আগের রাতে রিয়াল মাদ্রিদের ঘুরে দাঁড়ানো দেখার আশায় হতাশ হয়েছেন সবাই। সান্তিয়াগো বার্নাব্যুর সমস্ত হুংকার ‘আষাঢ়ে গর্জন’ হয়েই থেকে গেছে। কিন্তু বার্নাব্যুতে যা দেখা যায়নি গতকাল রাতে সেটাই দেখা গেল ওল্ড ট্রাফোর্ডে।

উত্থান–পতনের অনবদ্য এক লড়াইয়ে অবিশ্বাস্যভাবে শেষ মুহূর্তে ঘুরে দাঁড়িয়ে জিতেছে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড। ইউরোপা লিগ কোয়ার্টার ফাইনাল ফিরতি লেগ লড়াইয়ে লিঁওর বিপক্ষে ইউনাইটেডের জিতেছে ৫–৪ গোলে। দুই লেগ মিলিয়ে ৭–৬ গোলের অগ্রগামিতায় সেমিফাইনালে উঠেছে রুবেন আমোরিমের দল।

ওল্ড ট্রাফোর্ডে খেলা শেষে ভাইরাল হওয়া একটি ভিডিও দিয়ে পুরো ম্যাচটাকে বিশ্লেষণ করা যায়। ম্যাচের তখন ১১৭ মিনিট। ইউনাইটেড পিছিয়ে ৪–৩ গোলে (দুই লেগ মিলিয়ে ৬–৫ গোলে)। এমন পরিস্থিতিতে গ্যালারিতে এক শিশু হতাশায় কান্না জুড়ে দিল।

অতিরিক্ত সময়ের যোগ করা সময়ে ইউনাইটেডের হয়ে হ্যারি মাগুয়ার যখন জয়সূচক গোলটি করেন, তখনও কাঁদছিল সেই শিশু। চোখ ভেজা অথচ ঠোঁটে হাসি। অনবদ্য এক দৃশ্য। আসলে পুরো ম্যাচটাই ছিল আবেগের এমন রোলারকোস্টার। ওল্ড ট্রাফোর্ডের লাল গ্যালারির পুরোটাই ভেসেছে এমন আবেগে।    

প্রথম লেগে লিওঁর মাঠে ২–২ গোলে ড্রয়ের পর ফিরতি লেগে ইউনাইটেডের শুরুটা ছিল দুর্দান্ত। প্রথমার্ধেই ২–০ গোলে লিড নিয়ে নেয় স্বাগতিকরা। ইউনাইটেডের হয়ে গোল করেন ম্যানুয়াল উগার্তে ও দিয়াগো দালত।

আরও পড়ুনবার্নাব্যুর ভয়কেও জয়, রিয়ালকে বিদায় করে সেমিফাইনালে আর্সেনাল১৬ এপ্রিল ২০২৫

দ্বিতীয়ার্ধের ৭০ মিনিট পর্যন্ত এই লিড ধরে রেখেছে ইউনাইটেড। কিন্তু ৭১ থেকে ৭৭—এই সাত মিনিটে দুই গোল করে দারুণভাবে ম্যাচে ফিরে আসে লিওঁ। কোরেনটিন তোলিসোর পর গোল করেন নিকোলাস তালিয়াফিকো। নির্ধারিত সময়ে আর কোনো গোল না হলে ম্যাচ গড়ায় অতিরিক্ত সময়ে।

নির্ধারিত সময়ের ৮৯ মিনিটে লিওঁর তোলিসো লাল কার্ড দেখায় অতিরিক্ত সময়ে দশ জন নিয়ে খেলতে হয় লিওঁকে। কিন্তু একজন কম নিয়েও ১০৯ মিনিটের মাথায় ৪–২ গোলের লিড নেয় ফরাসি ক্লাবটি। অর্থাৎ দুই লেগ মিলিয়ে ইউনাইটেড তখন পিছিয়ে ৬–৪ গোলে। গোল দুটি করেন রায়ন চেরকি ও আলেক্সান্দার লাকাজেতে। এ পরিস্থিতিতে ইউনাইটেডের হতাশাজনক বিদায়ই ধরে নিয়েছিলেন অনেকে।

কিন্তু ভেতরে ভেতরে ওল্ড ট্রাফোর্ড প্রস্তুতি নিচ্ছিল মহাকাব্য লেখার। ১১৪ মিনিটে ব্রুনো ফার্নান্দেজের পেনাল্টি গোলে ব্যবধান ৪–৩ করে ইউনাইটেড। এরপর ১২০ মিনিটে কোবি মাইনু গোল করে সমতায় ফেরান ইউনাইটেডকে। সমতা ফেরার পর সবার চোখ ছিল সম্ভাব্য টাইব্রেকারে।

আরও পড়ুনএটাই ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের সবচেয়ে বাজে দল ১৪ এপ্রিল ২০২৫

কিন্তু ম্যাচটা ততদূর যেতে দেননি ম্যাগুয়ার। ১২১ মিনিটে গোল করে ইউনাইটেডকে আনন্দে এবং লিওঁকে ভাসান হতাশায়। আর সব মিলিয়ে ইউনাইটেড পেলে অনেক দিন মনে রাখার মতো এক জয়। যা তাদের মৌসুমে ট্রফি জেতার সম্ভাবনাও বাঁচিয়ে রেখেছে। ফাইনালে যাওয়ার লড়াইয়ে ইউনাইটেডের প্রতিপক্ষ অ্যাথলেটিক বিলবাও। আর  অন্য সেমিফাইনালে মুখোমুখি হবে টটেনহাম ও বোডো/গ্লিমট।

ইউনাইটেডের জন্য মৌসুমটা কাটছিল হতাশাজনকভাবে। প্রিমিয়ার লিগে দলটির অবস্থান এখন ১৪তম। প্রিমিয়ার লিগে নিজেদের ইতিহাসে সবচেয়ে কম পয়েন্টও পেতে যাচ্ছে তারা।

গ্যালারিতে হাসি ফুটবল ফার্গুসনের মুখে.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: ফ ইন ল গ ল কর ত সময়

এছাড়াও পড়ুন:

অভ্যুত্থানের অনবদ্য দলিল

বাংলাদেশের সম্প্রচার সাংবাদিকতার পুরোধা ব্যক্তিত্ব সাইমন জন ড্রিংয়ের সঙ্গে কাজ করার সুযোগ হয়েছিল যমুনা টিভিতে। সে সময় কাজের ফাঁকে তিনি শুনিয়েছিলেন ১৯৭৯ সালে ইরানের ইসলামি বিপ্লবের শ্বাসরুদ্ধকর ঘটনাপ্রবাহ। সাইমন তখন বিবিসির প্রতিবেদক হিসেবে তেহরানে কর্মরত। তাঁর চোখের সামনেই ঘটেছিল সেই গণবিপ্লব। সাইমন বলেছিলেন, সাংবাদিকতা পেশার একটি বিশেষ সুবিধা আছে। একজন সাংবাদিক পেশাগত দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি ইতিহাসকে রচিত হতে দেখেন।

ফটোসাংবাদিক জীবন আহমেদের উইটনেস টু দ্য আপরাইজিং গ্রন্থটি হাতে পাওয়ার পর সাইমনের কথা খুব মনে হচ্ছিল। ২০২৪ সালে বাংলাদেশের বর্ষা বিপ্লবের ঘটনাগুলো খুব কাছে থেকে দেখার সুযোগ পেয়েছেন জীবন। নেত্রনিউজের সংবাদকর্মী হিসেবে তিনি শুধু এই অভ্যুত্থান কাছ থেকেই দেখেননি, পেশাগত দায়িত্বের অংশ হিসেবে মৃত্যুঝুঁকি নিয়ে ক্যামেরায় ধারণ করেছেন অভ্যুত্থানের অভূতপূর্ব সব মুহূর্ত।

গ্রন্থটি বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের এক অনবদ্য দলিল। জুলাই অভ্যুত্থানের শ্বাসরুদ্ধকর মুহূর্তের সংবাদ, ছবি ও স্মৃতিকথা। একথা সত্য যে সাংবাদিকের ক্যামেরা ও কলমে কোনো অভ্যুত্থানেরই পুরো চিত্র তুলে ধরা সম্ভব নয়। নিশ্চিতভাবেই ২০২৪ সালের অভ্যুত্থানের বহু আত্মত্যাগের অনবদ্য গল্প এখনো অজানা। গ্রন্থটির ভূমিকায় ছবিশিল্পী জীবন আহমেদ লিখেছেন, জুলাই আন্দোলন চলাকালে ঢাকার রাজপথে, অলিতেগলিতে এমন সব দৃশ্যের জন্ম হয়েছে, যা কোনো ভিজ্যুয়াল মিডিয়া বা ফটোগ্রাফির সব সক্ষমতা দিয়েও ধারণ করা সম্ভব নয়।

জুলাই অভ্যুত্থানের আবেগ, ব্যাপকতা ও মাহাত্ম্য উল্লেখ করে নিজের অক্ষমতার কথা তুলে ধরলেও ফটোসাংবাদিক জীবন তাঁর ক্যামেরার লেন্সের মাধ্যমে ঠিকই এক জরুরি দায়িত্ব পালন করেছেন। ১৭৬টি সংবাদছবিতে জুলাই অভ্যুত্থানের রক্তাক্ত ঘটনাগুলোকে চিরযৌবন দান করেছেন। পুলিশের সাঁজোয়া যান, গুলি, কাঁদানে গ্যাস, আগুন বা প্রতিবাদের বহ্নিশিখা ধারণ করেছেন ক্যামেরার লেন্সে। মৃত্যু, আর্তনাদ, অভিশাপ, প্রতিবাদ, প্রত্যাখ্যান ও পতন জীবন্ত হয়ে উঠেছে বইটির পাতায় পাতায়।

গ্রন্থটি যে কাউকে এক পরাবাস্তব জগতে নিয়ে যেতে পারে। প্রতিটি ছবিই যেন একেকটি গল্প। নির্যাতন-নিপীড়ন-বলপ্রয়োগ–হত্যাযজ্ঞের এক রক্তাক্ত ইতিহাস। যে ইতিহাসের ধারাক্রম শুরু মধ্য জুলাই থেকে। ৩৬ পৃষ্ঠায় স্থান পাওয়া ১৪ জুলাইয়ের একটি ছবি বিশেষভাবে তাৎপর্যপূর্ণ। যাকে বলা যায় আইকনিক, মোড় পরিবর্তনকারী। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে জিরো পয়েন্টে যাওয়ার পথে পুলিশের প্রতিরোধ ভেঙে ফেলার এক অসাধারণ মুহূর্ত যে কাউকে স্পর্শ করবে। খুব সম্ভবত এটাই ছিল প্রতিরোধ ভাঙার সূচনা। এ ছাড়া ১৪ জুলাইয়ের স্মৃতিকথাতেও জীবন আহমদ এক ঐতিহাসিক ঘটনার উল্লেখ করেছেন। তিনি লিখেছেন, রাত সাড়ে ১০টার দিকে শামসুন্নাহার হলের মেয়েরা থালাবাসন দিয়ে আওয়াজ করতে শুরু করে, তুমি কে? আমি কে? রাজাকার! রাজাকার! পরে পুরো বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন হলেও এই থালাবাসন দিয়ে বিভিন্ন আওয়াজ ও স্লোগান শুরু হয়। (পৃষ্ঠা: ৩৪)

পরের দিনগুলো অগ্নিগর্ভ, শ্বাসরুদ্ধকর। রাজু ভাস্কর্যের সামনে বৈষম্যবিরোধী ছাত্রসমাজের আন্দোলনে ছাত্রলীগ-যুবলীগের বর্বর আক্রমণ, গায়েবানা জানাজা, শিক্ষার্থীদের জোর করে হল ত্যাগ করানো আর সংঘাতের জীবন্ত বিবরণ। মাঝখানে কয়েক দিন বিরতির পর আবার গণবিস্ফোরণ। তখন দিন-রাত এক করে ক্যামেরা হাতে ঢাকার রাজপথে ছিলেন জীবন। কখনো তাঁর ক্যামেরা ধারণ করেছে অগ্নিদগ্ধ যানবাহন, উত্তরার রাজপথ বা ঢাকা মেডিকেলে লাশের সারি। মাঝেমধে৵ আছে কয়েকটি হৃদয়বিদারক মৃত্যুর এপিটাফ। রিকশার পাদানিতে গোলাম নাফিজ, স্ট্রেচারে লাল-কালো চাদরে ঢাকা রিয়া গোপের মরদেহ, সমন্বয়ক নাহিদ ইসলামের আঘাত–জর্জরত পিঠ ও অন্যান্য। এই ছবিগুলোর প্রতিটিই মৌষলকালের একেকটি মর্মান্তিক গল্প।

৫ আগস্ট বিজয়ের দিনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজু ভাস্কর্যের ছবিটি অনবদ্য। এই সংবাদছবিটির দিকে দীর্ঘ সময় তাকিয়ে থাকা যায়। লাল-সবুজের পতাকায় ছাত্র-জনতার উল্লাস, পটভূমিতে পতিত স্বৈরাচারের ক্ষতবিক্ষত অবয়ব। যেন এই একটা ছবিই ৩৬ দিনের আন্দোলনের সব কথা বলে দিয়েছে। এখানেই শেষ নয়, অভ্যুত্থান–পরবর্তী সময়ে নৈরাজ্য ও অরাজকতার এক খণ্ডচিত্রও ধরা পড়েছে জীবন আহমদের চোখে। ১৫ আগস্ট ধানমন্ডির ৩২ নম্বরের সামনে এক নারীকে নির্যাতন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বাড়ি পুড়িয়ে দেওয়া, পরের দিকে গুঁড়িয়ে দেওয়ার স্থিরচিত্রও স্থান পেয়েছে বইটিতে, যা একজন সাংবাদিকের পেশাদারত্ব ও দলনিরপেক্ষতার প্রমাণ দেয়।

উইটনেস টু দ্য আপরাইজিং
জীবন আহমেদ

প্রকাশক: ইউপিএল
প্রকাশ: আগস্ট ২০২৫
প্রচ্ছদ: জীবন আহমেদের ছবি অবলম্বনে সুবিনয় মোস্তফি ইরন
পৃষ্ঠা: ৩২৩
মূল্য: ২৫০০ টাকা

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • অভ্যুত্থানের অনবদ্য দলিল