সিলেটের কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার ভোলাগঞ্জ পাথর কোয়ারি, শাহ আরেফিন টিলা ও বাংকার এলাকার পাথর লুটপাটের পর এবার ‘পাথরখেকো’দের নজর পড়েছে দেশের সুপরিচিত পর্যটনকেন্দ্র সাদা পাথর এলাকায়। গত ২৩ এপ্রিল থেকে চক্রটি সাদা পাথর এলাকায় পাথর লুট শুরু করেছে। ভোলাগঞ্জ পাথর কোয়ারি ও শাহ আরেফিন টিলা এলাকা এরই মধ্যে প্রায় পাথরশূন্য করে ফেলা হয়েছে। তবে পার্শ্ববর্তী বাংকার এলাকায় দেদার পাথর উত্তোলন চলছে।
বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তবর্তী ভোলাগঞ্জ সীমান্তের শূন্যরেখার কাছে সাদা পাথর পর্যটনকেন্দ্রের অবস্থান। প্রায় ১৫ একর এলাকাজুড়ে এ পর্যটনকেন্দ্র। ছোট-বড় অসংখ্য পাথরের ওপর দিয়ে প্রবাহিত জলের স্রোতোধারা এই পর্যটনকেন্দ্রের মূল আকর্ষণ। এই সৌন্দর্যের টানে প্রতিদিন দেশ-বিদেশের হাজারো পর্যটক ভিড় জমান।
বাংকার এলাকাটি দেশের সবচেয়ে বড় পাথর কোয়ারি ভোলাগঞ্জের পাশে অবস্থিত। বাংলাদেশ রেলওয়ের একমাত্র রজ্জুপথটি (রোপওয়ে) এখানে অবস্থিত। রোপওয়ে এলাকাটিই মূলত সংরক্ষিত বাংকার হিসেবে পরিচিত। ১৯৬৪ সালে ভোলাগঞ্জ থেকে সুনামগঞ্জের ছাতকে পাথর পরিবহনে স্থল কিংবা জলযানের বিকল্প হিসেবে ১১৯টি খুঁটির মাধ্যমে তৈরি হয় রোপলাইন। ভোলাগঞ্জের রোপওয়ে এলাকাটি ৫৯ একর জায়গাজুড়ে অবস্থিত। এখানে টিলার মতো সামান্য উঁচু ভূমি আর সমতল স্থানের নিচে আছে ছোট-বড় অসংখ্য পাথর।
পাথর উত্তোলন বন্ধে প্রশাসন নিয়মিত অভিযান চালাচ্ছে। ভ্রাম্যমাণ আদালত বসিয়ে দোষীদের কারাদণ্ডও দেওয়া হচ্ছে। পরিবেশ ও প্রতিবেশ রক্ষায় প্রয়োজনে তাঁরা আরও কঠোরতা দেখাবেন।সিলেটের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ শের মাহবুব মুরাদএই দুই এলাকায় পাথর লুটের বিষয়ে জানতে চাইলে সিলেটের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ শের মাহবুব মুরাদ বিষয়টি অবগত বলে স্বীকার করেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, পাথর উত্তোলন বন্ধে প্রশাসন নিয়মিত অভিযান চালাচ্ছে। ভ্রাম্যমাণ আদালত বসিয়ে দোষীদের কারাদণ্ডও দেওয়া হচ্ছে। পরিবেশ ও প্রতিবেশ রক্ষায় প্রয়োজনে তাঁরা আরও কঠোরতা দেখাবেন।
প্রকৃতি ও পরিবেশের সুরক্ষায় দেশের ৫১টি পাথর কোয়ারির মধ্যে ১৭টি কোয়ারির ইজারা স্থগিত রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। গত ২৭ এপ্রিল বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে সারা দেশের গেজেটভুক্ত পাথর, সিলিকা, বালু, নুড়িপাথর, সাদা মাটির কোয়ারিগুলোর ব্যবস্থাপনা-সংক্রান্ত সভায় এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
ইজারা স্থগিত রাখা কোয়ারির অধিকাংশই সিলেটে অবস্থিত। এর মধ্যে ভোলাগঞ্জ পাথর কোয়ারিও রয়েছে। কোয়ারিটির ঠিক পাশেই সংরক্ষিত বাংকার ও সাদা পাথর এলাকা অবস্থিত। তবে এ দুটি এলাকা কোয়ারিভুক্ত না হলেও এখানে প্রচুর পরিমাণে ছোট-বড় পাথর রয়েছে। মূলত এসব পাথরই অবৈধভাবে উত্তোলন করা হচ্ছে।
নৌকা যাঁর, পাথর তাঁর২৭ এপ্রিল বেলা সাড়ে ৩টা থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত সাদা পাথর ও বাংকার এলাকায় সরেজমিনে দেখা গেছে, শ্রমিকেরা বেলচা, কোদাল ও শাবল ব্যবহার করে পাথর উত্তোলন করে অন্তত শতাধিক বারকি নৌকায় বোঝাই করেছেন। পরে সেসব পাথর বিক্রির জন্য ধলাই নদ দিয়ে ভোলাগঞ্জ ১০ নম্বর সাইট এলাকায় নিয়ে যাচ্ছেন।
বিকেল পৌনে ৫টার দিকে সাদা পাথর এলাকার পৃথক দুটি অংশে ২১ ব্যক্তিকে পানি থেকে হাতড়ে পাথর তুলে ১৭টি নৌকায় বোঝাই করতে দেখা গেল। আবার দুজন ব্যক্তিকে সাদা পাথরমুখী রাস্তায় ধলাই নদের পাড় খুঁড়ে পাথর তুলতে দেখা গেল।
বিকেল সাড়ে পাঁচটার দিকে পার্শ্ববর্তী বাংকার এলাকায় অন্তত শতাধিক শ্রমিককে বেলচা, কোদাল ও শাবল দিয়ে মাটি খুঁড়ে পাথর তুলতে দেখা যায়। সেখানে খোঁড়াখুঁড়ির কারণে শত শত গভীর গর্ত তৈরি হয়েছে। ঝুঁকিপূর্ণ এসব গর্ত থেকে তোলা পাথর স্তূপাকারে পাড়ে জমা করছেন অনেকে। আবার কেউ কেউ এসব পাথর টুকরিতে ভরে মাথায় নিয়ে কিছু দূর পর্যন্ত হেঁটে নৌকায় রাখছেন।
পরদিন ২৮ এপ্রিল বেলা সাড়ে ১১টার দিকে সরেজমিনে দেখা যায়, প্রবল বৃষ্টির মধ্যেও বাংকার এলাকায় কিছু শ্রমিক পাথর উত্তোলন করে নৌকায় এনে রাখছিলেন। পাথরভর্তি চারটি নৌকাকে এ সময় বাংকার এলাকা থেকে ধলাই নদ দিয়ে ১০ নম্বর সাইট এলাকায় আসতে দেখা যায়।
কোয়ারিটির ঠিক পাশেই সংরক্ষিত বাংকার ও সাদা পাথর এলাকা অবস্থিত। তবে এ দুটি এলাকা কোয়ারিভুক্ত না হলেও এখানে প্রচুর পরিমাণে ছোট-বড় পাথর রয়েছে। মূলত এসব পাথরই অবৈধভাবে উত্তোলন করা হচ্ছে।বাংকার এলাকায় কর্মরত দুজন শ্রমিক জানান, ২৬ এপ্রিল ভ্রাম্যমাণ আদালত অভিযান চালিয়ে পাথর উত্তোলনে জড়িত ৯ ব্যক্তিকে ২ বছর করে কারাদণ্ড দিয়েছেন। এতে অনেকে ভয় পেয়েছেন। অন্য দিন হাজারো শ্রমিক বাংকার এলাকায় পাথর উত্তোলন করতে এলেও ২৭ এপ্রিল থেকে তুলনামূলকভাবে কম শ্রমিকই আসছেন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে বারকি নৌকার এক মালিক বলেন, যেহেতু ধলাই নদ পেরিয়ে পাথর নিয়ে আসতে হয়, তাই পরিবহনে এখানে কয়েক হাজার বারকি নৌকা আছে। মূলত শ্রমিকেরা পাথর তুলে এসব নৌকার মালিকদের কাছে বিক্রি করেন। পরে নৌকার মালিকেরা এসব পাথর ১০ নম্বর সাইট এলাকায় ক্রাশার মেশিন (পাথর ভাঙার কল) মালিকদের কাছে বিক্রি করেন। আবার অনেক নৌকামালিকের সরাসরি তত্ত্বাবধানেও পাথর উত্তোলন করেন শ্রমিকেরা। মূলত যাঁর নৌকা আছে, তাঁরা পাথর পরিবহনে সুবিধা ও মুনাফা বেশি পান। এককথায় নৌকা যাঁর, পাথরও তাঁর।
বিকেল পৌনে ৫টার দিকে সাদা পাথর এলাকার পৃথক দুটি অংশে ২১ ব্যক্তিকে পানি থেকে হাতড়ে পাথর তুলে ১৭টি নৌকায় বোঝাই করতে দেখা গেল। আবার দুজন ব্যক্তিকে সাদা পাথরমুখী রাস্তায় ধলাই নদের পাড় খুঁড়ে পাথর তুলতে দেখা গেল।শ্রমিকেরা জানান, দিনের চেয়ে রাতের বেলায় প্রশাসনের নজরদারির কোনো ভয় থাকে না। তাই ওই সময় পাথর উত্তোলন বেশি হয়। কয়েক হাজার শ্রমিক বাংকার এলাকায় প্রতিদিন পাথর উত্তোলন করেন। তবে অভিযানের কারণে পরিস্থিতির অনেকটা বদল হয়েছে। একেকজন শ্রমিক পাথর উত্তোলন করে তিন থেকে চার হাজার টাকা আয় করেন বলে জানান।
স্থানীয় পাথর ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, বারকি নৌকাভর্তি ‘বোল্ডার’ (বড় পাথর) ৫ হাজার টাকা, ‘ভুতু’ (মাঝারি) ৪ হাজার থেকে সাড়ে ৪ হাজার টাকা এবং ‘সিঙ্গেল’ (ছোট পাথর) ৩ হাজার থেকে সাড়ে ৩ হাজার টাকায় শ্রমিকেরা বিক্রি করেন।
সংরক্ষিত রোপওয়ে এলাকা থেকে পাথর উত্তোলন করে নেওয়া হচ্ছে। সিলেটের কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার ভোলাগঞ্জে.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ক র এল ক য় এল ক য় প অবস থ ত ছ ট বড়
এছাড়াও পড়ুন:
শেখ হাসিনার ফাঁসির রায় এবং তাঁর রাজনৈতিক মৃত্যু
জাতি হিসেবে এটা আমাদের জন্য ভীষণ দুর্ভাগ্যের এবং কলঙ্কের—সাম্প্রতিক সময়ের ইতিহাসে এই রাষ্ট্রের মাটিতে মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটিত হয়েছে। আবার আমাদের জন্য এটা ভীষণ গৌরবেরও—একটা সত্যিকার গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে আমরা সেই অপরাধকারীদের পতন ঘটিয়ে দেশ ছাড়তে বাধ্য করতে পেরেছি।
অপরাধকারীদের পতনের পর জাতি হিসেবে আমাদের ওপরে সেই অপরাধের ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার দায়িত্ব ন্যস্ত হয়েছে। প্রতিটি ন্যায়বিচার ভবিষ্যতে একই ধরনের অপরাধের ক্ষেত্রে নিবৃত্তকারী হিসেবে কাজ করে। শেখ হাসিনার অপরাধ এবং বিচার যেহেতু আন্তর্জাতিক মনোযোগ পেয়েছে, তাই একই ধরনের অপরাধ নিবৃত্তকারী হিসেবে এটার আন্তর্জাতিক প্রভাবও আছে।
শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে যে অভিযোগ ছিল, সেগুলো নেহাত হত্যা কিংবা নির্যাতন না, এগুলো মানবতাবিরোধী অপরাধ। শুধু জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের সময়ই না, তার শাসনামলের পুরোটা সময় গুম, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের মতো অপরাধ সংঘটিত হয়েছে নিয়মিতভাবেই। এর বাইরেও বিএনপি নেতা-কর্মীদের ওপরে এবং একটা সময় পর্যন্ত জামায়াতে ইসলামীর কর্মীদের ওপরেও পরিকল্পিতভাবে হেফাজতে নির্যাতন, গায়েবি মামলাসহ নানা রকম নিপীড়নও মানবতাবিরোধী অপরাধের আওতায় পড়বে।
আরও পড়ুনদ্য উইকে শেখ হাসিনার নিবন্ধ, অস্বীকারের রাজনীতি ও অসত্য চর্চার নমুনা১৪ নভেম্বর ২০২৫শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলার প্রথম মামলাটির রায়ে প্রত্যাশিতভাবেই পাঁচটি অভিযোগের মধ্যে তিনটির জন্য তিনি সর্বোচ্চ শাস্তি, মৃত্যুদণ্ড পেয়েছেন। বাকি দুটির জন্য পেয়েছেন আমৃত্যু কারাদণ্ড।
শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে গণ-অভ্যুত্থান এক অভাবনীয় উদাহরণ হয়ে থাকবে পৃথিবীর ইতিহাসে। কোনো রকম মারণাস্ত্র ছাড়া রাষ্ট্রীয় বাহিনীর বিরুদ্ধে শুধু নৈতিক শক্তিকে পুঁজি করে নেমে যাওয়া মানুষের ওপরে অকল্পনীয় বর্বরতা চালানো হয়েছে। সেই বিক্ষোভ দমনে শেখ হাসিনা ঠান্ডা মাথায় মারণাস্ত্র ব্যবহার করতে নির্দেশ দিচ্ছেন এমন ফোন রেকর্ড আছে।
আল-জাজিরা এবং বিবিসির মতো প্রতিষ্ঠান তাদের ডকুমেন্টারিতে সেই অডিও ব্যবহার করার জন্য নিজেরা ফরেনসিক টেস্ট করে নিশ্চিত হয়েছে সেটা তাঁরই কল রেকর্ড; কোনো প্রযুক্তির সহায়তায় তৈরি করা নয়।
শেখ হাসিনার প্রতিষ্ঠিত মাফিয়াতন্ত্রের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে যাঁরা কোনো না কোনোভাবে যুক্ত ছিলেন, বিশেষ করে নিহত ব্যক্তিদের স্বজন, অন্ধ-বিকলাঙ্গ মানুষ, আহত ব্যক্তিদের নিশ্চয়ই বেশি নজর ছিল এই বিচারের প্রতি।
আরও পড়ুনশেখ হাসিনা কি তাহলে পুলিশের ওপরই সব দায় চাপিয়ে দিলেন০৬ নভেম্বর ২০২৫তবে আমরা স্মরণ করব, এই অভ্যুত্থানে শুধু নয়, আওয়ামী শাসনের দীর্ঘ ১৫ বছর (বিশেষ করে অবৈধভাবে ক্ষমতায় থাকার সাড়ে দশ বছর) বিরুদ্ধাচরণ করে নিপীড়নের শিকার অসংখ্য রাজনৈতিক নেতা-কর্মী ও অরাজনৈতিক ব্যক্তি এবং লুণ্ঠিত গণতন্ত্রের দেশে মানবাধিকার ও নাগরিক অধিকার বঞ্চিত হয়ে রীতিমতো প্রজায় পরিণত হওয়া কোটি কোটি মানুষেরও এই রায়ের প্রতি নজর ছিল। এই রায় নিশ্চয়ই ন্যায়বিচার নিশ্চিত করেছে। তবে প্রশ্ন আসতেই পারে, এই রায় কি শেষ পর্যন্ত প্রতীকী বিষয়ে পরিণত হবে?
শেখ হাসিনার জীবদ্দশায় তাঁকে দেশে এনে রায় কার্যকর করা যাবে, এই সম্ভাবনা এখনো দেখা যাচ্ছে না। ভারত সরকার যেভাবে তাঁর আশ্রয় ও নিরাপত্তা বিধান করছে তাতে এটা প্রায় নিশ্চিত যে ভারত শেখ হাসিনাকে ফেরত দেবে না। ভারতের মানসিকতার প্রমাণ পেতে পারি স্বয়ং প্রধান উপদেষ্টাসহ বাংলাদেশ বারবার আপত্তি জানানোর পরও ভারত শেখ হাসিনাকে ক্রমাগত বাংলাদেশের বিরুদ্ধে উসকানিমূলক কথা বলায় বাধা দিচ্ছে না। এমনকি রায় ঘোষণার আগের দিনও তিনি তাঁর বক্তব্যে গণ-অভ্যুত্থানের শক্তিগুলোর বিরুদ্ধে মারাত্মক সব হুমকি দিয়েছেন।
বাংলাদেশ সরকারের উচিত হবে সরাসরি ভারত সরকারের ওপর শেখ হাসিনাকে হস্তান্তরের জন্য চাপ তৈরি করা। ভারত সরকারকে ভাবতে হবে, তারা যদি শেখ হাসিনার সময়ের মতো শুধু একজন ব্যক্তি বা একটি দলের সঙ্গে সম্পর্ক না করে একটি টেকসই দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক তৈরির জন্য বাংলাদেশের জনগণের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি করতে চায়, তাহলে শেখ হাসিনার ব্যাপারে তাদের সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা করতে হবে।মৃত্যুদণ্ডবিরোধী অবস্থানের কারণে জাতিসংঘ এবং আন্তর্জাতিক সংস্থার মাধ্যমে শেখ হাসিনাকে ফেরানোর জন্য ভারতের ওপর চাপ তৈরি করা প্রায় অসম্ভব হবে। তবে বাংলাদেশ সরকারের উচিত হবে সরাসরি ভারত সরকারের ওপর শেখ হাসিনাকে হস্তান্তরের জন্য চাপ তৈরি করা। ভারত সরকারকে ভাবতে হবে, তারা যদি শেখ হাসিনার সময়ের মতো শুধু একজন ব্যক্তি বা একটি দলের সঙ্গে সম্পর্ক না করে একটি টেকসই দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক তৈরির জন্য বাংলাদেশের জনগণের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি করতে চায়, তাহলে শেখ হাসিনার ব্যাপারে তাদের সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা করতে হবে।
শেখ হাসিনার বিচার নিয়ে আন্তর্জাতিক মহলে কিছু প্রশ্ন তৈরি হতেই পারে। জাতিসংঘসহ পশ্চিমা বিশ্ব মৃত্যুদণ্ডের বিরুদ্ধে। এটা ছাড়াও মানবতাবিরোধী অপরাধের মতো কোনো অপরাধে কারও অনুপস্থিতিতে বিচার আন্তর্জাতিক মানদণ্ডের বরখেলাপ হিসেবেই দেখা হয়। রোম স্ট্যাটিউটেও কোনো অভিযুক্তের বিরুদ্ধে বিশেষ পরিস্থিতিতে অভিযোগ নিশ্চিতকরণের শুনানি কারও অনুপস্থিতিতে হতে পারে, কিন্তু মূল বিচার এবং শুনানি অভিযুক্তের অনুপস্থিতিতে হওয়ার কোনো সুযোগ নেই।
আরও পড়ুনআওয়ামী লীগের লকডাউন, অগ্নিসন্ত্রাস ও ‘রাজনৈতিক মৃত্যু’১৫ নভেম্বর ২০২৫আমরা আশা করতে পারি, সরকার, বিশেষ করে প্রধান উপদেষ্টা তাঁর আন্তর্জাতিক অবস্থানকে ব্যবহার করে এসব চাপ সামাল দিতে পারবেন। জাতিসংঘের মানবাধিকার হাইকমিশনকে দিয়ে একটি পূর্ণাঙ্গ তদন্ত করানো শেখ হাসিনার বিচারের ক্ষেত্রে অন্তর্বর্তী সরকারের একটা অসাধারণ সিদ্ধান্ত হিসেবে বিবেচিত হবে।
সেই তদন্তের রিপোর্টে সংস্থাটি জানিয়েছিল, জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের সময় বাংলাদেশে উচ্চমাত্রায় মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটিত হয়েছিল। এসব অপরাধের সিদ্ধান্ত, নেতৃত্ব, পরিচালনা এবং সমন্বয়ের ক্ষেত্রে শেখ হাসিনাই ছিলেন প্রধান ব্যক্তি।
সময়ই বলবে শেখ হাসিনাকে এনে রায় কার্যকর করা যাবে কি না, তবে সেটা করা না গেলেও এই রায়ের মাধ্যমে এটা নিশ্চিত হলো শেখ হাসিনার রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ এখানেই শেষ হচ্ছে। দল হিসেবে আন্তর্জাতিক আদালতে আওয়ামী লীগের বিচার হওয়ার কথা আলোচনায় আছে। আলোচনার সুবিধার জন্য যদি এটা ধরেও নিই যে, সেই বিচারে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে সংগঠন হিসেবে মানবতাবিরোধী অপরাধের প্রমাণ না পেয়ে দলটিকে নিষিদ্ধ করা হলো না।
আরও পড়ুনআইসিসিতে আওয়ামী লীগের অভিযোগ কতটা যৌক্তিক১৩ নভেম্বর ২০২৫তারপরও এটা বলতেই হচ্ছে যে, বয়স শেখ হাসিনার পক্ষে নেই। আর এই রায়ের পর সেই প্রেক্ষাপট তৈরি হলেও বাংলাদেশে ফিরে এসে শেখ হাসিনার পক্ষে দলের নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করা এবং নেতৃত্ব দেওয়া একেবারেই অসম্ভব হবে বলে মনে হয়। কিছু অডিও বক্তব্যের মাধ্যমে (তাঁর পরাজিত চেহারা দেখাবেন না বলে তিনি ভিডিও বার্তায় আসবেন না সম্ভবত) তিনি হয়তো উসকানি দিয়ে যেতে পারবেন, যা আদতে তাঁর দলের প্রতি নেতিবাচক প্রভাবই ফেলবে।
শেখ হাসিনা এবং তাঁর ক্ষমতার কেন্দ্রে থাকা মানুষদের অনেকটা চেনা আছে বলেই এটা অপ্রত্যাশিত নয় যে তিনিসহ সেই সময়ে মানবতাবিরোধী অপরাধের সঙ্গে জড়িতরা কোনোভাবে তাঁদের দায় স্বীকারের আশপাশেও যাবেন না। কিন্তু দলটির সমর্থকদের একটা বড় অংশ এখনো শেখ হাসিনা এবং তাঁর সহযোগীদের অপরাধের মাত্রা এবং ব্যাপ্তি অনুধাবন করছেন না; এটা হতাশার। এই রায় সাধারণ সমর্থকদের মনে কিছু ভিন্ন চিন্তার উদ্রেক করবে বলে আশা করতে চাই আমরা।
আরও পড়ুনশেখ হাসিনার স্বৈরাচারী শাসনের রাজনৈতিক মনস্তত্ত্ব২০ সেপ্টেম্বর ২০২৫মানুষ রাষ্ট্র তৈরি করেছিল এমন একটা ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে, যার মাধ্যমে সব মানুষ কিছু নিয়মনীতির মধ্যে বসবাস করবে এবং এর ব্যত্যয় হলে ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার মাধ্যমে রাষ্ট্র ও সমাজে নজির স্থাপিত হবে। কোনো রাষ্ট্র যদি ন্যায়বিচার করতে ব্যর্থ হয়, বিশেষ করে মানবতাবিরোধী অপরাধের মতো ক্ষেত্রে, সেটা সেই রাষ্ট্রের আর যেকোনো বিচার করার অধিকারকেই প্রশ্নবিদ্ধ করে। আমরা স্মরণ রাখব মার্টিন লুথার কিং এর বিখ্যাত উক্তি—‘যেকোনো অবিচারই সব ক্ষেত্রে ন্যায়বিচারের জন্য হুমকি।’
জাহেদ উর রহমান শিক্ষক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক
*মতামত লেখকের নিজস্ব