চলতি মাসের শুরুতে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প যখন ৫৭টি দেশের ওপর উচ্চ ‘পারস্পরিক’ শুল্ক আরোপ করলেন, তখন মার্কিন শেয়ারবাজার ধসে পড়ে, ডলারের মূল্য কমে যায় এবং সরকারি বন্ডের সুদের হার বেড়ে যায়। যদিও পরবর্তী সময়ে বেশির ভাগ শুল্ক ৯০ দিনের জন্য স্থগিত রাখা হয়েছে। তবে চীনের ওপর শুল্ক আরও বেড়েই চলেছে। এই সাময়িক বিরতি দেওয়ার পরও ট্রাম্প জোর দিয়ে বলে যাচ্ছেন, তাঁর মতে এই শুল্কই যুক্তরাষ্ট্রে শিল্প ও উৎপাদন খাতকে ফিরিয়ে আনবে। 

যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসেই শুল্ক কতটা ক্ষতিকর হতে পারে, তার একটি বড় উদাহরণ ১৯৩০ সালের ‘স্মুট-হ্যালি ট্যারিফ অ্যাক্ট’। অনেকেই বলেন, এই আইনের কারণে গভীর অর্থনৈতিক মন্দা আরও খারাপ হয়েছিল। তবে পূর্ব এশিয়ার দেশগুলো (বিশেষ করে দক্ষিণ কোরিয়া) শুল্ককে কার্যকরভাবে ব্যবহার করে শক্তিশালী শিল্প খাত গড়ে তুলতে পেরেছে। তবে যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষেত্রে যেভাবে ট্রাম্প প্রশাসন শুল্ক দিচ্ছে, তা পূর্ব এশিয়ার সফল মডেল থেকে অনেক ভিন্ন। 

প্রথমত, দক্ষিণ কোরিয়ার শুল্কনীতি ছিল অসম। তারা ভোক্তাপণ্যের (যেমন রেফ্রিজারেটর বা টেলিভিশন) ওপর খুব বেশি শুল্ক বসিয়েছিল। এগুলোকে তারা রপ্তানিমুখী শিল্প হিসেবে গড়ে তুলতে চেয়েছিল। আর যেসব যন্ত্রপাতি বা মেশিন প্রয়োজন ছিল এই পণ্য উৎপাদনের জন্য (মানে  ক্যাপিটাল গুডস), সেগুলোর ওপর খুব কম শুল্ক রেখেছিল। এই কম শুল্ক আর কম মজুরির মিলেই কোরিয়াকে সস্তায় পণ্য উৎপাদনের কেন্দ্র করে তুলেছিল। 

কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের শ্রমব্যয় এমনিতেই অনেক বেশি। বিশেষ করে যেসব দেশ থেকে উৎপাদন ফিরিয়ে আনতে চায় যুক্তরাষ্ট্র, তাদের তুলনায় যুক্তরাষ্ট্রের শ্রমব্যয় বেশি। এর ওপর আবার ট্রাম্প প্রশাসন যখন উচ্চ ও বিস্তৃত শুল্ক আরোপ করছে, তখন যুক্তরাষ্ট্রে শিল্প স্থাপন বা উৎপাদন চালানো অনেক খরচসাপেক্ষ হয়ে যাচ্ছে। এটি এতটাই ব্যয়বহুল যে কিছু কোরিয়ান কোম্পানি মনে করছে, যুক্তরাষ্ট্রে নতুন কারখানা বানানোর চেয়ে নিজেদের দেশে উৎপাদন চালিয়ে যাওয়া তাদের জন্য ভালো। অর্থাৎ ট্রাম্প যে শুল্কনীতি নিয়েছেন, তা যুক্তরাষ্ট্রে সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) আকৃষ্ট করার বদলে বরং তা নিরুৎসাহিত করছে। ট্রাম্প প্রশাসন যদি সত্যিই যুক্তরাষ্ট্রে উৎপাদন বাড়াতে চায়, তাহলে যেকোনো দেশের ওপর শুল্ক বসানোর ক্ষেত্রে সেই দেশের যুক্তরাষ্ট্রে বিনিয়োগ (এফডিআই) কতটুকু, তা হিসাবের মধ্যে আনতে হবে। 

বর্তমানে যেটা করা হচ্ছে, তা হলো—প্রথমে কোনো একটি দেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের পণ্য বাণিজ্যে ঘাটতি কত, তা ধরা হচ্ছে। তারপর সেটি ওই দেশের কাছ থেকে মোট আমদানি করা পণ্যের পরিমাণ দিয়ে ভাগ করা হচ্ছে। এরপর যা পাওয়া যাচ্ছে, সেটিকে আবার দুই দিয়ে ভাগ করে সেই হার শুল্ক হিসেবে বসানো হচ্ছে। ট্রাম্প প্রশাসনের এই পদ্ধতির বদলে উচিত হবে প্রথমে সেই দেশের বিনিয়োগ (এফডিআই) পরিমাণটি ওই বাণিজ্যঘাটতি থেকে বাদ দেওয়া, তারপর বাকিটা দিয়ে আগের মতো হিসাব করা। এর ফলে যেসব দেশ যুক্তরাষ্ট্রে বেশি বিনিয়োগ করছে, তাদের ওপর শুল্ক কম হবে। 

তবে এটা মনে রাখা জরুরি, এই সংশোধন করলেও ট্রাম্প প্রশাসনের পুরো হিসাব ঠিক হয়ে যাবে না। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, দক্ষিণ কোরিয়ার ওপর ২৫ শতাংশ শুল্ক বসানো হয়েছে, অথচ দক্ষিণ কোরিয়া থেকে যুক্তরাষ্ট্রের আমদানির গড় শুল্কহার ১ শতাংশের কম। এ ছাড়া ট্রাম্প প্রশাসনের এই শুল্কনীতি বিভিন্ন দেশের অর্থনৈতিক কাঠামো ও আয়ের স্তরের পার্থক্য বিবেচনায় নেয় না। যেমন বাংলাদেশ বা লেসোথোর মতো দরিদ্র দেশের ওপর ৩৭ শতাংশ বা ৫০ শতাংশ শুল্ক বসানো মোটেই যৌক্তিক নয়। 

তবে শুল্কই সব নয়। দক্ষিণ কোরিয়া যেভাবে তাদের উৎপাদন খাত গড়ে তুলেছিল, তার আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক ছিল সুদের হার কমিয়ে রাখা এবং শিল্প খাতে কম সুদে ঋণ দেওয়া। এর ফলে প্রাইভেট বিনিয়োগগুলো মূলত শিল্প খাতে গেছে, ব্যাংকিং বা অন্যান্য সেবা খাতে নয়, যেগুলো অল্প সময়ে বেশি মুনাফা দেয়।

যুক্তরাষ্ট্রে উৎপাদন খাতে বিনিয়োগকে আরও আকর্ষণীয় করে তোলা সহজ কাজ নয়; বিশেষ করে যখন অর্থ, শিক্ষা ও বিনোদন খাত ইতিমধ্যেই অত্যন্ত লাভজনক এবং বৈশ্বিক প্রতিযোগিতায় শক্ত অবস্থানে রয়েছে। দক্ষিণ কোরিয়ার সরকার বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর সুদের হারের ওপর যথেষ্ট নিয়ন্ত্রণ রেখেছিল এবং কোন খাতে ঋণ দেওয়া হবে, সে বিষয়ে তাদের বিশেষ সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা ছিল। এ ছাড়া কোরিয়া ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক (যা দীর্ঘমেয়াদি মূলধনি বিনিয়োগে ঋণ দেয়) ও কোরিয়া এক্সপোর্ট-ইমপোর্ট ব্যাংক (সরকারি রপ্তানি ঋণ সংস্থা) থেকেও উৎপাদন খাতে সহায়তা দেওয়া হতো। 

ট্রাম্প প্রশাসন যদি সত্যিই উৎপাদন সক্ষমতা পুনর্গঠনে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয়, তাহলে তাদের নির্দিষ্ট কিছু খাতকে কেন্দ্র করে নীতি গ্রহণ করতে হবে, যাতে উৎপাদনের মূল উপাদানগুলোর খরচ কমানো যায় এবং প্রয়োজনে সরাসরি সরকারি বিনিয়োগও করতে হতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রের আবার পোশাক বা জুতা তৈরি শুরু করা উচিত হবে না; বরং তাদের জ্ঞানভিত্তিক খাতে (যেগুলো অর্থনৈতিক ও নিরাপত্তাগত দিক থেকে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ) মনোযোগ দেওয়া উচিত।

কিন্তু যদি ট্রাম্প প্রশাসন এখনকার মতো নীতি চালিয়ে যায়, তাহলে তারা শুধু ব্যর্থই হবে না, তারা আন্তর্জাতিক বাণিজ্য অংশীদারদের বিরূপ করবে, যুক্তরাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক বিশ্বাসযোগ্যতা ধ্বংস করবে এবং বৈশ্বিক স্থিতিশীলতাও ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এর সবচেয়ে বড় উপকারভোগী হবে চীন।  

কেউন লি দক্ষিণ কোরিয়ার প্রেসিডেন্টের ন্যাশনাল ইকোনমিক অ্যাডভাইজরি কাউন্সিলের সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান


স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট, অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: শ ল ক আর সরক র র ওপর

এছাড়াও পড়ুন:

শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস আজ

‘উদয়ের পথে শুনি কার বাণী/ ভয় নাই ওরে ভয় নাই/ নিঃশেষে প্রাণ যে করিবে দান/ ক্ষয় নাই তার ক্ষয় নাই’। তাঁদের নিঃশেষে প্রাণদানের স্মৃতি আজ গভীর বেদনায় স্মরণ করবে জাতি। আজ থেকে ৫৪ বছর আগে দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তান বুদ্ধিজীবীরা হানাদার পাকিস্তান সেনাবাহিনীর নীলনকশার শিকার হয়ে নির্মম হত্যার শিকার হয়েছিলেন।

অমিত বিক্রম বাঙালির জীবনপণ যুদ্ধে হানাদার পাকিস্তানি বাহিনীর চূড়ান্ত পরাজয় তখন ছিল কেবল দিনগণনার বিষয়। সেই অনিবার্য পরাজয়ের প্রাক্কালে মরণকামড় দেওয়ার চেষ্টা করেছিল ঘাতক বাহিনী। স্বাধীনতা অর্জন করলেও বাঙালি জাতি যেন মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে না পারে, সেই চক্রান্ত করেছিল তারা। দেশের সেরা বুদ্ধিজীবীদের তালিকা করে তাঁদের বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে গিয়ে নির্মম নির্যাতন করে হত্যা করা হয়েছিল। এ কাজে পাকিস্তানি সেনাদের সরাসরি সহায়তা করেছিল তাদের মিত্র এ দেশি রাজাকার, আলবদর বাহিনী। এরাই ঘাতক সেনাদের নিয়ে গিয়ে চিনিয়ে দিয়েছে বুদ্ধিজীবীদের বাড়ি। চিনিয়ে দিয়েছে সেই নিরীহ মানুষগুলোকে।

মহান মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ে পরে মিরপুরে রায়েরবাজার পরিত্যক্ত ইটখোলা ও মিরপুরে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে যাওয়া সেসব বুদ্ধিবৃত্তিক পেশায় যুক্ত মানুষের মরদেহগুলো উদ্ধার করা হয়। তাঁদের অনেকের ছিল পিছমোড়া করে হাত ও চোখ বাঁধা। ভয়ানক নির্যাতনের চিহ্ন ছিল শরীরে। তাঁদের মরদেহ উদ্ধার হওয়ার মধ্য দিয়ে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বুদ্ধিজীবী হত্যার গভীর ষড়যন্ত্র প্রকাশ হয়ে পড়ে। এর পর থেকেই শহীদ বুদ্ধিজীবীদের প্রতি শ্রদ্ধা ও শোক প্রকাশ করে ১৪ ডিসেম্বর শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস পালিত হয়ে আসছে।

শুধু ঢাকাতেই নয়, সারা দেশেই বুদ্ধিবৃত্তিক কাজে যুক্ত মানুষদের হত্যা করেছিল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী। এই হত্যাকাণ্ডের ছিল দুটি পর্যায়। ‘অপারেশন সার্চলাইট’ নামে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে হানাদার সেনারা রাজধানীতে গণহত্যা শুরু করেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও আশপাশের এলাকায় সাধারণ নিরীহ জনসাধারণের পাশাপাশি শিক্ষক, চিকিৎসকদেরও হত্যা করে। এরপর থেকে হানাদাররা সারা দেশের শিক্ষক, চিকিৎসক, প্রকৌশলী, আইনজীবী, শিল্পী, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, গবেষক, সংস্কৃতিসেবীসহ মেধা মনন সৃজনশীল কাজে যুক্ত মানুষদের বেছে বেছে হত্যা করতে থাকে। মুক্তিযুদ্ধে শেষ পর্যায় তারা এই বুদ্ধিবৃত্তিক মানুষদের নিঃশেষ করে দেওয়ার জন্য তালিকা করে হত্যা চালাতে থাকে। তাঁদের মধ্যে যেমন প্রবীণ প্রাজ্ঞজনেরা ছিলেন, তেমনি ছিলেন উদিত যৌবনের বহু সম্ভাবনাময় তরতাজা প্রাণ। আজ তাঁদের স্মৃতির স্মরণ করা হবে সারা দেশে।

শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন ও প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস পৃথক বাণী দিয়েছেন।

কর্মসূচি

শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস পালন উপলক্ষে অনুষ্ঠিত আন্তমন্ত্রণালয়ের সভায় জানানো হয়েছে, আজ রোববার সকাল ৭টা ৫ মিনিটে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন এবং ৭টা ৬ মিনিটে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস মিরপুর শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধে পুষ্পস্তবক অর্পণ করবেন। তাঁরা জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানিয়ে সেখানে নীরবে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকবেন। এ সময় বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর একটি চৌকস দল রাষ্ট্রপতি ও প্রধান উপদেষ্টাকে রাষ্ট্রীয় স্যালুট প্রদান করবে।

রাষ্ট্রপতি ও প্রধান উপদেষ্টার পুষ্পস্তবক অর্পণের পর মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক উপদেষ্টা ফারুক-ই-আজম, মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয়ের সচিব ইসরাত চৌধুরী, শহীদ বুদ্ধিজীবী পরিবারের সদস্য এবং হুইলচেয়ারধারী যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধারা মিরপুর শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধে পুষ্পস্তবক অর্পণ করবেন।

সম্পর্কিত নিবন্ধ