‘পুতের মুহেত্তে একটাবার মা ডাক হুনবার চাই’
Published: 20th, April 2025 GMT
রাজধানীর বনানীতে হাসাহাসির মতো তুচ্ছ বিষয় নিয়ে ছুরিকাঘাতে প্রাইমএশিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী জাহিদুল ইসলাম পারভেজ নিহতের ঘটনা মানতে পারছেন না স্বজন ও এলাকাবাসী। একমাত্র ছেলেকে হারিয়ে অবিরাম কাঁদছেন মা পারভীন আক্তার ও বাবা জসিম উদ্দিন। কাঁদতে কাঁদতে অচেতন হয়ে পড়ছেন পারভীন। জ্ঞান ফিরলে বিলাপ করে তিনি বলছেন, ‘আমার পুতেরে আইনা দাও। আমি একটাবার পুতের মুহেত্তে মা ডাক হুনবার চাই।’
পারভেজের বাড়ি ময়মনসিংহের ভালুকা উপজেলার বিরুনীয়া ইউনিয়নের কাইচান গ্রামে। তিনি প্রাইমএশিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ষষ্ঠ সেমিস্টারের শিক্ষার্থী ছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে শনিবার বিকেলে একদল যুবক তাঁকে ছুরিকাঘাতে হত্যা করে। রোববার বিকেল সাড়ে ৫টায় গ্রামের বাড়িতে মরদেহ পৌঁছায়। এর আগে ছেলের মৃত্যুর খবর পেয়ে রোববারই কুয়েত থেকে ফিরেছেন জসিম উদ্দিন। মরদেহ বাড়িতে পৌঁছলে পারভেজের মা-বাবার কান্না দেখে উপস্থিত কেউ চোখের পানি ধরে রাখতে পারেননি।
সন্ধ্যায় তাদের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, পারভেজের নিথর দেহের পাশে কাঁদছেন স্বজন ও গ্রামবাসী। আহাজারি করতে করতে জসিম বলেন, ‘আমার পুতেই যদি না থাহে, আমি বাইচ্চা থাইক্কা লাভ কী? যারা আমার পুতেরে মারছে তাদের ফাঁসি চাই।’
পারভেজ ছাত্রদলের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। রোববার দুপুরে ঢাকা মেডিকেল কলেজ মর্গে ময়নাতদন্ত শেষে তাঁর মরদেহ নেওয়া হয় নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে। সেখানে প্রথম জানাজা হয়। পরে রাত ১০টার দিকে গ্রামে তাঁর লাশ দাফন করা হয়।
এদিকে পারভেজ হত্যার প্রতিবাদে আজ সোমবার সারাদেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ কর্মসূচি ঘোষণা করেছে ছাত্রদল। রোববার নয়াপল্টনে সংবাদ সম্মেলনে ছাত্রদলের সভাপতি রাকিবুল ইসলাম রাকিব বলেন, ‘পারভেজের খুনিদের রাজনৈতিক প্রশ্রয়দাতাসহ খুন ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে জড়িত সবার যথাযথ বিচার ও শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। আমরা এই হত্যাকাণ্ডের তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাচ্ছি।’
জানাজা শেষে নয়াপল্টন থেকে মরদেহ নেওয়া হয় প্রাইমএশিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে। সেখান থেকে পরে পারভেজের মরদেহ গ্রামের বাড়িতে পাঠানো হয়। পুলিশ জানিয়েছে, নিহতের মামাতো ভাই হুমায়ন কবীর শনিবার গভীর রাতে বনানী থানায় আটজনের নামে হত্যা মামলা করেন। মামলায় অজ্ঞাতপরিচয় আসামি ২৫ থেকে ৩০ জন।
এজাহারনামীয় আসামিরা হলেন– বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের বনানী থানার যুগ্ম আহ্বায়ক সোবহান নিয়াজ তুষার ও যুগ্ম সদস্য সচিব হৃদয় মিয়াজি এবং মেহেরাজ ইসলাম, আবু জহর গিফ্ফারি ওরফে পিয়াস, মাহাথির হাসান, রিফাত, আলী ও ফাহিম। রোববার রাত ৯টা পর্যন্ত কেউ গ্রেপ্তার হয়নি। পুলিশ বলছে, পারভেজ হত্যায় জড়িতদের শনাক্ত করা হয়েছে। তাদের গ্রেপ্তারে পুলিশের একাধিক দল কাজ করছে।
এজাহারে বলা হয়েছে, শনিবার বিকেল ৩টার দিকে পারভেজ, তাঁর বন্ধু টেক্সটাইল বিভাগের তরিকুল, সুকর্ণ, ইমতিয়াজসহ কয়েকজন বিশ্ববিদ্যালয়ের বিপরীতে একটি দোকানে নিজেরা কথাবার্তা এবং হাসাহাসি করছিলেন। তাদের পেছনেই ইউনিভার্সিটি অব স্কলারসের দুই ছাত্রী দাঁড়িয়েছিলেন। এ সময় আসামি মেহেরাজ, পিয়াস ও মাহাথি হাসাহাসির কারণ জানতে চান। এ নিয়ে পারভেজদের সঙ্গে তাদের বাগ্বিতণ্ডা শুরু হয়। ঘটনা নজরে এলে তাদের নিয়ে বসে তিন শিক্ষক বিষয়টি মীমাংসা করে দেন। এর পর আসামিরা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বের হয়ে যান। বন্ধুদের সঙ্গে পারভেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনের রাস্তায় দাঁড়িয়ে কথা বলছিলেন। বিকেল ৪টা ৪০ মিনিটে মেহেরাজ, পিয়াস ও মাহাথি বহিরাগতদের সঙ্গে মিলে পারভেজসহ অন্যদের ধাওয়া করেন। তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতরে আশ্রয় নেওয়ার চেষ্টা করেন। এ সময় আসামিরা পারভেজ ও তরিকুলকে ফটকের সামনে মারধর করেন। এক পর্যায়ে পারভেজের বুকে ছুরিকাঘাত করেন মেহেরাজ। তিনি মাটিতে লুটিয়ে পড়লে অন্য আসামিরাও মারধর ও ছুরিকাঘাত করেন। এ সময় তরিকুলকেও ছুরিকাঘাত করা হয়। পরে রক্তাক্ত অবস্থায় দু’জনকে কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে নেওয়া হলে চিকিৎসক পারভেজকে মৃত ঘোষণা করেন। তরিকুল সেখানে চিকিৎসাধীন।
বনানী থানার ওসি রাসেল সারোয়ার বলেন, রোববার দুপুরে অন্তত ৩০ শিক্ষার্থী থানায় এসে আসামিদের গ্রেপ্তার এবং সুষ্ঠু তদন্তের দাবি জানান। আমরা তাদের আশ্বস্ত করেছি, দ্রুত আসামিদের গ্রেপ্তার করা হবে।
এদিকে পারভেজ হত্যার বিচার দাবিতে রোববার দুপুরে ভালুকায় ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ মিছিল করেছে উপজেলা ছাত্রদল। এ ছাড়া প্রাইমএশিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে ও বনানীর কাকলী এলাকায় বিক্ষোভ করেন শিক্ষার্থীরা।
.উৎস: Samakal
এছাড়াও পড়ুন:
হাদির ওপর গুলিবর্ষণে জড়িত ব্যক্তিদের পালানো ঠেকাতে সীমান্তে টহল জোরদার
ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ঢাকা–৮ আসনের সম্ভাব্য স্বতন্ত্র প্রার্থী ও ইনকিলাব মঞ্চের আহ্বায়ক শরিফ ওসমান বিন হাদির ওপর গুলিবর্ষণের ঘটনায় জড়িত ব্যক্তিরা যেন দেশ ছেড়ে পালাতে না পারেন, সে জন্য সীমান্তে তৎপরতা জোরদার করেছে বিজিবি। ময়মনসিংহ ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া সীমান্তে চেকপোস্ট স্থাপনসহ বিশেষ টহল, তল্লাশি অভিযান ও নিরাপত্তা বাড়ানো হয়েছে।
নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পরদিন গতকাল শুক্রবার দুপুরে রাজধানীর পুরানা পল্টনের বক্স কালভার্ট রোডে গুলিবিদ্ধ হন ইনকিলাব মঞ্চের আহ্বায়ক ও ঢাকা–৮ সংসদীয় আসনের সম্ভাব্য প্রার্থী ওসমান হাদি। মোটরসাইকেলে থাকা আততায়ী তাঁকে গুলি করে মোটরসাইকেলে করেই পালিয়ে যায়। হাদি এখন রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। তাঁর অবস্থা এখনো শঙ্কামুক্ত নয় বলে জানিয়েছে ইনকিলাব মঞ্চ।
ওসমান হাদিকে গুলি করার ঘটনায় সন্দেহভাজন একজনকে শনাক্ত করেছে পুলিশ। বলা হচ্ছে, ওই ব্যক্তির নাম ফয়সাল করিম মাসুদ ওরফে দাউদ খান। ঘটনার সিসিটিভি ক্যামেরার ফুটেজ বিশ্লেষণ করে ওই ব্যক্তিকে শনাক্ত করা হয়েছে। তাঁর ব্যাপারে তথ্য দিতে সবাইকে অনুরোধ জানিয়েছে ডিএমপি। এ ছাড়া ওসমান হাদিকে গুলি করা ব্যক্তিকে ধরিয়ে দিতে পারলে ৫০ লাখ টাকা পুরস্কারের ঘোষণা দিয়েছেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী।
আরও পড়ুনওসমান হাদিকে গুলির ঘটনায় সন্দেহভাজন কে এই ফয়সাল করিম দাউদ১ ঘণ্টা আগেআজ শনিবার বিজিবির ৩৯ ব্যাটালিয়ন থেকে পাঠানো বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে, ওসমান হাদির ওপর গুলির ঘটনার পরিপেক্ষিতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং সদর দপ্তর বিজিবির নির্দেশনা অনুযায়ী ময়মনসিংহ ব্যাটালিয়নের (৩৯ বিজিবি) দায়িত্বপূর্ণ শেরপুর ও ময়মনসিংহ জেলার সীমান্তবর্তী বিভিন্ন যাতায়াতের পথে এবং গুরুত্বপূর্ণ স্থানে কঠোর নজরদারি বৃদ্ধি করা হয়েছে। আততায়ী যেন সীমান্ত দিয়ে পালিয়ে যেতে না পারে, সেই লক্ষ্যে ময়মনসিংহ ব্যাটালিয়ন (৩৯ বিজিবি) নিয়মিত টহলের পাশাপাশি অতিরিক্ত বিশেষ টহল পরিচালনা করছে। সেই সঙ্গে সীমান্তের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থানে চেকপোস্ট স্থাপন করে তল্লাশি কার্যক্রম পরিচালনা করা হচ্ছে। সীমান্ত এলাকায় নজরদারি বৃদ্ধি, সন্দেহভাজন ব্যক্তিদের চলাচল নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ, অনুপ্রবেশ প্রতিরোধ এবং সার্বিক নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে। পাশাপাশি সীমান্ত এলাকায় বসবাসরত স্থানীয় জনসাধারণের সহযোগিতার মাধ্যমেও সীমান্তে নজরদারি করা হচ্ছে।
ময়মনসিংহ ব্যাটালিয়ন (৩৯ বিজিবি) অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মেহেদী হাসান বলেন, ময়মনসিংহ ও শেরপুর জেলার আন্তর্জাতিক সীমানা রক্ষায় বিজিবি সর্বোচ্চ সতর্কতা ও পেশাদারত্বের সঙ্গে দায়িত্ব পালন করছে এবং দেশের সার্বভৌমত্ব ও সীমান্ত নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। এ লক্ষ্যে স্থানীয় প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে সমন্বয় বজায় রেখে প্রয়োজনীয় সব ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে। পরিস্থিতি বিবেচনায় এ ধরনের নিরাপত্তামূলক কার্যক্রম অব্যাহত থাকবে।
বিজিবি একই উদ্যোগ নিয়েছে ব্রাহ্মণবাড়িয়া সীমান্তে। জেলার সীমান্তবর্তী কসবা, আখাউড়া ও বিজয়নগর উপজেলায় যানবাহনে তল্লাশি বাড়ানো হয়েছে। সীমান্ত দিয়ে যাতে কেউ অবৈধভাবে ভারতে যেতে না পারে, সে জন্য জেলার সরাইল (২৫ বিজিবি) ব্যাটালিয়ন ও সুলতানপুর (৬০ বিজিবি) ব্যাটালিয়নের সদস্যরা গতকাল রাত থেকেই সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নিয়েছেন। আজ দিনভর তাঁরা সীমান্ত এলাকায় টহল ও বিভিন্ন যানবাহনে তল্লাশি চালিয়েছেন।
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরাইলের বিজিবি ২৫ ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল জব্বার আহমেদ জানান, সদর দপ্তরের নির্দেশনা মোতাবেক দায়িত্বপূর্ণ এলাকা ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়া, বিজয়নগর ও হবিগঞ্জের কিছু সীমান্ত এলাকায় টহল কার্যক্রম স্বাভাবিকের চেয়ে দ্বিগুণ করা হয়েছে। অবৈধভাবে কেউ সীমান্ত অতিক্রম করতে পারবে না। সুলতানপুর ব্যাটালিয়নের (৬০ বিজিবি) অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মো. জিয়াউর রহমান জানান, অবৈধভাবে সীমান্ত পারাপার রোধকল্পে বিজিবির সদস্যরা সর্বদা সীমান্তে টহল দেন। সীমান্ত রক্ষার পাশাপাশি দেশের নিরাপত্তার স্বার্থে সন্ত্রাসীদের অবৈধভাবে পারাপার ঠেকাতে বিজিবি বদ্ধপরিকর।