পবিত্র রমজান বিদায় নিচ্ছে। চারদিকে ঈদের আমেজ। জমে উঠেছে ঈদের কেনাকাটা। ঈদ আমেজে অনেকটাই আড়াল হয়ে যাচ্ছে রমজানের মাহাত্ম্য ও পবিত্রতা। পবিত্র রমজান মাস সংযম ও সাম্যের যে বার্তা নিয়ে আগমন করেছিল তার অনেকটাই ম্লান হয়ে যাচ্ছে ঈদের কেনাকাটায়। যা কোনোভাবেই কাম্য নয়।
সন্দেহ নেই, ঈদের আনন্দ ইসলামে অনুমোদিত। ইসলাম সাধ্যানুসারে ঈদের দিন ভালো পোশাক ও খাবার গ্রহণের নির্দেশও দিয়েছে। তবে সেই আনন্দেরও একটি সীমারেখা টেনে দিয়েছে ইসলাম। ইসলাম ঈদ উপলক্ষ্যে অসংযত আনন্দ ও উৎসবের অনুমতি দেয় না; এমনকি ঈদ উৎসবে ভিনদেশী ও ভিন্ন ধর্মের রীতি-নীতিও গ্রহণযোগ্য নয়। আনাস ইবনে মালিক (রা.
বুজুর্গ আলেমরা বলেন, ‘ঈদের আনন্দ সেই মুমিনের জন্য যে মাহে রমজানের রহমত ও বরকত লাভে সক্ষম হয়েছে এবং যে পবিত্র রমজানে তার গুনাহগুলো ক্ষমা করিয়ে নিতে পেরেছে। আর রমজানের সময়টুকু যার অনাদরে ও অবহেলায় কেটেছে এবং যে তার গুনাহগুলো ক্ষমা করাতে পারেনি, বরং রমজানেও গুনাহে লপ্তি ছিল তার জন্য ঈদ হলো মহা দুঃসংবাদ। কেননা রাসুলুল্লাহ (সা.) সেই ব্যক্তির জন্য অভিশাপ করেছেন যে রমজান মাস পেয়েও তার গুনাহ ক্ষমা করাতে পারেনি। তাই আসুন! রমজানের বিদায়লগ্নে আমরা নিজেদের আমলের হিসাবটুকু মিলিয়ে নেই।
আরো পড়ুন:
মাহে রমজানে আল্লাহ প্রেমের সাধনা
যেসব সম্পদের জাকাত দিতে হয় এবং যারা প্রাপ্য
সামর্থ অনুসারে ঈদ-উৎসবের জন্য কেনাকাটা করা, বিশেষত নতুন পোশাক ও ভালো খাবারের ব্যবস্থা করার অবকাশ ইসলামে আছে। তবে লক্ষ্য রাখতে হবে সেটা যেন অপচয়ের অন্তর্ভুক্ত না হয়। কেননা মহান আল্লাহর নির্দেশ হলো, ‘তোমরা খাও ও পান করো; অপচয় করো না।’ (সুরা আরাফ, আয়াত : ৩১)
মূলত ইসলামের শিক্ষা হলো মানুষ তার যাপিত জীবনে মধ্যপন্থা অবলম্বন করে চলবে এবং নিজের আয় ও ব্যয়ের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করবে। মহান আল্লাহ বলেন, ‘তুমি তোমার হাত তোমার গ্রীবায় আবদ্ধ করে রেখো না এবং তা সম্পূর্ণ প্রসারিতও কোরো না, তাহলে তুমি তিরস্কৃত ও নিঃস্ব হয়ে পড়বে।’ (সুরা বনি ইসরাইল, আয়াত : ২৯)
ঈদের কেনাকাটায় একটি মন্দ দিক হলো লৌকিকতা। মানুষ সামাজিক মর্যাদা ও আত্মীয়-স্বজনের ভেতর অবস্থান তৈরির জন্য কখনো কখনো ঈদের কেনাকাটায় লৌকিকতার আশ্রয় নেয়। ফলে তারা সাধ্যের বাইরে গিয়েও কেনাকাটা করে, এমনকি অনেকে ঋণ করতেও দ্বিধা করে না। ইসলামে এমন মানসিকতা গ্রহণযোগ্য নয়। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘আল্লাহ কারো ওপর এমন কোনো কষ্টদায়ক দায়িত্ব অর্পণ করেন না, যা তার সাধ্যাতীত। সে ভালো যা উপার্জন করে তার প্রতিফল তারই এবং সে মন্দ যা উপার্জন করে তার প্রতিফল তারই।’ (সুরা বাকারা, আয়াত : ২৮৬)
প্রাজ্ঞ আলেমরা বলেন, আল্লাহ রমজান মাসে পানাহার করতে নিষেধ করেছেন যেন মানুষ অভাবী ও দুঃখী মানুষের কষ্ট বোঝে। তাই ঈদের কেনাকাটায় আমরা যেন সমাজের অসহায় ও পিছিয়ে পড়া মানুষের কথা ভুলে না যাই। বিশেষত আপনজন ও আত্মীয়স্বজনের মধ্যে কেউ আর্থিকভাবে অস্বচ্ছল হলে তার পরিবারেও যেন ঈদের আনন্দ আসে সে দিকে লক্ষ্য রাখা জরুরি। এ ক্ষেত্রে উদারতাই কাম্য। মহান আল্লাহ বলেন, ‘আত্মীয়-স্বজনকে দেবে তার প্রাপ্য এবং অভাবগ্রস্ত ও মুসাফিরকেও এবং কিছুতেই অপব্যয় কোরো না।’ (সুরা বনি ইসরাইল, আয়াত : ২৬)
অন্য আয়াতে ইরশাদ হয়েছে, ‘(সফল তারা) যারা সচ্ছল ও অসচ্ছল অবস্থায় ব্যয় করে।’ (সুরা আলে ইমরান, আয়াত : ১৩৪)। তবে যেসব আত্মীয় ঈদ উপহারের নামে যৌতুক পেতে চায় তাদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ হওয়া আবশ্যক। দুঃখজনক ব্যাপার হলো, ঈদের আনন্দ আতঙ্কে পরিণত হয় এ দেশের বহু মেয়ের বাবার জন্য। ঈদ এলে মেয়ের বাড়ি থেকে কথিত ঈদ উপহারের তালিকা আসে। যে উপহারের ওপর নির্ভর করে মেয়ের সংসার জীবনের সুখ ও স্বস্তি। তাই মেয়ের বাবা বুকে পাথর বেধে, ঋণ করে, সুদে টাকা নিয়ে মেয়ের শ্বশুর বাড়িতে উপহার পাঠায়। ইসলামের দৃষ্টিতে এমন উপহার নিষিদ্ধ ও হারাম। মহানবী (সা.) বলেছেন, ‘যে উপহার খুশি মনে দেওয়া হয় সেটাই শুধু বৈধ।’ (মুসনাদে আহমাদ, হাদিস : ২০৭১৪)
যারা সামাজিক ও পারিবারিকভাবে চাপ সৃষ্টি করে এমন উপহার ‘আত্মসাৎ করে’ তাদের ব্যাপারে মহান আল্লাহর হুঁশিয়ারি হলো, ‘তোমরা অন্যায়ভাবে পরস্পরের সম্পদ গ্রাস করো না।’ (সুরা বাকারা, আয়াত : ১৮৮)
আয়াতের ব্যাখ্যায় আল্লামা ইবনে কাসির (রহ.) লিখেছেন, এমন সব অপকৌশল আয়াতের অন্তর্ভুক্ত হবে, যার মাধ্যমে মানুষের অসন্তোষ সত্ত্বেও তার থেকে অর্থ বা সম্পদ আদায় করা হয় বা সে দিতে বাধ্য হয়। (তাফসিরে ইবনে কাসির)
ঈদের কেনাকাটা করার সময় বহু মানুষের নামাজ কাজা হয়। যা কোনোভাবেই কাম্য নয়। এই ব্যাপারে পবিত্র কোরআনের হুঁশিয়ারি হলো, ‘তাদের পরে এলো অপদার্থ পরবর্তীরা, তারা নামাজ নষ্ট করল ও লালসার বশবর্তী হলো। সুতরাং তারা অচিরেই কুকর্মের শাসিত প্রত্যক্ষ করবে।’ (সুরা মারিয়াম, আয়াত : ৫৯)
ঈদ মৌসুমে ব্যবসায়ীদের জন্য ব্যবসার একটি গুরুত্বপূর্ণ সময়। এ সময় অবশ্যই ব্যবসা করতে হবে। তবে তা যেন আল্লাহর বিধান লঙ্ঘনের মাধ্যমে না হয়। প্রথম কথা হলো ব্যবসার অজুহাতে যেন নামাজ-রোজা ছুটে না যায়। কেননা মহান আল্লাহ বলেছেন, ‘সেসব লোক, যাদেরকে ব্যবসা-বাণিজ্য এবং ক্রয়-বিক্রয় আল্লাহর স্মরণ থেকে এবং নামাজ আদায়, জাকাত প্রদান থেকে বিরত রাখে না, তারা ভয় করে সেদিনকে যেদিন অনেক অন্তর ও দৃষ্টি বিপর্যস্ত হয়ে পড়বে। যাতে তারা যে কাজ করে তজ্জন্য আল্লাহ তাদেরকে উত্তম পুরস্কার দেন এবং নিজ অনুগ্রহে তাদের প্রাপ্যের অধিক দেন। আল্লাহ যাকে ইচ্ছা অপরিমিত জীবিকা দান করেন।’ (সুরা নুর, আয়াত : ৩৭-৩৮)
দ্বিতীয়ত ধোঁকা ও প্রতারণা পরিহার করা। কেননা ব্যবসায় প্রতারণা পৃথিবীতে বিপর্যয় সৃষ্টির নামান্তর। আল্লাহ বলেন, ‘তোমরা ন্যায়সঙ্গতভাবে পরিমাপ ও ওজন করো, মানুষকে তাদের প্রাপ্য বস্তু কম দিও না এবং পৃথিবীতে বিপর্যয় সৃষ্টি করে বেরিও না।’ (সুরা হুদ, আয়াত : ৮৫)
আল্লাহ সবাইকে দ্বীনের সঠিক বুঝ দান করুন। আমিন।
লেখক : মুহাদ্দিস, সাঈদিয়া উম্মেহানী মহিলা মাদরাসা, ভাটারা, ঢাকা।
শাহেদ//
উৎস: Risingbd
কীওয়ার্ড: চ কর চ কর স য় ম স ধন রমজ ন ঈদ র ক ন ক ট য় ঈদ র আনন দ রমজ ন র র রমজ ন র জন য উপহ র ইসল ম ব যবস
এছাড়াও পড়ুন:
শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস আজ
‘উদয়ের পথে শুনি কার বাণী/ ভয় নাই ওরে ভয় নাই/ নিঃশেষে প্রাণ যে করিবে দান/ ক্ষয় নাই তার ক্ষয় নাই’। তাঁদের নিঃশেষে প্রাণদানের স্মৃতি আজ গভীর বেদনায় স্মরণ করবে জাতি। আজ থেকে ৫৪ বছর আগে দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তান বুদ্ধিজীবীরা হানাদার পাকিস্তান সেনাবাহিনীর নীলনকশার শিকার হয়ে নির্মম হত্যার শিকার হয়েছিলেন।
অমিত বিক্রম বাঙালির জীবনপণ যুদ্ধে হানাদার পাকিস্তানি বাহিনীর চূড়ান্ত পরাজয় তখন ছিল কেবল দিনগণনার বিষয়। সেই অনিবার্য পরাজয়ের প্রাক্কালে মরণকামড় দেওয়ার চেষ্টা করেছিল ঘাতক বাহিনী। স্বাধীনতা অর্জন করলেও বাঙালি জাতি যেন মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে না পারে, সেই চক্রান্ত করেছিল তারা। দেশের সেরা বুদ্ধিজীবীদের তালিকা করে তাঁদের বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে গিয়ে নির্মম নির্যাতন করে হত্যা করা হয়েছিল। এ কাজে পাকিস্তানি সেনাদের সরাসরি সহায়তা করেছিল তাদের মিত্র এ দেশি রাজাকার, আলবদর বাহিনী। এরাই ঘাতক সেনাদের নিয়ে গিয়ে চিনিয়ে দিয়েছে বুদ্ধিজীবীদের বাড়ি। চিনিয়ে দিয়েছে সেই নিরীহ মানুষগুলোকে।
মহান মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ে পরে মিরপুরে রায়েরবাজার পরিত্যক্ত ইটখোলা ও মিরপুরে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে যাওয়া সেসব বুদ্ধিবৃত্তিক পেশায় যুক্ত মানুষের মরদেহগুলো উদ্ধার করা হয়। তাঁদের অনেকের ছিল পিছমোড়া করে হাত ও চোখ বাঁধা। ভয়ানক নির্যাতনের চিহ্ন ছিল শরীরে। তাঁদের মরদেহ উদ্ধার হওয়ার মধ্য দিয়ে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বুদ্ধিজীবী হত্যার গভীর ষড়যন্ত্র প্রকাশ হয়ে পড়ে। এর পর থেকেই শহীদ বুদ্ধিজীবীদের প্রতি শ্রদ্ধা ও শোক প্রকাশ করে ১৪ ডিসেম্বর শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস পালিত হয়ে আসছে।
শুধু ঢাকাতেই নয়, সারা দেশেই বুদ্ধিবৃত্তিক কাজে যুক্ত মানুষদের হত্যা করেছিল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী। এই হত্যাকাণ্ডের ছিল দুটি পর্যায়। ‘অপারেশন সার্চলাইট’ নামে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে হানাদার সেনারা রাজধানীতে গণহত্যা শুরু করেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও আশপাশের এলাকায় সাধারণ নিরীহ জনসাধারণের পাশাপাশি শিক্ষক, চিকিৎসকদেরও হত্যা করে। এরপর থেকে হানাদাররা সারা দেশের শিক্ষক, চিকিৎসক, প্রকৌশলী, আইনজীবী, শিল্পী, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, গবেষক, সংস্কৃতিসেবীসহ মেধা মনন সৃজনশীল কাজে যুক্ত মানুষদের বেছে বেছে হত্যা করতে থাকে। মুক্তিযুদ্ধে শেষ পর্যায় তারা এই বুদ্ধিবৃত্তিক মানুষদের নিঃশেষ করে দেওয়ার জন্য তালিকা করে হত্যা চালাতে থাকে। তাঁদের মধ্যে যেমন প্রবীণ প্রাজ্ঞজনেরা ছিলেন, তেমনি ছিলেন উদিত যৌবনের বহু সম্ভাবনাময় তরতাজা প্রাণ। আজ তাঁদের স্মৃতির স্মরণ করা হবে সারা দেশে।
শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন ও প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস পৃথক বাণী দিয়েছেন।
কর্মসূচিশহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস পালন উপলক্ষে অনুষ্ঠিত আন্তমন্ত্রণালয়ের সভায় জানানো হয়েছে, আজ রোববার সকাল ৭টা ৫ মিনিটে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন এবং ৭টা ৬ মিনিটে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস মিরপুর শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধে পুষ্পস্তবক অর্পণ করবেন। তাঁরা জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানিয়ে সেখানে নীরবে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকবেন। এ সময় বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর একটি চৌকস দল রাষ্ট্রপতি ও প্রধান উপদেষ্টাকে রাষ্ট্রীয় স্যালুট প্রদান করবে।
রাষ্ট্রপতি ও প্রধান উপদেষ্টার পুষ্পস্তবক অর্পণের পর মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক উপদেষ্টা ফারুক-ই-আজম, মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয়ের সচিব ইসরাত চৌধুরী, শহীদ বুদ্ধিজীবী পরিবারের সদস্য এবং হুইলচেয়ারধারী যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধারা মিরপুর শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধে পুষ্পস্তবক অর্পণ করবেন।