সত্তরের দশকে মা-খালা-ফুপুদের বোনের বাড়ি বেড়াতে যাওয়া, তাদের দুলাভাই, বেয়াই-বেয়ান, তালই-মাউইয়ের সঙ্গে মধুর খুনসুটি সে সময়ের আর্থসামাজিক ও সাংস্কৃতিক জীবনের সরল ছবি তুলে ধরে। দুলাভাইকে নিজের ভাইদের মতো, বোনের বাড়ির আত্মীয়স্বজনকে নিকটাত্মীয় মনে করা হতো সে সময়। তার মানে এই নয় যে, তখন নারী ও শিশুর প্রতি সহিংসতা ঘটত না। কিন্তু ঘটনার সংখ্যা ও সহিংসতার মাত্রা এত তীব্র ছিল না। 

মাগুরার কন্যাশিশুটিও গিয়েছিল বোনের বাড়িতে। ঠিক সানন্দে ‘বেড়াতে’ নয়, সে গিয়েছিল বোনকে অনাকাঙ্ক্ষিত অবস্থা থেকে স্বস্তি বা সুরক্ষা দিতে। শিশুটি শেষ পর্যন্ত তার বোনকে বাঁচাতে পেরেছে, কিন্তু বিনিময়ে নিজের জীবনটা দিতে হয়েছে। তার আগে সহ্য করতে হয়েছে পাশবিক নির্যাতন। 

এমন অবস্থা পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র কারও কাম্য নয়। কিন্তু ঘটনাগুলো প্রায়ই ঘটে চলেছে। সমাজে একদিকে যেমন হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার হয়ে যাওয়ার উদাহরণ রয়েছে, তেমনি অন্যদিকে কন্যাকে ‘পার করে’ দিতে পারলে দরিদ্র পিতা-মাতার বেঁচে যাওয়ার দৃষ্টান্তও অহরহ। কন্যা শ্বশুরবাড়িতে নির্যাতনের শিকার হলে তাকে নিয়ে আসার চিন্তা না করে নির্যাতন সহ্য করে সংসার করার শিক্ষা ও পরামর্শ দেওয়া হয়। শুধু দরিদ্র পরিবারে নয়, মধ্যবিত্ত-উচ্চবিত্ত সব পরিবারেই একই অবস্থা। কিছুটা যে পরিবর্তন হয়নি, তা নয়। ডিভোর্সের হার বেড়ে যাওয়া এর প্রমাণ। বিয়েবিচ্ছেদ সংক্রান্ত সালিশি পরিষদের বার্ষিক প্রতিবেদন বলছে, পুরুষদের চেয়ে নারীরাই বিয়ে বিচ্ছেদের উদ্যোগে এগিয়ে। 

বিচ্ছেদের হার হ্রাস-বৃদ্ধিতে অবশ্য নারী ও শিশুর প্রতি সহিংসতায় খুব একটা হেরফের হচ্ছে না। অবস্থাদৃষ্টে মনে হতে পারে আমরা নারী ও শিশু নির্যাতনের স্বর্গরাজ্যে বাস করছি। পুলিশ সদরদপ্তরের তথ্য অনুসারে গত বছরের ফেব্রুয়ারি মাসেও ধর্ষণের মামলার সংখ্যা চলতি বছরের মতোই ছিল। মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশনের দেশের বিভিন্ন পত্রপত্রিকা থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুসারে জানা যায়, ২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছিল ৬৮টি এবং চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে ৭৬টি। ২০২৪ সালের মার্চ মাসের প্রথম দশ দিনে ধর্ষণের শিকার হয়েছিল ১৫ জন নারী ও শিশু এবং ২০২৫ সালের মার্চ মাসের প্রথম দশ দিনে ২৬ জন নারী ও শিশু।

জুলাই গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে পাওয়া অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে আমাদের প্রত্যাশা অনেক বেশি। কারণ এ সরকার সকল অবিচার-অনাচার ও বৈষম্য বিলোপের অঙ্গীকার করেছে। এই প্রত্যয়ের মূলে রয়েছে দেড় হাজারের বেশি শহীদের তাজা রক্ত। তাই যখন গত ১১ ফেব্রুয়ারি ধর্ষণবিরোধী আন্দোলনে পুলিশ হামলা করে, তখন আমরা স্তম্ভিত হই। চোখের সামনে ভেসে ওঠে বিগত কর্তৃত্ববাদী সরকারের প্রতিচ্ছবি।

সরকারের সদিচ্ছা ও জনসচেতনতা যে সহিংসতা কমাতে পারে তার উদাহরণ এসিড সন্ত্রাসের হার কমে আসা। এসিড সারভাইভারস ফাউন্ডেশন পরিচালিত গবেষণামতে, এই সহিংসতা কমার নেপথ্যে অন্যতম কারণ গণমাধ্যমের ভূমিকা ও বিভিন্ন প্রচার অভিযান, এসিড নিয়ন্ত্রণ আইন ২০০২ এবং এসিড অপরাধ প্রতিরোধ আইন ২০০২। এ ছাড়াও রয়েছে নারী ও মানবাধিকার সংগঠনগুলোর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা এবং এসিড সারভাইভারস ফাউন্ডেশনের কার্যকর ও দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণ। 

ধর্ষণের ক্ষেত্রে কঠিন আইন থাকলেও আইনের প্রয়োগ বা বাস্তবায়ন এবং নির্যাতিত নারী নিরাপত্তা নিশ্চিত করা এ বিষয়গুলোতে বড় সমস্যা রয়েছে। এ ক্ষেত্রে ধর্ষণের শিকার ভুক্তভোগী ব্যক্তির জন্য ন্যায়বিচার নিশ্চিতে ‘ধর্ষণ আইন সংস্কার জোট’ (আরএলআরসি) যে ১০ দফা দাবি জানিয়েছে, তা বিবেচনায় নিলে এসিড সহিংসতার মতো ধর্ষণও কমে যাবে বলে আশা করা যায়। 
এটাও মনে রাখতে হবে, অপরাধ সংঘটিত হয় প্রথমে সাংস্কৃতিক মননে। কিশোর ছেলেরা এলাকার মেয়েদের দিকে শিস ছুড়ে দিতে দিতে পুরুষ হয়ে ওঠে। সমাজের নানা-দাদা, বয়োজ্যষ্ঠ, দুলাভাই, বেয়াই-বেয়াইনের অশ্লীল কথাবার্তা এবং অনেক ক্ষেত্রে ইয়ার্কির ছলে গায়ে হাত দেওয়ার প্রশ্রয়ও আমাদের সমাজে আছে। এ মানসিকতাকে কেবল আইনি কাঠামো দিয়ে পরিবর্তন করা যাবে না; মনোজগতে পরিবর্তন প্রয়োজন। এ কাজটিই সবচেয়ে কঠিন। 

নারী ও শিশুর প্রতি সামাজিক ও সাংস্কৃতিক মনোজগৎ পরিবর্তনের কাজটি বহুস্তরভিত্তিক এবং এর জন্য রাষ্ট্রের অঙ্গীকার প্রয়োজন। প্রয়োজন যথাযথ বিনিয়োগ; বুদ্ধিবৃত্তিক ও অর্থনৈতিক। অপরাধী মনকে শিক্ষিত করার জন্য, নারী ও কন্যাদেরও সুরক্ষা নিশ্চিত করার জন্য এবং নারী-পুরুষ নির্বিশেষে মানবিক মন গড়ে তোলার জন্য গণমাধ্যমে নাটিকা, তথ্যচিত্র প্রদর্শন কার্যকর হতে পারে। অর্থাৎ সর্বমাত্রিক শিক্ষা-সচেতনতা কার্যক্রমের আওতায় আনতে হবে দেশের মানুষকে। সেইসব বার্তার উদ্দিষ্ট গ্রাহক যে কেবল কিশোর-কিশোরী, তরুণ-তরুণী হবেন এমন নয়; মাতাপিতা, অভিভাবক, সমাজের বয়োজ্যষ্ঠ, স্থানীয় নেতা সবাইকেই শিক্ষিত করার লক্ষ্য থাকতে হবে।
অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে বিনীত অনুরোধ, যে দায় ও দরদের সমাজ প্রতিষ্ঠার অভিপ্রায় নিয়ে আপনারা কাজ করছেন, সেখানে দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করে বলেন– প্রত্যেক শিশু ও নারী থাকবে সুরক্ষিত সারাক্ষণ, কারও অধিকার হবে না ভূলুণ্ঠিত, মাগুরার শিশুটির মতো কোনো শিশুকে পৃথিবী থেকে নিতে হবে না অকালবিদায়।

তানিয়া খাতুন: মানবাধিকারকর্মী

.

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: সরক র র এস ড স র জন য অবস থ

এছাড়াও পড়ুন:

শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস আজ

‘উদয়ের পথে শুনি কার বাণী/ ভয় নাই ওরে ভয় নাই/ নিঃশেষে প্রাণ যে করিবে দান/ ক্ষয় নাই তার ক্ষয় নাই’। তাঁদের নিঃশেষে প্রাণদানের স্মৃতি আজ গভীর বেদনায় স্মরণ করবে জাতি। আজ থেকে ৫৪ বছর আগে দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তান বুদ্ধিজীবীরা হানাদার পাকিস্তান সেনাবাহিনীর নীলনকশার শিকার হয়ে নির্মম হত্যার শিকার হয়েছিলেন।

অমিত বিক্রম বাঙালির জীবনপণ যুদ্ধে হানাদার পাকিস্তানি বাহিনীর চূড়ান্ত পরাজয় তখন ছিল কেবল দিনগণনার বিষয়। সেই অনিবার্য পরাজয়ের প্রাক্কালে মরণকামড় দেওয়ার চেষ্টা করেছিল ঘাতক বাহিনী। স্বাধীনতা অর্জন করলেও বাঙালি জাতি যেন মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে না পারে, সেই চক্রান্ত করেছিল তারা। দেশের সেরা বুদ্ধিজীবীদের তালিকা করে তাঁদের বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে গিয়ে নির্মম নির্যাতন করে হত্যা করা হয়েছিল। এ কাজে পাকিস্তানি সেনাদের সরাসরি সহায়তা করেছিল তাদের মিত্র এ দেশি রাজাকার, আলবদর বাহিনী। এরাই ঘাতক সেনাদের নিয়ে গিয়ে চিনিয়ে দিয়েছে বুদ্ধিজীবীদের বাড়ি। চিনিয়ে দিয়েছে সেই নিরীহ মানুষগুলোকে।

মহান মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ে পরে মিরপুরে রায়েরবাজার পরিত্যক্ত ইটখোলা ও মিরপুরে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে যাওয়া সেসব বুদ্ধিবৃত্তিক পেশায় যুক্ত মানুষের মরদেহগুলো উদ্ধার করা হয়। তাঁদের অনেকের ছিল পিছমোড়া করে হাত ও চোখ বাঁধা। ভয়ানক নির্যাতনের চিহ্ন ছিল শরীরে। তাঁদের মরদেহ উদ্ধার হওয়ার মধ্য দিয়ে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বুদ্ধিজীবী হত্যার গভীর ষড়যন্ত্র প্রকাশ হয়ে পড়ে। এর পর থেকেই শহীদ বুদ্ধিজীবীদের প্রতি শ্রদ্ধা ও শোক প্রকাশ করে ১৪ ডিসেম্বর শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস পালিত হয়ে আসছে।

শুধু ঢাকাতেই নয়, সারা দেশেই বুদ্ধিবৃত্তিক কাজে যুক্ত মানুষদের হত্যা করেছিল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী। এই হত্যাকাণ্ডের ছিল দুটি পর্যায়। ‘অপারেশন সার্চলাইট’ নামে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে হানাদার সেনারা রাজধানীতে গণহত্যা শুরু করেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও আশপাশের এলাকায় সাধারণ নিরীহ জনসাধারণের পাশাপাশি শিক্ষক, চিকিৎসকদেরও হত্যা করে। এরপর থেকে হানাদাররা সারা দেশের শিক্ষক, চিকিৎসক, প্রকৌশলী, আইনজীবী, শিল্পী, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, গবেষক, সংস্কৃতিসেবীসহ মেধা মনন সৃজনশীল কাজে যুক্ত মানুষদের বেছে বেছে হত্যা করতে থাকে। মুক্তিযুদ্ধে শেষ পর্যায় তারা এই বুদ্ধিবৃত্তিক মানুষদের নিঃশেষ করে দেওয়ার জন্য তালিকা করে হত্যা চালাতে থাকে। তাঁদের মধ্যে যেমন প্রবীণ প্রাজ্ঞজনেরা ছিলেন, তেমনি ছিলেন উদিত যৌবনের বহু সম্ভাবনাময় তরতাজা প্রাণ। আজ তাঁদের স্মৃতির স্মরণ করা হবে সারা দেশে।

শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন ও প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস পৃথক বাণী দিয়েছেন।

কর্মসূচি

শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস পালন উপলক্ষে অনুষ্ঠিত আন্তমন্ত্রণালয়ের সভায় জানানো হয়েছে, আজ রোববার সকাল ৭টা ৫ মিনিটে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন এবং ৭টা ৬ মিনিটে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস মিরপুর শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধে পুষ্পস্তবক অর্পণ করবেন। তাঁরা জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানিয়ে সেখানে নীরবে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকবেন। এ সময় বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর একটি চৌকস দল রাষ্ট্রপতি ও প্রধান উপদেষ্টাকে রাষ্ট্রীয় স্যালুট প্রদান করবে।

রাষ্ট্রপতি ও প্রধান উপদেষ্টার পুষ্পস্তবক অর্পণের পর মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক উপদেষ্টা ফারুক-ই-আজম, মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয়ের সচিব ইসরাত চৌধুরী, শহীদ বুদ্ধিজীবী পরিবারের সদস্য এবং হুইলচেয়ারধারী যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধারা মিরপুর শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধে পুষ্পস্তবক অর্পণ করবেন।

সম্পর্কিত নিবন্ধ