংশোধন করে মোট ৫২ প্রজাতির হাঙর ও রে মাছকে সুরক্ষার তালিকায় আনা হয়। আইন থাকার পরও আমাদের পাখিগুলো দিন দিন কমছে। কিছু পাখি চিরতরে হারিয়ে গেছে। অভয়ারণ্য হয়ে উঠছে পাখিদের বধ্যভূমি। এই করুণ অবস্থা আগে ছিল না।
৯২০ সালে প্রকাশিত চৌধুরী পূর্ণচন্দ্র দেববর্ম্মা তত্ত্বনিধি তাঁর ইতিহাস গ্রন্থ ‘চট্টগ্রামের ইতিহাসে’ লিখেছেন, ‘চট্টগ্রামের প্রায় সবখানে বন্য হস্তী, নানা প্রকারের হরিণ, বানর, হনুমান, বন্য বরাহ, শজারু, বাগডাস, কাঠবিড়ালি, বনবিড়াল, খান্ডাস, গোরখোদা, শৃগাল, রামকুত্তা চোখে পড়ত। মাঝেমধ্যে গন্ডার, ভালুক ও উল্লুকও পাওয়া যেত।’ তারও আগে সপ্তদশ শতকের ঐতিহাসিক ও পর্যটক শিহাবউদ্দিন তালিশ তাঁর ‘ফতিয়া ই ইব্রিয়া’ বইয়ে চট্টগ্রামের প্রকৃতি ও পাহাড়কে আলেক্সান্ডারের দুর্গের মতোই দুর্ভেদ্য বলে বর্ণনা করেছেন। সেই দুর্ভেদ্য পাহাড়শ্রেণি আর তার পাদদেশে সমতল ছিল নিবিড় গাছপালায় ঢাকা। চট্টগ্রাম ছিল বিপুল জীববৈচিত্র্যে ভরা এক জনপদ। কিন্তু কালে কালে সেই পাহাড়, অরণ্য ও জলাভূমি নিশ্চিহ্ন হয়েছে। আর এই প্রকৃতিকে ঘিরে বিকশিত প্রাণিকুলের সমাজটাও সংকুচিত হয়েছে। এ অঞ্চলের প্রাণীগুলো সেই পরিণতি মেনে নিয়ে ঠাঁই নিয়েছে ইতিহাসের পাতায়।
২০২২ সালে প্রকাশিত চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘ইনস্টিটিউট অব ফরেস্ট্রি অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্সের’ অধ্যাপক জি এন তানজিনা হাসনাত ও একই বিভাগের মোহাম্মদ আলীর লেখা এক প্রবন্ধে বলা হয়, গত ৩০ বছরে চট্টগ্রামে পাহাড়-জঙ্গলের সবুজ কমেছে ২১ দশমিক ৮২ শতাংশ আর পুকুর-জলাশয় কমেছে ৮ দশমিক ৩৭ শতাংশ। ১৯৯০ সালে নগরের মাত্র ১৯ শতাংশ এলাকায় বসতি থাকলেও এখন ৪৫ শতাংশ এলাকায় বিস্তৃত হয়েছে। এভাবে প্রকৃতির অংশ মানুষ দখল করতে থাকলে একদিন নিশ্বাস নিতেও কষ্ট হবে মানুষের। তাই এই আচরণের একটা ইতি টানতে হবে এখনই। পৃথিবীতে সব প্রাণীর সমান অধিকার, মানুষ নিজের স্বার্থে অন্য প্রাণীর জীবন ধ্বংস করা অপরাধ, অনৈতিক—এই চির নীতিবাক্যটি আমরা গ্রহণ না করলেও আমাদের এখন নিজেদেরই স্বার্থে পৃথিবীটাকে বসবাস উপযোগী রাখার জন্যই অন্যান্য প্রাণীর অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখা জরুরি হয়ে পড়েছে। বধ্যভূমি নয়, পৃথিবীকে পাখির অভয়ারণ্য বানাতে হবে, মানুষের জন্যই।
ওমর কায়সার প্রথম আলোর চট্টগ্রাম অফিসের বার্তা সম্পাদক
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: বন য প র ণ আম দ র প র জন য অপর ধ
এছাড়াও পড়ুন:
নির্বাচনের দিন অমোচনীয় কালি সরবরাহ না হলে ভোট গ্রহণ বন্ধ থাকবে: ছাত্রদল
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (জকসু) নির্বাচনে অমোচনীয় কালি সরবরাহ না করলে ভোট গ্রহণ বন্ধ থাকবে বলে হুঁশিয়ারি দিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রদলের নেতারা। এ ছাড়া এমফিল কোর্সে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীদের ভোটার ও প্রার্থী হওয়ার যোগ্যতা না দিয়ে ইচ্ছাকৃতভাবে ছাত্রদলকে ভোট প্রক্রিয়া থেকে বাদ দেওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে বলেও অভিযোগ করেছেন তাঁরা।
রোববার উপাচার্যের সভাকক্ষে রাজনৈতিক ও সক্রিয় সংগঠনের নেতাদের সঙ্গে অনুষ্ঠিত জকসু ও হল সংসদ নির্বাচন ২০২৫–এর আচরণবিধিবিষয়ক এক মতবিনিময় সভায় ছাত্রদলের নেতারা এমন মন্তব্য করেন।
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রদলের সদস্যসচিব শামসুল আরেফিন বলেন, ‘নির্বাচনে যদি কোনো ধরনের অনিয়মের ঘটনা ঘটে, তাহলে আমরা একচুল ছাড় দেব না। আমি প্রতিজ্ঞা করছি, যদি কোনো ধরনের অনিয়ম হয়— কোনো ছাড় হবে না। নির্বাচনের সময় অমোচনীয় কালি ব্যবহার করতে হবে। যদি নির্বাচন কমিশন অমোচনীয় কালি ব্যবহার করতে ব্যর্থ হয়, তাহলে ভোট গ্রহণ বন্ধ থাকবে।’
ভোটের স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে ‘ম্যানুয়ালি’ ভোট গণনার দাবি জানিয়ে শামসুল আরেফিন বলেন, ‘কত ব্যালট ছাপানো হলো, কত ভোট গণনা হলো, কত ব্যালট নষ্ট হলো—এসব তথ্য স্বচ্ছতার সঙ্গে প্রকাশ করতে হবে। কারণ, আমরা ডাকসুতে ব্যালট কেলেঙ্কারির অভিযোগ সম্পর্কে জানি।’
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রদলের আহ্বায়ক মেহেদী হাসান অভিযোগ করেন, কেন্দ্রীয় শিক্ষার্থী সংসদ বিধিমালায় এমফিল শিক্ষার্থীদের ভোটার ও প্রার্থী হওয়ার যোগ্যতা না দিয়ে ছাত্রদলকে ‘মাইনাস’ করার একটি মাস্টারপ্ল্যান করা হয়েছে। তিনি বলেন, ‘জকসু গঠন ও পরিচালনা বিধিমালায় বলা হয়েছে, তফসিল ঘোষণার পর নিয়মিত শিক্ষার্থী ভোটার কিংবা প্রার্থী ছাড়া কেউ বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশ করতে পারবে না। অন্যদিকে এমফিল শিক্ষার্থীদের ভোটার ও প্রার্থীর যোগ্যতা না দিয়ে আমাদের মাইনাস করা ছিল মাস্টারপ্ল্যান—আর সেই মাস্টারপ্ল্যান সফল হয়েছে।’
প্রধান নির্বাচন কমিশনার অধ্যাপক মোস্তফা হাসানের সভাপতিত্বে এ মতবিনিময় সভা অনুষ্ঠিত হয়। এতে উপস্থিত ছিলেন উপাচার্য রেজাউল করিম, প্রক্টর, সিন্ডিকেটের সদস্য, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় শিক্ষার্থী সংসদ ও হল শিক্ষার্থী সংসদ নির্বাচন ২০২৫-এর নির্বাচন কমিশনার এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে সক্রিয় বিভিন্ন সংগঠনের নেতারা।