‘দেবতার সময়ের অভাব নেই, পুজোর জন্য যুগযুগান্তর অপেক্ষা করতে পারেন। মানুষের দুখ মানুষের নাগাল চায় যে, তার তো সময় অল্প।’ সংলাপটি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘রক্তকরবী’ নাটকের নন্দিনীর কণ্ঠে উচ্চারিত হয়। যতবার ‘রক্তকরবী’ পড়ি, বা কোথাও কোনো আলোচনা শুনি, ঠিক তখনই মনে হয়, আমার ভেতরে অনেক অনেক দিনের জমাট অন্ধকার এখনও আমাকে বেঁধে রেখেছে, ‘এ আমির আবরণে’ এখনও আচ্ছন্ন আমি।
বাংলা ১৩৩০ সালে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যখন রক্তকরবী নাটক লেখেন তখন তাঁর বয়েস ষাট বছরের কিছু বেশি। এ নাটকটি তিনি বহুবার সংশোধন করেছেন। খসড়া করার সময় মূল নাম কখনও নন্দিনী রেখেছেন, কখনও রেখেছেন যক্ষপুরী। অনেক সংশোধনের পর শেষতম নামটি দেন রক্তকরবী।
রক্তকরবী কেমন নাটক? স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ একে বলেছেন পালা, মানবিক পালা। যেখানে আছে একটি যক্ষপুরী, সেই যক্ষপুরীর ভূগর্ভে আছে তাল তাল সোনা। ভূগর্ভের সেই সোনা তুলে আনে সাধারণ মানুষেরা। আছে এক রাজা আর আছে রাজার শাসন। রাজাই সেই যক্ষপুরীর ব্যবস্থার অধিকারী। কিন্তু সে রাজা বড়ই বিচ্ছিন্ন রাজা। যে নির্মম শাসনে সকলকে নিষ্পেষণ করছেন, সেই শাসনযন্ত্রই একসময় চলে যাচ্ছে তাঁর নাগালের বাইরে। তাঁর হাতের মরা ব্যাঙ নিয়ে তিনি অনেক আস্ফালন করেন, করেন অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষাও, কিন্তু যে প্রাণের স্পর্শ তিনি পেতে চান, তা আর কিছুতে মেলে না।
এ কারণেই তাঁর নন্দিনীকে প্রয়োজন। নন্দিনী হলো পূর্ণ প্রাণের অধিকারী। এক আদিগন্ত খোলা হাওয়া যার চিরসঙ্গী। আনন্দই যার প্রাণশক্তির উৎস। তাই রাজা চান নন্দিনীর সঙ্গে প্রাণের সংযোগ ঘটাতে। কিছুতেই তা পান না রাজা।
পূর্ণ প্রাণে যা চাইতে হয়, তাকে রিক্ত হাতে চাইলে, চাওয়াও অসম্পূর্ণ থাকে আর পাওয়া তো যায়ই না। একসময় রাজা সেকথা বোঝেন, অনুভব করেন তিনি নিজেই নিজের কাছে বন্দি। তাই নন্দিনীর কাছে নেমে আসেন তিনি, তার হাত ধরে মুক্তির স্বাদ পেতে চান তিনি। রাজা তাঁর হাত বাড়িয়ে দেন, কিন্তু নন্দিনী রাজার সবটুকু বাদ দিয়ে শুধু হাত ধরতে চায় না। সমর্পন কখনও আংশিক হয় না।
রবীন্দ্রনাথের ‘রক্তকরবী’ নাটকের নন্দিনী চরিত্রে অভিনয় আমার জীবনের অনন্য এক ঘটনা। নন্দিনী চরিত্রে অভিনয় শুধু অভিনয়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না। ছিল একটি যাত্রা, এক ধরনের আত্মসন্ধান। আজও আমি যখন আয়নার সামনে দাঁড়াই, মাঝে মাঝে মনে হয় আমি সেই নারী ‘নন্দিনী’, যিনি ‘রক্তকরবী’র অন্ধকার রাজ্যে আলো নিয়ে এসেছিলেন। নন্দিনী কেবল একটি চরিত্র নয়, এক দর্শন, এক প্রতিবাদ, এক আলোকবর্তিকা। নন্দিনী হচ্ছে সেই নারী, যে ভালোবাসে, প্রশ্ন তোলে, প্রতিবাদ করে, আর সাহসের সঙ্গে সত্যকে গ্রহণ করে। তার কণ্ঠস্বর শুধু নাটকে নয়–সমাজেও প্রতিধ্বনিত হয়।
মানুষের আবেগ, ভাবনা ও স্বপ্নপূরণের কথা তো সবচেয়ে বেশি থিয়েটারে ফুটে ওঠে। আমার জীবনেও অনেক কিছু শিখেছি এই থিয়েটারের মাধ্যমে। ২০০১ সালে আমি যখন থিয়েটারে যোগ দিলাম তখন বুয়েট অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ। সেই সময় একদিন যুবদা [খালেদ খান] ফোন করে বললেন, ‘‘আমরা দল থেকে ‘রক্তকরবী’ মঞ্চে আনছি। তোমাকে আমরা ‘রক্তকরবী’তে একটি চরিত্রে ভাবছি।’’ তার এই কথা শোনা মাত্র আমি রাজি হই। যুবদার সঙ্গে কথা শেষ করে আম্মার কাছে গিয়ে বললাম, যুবদা রক্তকরবীতে অভিনয়ের কথা বলেছেন। মা বললেন কোন চরিত্রে। বললাম তা জানতে চাইনি। আমাকে যেতে বলেছেন। তার কিছুসময় পর আবারো ফোন করলেন যুবদা। বললেন, ‘আমরা নন্দিনী চরিত্রের জন্য তোমায় চিন্তা করেছি। তোমার কাছে রক্তকরবী বইটি আছে। থাকলে একটু পড়ে এসো।’ কথাটি শোনার পর খুশিতে আত্মহারা।
আমার অভিনীত প্রথম মঞ্চ নাটকে আলী যাকেরকে রাজা হিসেবে পেলাম। আমার অভিনয় জীবনে অনেক ধরনের চরিত্রে কাজ করেছি–আধুনিক, ক্লাসিক, বাস্তবধর্মী, কিংবা একেবারে প্রতীকী। কিন্তু নন্দিনী একেবারে আলাদা। এই চরিত্রে অভিনয়ের আগে আমাকে মানসিকভাবে তৈরি হতে হয়েছে। কতবার ‘রক্তকরবী’ পড়েছি। নিজের মধ্যে নানাভাবে ব্যাখ্যা খুঁজেছি।
কখনও রাত জেগে নন্দিনীর সংলাপ বলেছি, শুধু অনুভবের জন্য নয়, মুখস্থ করার জন্যও। নন্দিনী যখন বলে, ‘আমি কাউকে ভয় পাই না’–এই সংলাপটি প্রথম বলেছিলাম একা একা, আমার ঘরের কোনায় দাঁড়িয়ে। শুধু আমি আর শব্দ। কিন্তু সে দিনই প্রথম অনুভব করেছিলাম–এই চরিত্রের মধ্যে কী অসম্ভব শক্তি লুকিয়ে আছে।
রিহার্সালের সময় শুরুটা সহজ ছিল না। আমি চেয়েছিলাম নন্দিনীর প্রতিটি অনুভব আমার শরীরী প্রকাশে ফুটে উঠুক। শুধু সংলাপ উচ্চারণ নয়, তার হাঁটা, তাকানো, দাঁড়ানো–সব কিছু যেন সেই প্রতিবাদী, ভালোবাসাময় আত্মা হয়ে ওঠে। সহশিল্পীরা দারুণভাবে সহযোগিতা করেছেন।
‘রক্তকরবী’ করতে গিয়ে আলী যাকের, খালেদ খান, গাজী রাকায়েত, আতাউর রহমানের কাছ থেকে কত কিছু যে শিখলাম। বিশেষ করে আতাউর রহমান এবং খালেদ খানের কাছে ঋণী হলাম। ওনারা যদি রক্তকরবী না দিত তাহলে আমি হয়তো অন্য অপি হতাম। নাটকটির মহড়ার সময় বুয়েট খুলে দিল। সেই সময় দেখা যেত আমি ক্লাসের ফাঁকে ড্রইং করছি, আর নাটকের সংলাপ বলছি। সেই সময় আমি ইউনিভার্সিটি শেষ করে মহড়ায় অংশ নিতাম। একদিন আলী যাকেরের সঙ্গে কাজ করছি। দুপুরে কিছু খাইনি। ফলে পেটের মধ্যে গুড়গুড় শব্দ হচ্ছে। এটি শুনে যাকের আঙ্কেল বললেন, কে আছে ওই মেয়েকে আগে খাওয়া দাও। ওর পেটের গুড়গুড়ানিতে ডায়ালগ ভুলে যাচ্ছি। মঞ্চ নাটকে যখন কাজ করি, তখন থিয়েটারের শিল্পীরা আমায় বলতেন ভাড়া করা নায়িকা। এ নাটকটির প্রথম শো থেকে শুরু করে যতদিন করেছি, ততদিন সবাই আমাকে দারুণ সহযোগিতা করেছেন। অনেকে যেমন প্রশংসা করতেন, ঠিক তেমনি সমালোচনাও করতেন। যুবদার কথাই বলব। একটা শব্দের উচ্চারণ নিয়ে, তাঁর কাছে জানতে চাইলে, তখন তিনি এই শব্দের উৎপত্তি থেকে শুরু করে সবই বলেছেন। এগুলো ছিল আশীর্বাদের মতো। একটি ঘটনা আজও মনে পড়ে–একদিন আমরা চূড়ান্ত দৃশ্যের মহড়া করছিলাম। রাজাকে যখন নন্দিনী যখন বলে, ‘জাগো, উঠে দাঁড়াও’–আমি সংলাপ বলতে বলতে থেমে গিয়েছিলাম। গলা কেঁপে উঠেছিল। এক মুহূর্তের জন্য মনে হয়েছিল, আমি অপি নই, আমি নন্দিনী এবং আমি কোনো মঞ্চে নয়, সমাজের সামনে দাঁড়িয়ে বলছি ‘জেগে ওঠো!’ সেই মুহূর্তটি আমাকে কাঁপিয়ে দিয়েছিল। রবীন্দ্রনাথের ভাষার সঙ্গে বোঝাপড়া করাও ছিল একটা বড় কাজ। তাঁর প্রতিটি সংলাপের গতি, ছন্দ, থেমে যাওয়ার সময়–সব নিয়ে বারবার আলোচনা করেছি। নন্দিনীর ভাষায় যে কাব্যিকতা, সেটি বজায় রেখেও অনুভূতিকে বাস্তব করে তোলা–এটি ছিল সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। অনেকে বলেন, মঞ্চে অভিনয় সিনেমা বা টিভির চেয়ে বেশি আকর্ষণীয়। আমি বলবো, সেটি শুধু মঞ্চে সরাসরি অভিনয়ের জন্য নয়, মঞ্চের চরিত্রগুলোর জন্যও। তারা আপনাকে নিংড়ে নেয়। এবং নন্দিনী তো একেবারে তেমন একটি চরিত্র। সে যেন আমার আত্মাকে নিজের রূপে রাঙিয়ে দিয়েছিল।
১১৭ বার মঞ্চায়িত হয়েছে নাগরিকের ‘রক্তকরবী’। অন্যদিকে নাটকটি রচনার শতবর্ষ পূর্তি হলো এ বছর। বাংলা ভাষার চিরকালের সম্পদ ‘রক্তকরবী’।
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: নন দ ন র র জন য বল ছ ন প রথম ন টকট বলল ন র সময়
এছাড়াও পড়ুন:
অতি ভারী বৃষ্টির পূর্বাভাস, পাহাড়ে ভূমিধসের শঙ্কা
আজ শ্রাবণের ১৬ তারিখ। প্রকৃতির নিয়মে এ মাসে বৃষ্টি বেশি ঝরে। আজও ঢাকার আকাশ মেঘলা। বুধবার রাত থেকে থেমে থেমে বৃষ্টি হচ্ছে। কখনও ঝুম বৃষ্টি কখনও গুঁড়ি গুঁড়ি। তবে সক্রিয় মৌসুমি বায়ুর প্রভাবে উপকূলীয় ও পাহাড়ি এলাকায় অতি ভারী বৃষ্টি হতে পারে বলে জানিয়েছে আবহাওয়া অধিদপ্তর। রয়েছে ভূমিধসের ঝুঁকি।
বৃহস্পতিবার (৩১ জুলাই) ভারী বৃষ্টিপাতের সতর্কবার্তায় বলা হয়েছে, আগামী ২৪ ঘণ্টায় খুলনা, বরিশাল ও চট্টগ্রাম বিভাগের বিভিন্ন স্থানে ভারী থেকে অতি ভারী বৃষ্টির আশঙ্কা করা হচ্ছে। ফলে চট্টগ্রাম, রাঙামাটি, বান্দরবান, খাগড়াছড়ি ও কক্সবাজারের পাহাড়ি এলাকায় কোথাও কোথাও ভূমিধসের ঝুঁকি রয়েছে।
আবহাওয়া পূর্বাভাসে বলা হয়েছে, অতিভারী বৃষ্টির কারণে খুলনা, বরিশাল ও চট্টগ্রাম মহানগরীর কিছু এলাকায় সাময়িক জলাবদ্ধতা দেখা দিতে পারে। নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হওয়াসহ বাস, রিকশা ও সাধারণ চলাচলে বিঘ্ন ঘটতে পারে।
বঙ্গোপসাগরে উত্তাল থাকায় চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, মোংলা ও পায়রা সমুদ্র বন্দরসমূহকে তিন নম্বর স্থানীয় সতর্ক সংকেত দেখাতে বলা হয়েছে। নদী ও সমুদ্রবন্দর এলাকায় অবস্থানরত নৌযানগুলোকে সাবধানতার সঙ্গে চলাচলের নির্দেশ দিয়েছে আবহাওয়া অধিদপ্তর। সারা দেশে আজ দিনের তাপমাত্রা সামান্য কমতে পারে, রাতের তাপমাত্রা প্রায় অপরিবর্তিত থাকবে।
শুক্রবার ঢাকা, ময়মনসিংহ, চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগের অধিকাংশ জায়গায়, এবং রংপুর, রাজশাহী, খুলনা ও বরিশাল বিভাগের অনেক জায়গায় হালকা থেকে মাঝারি বৃষ্টি হতে পারে। কোথাও কোথাও ভারী থেকে অতি ভারী বর্ষণের সম্ভাবনা রয়েছে। দিন ও রাতের তাপমাত্রা প্রায় অপরিবর্তিত থাকবে।
শনিবারও সারা দেশে বৃষ্টিপাত অব্যাহত থাকবে। বিশেষ করে ঢাকা, ময়মনসিংহ, চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগে অধিকাংশ এলাকায় এবং অন্যান্য বিভাগে অনেক জায়গায় দমকা হাওয়াসহ বৃষ্টি হতে পারে। সারা দেশে দিনের ও রাতের তাপমাত্রা সামান্য কমতে পারে।
রবিবার রংপুর, রাজশাহী, ঢাকা, ময়মনসিংহ, চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগের অধিকাংশ জায়গায় এবং খুলনা ও বরিশাল বিভাগে অনেক জায়গায় বৃষ্টি হতে পারে। কোথাও কোথাও হতে পারে অতি ভারী বৃষ্টিপাত।
আবহাওয়া অধিদপ্তরের বর্ধিত পূর্বাভাস অনুযায়ী, আগামী পাঁচ দিন দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বৃষ্টিপাতের প্রবণতা অব্যাহত থাকতে পারে।
গত ২৪ ঘণ্টায় সর্বোচ্চ বৃষ্টি হয়েছে কক্সবাজার ৬৮ মিলিমিটার। সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল সৈয়দপুরে ৩৬ দশমিক ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস। গতকাল ঢাকায় সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল ৩৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস।
ঢাকা/ইভা