অনার্স-মাস্টার্সের সনদ হাতে পেয়ে যখন সুন্দর ক্যারিয়ারের স্বপ্ন বুনছিলেন, তখন হয়তো স্বপ্নেও ভাবেননি একদিন তাঁর জীবিকার একমাত্র অবলম্বন হয়ে উঠবে রিকশার হ্যান্ডল। এক সময় পড়াশোনার খরচ চালাতে করেছেন রংমিস্ত্রির কাজ। এখন চালাচ্ছেন রিকশা।
ফরিদপুর সরকারি রাজেন্দ্র কলেজের ব্যবস্থাপনা বিভাগের এক সময়ের মেধাবী ছাত্র জুলহাস বেপারি। ২০১০-১১ শিক্ষাবর্ষে ব্যবস্থাপনা বিভাগে ভর্তি হন, মাস্টার্স শেষ করেন ২০১৪-১৫ শিক্ষাবর্ষে।
ফরিদপুরের ভাজনডাঙ্গায় জীর্ণশীর্ণ ছোট্ট এক ঘরে স্ত্রী, মেয়ে ও বাবা-মাকে নিয়ে বাস করেন জুলহাস। তাঁর জীবন কখনও সহজ ছিল না। এক সময় রংমিস্ত্রি হিসেবে কাজ করতেন। তবে ভালো একটি চাকরির আশায় পড়াশোনা চালিয়ে যান। ব্যবস্থাপনা বিভাগে পড়াশোনা শেষ করার পর তাঁর স্বপ্ন ছিল কোনো করপোরেট অফিসে চাকরি করবেন– হয়তো ব্যাংকে বা সরকারি কোনো দপ্তরে। বাস্তবতা ছিল ভিন্ন। চাকরির আবেদন করেছেন, পরীক্ষা দিয়েছেন, ইন্টারভিউয়ে অংশ নিয়েছেন। ভাগ্য তাঁর জন্য কোনো দরজা খোলেনি। কোথাও বলা হয়েছে ‘অভিজ্ঞতার অভাব’, কোথাও শুনেছেন ‘সুপারিশ বা তদবির লাগবে’। টাকা দিয়ে চাকরি করার ক্ষমতা ছিল না, রাজনৈতিক ছত্রছায়াও ছিল না, তাই বারবার ব্যর্থ হয়েছেন।
দিনের পর দিন চেষ্টা করেও চাকরি নামের সোনার হরিণের সন্ধান না পেয়ে এক সময় হাল ছেড়ে দেন। কেননা সংসারে ক্রমেই বাড়ছিল অভাব। বাবা-মা বৃদ্ধ, কাজ করতে পারেন না। আছে স্ত্রী, সংসার, তৃতীয় শ্রেণিতে পড়া ছোট্ট মেয়ে
জোবাইদার পড়াশোনা। সবকিছুই তাঁর সামান্য উপার্জনের ওপর নির্ভরশীল।
‘আমি পড়াশোনা করেছি, একটা ভালো চাকরির স্বপ্ন দেখেছি। কিন্তু এখন আমার পরিচয় কী? আমি একজন রিকশাচালক। সমাজে আমার কোনো সম্মান নেই, কেউ আমাকে গুরুত্ব দেয় না।’ কথাগুলো বলার সময় জুলহাসের চোখে পানি জমে যায়। তাঁর ৯ বছরের একমাত্র মেয়ে জোবাইদা, যার ছোট্ট দুটি চোখে বাবার জন্য গর্ব থাকার কথা, সেখানে আজ শুধুই হতাশার ছায়া।
ফরিদপুর প্রেস ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক মাহাবুব পিয়াল ছেলেটিকে চেনেন। তিনি বলেন, জুলহাসের জীবনের গল্প শুধু তাঁর একার নয়, হাজারো মেধাবী তরুণের গল্প, যারা সিস্টেমের ব্যর্থতার কারণে হারিয়ে যাচ্ছে। শুধু সুপারিশ আর টাকার জোরেই কি চাকরি পাওয়া যাবে? তাহলে জুলহাসদের মতো মেধাবী, পরিশ্রমী তরুণদের কী হবে? আর্থিক সাহায্য নয়, যোগ্যতা অনুযায়ী ভালো একটি কর্মসংস্থানের ব্যবস্থাই পারে জুলহাসের জীবনে আলো ফেরাতে।
উৎস: Samakal
এছাড়াও পড়ুন:
মহাবিশ্বের কেন্দ্র কোথায়
বিজ্ঞানী আলবার্ট আইনস্টাইন প্রথমে মনে করতেন মহাবিশ্ব স্থির। তিনি বিশ্বাস করতেন আজকের মহাবিশ্বের আকার-আকৃতি কমবেশি ‘হয়তো’ আগের মতো একই ধরনের রয়েছে। আর তাই ১৯১৭ সালে আইনস্টাইন তাঁর আপেক্ষিকতা তত্ত্ব ব্যবহার করে মহাবিশ্বের স্থির মডেল প্রস্তাব করেন। তবে পরবর্তী সময়ে বিজ্ঞানী এডুইন হাবল গ্যালাক্সির (ছায়াপথ) বর্ণালি বিশ্লেষণ করে প্রমাণ করেন মহাবিশ্ব সম্প্রসারণশীল। এরপর নিজের পুরোনো ধারণাকে ‘জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল’ হিসেবে আখ্যা দিয়ে মহাবিশ্ব সম্প্রসারণশীল হিসেবে মেনে নেন আইনস্টাইন।
বিজ্ঞানীদের তথ্যমতে, আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতা তত্ত্বের গাণিতিক কাঠামো ব্যবহার করে নতুন মডেল তৈরি করা হয়েছে। এই মডেল থেকে বোঝা যায়, মহাবিশ্ব আসলে গতিশীল এবং এটি ক্রমাগত বিকশিত হচ্ছে।
রোড আইল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানী রব কয়নে বলেন, ‘আমি কয়েক দশক ধরে সাধারণ আপেক্ষিকতা বোঝার চেষ্টা করছি। ক্রমবর্ধমান মহাবিশ্বের ধারণা নিয়ে মাথা ঘামানো কঠিন মনে হতে পারে। মহাবিশ্বের মতো বৃহৎ কোনো কিছুর কেন্দ্র নেই, এমনটা কল্পনা করা কঠিন। পদার্থবিজ্ঞান অনুসারে এটাই কিন্তু বাস্তবতা।’
বিষয়টা জানতে হলে প্রথমে মহাবিশ্বের সম্প্রসারণ বলতে কী বোঝায়, তা জানতে হবে। পৃথিবীতে কোনো কিছুর সম্প্রসারণ মানে, কোনো কিছু বড় হচ্ছে এবং আমাদের থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। মহাবিশ্বের ক্ষেত্রেও বিষয়টা একরকম সত্য। টেলিস্কোপে দেখলে মনে হয়, দূরবর্তী গ্যালাক্সিগুলো যত দূরে অবস্থান করছে, তত দ্রুত সেগুলো পরস্পর থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। আর তাই মহাবিশ্বের সবকিছুই একসঙ্গে অন্য সবকিছু থেকে দূরে সরে যাচ্ছে, এমনটাই বলা যুক্তিসংগত। ধারণাটি সূক্ষ্ম কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ। মহাবিশ্বের সৃষ্টি সম্পর্কে চিন্তা করা সহজ। আতশবাজির বিস্ফোরণের মতো একটি বিগ ব্যাং দিয়ে ব্যাপারটা শুরু করা যায়। তারপর মহাবিশ্বের সব ছায়াপথ যেন কোনো কেন্দ্রীয় বিন্দু থেকে সব দিকে সরে যাচ্ছে। যদিও এই উপমা সঠিক নয় বলে মনে করেন বিজ্ঞানীরা। তাঁদের মতে, সাধারণভাবে গ্যালাক্সিগুলো একে অপরের থেকে দূরে সরে যাচ্ছে, এমনটা বলা যাবে না। গ্যালাক্সিগুলোর মধ্যকার স্থান মহাবিশ্বের কাঠামোর মধ্যে সময়ের সঙ্গে ক্রমাগত প্রসারিত হচ্ছে। আর তাই গ্যালাক্সিগুলো দূরে সরে যাচ্ছে, বিষয়টি এমন নয়, মহাবিশ্ব নিজেই প্রসারিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তাদের আরও দূরে নিয়ে যাচ্ছে।
সাধারণ উপমা হিসেবে, বেলুনের পৃষ্ঠে কিছু বিন্দু আটকে দেওয়ার কথা বলা হয়। বেলুনে বাতাস দিলে তা প্রসারিত হয়। বিন্দুগুলো বেলুনের পৃষ্ঠে আটকে থাকে আর বাতাস বাড়ালে দূরে সরে যায়। যদিও তারা নড়াচড়া করে বলে মনে হতে পারে। আসলে বিন্দু ঠিক যেখানে আপনি রেখেছেন সেখানেই থাকবে। বেলুনের প্রসারণের কারণে তাদের মধ্যে দূরত্ব আরও বড় হয়। বেলুনের পৃষ্ঠ দ্বিমাত্রিক। আপনি যদি এটির ওপর দিয়ে হেঁটে বেড়ান, তাহলে আপনি সামনে এগিয়ে বা পেছনে যাবেন। বাঁয়ে বা ডানেও যেতে পারবেন। পৃষ্ঠ ছেড়ে না গিয়ে আপনি ওপরে বা নিচে যেতে পারবেন না। বেলুনের পৃষ্ঠ দ্বিমাত্রিক হলেও ভেতরের অংশ ত্রিমাত্রিক। সেখানে আপনি ওপরে বা নিচে যাওয়ার জন্য দৈর্ঘ্য, প্রস্থ, উচ্চতাসহ যেকোনো দিকে অবাধ চলাচল করতে সক্ষম। এখানেই বিভ্রান্তির শুরু। আমরা যে জিনিসকে বেলুনের কেন্দ্র বলে মনে করি, তা বেলুনের অভ্যন্তরের কোথাও হতে পারে। পৃষ্ঠের নিচে বাতাসভর্তি স্থানে একটি বিন্দু হতে পারে। আমাদের মহাবিশ্বে বেলুনের বায়ুপূর্ণ অভ্যন্তরের কোনো প্রতিরূপ নেই। এ কারণে ‘মহাবিশ্বের কেন্দ্র কোথায়’, এমন জিজ্ঞাসা ‘বেলুনের পৃষ্ঠের কেন্দ্র কোথায়’ প্রশ্নের মতোই। আপনি বেলুনের পৃষ্ঠ বরাবর যেকোনো দিকে ভ্রমণ করতে পারেন, যতক্ষণ আপনি চান। আপনি কখনো এমন কোনো স্থানে পৌঁছাতে পারবেন না যাকে আপনি এর কেন্দ্র বলতে পারেন, কারণ আপনি আসলে কখনোই বেলুনের পৃষ্ঠ ছেড়ে যাবেন না। একইভাবে আপনি মহাবিশ্বের যেকোনো দিকে ভ্রমণ করতে পারেন। কখনো মহাবিশ্বের কেন্দ্র খুঁজে পাবেন না।
সূত্র: এনডিটিভি