শিক্ষা যেন অগ্রাধিকারের তালিকা থেকে ছিটকে পড়েছে। ইদানীং এটি আরও বেশি হয়েছে। নানা সংস্কারের জন্য কমিশন হয়েছে। কিন্তু শিক্ষা সংস্কারের জন্য কোনো কমিশনও হলো না। আগে যেমন খণ্ডিতভাবে ও বিচ্ছিন্নভাবে শিক্ষার নানা রকম কাজ হতো, এখনো যেন সেই ধারাই চলছে।

শিক্ষা নিয়ে কাজ করা বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থাগুলোর মোর্চা গণসাক্ষরতা অভিযানের উদ্যোগে আয়োজিত ‘বৈষম্যহীন বাংলাদেশের প্রত্যাশায় শিক্ষা বাজেট: আমাদের প্রস্তাবনা’ শীর্ষক প্রাক্‌–বাজেট সংবাদ সম্মেলনে এ কথাগুলো বলেন শিক্ষাবিদ, গবেষক ও শিক্ষা নিয়ে কাজ করা ব্যক্তিরা। আজ সোমবার রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত এ সংবাদ সম্মেলনে গণসাক্ষরতা অভিযানের পক্ষ থেকে আসন্ন মোট বাজেটের অন্তত ১৫ শতাংশ শিক্ষা খাতে বরাদ্দ দেওয়াসহ বেশ কিছু দাবি তুলে ধরা হয়।

সংবাদ সম্মেলনের সূচনা বক্তব্যে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে চৌধূরী বলেন, শিক্ষা কী করে যেন সবার মাইন্ডসেট (মনোজগৎ) থেকে, অগ্রাধিকারের জায়গা থেকে চলে গেছে। নীতিনির্ধারক থেকে শুরু করে বিভিন্ন পর্যায়ে এমনটি দেখা যাচ্ছে। মানবসম্পদ উন্নয়নের সবচেয়ে হাতিয়ার শিক্ষা। কিন্তু এটি কী করে যেন অগ্রাধিকারের তালিকা থেকে ছিটকে পড়েছে।

রাশেদা কে চৌধূরী বলেন, একটি গণ–অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে নতুন বাংলাদেশে নবতর স্বপ্ন দেখা হচ্ছে। সেই জায়গায় প্রথম দাবি হবে শিক্ষাকে অগ্রাধিকারের জায়গা থেকে বিচ্যুত করা যাবে না।

সংবাদ সম্মেলনে সম্মানিত আলোচক ছিলেন ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক মনজুর আহমদ। তিনি বলেন, দেশের শিক্ষার মূল যে চরিত্র বা বৈশিষ্ট্য, সেটা হলো একটি চরম বৈষম্য বা অসাম্য নানা রকমভাবে। এর একটি হলো শিক্ষার তিন ধারায় একধরনের বৈষম্য আছে। আবার প্রতিটি ধারায় আছে আরেক বৈষম্য। যেমন মূল ধারা অর্থাৎ বাংলা মাধ্যমে কিছু বিদ্যালয় আছে অভিজাত বা এলিট, সেগুলো একটু ভালো। বিত্তশালী বা যাঁদের একটু সুযোগ আছে, তাঁরা সেখানে যান। বাকি সাধারণ সরকারি স্কুল বা সরকারি সাহায্যপ্রাপ্ত স্কুল, সেগুলোর মান ততটা নেই। আবার নানা রকমের ইংরেজি মাধ্যম স্কুল আছে। মাদ্রাসায়ও নানা ধারা ও ভালো–মন্দ আছে। অর্থাৎ শিক্ষায় যেগুলোয় গুণমান আছে, সেগুলোর সুবিধা নেন কেবল সুবিধাপ্রাপ্তরা। বাকি অধিকাংশ সেই গুণমানের শিক্ষা থেকে বঞ্চিত।

মনজুর আহমদ বলেন, ‘অথচ বিরাট আন্দোলন হলো, পটপরিবর্তন হলো বৈষম্যবিরোধী সমাজ চাই, বৈষম্য দূর করতে চাই। কিন্তু শিক্ষা যে বৈষম্যের একটি বাহন এবং শিক্ষা বৈষম্য উত্তরণের উপায় না হয়ে বৈষম্য রক্ষা করার একটি ব্যবস্থা হিসেবে চালু আছে। সেটি নিয়ে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর তেমন কোনো আলাপ–আলোচনা দেখলাম না। নানা সংস্কারের কথা হচ্ছে। কিন্তু শিক্ষা সংস্কারের জন্য কোনো কমিশনও হলো না। আগে যেমন খণ্ডিতভাবে, আংশিকভাবে ও বিচ্ছিন্নভাবে নানা রকম কাজ হতো, এখনো সেই ধারাই চলছে।’

কেবল প্রাথমিক শিক্ষা মানোন্নয়নের জন্য নিজের নেতৃত্বে একটি কমিটি হওয়ার প্রসঙ্গ টেনে সেই কমিটির সুপারিশ বাস্তবায়ন নিয়েও কিছুটা হতাশা ব্যক্ত করেন অধ্যাপক মনজুর আহমদ। তিনি বলেন, তাঁরা বিচার–বিবেচনা করে বাস্তবসম্মত কিছু সুপারিশ করেছেন। কিছু পদক্ষেপ দেখা যাচ্ছে, তা–ও যেন মনে হচ্ছে খণ্ডিতভাবে।

সংবাদ সম্মেলনে গবেষণাপ্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম সম্মানিত আলোচক হিসেবে বক্তব্য দেন। এ সময় তিনি শিক্ষার নানা সমস্যার কথা তুলে ধরেন। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরে দীর্ঘদিনেও সব শিক্ষার্থী সব বই না পাওয়ায় সরকারের কাছে প্রশ্ন রাখেন তিনি। এ ছাড়া এত কমিশন হলো, কিন্তু শিক্ষার জন্য কমিশন না হওয়া নিয়েও প্রশ্ন তুলে ধরেন তিনি।

শিক্ষার বাজেট প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, শিক্ষার বাজেট বরাদ্দ বাড়ানোর কথা বলা হয়। কিন্তু শিক্ষা মন্ত্রণালয় বরাদ্দ দেওয়া টাকাই ব্যয় করতে পারে না। এটি আরেক সমস্যা। একদিকে বরাদ্দ বাড়ানো দরকার, অন্যদিকে আবার মন্ত্রণালয় খরচ করতে পারে না। আবার খরচও যা করে, সেগুলোও গুণগত মানসম্মতভাবে খরচ হয় না। সিপিডির গবেষণায় দেখা যায়, ২০২২ সালে বাজেটে যা ঘোষণা হয়েছিল, তার মধ্যে ৭৮ শতাংশ বাস্তবায়ন করেছে। অর্থাৎ ২২ শতাংশ বাস্তবায়নই করতে পারেনি। এই যে নিম্ন বাস্তবায়নমুখী একটি মন্ত্রণালয়, এই গ্যাঁড়াকল থেকে বের হতে হবে।

এখন ১৫ শতাংশ, ২০৩০ সালে ২০ শতাংশ বরাদ্দের দাবি

সংবাদ সম্মেলনে গণসাক্ষরতা অভিযানের পক্ষ থেকে আসন্ন বাজেটে শিক্ষা খাতে বরাদ্দের বিষয়ে বিভিন্ন দাবি ও সুপারিশ তুলে ধরেন এডুকেশন ওয়াচের ফোকাল পয়েন্ট ও গণসাক্ষরতা অভিযানের উপপরিচালক মোস্তাফিজুর রহমান। তিনি ২০১৬–১৭ অর্থবছরের বাজেট থেকে ২০২৩–২৪ অর্থবছরের বাজেটে শিক্ষা খাতে বরাদ্দের তুলনামূলক চিত্র উল্লেখ করে বলেন, টাকার অঙ্কে বরাদ্দ বাড়লেও মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) হিসেবে তা কমছে। কয়েক বছর ধরে মোট বাজেটের ১১ শতাংশের ঘরে আটকে আছে শিক্ষা খাতের বাজেট। সার্কভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে শিক্ষা খাতে সবচেয়ে কম বরাদ্দ হয় বাংলাদেশে।

এমন পরিস্থিতিতে আসন্ন বাজেটে শিক্ষা খাতে কমপক্ষে ১৫ শতাংশ বরাদ্দ রেখে ২০৩০ সালের মধ্যে তা কীভাবে ২০ শতাংশে উন্নীত করা যায়, তার পথরেখা দেওয়ার দাবি করেন মোস্তাফিজুর রহমান। এ ছাড়া প্রাথমিক শিক্ষাকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত করে সে পর্যন্ত শিক্ষা অবৈতনিক করা, প্রাথমিকে শিক্ষাপ্রতি উপবৃত্তির টাকা মাসে ৫০০ টাকা এবং মাধ্যমিকের অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত ৭০০ টাকা ও তার ওপরের শ্রেণিতে ১ হাজার টাকা করা, মিড ডে মিল সর্বজনীন করাসহ আরও কিছু দাবি জানানো হয়।

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: বর দ দ র র জন য ক র একট সরক র

এছাড়াও পড়ুন:

শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস আজ

‘উদয়ের পথে শুনি কার বাণী/ ভয় নাই ওরে ভয় নাই/ নিঃশেষে প্রাণ যে করিবে দান/ ক্ষয় নাই তার ক্ষয় নাই’। তাঁদের নিঃশেষে প্রাণদানের স্মৃতি আজ গভীর বেদনায় স্মরণ করবে জাতি। আজ থেকে ৫৪ বছর আগে দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তান বুদ্ধিজীবীরা হানাদার পাকিস্তান সেনাবাহিনীর নীলনকশার শিকার হয়ে নির্মম হত্যার শিকার হয়েছিলেন।

অমিত বিক্রম বাঙালির জীবনপণ যুদ্ধে হানাদার পাকিস্তানি বাহিনীর চূড়ান্ত পরাজয় তখন ছিল কেবল দিনগণনার বিষয়। সেই অনিবার্য পরাজয়ের প্রাক্কালে মরণকামড় দেওয়ার চেষ্টা করেছিল ঘাতক বাহিনী। স্বাধীনতা অর্জন করলেও বাঙালি জাতি যেন মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে না পারে, সেই চক্রান্ত করেছিল তারা। দেশের সেরা বুদ্ধিজীবীদের তালিকা করে তাঁদের বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে গিয়ে নির্মম নির্যাতন করে হত্যা করা হয়েছিল। এ কাজে পাকিস্তানি সেনাদের সরাসরি সহায়তা করেছিল তাদের মিত্র এ দেশি রাজাকার, আলবদর বাহিনী। এরাই ঘাতক সেনাদের নিয়ে গিয়ে চিনিয়ে দিয়েছে বুদ্ধিজীবীদের বাড়ি। চিনিয়ে দিয়েছে সেই নিরীহ মানুষগুলোকে।

মহান মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ে পরে মিরপুরে রায়েরবাজার পরিত্যক্ত ইটখোলা ও মিরপুরে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে যাওয়া সেসব বুদ্ধিবৃত্তিক পেশায় যুক্ত মানুষের মরদেহগুলো উদ্ধার করা হয়। তাঁদের অনেকের ছিল পিছমোড়া করে হাত ও চোখ বাঁধা। ভয়ানক নির্যাতনের চিহ্ন ছিল শরীরে। তাঁদের মরদেহ উদ্ধার হওয়ার মধ্য দিয়ে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বুদ্ধিজীবী হত্যার গভীর ষড়যন্ত্র প্রকাশ হয়ে পড়ে। এর পর থেকেই শহীদ বুদ্ধিজীবীদের প্রতি শ্রদ্ধা ও শোক প্রকাশ করে ১৪ ডিসেম্বর শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস পালিত হয়ে আসছে।

শুধু ঢাকাতেই নয়, সারা দেশেই বুদ্ধিবৃত্তিক কাজে যুক্ত মানুষদের হত্যা করেছিল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী। এই হত্যাকাণ্ডের ছিল দুটি পর্যায়। ‘অপারেশন সার্চলাইট’ নামে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে হানাদার সেনারা রাজধানীতে গণহত্যা শুরু করেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও আশপাশের এলাকায় সাধারণ নিরীহ জনসাধারণের পাশাপাশি শিক্ষক, চিকিৎসকদেরও হত্যা করে। এরপর থেকে হানাদাররা সারা দেশের শিক্ষক, চিকিৎসক, প্রকৌশলী, আইনজীবী, শিল্পী, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, গবেষক, সংস্কৃতিসেবীসহ মেধা মনন সৃজনশীল কাজে যুক্ত মানুষদের বেছে বেছে হত্যা করতে থাকে। মুক্তিযুদ্ধে শেষ পর্যায় তারা এই বুদ্ধিবৃত্তিক মানুষদের নিঃশেষ করে দেওয়ার জন্য তালিকা করে হত্যা চালাতে থাকে। তাঁদের মধ্যে যেমন প্রবীণ প্রাজ্ঞজনেরা ছিলেন, তেমনি ছিলেন উদিত যৌবনের বহু সম্ভাবনাময় তরতাজা প্রাণ। আজ তাঁদের স্মৃতির স্মরণ করা হবে সারা দেশে।

শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন ও প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস পৃথক বাণী দিয়েছেন।

কর্মসূচি

শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস পালন উপলক্ষে অনুষ্ঠিত আন্তমন্ত্রণালয়ের সভায় জানানো হয়েছে, আজ রোববার সকাল ৭টা ৫ মিনিটে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন এবং ৭টা ৬ মিনিটে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস মিরপুর শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধে পুষ্পস্তবক অর্পণ করবেন। তাঁরা জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানিয়ে সেখানে নীরবে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকবেন। এ সময় বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর একটি চৌকস দল রাষ্ট্রপতি ও প্রধান উপদেষ্টাকে রাষ্ট্রীয় স্যালুট প্রদান করবে।

রাষ্ট্রপতি ও প্রধান উপদেষ্টার পুষ্পস্তবক অর্পণের পর মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক উপদেষ্টা ফারুক-ই-আজম, মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয়ের সচিব ইসরাত চৌধুরী, শহীদ বুদ্ধিজীবী পরিবারের সদস্য এবং হুইলচেয়ারধারী যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধারা মিরপুর শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধে পুষ্পস্তবক অর্পণ করবেন।

সম্পর্কিত নিবন্ধ