সিলেটে ছিনতাইকারীদের ছুরিকাঘাতে ব্যবসায়ী খুন
Published: 21st, April 2025 GMT
সিলেটের বিশ্বনাথে ছিনতাইকারীদের ছুরিকাঘাতে নিপেশ তালুকদার (৪২) নামে এক ভ্রাম্যমাণ ব্যবসায়ী (ফেরিওয়ালা) নিহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। রোববার রাত ৮টার দিকে উপজেলার খাজাঞ্চী ইউনিয়নের পীরের বাজার এলাকায় এ ঘটনা ঘটে।
খবর পেয়ে রাত ১১টায় লাশ উদ্ধার করে ময়নাতদন্তের জন্যে সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে প্রেরণ করেছে পুলিশ। নিহত নিপেশ তালুকদার সুনামগঞ্জ জেলার দিরাই উপজেলার সুনামপুর গ্রামের সানন্দ তালুকদারের ছেলে। দীর্ঘদিন ধরে তিনি পরিবার নিয়ে সিলেটের জালালাবাদ থানার তেমুখিস্থ খালেদ মিয়ার বিল্ডিংয়ের দ্বিতীয় তলায় ভাড়ায় বসবাস করে আসছিলেন।
প্রাথমকিভাবে ধারণা করা হচ্ছে ছিনতাইকারীরা তাকে ছুরিকাঘাত করে সর্বস্ব লুটে নিয়েছে।
স্থানীয় ও পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, নিহত নিপেশ তালুকদারকে স্থানীয়রা বাবু নামে চিনতেন। তিনি (নিপেশ) প্রতিদিন বাইসাইকেলে করে বাজারে বাজারে পান, সুপারি, সিগারেট, কয়েল ইত্যাদি ফেরি করে বিক্রি করতেন। রোববারও সন্ধ্যায় একইভাবে বাইসাইকেল দিয়ে মালামাল বিক্রি শেষে পীরের বাজারের পশ্চিমে যাওয়া মাত্রই অজ্ঞাতনামা ছিনতাইকারীরা তার বুকের বাম পাশে ছুরিকাঘাত করে মালপত্র ও টাকা নিয়ে পালিয়ে যায়। এ সময় রক্তাক্ত অবস্থায় পীরের বাজারের ব্যবসায়ী আব্দুল কুদ্দুছ আলীর চায়ের দোকানে দৌড়ে গিয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে প্রাণ বাঁচানোর আকুতি জানান। কিন্তু লোকজন তাকে চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যাওয়ার আগেই তিনি মারা যান।
খবর পেয়ে একদল পুলিশসহ রাত ১১টার দিকে সিলেটের ওসমানীনগর সার্কেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আশরাফুজ্জামান ও বিশ্বনাথ থানার ওসি এনামুল হক চৌধুরী ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন। পরে তারা লাশের সুরতহাল শেষে ময়নাতদন্তের জন্য লাশ সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেলে কলেজ হাসপাতালে পাঠান।
বিশ্বনাথ থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) এনামুল হক চৌধুরী হত্যার সত্যতা স্বীকার করে সমকালকে বলেন, প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে ছিনতাইকারীরাই তাকে ছুরিকাঘাত করে হত্যা করেছে। লাশ উদ্ধার করে মর্গে পাঠানো হয়েছে এবং পরবর্তী আইনি ব্যবস্থা চলমান রয়েছে।
.উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: ব যবস
এছাড়াও পড়ুন:
যুক্তরাষ্ট্রের প্রস্তাবে সোভিয়েত ভেটো
৪ ডিসেম্বর ১৯৭১। নিউইয়র্ক সময় বিকেল পাঁচটা। যুক্তরাষ্ট্রসহ নয়টি রাষ্ট্রের অনুরোধে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের জরুরি অধিবেশন শুরু হলো। পরিষদের স্থায়ী ও অস্থায়ী ১৫ সদস্যরাষ্ট্র ছাড়াও ভারত ও পাকিস্তানের প্রতিনিধিরা উপস্থিত। আলোচনার বিষয় ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধবিরতি।
ভারতের স্থায়ী প্রতিনিধি সমর সেন সেদিন দুপুরে নিরাপত্তা পরিষদে বাংলাদেশের প্রতিনিধি আবু সাঈদ চৌধুরীর অংশগ্রহণের অনুরোধ জানিয়ে একটি চিঠি পাঠান। চিঠিটি পাঠানো হয় নিরাপত্তা পরিষদের সভাপতি সিয়েরা লিওনের আই বি টেইলর কামারার কাছে।
অধিবেশনে ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধবিরতির একটি খসড়া প্রস্তাব যুক্তরাষ্ট্র বিলি করে। এরপর বক্তব্য দিতে ওঠেন সোভিয়েত ইউনিয়নের স্থায়ী প্রতিনিধি ইয়াকফ মালিক। কোনো রাখঢাক ছাড়াই তিনি বললেন, এ আলোচনার কেন্দ্রে রয়েছে বাংলাদেশের অবনতিশীল পরিস্থিতি। বাংলাদেশের একজন প্রতিনিধির বক্তব্য দেওয়ার সুযোগ রাখা হোক।
এর আগের দিন, অর্থাৎ ৩ ডিসেম্বর পাকিস্তানের যুদ্ধবিমান ভারতের পশ্চিম সীমান্তে একযোগে হামলা চালিয়েছে। সেদিন কলকাতায় ব্রিগেড প্যারেড গ্রাউন্ডের বিশাল জনসভায় ভাষণ দেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী। হামলার খবর পেয়ে বিমানে করে তড়িঘড়ি দিল্লি ফিরে মন্ত্রিপরিষদের জরুরি সভা ডাকেন। ওই সভায় ঠিক হয়, ভারত পাল্টাযুদ্ধ ঘোষণা করবে এবং বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেবে। মধ্যরাতের পর অর্থাৎ ৪ ডিসেম্বর প্রথম প্রহরে আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হলো ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ। এ দিনই বাংলাদেশের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ এক জরুরি লিপিতে ইন্দিরা গান্ধীকে জানালেন, পাকিস্তানের সর্বশেষ আক্রমণের সমুচিত জবাব দিতে ভারতীয় বাহিনী ও বাংলাদেশ মুক্তিবাহিনীর মিলিত ভূমিকা সফলতর হতে পারে, যদি এ দুটি দেশের মধ্যে আনুষ্ঠানিক কূটনৈতিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত হয়। (মূলধারা ’৭১, মঈদুল হাসান)
নিক্সন-কিসিঞ্জারের ‘মাথাব্যথা’
সর্বাত্মক এ যুদ্ধে পাকিস্তানের পরাজয় ঠেকানো যে অসম্ভব, সে দুর্ভাবনা মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন ও তাঁর জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা হেনরি কিসিঞ্জারের মস্ত মাথাব্যথার কারণ হয়ে ওঠে। প্রত্যক্ষভাবে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ার প্রশ্নই ওঠে না, কেননা তাতে সোভিয়েত ইউনিয়নকে টেনে আনা হবে। গত আগস্টেই ভারত ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে সই হয়েছে ২০ বছর মেয়াদি ‘শান্তি, বন্ধুত্ব ও সহযোগিতার চুক্তি’ (মৈত্রী চুক্তি)। পাকিস্তানের ভরাডুবি ঠেকাতে নিক্সন-কিসিঞ্জার নিরাপত্তা পরিষদের মাধ্যমে যুদ্ধবিরতি প্রস্তাব পাসে অগ্রসর হলেন। তবে ওয়াশিংটনের এ রণকৌশলের বিপরীতে দাঁড়ায় সোভিয়েত ইউনিয়ন। সামরিক যুদ্ধের পাশাপাশি ওই ‘কূটনৈতিক যুদ্ধে’ জয়ও তখন বাংলাদেশের জন্য কম গুরুত্বপূর্ণ ছিল না।
পাকিস্তানের হামলার জবাবে ভারত যখন যুদ্ধ ঘোষণা করে, নিউইয়র্কে তখন সকাল। টেলিফোনে ইয়াকফ মালিক ও সমর সেনের মধ্যে কথা হয়। ওয়াশিংটন যে অনতিবিলম্বে যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব তুলবে, সে ব্যাপারে তাঁরা নিশ্চিত ছিলেন। সিদ্ধান্ত হয়, মার্কিন যুদ্ধবিরতি প্রস্তাবের বিপরীতে পাল্টা প্রস্তাব তুলবে সোভিয়েত ইউনিয়ন।
ভারত ও সোভিয়েত ইউনিয়ন উভয়েই বাংলাদেশে পাকিস্তানের সামরিক হামলা ও গণহত্যার নিন্দা করেছে। তবে তখন পর্যন্ত বাঙালিদের আত্মনিয়ন্ত্রণের দাবির কথা স্পষ্টভাবে তারা উল্লেখ করেনি। ৪ ডিসেম্বরের অধিবেশনে সেই অধিকারের স্বীকৃতি দিলেন ইয়াকফ মালিক। তাঁর মাধ্যমে গোটা বিশ্ব জানল, বাংলাদেশে যা ঘটছে, তা মূলত একটি জাতির মুক্তি আন্দোলন।
পাকিস্তানের হামলার জবাবে ভারত যখন যুদ্ধ ঘোষণা করে, নিউইয়র্কে তখন সকাল। টেলিফোনে ইয়াকফ মালিক ও সমর সেনের মধ্যে কথা হয়। ওয়াশিংটন যে অনতিবিলম্বে যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব তুলবে, সে ব্যাপারে তাঁরা নিশ্চিত ছিলেন। সিদ্ধান্ত হয়, মার্কিন যুদ্ধবিরতি প্রস্তাবের বিপরীতে পাল্টা প্রস্তাব তুলবে সোভিয়েত ইউনিয়ন।ইয়াকফ মালিক বলেন, ‘আমরা যদি উটপাখির মতো বালুতে মাথা গুঁজে থাকতে চাই, তাহলে এ নিয়ে ভাবার কিছু নেই। কিন্তু বাস্তব সত্য যদি আমরা জানতে চাই, কেন এ দুই দেশের মধ্যে সামরিক সংঘর্ষ দেখা দিয়েছে, তাহলে সংকটের মূল কারণ জানতে হবে। এ ঘটনা ও এর কারণ নিরূপণ করতে হবে। এই যে বিদ্রোহ, জাতিসংঘের নিজস্ব পরিভাষায় তা অন্যভাবেও বর্ণনা করা যায়, আর তা হলো জাতীয় মুক্তিবাহিনী (ন্যাশনাল লিবারেশন ফোর্সেস) ও জাতীয় মুক্তি আন্দোলন (ন্যাশনাল লিবারেশন মুভমেন্ট), এই দৃষ্টিকোণ থেকে তাকে দেখা।’
সেদিনের বিতর্কে সবচেয়ে তির্যক মন্তব্যটি করেন সমর সেন। তাঁর কথায়, ‘বাংলাদেশকে বাদ দিয়ে এই প্রশ্নে আলোচনা হবে প্রিন্স অব ডেনমার্ককে বাদ দিয়ে হ্যামলেট নাটকের অভিনয়।’
শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশের প্রতিনিধি সেদিন বক্তব্য দিতে পারেননি। কিন্তু এ বক্তব্য রাখার সূত্র ধরে যে বিতর্ক হয়, তাতে দিবালোকের মতো স্পষ্ট হয়ে যায়, বাংলাদেশের সংকট শুধু শরণার্থীবিষয়ক নয়।
বাংলাদেশের প্রতিনিধির বক্তব্য প্রদানের দাবি অগ্রাহ্য হওয়ার পর যুক্তরাষ্ট্র ও বিভিন্ন আরব দেশের সমর্থনে উত্থাপিত যুদ্ধবিরতির প্রস্তাবটি নাচক হয়ে যায় সোভিয়েত ভেটোর কারণে। এরপর ইয়াকফ মালিক একটি পাল্টা প্রস্তাব রাখলেন। তাতে সংকট থেকে উত্তরণের জন্য ‘রাজনৈতিক সমাধানের’ দাবি যুক্ত হলো। ওই দাবির অর্থই ছিল বাংলাদেশের রাজনৈতিক ক্ষমতা দেশটির নির্বাচিত গণপ্রতিনিধিদের কাছে হস্তান্তর। পাকিস্তান স্বাভাবিকভাবে এ প্রস্তাবের বিরুদ্ধে। চীন ও পরিষদের আরও ১০ সদস্য তাদের পক্ষে দাঁড়ায়। ফলে সোভিয়েত প্রস্তাবটি বাতিল হয়ে যায়।
বাংলাদেশের প্রতিনিধির বক্তব্য প্রদানের দাবি অগ্রাহ্য হওয়ার পর যুক্তরাষ্ট্র ও বিভিন্ন আরব দেশের সমর্থনে উত্থাপিত যুদ্ধবিরতির প্রস্তাবটি নাচক হয়ে যায় সোভিয়েত ভেটোর কারণে।পরদিন ৫ ডিসেম্বর নিরাপত্তা পরিষদে আবার বিতর্ক শুরু হলে সোভিয়েত ইউনিয়ন ছাড়াও চীন ও আট অস্থায়ী সদস্যের যৌথ প্রস্তাব উত্থাপন করা হয়। সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রস্তাবের পক্ষে শুধু তারা ও পোল্যান্ড ভোট দেয়। বিপক্ষে ভোট দেয় চীন; বাকিরা ভোটদানে বিরত থাকে। কোনো প্রস্তাব গৃহীত হওয়ার জন্য কমপক্ষে নয়টি সদস্যদেশের সমর্থন প্রয়োজন। তা অর্জনে ব্যর্থ হয় সোভিয়েত প্রস্তাবটি। অন্যদিকে যৌথ প্রস্তাবটিও সোভিয়েত ইউনিয়নের ভেটোর কারণে বাতিল হয়ে যায়। আর চীনের অনুরোধে তাদের উত্থাপিত প্রস্তাবটি সেদিন আর ভোটাভুটিতে দেওয়া হয়নি।
এরই মধ্যে ৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশকে স্বাধীন ও সার্বভৌম দেশ হিসেবে স্বীকৃতি দেয় ভারত। ফলে বাংলাদেশ প্রশ্নে সংকট যে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত হচ্ছে, তা যুক্তরাষ্ট্র বা চীন কারোরই বুঝতে বাকি রইল না। একই দিন ভুটানও বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়।
৪, ৫ ও ৬ ডিসেম্বর মোট ২০ ঘণ্টা আলাপ-আলোচনা ও যুক্তিতর্ক উপস্থাপনের পর আরেকটা বিষয় পরিষ্কার হয়ে যায়, সোভিয়েত ইউনিয়ন অথবা চীন-যুক্তরাষ্ট্র—এ দুই পক্ষের আপত্তির কারণে নিরাপত্তা পরিষদে কোনো প্রস্তাবই গৃহীত হওয়ার বাস্তবসম্মত কারণ নেই। এ পরিস্থিতিতে যুদ্ধবিরতির প্রসঙ্গটি সাধারণ পরিষদে স্থানান্তরের কথা ওঠে।
সে অনুযায়ী ৭ ডিসেম্বর সাধারণ পরিষদের জরুরি অধিবেশন আহ্বান করা হয়। সেদিন ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সরদার শরণ সিং সংকটের ঐতিহাসিক পটভূমি তুলে ধরে বলেন, পূর্ব পাকিস্তানের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর ছাড়া এ সংকটের সুরাহা হবে না।
বিতর্ক শেষে যে প্রস্তাব উত্থাপিত হয়, তাতে ভারত ও পাকিস্তানকে অবিলম্বে যুদ্ধবিরতি কার্যকর করার কথা বলা হয়। প্রস্তাবের পক্ষে ১০৪ ও বিপক্ষে ১১ ভোট পড়ে। বিপক্ষে ভোট দেওয়া দেশগুলো হলো ভারত, ভুটান, সোভিয়েত ইউনিয়ন, পোল্যান্ড, বেলারুশ, পূর্ব জার্মানি, বুলগেরিয়া, চেকোস্লোভাকিয়া, হাঙ্গেরি, কিউবা ও মঙ্গোলিয়া।
ভারত ও সোভিয়েত ইউনিয়ন উভয়েই যেহেতু কালক্ষেপণের কৌশল নিয়েছিল, তাই তারা চাইছিল যুদ্ধাবস্থা এমন পর্যায়ে পৌঁছাক, যখন কোনো যুদ্ধবিরতি প্রস্তাবই তাকে প্রভাবিত করতে পারবে না। ভারত এ কারণে গৃহীত প্রস্তাবের ব্যাপারে তাদের অবস্থান জানাতে পাঁচ দিন সময় নেয়।কূটনৈতিক বিপর্যয়েও জয়ের হাতছানি
বলা বাহুল্য, এ ভোটের ফলাফল বাংলাদেশ ও ভারত উভয়ের জন্য ছিল কূটনৈতিক বিপর্যয়। পরাশক্তি হিসেবে সোভিয়েত ইউনিয়ন প্রবল সমালোচনার মুখে পড়ে। অবশ্য এটা যে খুব অপ্রত্যাশিত ছিল, তা বলা যাবে না। ফলে তাৎক্ষণিকভাবে প্রস্তাবটি বিব্রতকর হলেও তাদের জন্য স্বস্তির ছিল রণক্ষেত্রের পরিবর্তিত সমীকরণ। মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় বাহিনীর যৌথ আক্রমণে তখন পাকিস্তানি বাহিনী কোণঠাসা হয়ে পড়ছে। পরাজয় স্বীকার করা ছাড়া পাকিস্তানিদের যে গত্যন্তর নেই, তা শুধু সময়ের অপেক্ষা—এ বিষয়ে তারা নিশ্চিত ছিল। মাত্র আট দিন পর ১৬ ডিসেম্বর আসে সেই মাহেন্দ্রক্ষণ, পৃথিবীর মানচিত্রে জায়গা করে নেয় নতুন রাষ্ট্র বাংলাদেশ।
সাধারণ পরিষদে বিপুল ভোটে যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব গৃহীত হলো বটে, কিন্তু এতে করে রণাঙ্গনের পরিস্থিতির কোনো বদল ঘটল না। কেননা, সাধারণ পরিষদের সিদ্ধান্তের নৈতিক গুরুত্ব থাকলেও তা মানার আইনগত বাধ্যবাধকতা নেই।
ভারত ও সোভিয়েত ইউনিয়ন উভয়েই যেহেতু কালক্ষেপণের কৌশল নিয়েছিল, তাই তারা চাইছিল যুদ্ধাবস্থা এমন পর্যায়ে পৌঁছাক, যখন কোনো যুদ্ধবিরতি প্রস্তাবই তাকে প্রভাবিত করতে পারবে না। ভারত এ কারণে গৃহীত প্রস্তাবের ব্যাপারে তাদের অবস্থান জানাতে পাঁচ দিন সময় নেয়। ১২ ডিসেম্বর তারা জানাল, এই প্রস্তাবে সমস্যার মূল কারণ এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে।
সেদিনই আবার বসল নিরাপত্তা পরিষদের সভা। ওয়াশিংটন প্রস্তুত ছিল যুদ্ধবিরতির নতুন প্রস্তাব নিয়ে। সলাপরামর্শের জন্য সময় প্রয়োজন, এই কথা তুলে ইয়াকভ মালিক বিতর্ক এক দিন পেছাতে অনুরোধ করেন। এতে আরও একটি দিন পাওয়া গেল। পরে ১৩, ১৪ ও ১৫ ডিসেম্বর টানা তিন বৈঠক বসলেও কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছানো সম্ভব হয়নি। ১৪ ডিসেম্বরের বৈঠকে বক্তৃতার সময় উত্তেজিত হয়ে পড়েন পাকিস্তানের উপপ্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টো। একপর্যায়ে তিনি এ–ও বলেন, এটাই তাঁর শেষ বক্তৃতা। এরপর তিনি পোল্যান্ডসহ চার দেশের খসড়া প্রস্তাব কপি ছিঁড়ে বেরিয়ে আসেন। ১৬ ডিসেম্বরের বৈঠকে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সরদার শরণ সিং প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর একটি বিবৃতি পড়ে শোনান। এর মূল কথা ছিল দুটি—১. ঢাকায় পাকিস্তানি সেনাদের আত্মসমর্পণের মাধ্যমে বাংলাদেশের অভ্যুদয় এবং ২. পশ্চিম রণাঙ্গনে ভারতের যুদ্ধবিরতি ঘোষণা। (মুক্তিযুদ্ধ, বাংলাদেশের জন্ম ও জাতিসংঘ, আশফাক হোসেন)
বাংলাদেশ বা ভারত-বাংলাদেশ প্রশ্নে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন নিরাপত্তা পরিষদ কোনো সিদ্ধান্তেই আসতে পারেনি। যুদ্ধ সমাপ্তির পাঁচ দিন পর, ২১ ডিসেম্বর অবশেষে একটি ‘অর্থহীন’ প্রস্তাব গৃহীত হয়। প্রস্তাবের পক্ষে ১৩টি দেশ ভোট দেয়। ভোটদানে বিরত থাকে সোভিয়েত ইউনিয়ন ও পোল্যান্ড। ওই প্রস্তাবে নিরাপত্তা পরিষদ প্রথমবারের মতো বাংলাদেশকে একটি পক্ষ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। তত দিনে সারা বাংলাদেশের আকাশে পতপত করে উড়ছে লাল-সবুজের পতাকা।
দুঃসময়ের বন্ধু
যে সোভিয়েত ইউনিয়নের কথা বলা হচ্ছে, পৃথিবীর মানচিত্রে সে নামের দেশ অবশ্য এখন আর নেই। গত শতকের নব্বইয়ের দশকের গোড়ায় দেশটি ১৫ টুকরা হয়ে গেছে। মুক্তিযুদ্ধের সেই কঠিন দুঃসময়ে ভারত ছাড়া যে কটি দেশ বাংলাদেশের পাশে দাঁড়িয়েছিল, অখণ্ড সোভিয়েত ইউনিয়নসহ অন্যান্য সমাজতান্ত্রিক দেশ তাদের অন্যতম।
সোভিয়েত ইউনিয়নই প্রথম প্রকাশ্যে পূর্ব পাকিস্তানে সামরিক অভিযানের সমালোচনা করেছিল। ২ এপ্রিল সোভিয়েত প্রেসিডেন্ট নিকোলাই পদগোর্নির সই করা বিবৃতিতে পূর্ব পাকিস্তানে রক্তপাত ও ‘নিষ্পেষণ’ বন্ধের পাশাপাশি সংকটের রাজনৈতিক সমাধানের কথা বলা হয়। একই দিন হোয়াইট হাউসের প্রথম প্রকাশ্য প্রতিক্রিয়া ছিল, বাংলাদেশে যা হচ্ছে, তা পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার। বোঝাই যাচ্ছে, সংকটের শুরু থেকেই বাংলাদেশ প্রশ্নে সোভিয়েত ইউনিয়নের অবস্থান ছিল ‘পক্ষপাতপূর্ণ’। এই পক্ষপাত সত্যের খাতিরে, ন্যায্যতার প্রশ্নে।
যুক্তরাষ্ট্র ও চীন উভয়ের প্রচেষ্টা ছিল যেকোনো মূল্যে যুদ্ধবিরতি প্রস্তাব পাস এবং মধ্যস্থতাকারী হিসেবে জাতিসংঘ শান্তি রক্ষা বাহিনী প্রেরণ। এমনটা হলে বাংলাদেশের স্বাধীনতার স্বপ্নপূরণ বাধাগ্রস্ত না হোক, বিলম্বিত যে হতো, তাতে সন্দেহের অবকাশ নেই। সোভিয়েত ইউনিয়ন আন্তর্জাতিক সমালোচনা উপেক্ষা করে মার্কিন সেই রণকৌশল বাস্তবায়িত হতে দেয়নি। এ ক্ষেত্রে তারা তিনবার নিজেদের ভেটো ক্ষমতা প্রয়োগ করে। শেষতক বাংলাদেশ প্রশ্নে পক্ষ ত্যাগ করেনি সোভিয়েত ইউনিয়ন।
তথ্যঋণ
মুক্তিযুদ্ধ, বাংলাদেশের জন্ম ও জাতিসংঘ, আশফাক হোসেন, প্রথমা প্রকাশন; মুক্তিযুদ্ধে সোভিয়েত বন্ধুরা, হাসান ফেরদৌস, প্রথমা প্রকাশন; দিনপঞ্জি—মুক্তিযুদ্ধের দৈনিক ঘটনালিপি, সম্পাদনা: সাজ্জাদ শরিফ, প্রথমা প্রকাশন; মূলধারা ’৭১, মঈদুল হাসান, দ্য ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড।