বৈঠকের সময় আগে থেকেই ঠিক করা ছিল। ১৯৭১ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর ইন্দিরা গান্ধী মস্কোয় পৌঁছানোর দুই ঘণ্টার মধ্যেই শুরু হবে আলোচনা। কিন্তু সেদিন কোনো আলোচনা হলো না। ক্রেমলিনে অনেকটা অলস সময় কাটালেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী। এমনকি সেদিনের নৈশভোজও স্থগিত হলো। সোভিয়েত শীর্ষ নেতাদের অনেকেই ওই সভায় যোগদানের আগ্রহ প্রকাশ করেছিলেন। তবে সেই সময়ে কেউ কেউ জরুরি কাজে নানা জায়গায় থাকায় সভার তারিখ এক দিন পিছিয়ে দিতে হলো।

পরদিন ২৮ সেপ্টেম্বর সোভিয়েত ইউনিয়নের কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক লিওনিদ ব্রেজনেভ, প্রধানমন্ত্রী আলেক্সি কোসিগিন এবং অন্য নেতাদের সঙ্গে ইন্দিরার দফায় দফায় ফলপ্রসূ আলোচনা হলো। বৈঠকের পর সোভিয়েত প্রধানমন্ত্রী আলেক্সি কোসিগিন যে বক্তব্য দিলেন, সেটা ছিল পাকিস্তানের জন্য বড় এক বার্তা। পরদিন কলকাতার আনন্দবাজার পত্রিকায় এর শিরোনাম ছিল, ‘যত শীঘ্র সম্ভব পূর্ববঙ্গে রাজনৈতিক মীমাংসা কাম্য’।

ইন্দিরা গান্ধীর এই সফরের এক মাস আগেই অবশ্য ঠিকঠাক হয়ে গিয়েছিল যে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সোভিয়েতকে পাশে পাচ্ছে ভারত। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালেই আগস্ট মাসে সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে ভারতের মৈত্রী চুক্তি হয়, যেখানে ভারতকে সামরিক সহায়তা দেওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করে সোভিয়েত পক্ষ। আর এই চুক্তি এবং ইন্দিরার সোভিয়েত সফরের পর থেকেই ভারত তাদের কাছ থেকে ব্যাপক অস্ত্র-গোলাবারুদ পেতে আরম্ভ করে। ভারতও এ সময় মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্র-গোলাবারুদ সরবরাহ বাড়িয়ে দেয়। অস্ত্র পাওয়ার পর বাংলাদেশের প্রশিক্ষিত গেরিলারা ঝাঁকে ঝাঁকে দেশে প্রবেশ করতে থাকেন। মুক্তিযুদ্ধের গতি কয়েক গুণ বেড়ে যায়। তবে সে যুদ্ধে সমন্বয় না থাকায় মাঠের লড়াইয়ে সুফল পাওয়া কঠিন হয়ে যাচ্ছিল।

সমন্বয়হীনতা পর্ব

২৫ মার্চ রাতে পশ্চিম পাকিস্তানের হামলার পরই প্রাথমিক প্রতিরোধ গড়ে তোলেন সামরিক, আধা সামরিক বাহিনীর (ইপিআর ও পুলিশ) বাঙালি সদস্যরা। ধীরে ধীরে যুক্ত হতে থাকে দেশের সাধারণ মানুষ।

গ্রুপ ক্যাপ্টেন হিসেবে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেওয়া ডেপুটি চিফ অব স্টাফ এ কে খন্দকার ১৯৭১: ভেতরে বাইরে (প্রথমা প্রকাশন, ২০১৪) বইয়ে লিখেছেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের শুরু থেকে মাঠপর্যায়ে পাশাপাশি দুটি সামরিক নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠিত ছিল। একটি ভারতীয় সেনাবাহিনীর নেতৃত্ব এবং অন্যটি আমাদের ব্রিগেড ও সেক্টরের নেতৃত্ব। অথচ যুদ্ধ ছিল একটাই।’

মুক্তিযুদ্ধের ব্যাপ্তি ও তীব্রতা বাড়তে থাকায় একটি পর্যায়ে দুই বাহিনীর মধ্যে সমন্বয়ের প্রয়োজন দেখা দেয়। সমন্বয় না থাকায় অনেক ভুল-বোঝাবুঝির সুযোগও তৈরি হচ্ছিল। কোনো কোনো মুক্তিযোদ্ধার মধ্যে ভারতীয় বাহিনী নিয়ে দেখা দেয় ক্ষোভ।

১৯৭১: ভেতরে বাইরে বই থেকে জানা যায়, সংগত কারণেই কূটনৈতিক, সামরিক ও অন্যান্য কারণে মুক্তিযুদ্ধের প্রাক্কালে ভারতীয় সেনাবাহিনীর সীমান্ত অতিক্রম করে পূর্ব পাকিস্তানে ঢুকে মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগিতা করার ওপর বাধানিষেধ ছিল। সেপ্টেম্বর মাসে ইন্দিরা গান্ধী সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে ফিরে আসেন এবং অক্টোবরের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে সীমান্তে ভারতীয় বাহিনীর তৎপরতা ও সীমান্ত অতিক্রম বিষয়ে নিষেধাজ্ঞা অনেকটা শিথিল করেন। এ সময় ইন্দিরা গান্ধী সেনাবাহিনীকে নির্দেশ দেন যে যদি ঘটনার চাপে সীমান্ত অতিক্রম করতে হয়, তাহলে তা তারা করতে পারবে।

অক্টোবর থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের অভিযানে ভারতীয় গোলন্দাজ বাহিনীর সহায়তা বাড়তে থাকে। ১২ অক্টোবর থেকে ভারতীয় সেনাবাহিনী মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে যৌথভাবে বিভিন্ন যুদ্ধে অংশ নিতে শুরু করে। পর্যাপ্ত যুদ্ধসামগ্রী নিয়ে মুক্তিযোদ্ধারা যখন অভিযানে যেতেন, তার আগে ভারতীয় গোলন্দাজ বাহিনী কামানের গোলা ছুড়ে পাকিস্তানি বাহিনীকে সন্ত্রস্ত ও বিপর্যস্ত করে তুলত। এরপর মুক্তিযোদ্ধারা সেখানে গিয়ে চূড়ান্ত আক্রমণ করতেন।

১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১, পাকিস্তানি বাহিনী আত্মসমর্পণ করে বাংলাদেশ–ভারত যৌথ কমিশনের কাছে.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: ইন দ র

এছাড়াও পড়ুন:

চিরচেনা ছবির হারানো নায়কেরা

শত্রুবাহিনীর শক্ত ঘাঁটি লক্ষ্য করে গ্রেনেড ছুড়ে মারছেন এক কিশোর। তাঁর ডান পাশে রাইফেল তাক করে স্থির বসে আছেন আরও দুজন। তাঁদের বুকে তুষের মতো বদলা নেওয়ার আগুন। আর চোখে পরাধীন দেশকে মুক্ত করার প্রত্যয়। অসম সাহসী এই কিশোরদের পেছনে বিস্তীর্ণ ব্রহ্মপুত্র নদ আর তার পেছনে বিশাল আকাশ। ডিসেম্বর মাস বলে ব্রহ্মপুত্রের পানি কিছুটা শুকিয়ে এসেছে। নদের ওপারে যে গ্রামটা, তা একটা রেখার মতো মিশে গেছে অসীমায়। এত এলিমেন্টের মধ্যেও কিন্তু ছবির মূল ফোকাস এই তিন কিশোর। তাঁরা যে ঝোপের আড়াল থেকে গ্রেনেড ছুড়ে মারছেন, তার ডান পাশে একটা বরুণগাছ। শত্রুপক্ষের পাল্টা আক্রমণ এলে এই গাছটাকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে লড়াইটা চালিয়ে যাবেন তাঁরা। মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে বাঙালি মানসে এই দৃশটি একটি চিরচেনা আলোকচিত্র। বহু মাধ্যমে বহুল ব্যবহারের ফলে এই ছবির নির্মাতা যে নাইব উদ্দিন আহমেদ, তা অনেকেরই জানা। কিন্তু চিরচেনা এই ছবির নায়কদের কথা তেমন কেউ জানে না।

আমি বহুদিন ধরে চেষ্টা করছি এই ছবির নায়কদের খুঁজে বের করতে। অনেক বছর আগে কে যেন আমাকে বলেছিলেন, এই কিশোরদের বাড়ি টাঙ্গাইল অঞ্চলে এখন আর তাঁর নামটা মনে করতে পারি না। ৮ নভেম্বর রাত ১১টা ২৪ মিনিটে আমার হোয়াটসঅ্যাপ মেসেঞ্জারটা টুং করে বেজে উঠল। নির্মাতা শরীফ রেজা মাহমুদ লিখেছেন, ‘এই তিন বীর মুক্তিযোদ্ধার নাম আবদুল খালেক, আবদুল মজিদ ও মজিবর রহমান। তঁদের বাড়ির টাঙ্গাইলের দেলদুয়ার উপজেলার মুশুরিয়া গ্রামে।’ খালেক ও মজিদের ফোন নম্বর দিয়ে শরীফ জানালেন মজিবর মারা গেছেন কয়েক বছর আগে। শরীফ এই তথ্যগুলো পেয়েছেন শেরপুরের বীর মুক্তিযোদ্ধা আবু সালেহ মো. নূরুল ইসলাম হিরোর কাছে। শরীফের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে আমি পেয়ে যাই এই ঐতিহাসিক ছবির হারানো নায়কদের।

ছবিটি তোলা হয়েছিল ১৯৭১ সালের ৭ ডিসেম্বর, ময়মনসিংহের শম্ভুগঞ্জে। ৩ ডিসেম্বর ভারতীয় মিত্রবাহিনী পাকিস্তানি হানাদারদের বিপক্ষে যুদ্ধ ঘোষণা করল। ওই দিনই মিত্রবাহিনীর সঙ্গেই বাংলাদেশের সীমানায় প্রবেশ করেন এই তিন বীর।মুক্তিযুদ্ধের সেই চিরচেনা ছবি [ময়মনসিংহ, ৭ ডিসেম্বর, ১৯৭১]। আলোকচিত্র: নাইব উদ্দিন আহমেদ

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • ব্যাপক এক নৌ হামলা অপারেশন জ্যাকপট
  • এই দিনে হানাদার মুক্ত হয়েছিল কুষ্টিয়ার যেসব স্থান
  • ঝালকাঠি পাক হানাদার মুক্ত দিবস আজ 
  • তাদের দেশের মানুষ ১৯৭১ সালেই দেখেছে: তারেক রহমান 
  • দেশের মানুষ ১৯৭১ সালে তাদের দেখেছে: তারেক
  • চিরচেনা ছবির হারানো নায়কেরা