পাকিস্তান কি ভারতের সঙ্গে আরেকটা সংঘাত সামলাতে সক্ষম?
Published: 10th, May 2025 GMT
ভারত মিসাইল হামলা চালিয়েছে পাকিস্তানের ওপর। পারমাণবিক অস্ত্রের অধিকারী প্রতিবেশী পাকিস্তানের সঙ্গে তা নিয়ে উত্তেজনা আরও বেড়েছে। এখন দুই দেশের নিজেদের সীমানা নিয়ে উদ্বেগ স্বাভাবিকভাবেই বাড়বে। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফ ভারতের আক্রমণকে সরাসরি ‘যুদ্ধ’ হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন। সেই সূত্র ধরে পাকিস্তান প্রতিশোধ নেওয়ারও ঘোষণা দিয়েছে। (ইতিমধ্যে পাকিস্তানও পাল্টা হামলা চালিয়েছে।)
এই সংঘাতের নতুন করে সূত্রপাত ঘটে গত এপ্রিলে ভারতের কাশ্মীরে সন্ত্রাসী হামলার মধ্য দিয়ে। ২৬ জন সাধারণ ভারতীয় পর্যটক নিহত হওয়ার পর, আন্তর্জাতিকভাবেও প্রতিক্রিয়া হয়। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প একে ‘হতাশাজনক’ বলে আখ্যায়িত করে সমস্যার দ্রুত সমাধান আশা করেন।
পাকিস্তানের জন্য আরেকটি দীর্ঘমেয়াদি সংঘাতের অর্থনৈতিক অভিঘাত সামলানো কঠিন হবে। ভারতের তুলনায় সেই আঘাত হবে অনেক বেশি। সেই সংঘাত যত দীর্ঘ হবে, পাকিস্তানের জন্য তা হবে তত বেশি ভয়াবহ। বিনিয়োগ বিষয়ে আগাম অবস্থা জানানোর জন্য মুডিস ইনভেস্টরস সার্ভিস নামে একটি প্রতিষ্ঠান আছে। তারা এ বিষয়ে ৫ মে জানিয়েছে যে ভারতের সঙ্গে উত্তেজনা পাকিস্তানের প্রবৃদ্ধির ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলার সম্ভাবনা আছে। এতে পাকিস্তানের রাজস্ব কমবে। সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতা নষ্ট হবে। আইএমএফের কাছ থেকে ৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার পেয়ে পাকিস্তানের অর্থনীতি কিছুটা সামলে আসার সম্ভাবনা ছিল। ভারতের সঙ্গে সংঘাত সেই সুযোগ লন্ডভন্ড করে দিতে পারে।
ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যায় যে এ ধরনের সংঘাত পাকিস্তানকে অস্থিতিশীল করে দেয়। আফগানিস্তান যুদ্ধ পাকিস্তানের ওপর মারাত্মক প্রভাব ফেলেছিল। দেশে দেখা দিয়েছিল সাম্প্রদায়িক সহিংসতা। অস্ত্র আর মাদক চোরাচালান সেই যে বেড়েছে, তা আজও সামলানো যায়নি। সন্ত্রাসীগোষ্ঠীগুলো এখনো খোদ পাকিস্তান রাষ্ট্রের কর্তৃত্বকে চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছে।
বর্তমানে পাকিস্তানের অর্থনীতি অত্যন্ত নাজুক অবস্থায় রয়েছে। ২০২৪ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত তাদের বৈদেশিক ঋণ ১৩১ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে গেছে। অথচ বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ মাত্র ১০ বিলিয়ন ডলার, যা দিয়ে তিন মাসের আমদানি খরচই ঠিকমতো মেটানো যাবে না। এ অবস্থায় যুদ্ধ বা সামরিক উত্তেজনা বাড়লে বিদেশি বাজার থেকে ঋণ পাওয়া কঠিন হয়ে যাবে। ফলে ঋণ পরিশোধ আরও জটিল হয়ে উঠবে, আর রিজার্ভেও চাপ পড়বে। এমনকি আইএমএফের পুনরুদ্ধার কর্মসূচিও বাধাগ্রস্ত হতে পারে।
অবশ্য পাকিস্তানের এই দুর্বলতা আজকের নয়। ২০২১ সালে সেই সময়ের সেনাপ্রধান কামার বাজওয়া সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন যে তাঁদের ট্যাংক চালানোর মতো ডিজেল পর্যন্ত নেই। সামরিক যানবাহন বা অস্ত্র সচল রাখার জন্য রক্ষণাবেক্ষণ করার টাকাও নেই তহবিলে। সেই দুর্বলতা আজও কাটেনি।
ভারতের অবস্থা একেবারে ভিন্ন। ২০২৪ সালে পাকিস্তানের সঙ্গে ভারতের রপ্তানি ছিল ভারতের মোট রপ্তানির শূন্য দশমিক ৫ শতাংশের কম। অর্থাৎ দুই দেশের মধ্যে বড় ধরনের সামরিক উত্তেজনা হলেও ভারতের অর্থনীতি তেমন প্রভাবিত হবে না।
তবে ভারতের ক্ষেত্রেও কিছু বিষয় গুরুত্বপূর্ণ। প্রতিরক্ষা খাতে ব্যয় বাড়লে বাজেটঘাটতি বাড়তে পারে। তাহলে উন্নয়ন ও সামাজিক খাতে বরাদ্দ কমিয়ে দিতে হবে। এ ছাড়া ভারতের জন্য নিরাপত্তাচাপ কেবল পশ্চিম সীমান্তেই নয়, চীন সীমান্তেও রয়েছে। দুই সীমান্তে একসঙ্গে প্রস্তুত থাকতে হলে অনেক খরচ হয়। তাই ভারতেরও সাবধানতা অবলম্বন করা ছাড়া উপায় নেই।
কিন্তু এই সব চাপ পাকিস্তানের বিপদের সঙ্গে তুলনীয় নয়। পাকিস্তানের জন্য যুদ্ধ মানে কেবল সাময়িক রাজনৈতিক উত্তেজনা নয়, বরং অর্থনৈতিক ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছানো। চীনের কাছে থেকে তারা সম্প্রতি দুই বিলিয়ন ডলার ঋণ নবায়ন করেছে। কিন্তু এর ফলে পাকিস্তান চীনের ওপর আরও বেশি নির্ভরশীল হয়ে পড়বে। আর তা পশ্চিমা মিত্রদের (বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের) সঙ্গে পাকিস্তানের সম্পর্ক জটিল করে তুলতে পারে।
এ ছাড়া পাকিস্তানের কৃষি খাত সামরিক উত্তেজনায় বড় ধাক্কা খেতে পারে। ভারত ১৯৬০ সালের সিন্ধু পানিবণ্টন চুক্তি স্থগিত করেছে। এটা বড় ধরনের অস্থিতিশীলতার সংকেত। অথচ কৃষিই পাকিস্তানের মূল অর্থনৈতিক খাত। এই খাতে তাদের ৪০ শতাংশের মতো মানুষ কাজ করে। ২০২২ সালের ভয়াবহ বন্যার ধাক্কা এখনো সামলে উঠতে পারেনি দেশটি। এ অবস্থায় আরেকটি বড় সংকট এলে দেশের অর্থনীতি ভেঙে পড়বে। সাধারণ মানুষের দুর্ভোগ সীমা ছাড়াবে।
তাই পাকিস্তানের জন্য বড় ধরনের সামরিক সংঘাত এড়িয়ে চলা কেবল কৌশলগত নয়, বরং টিকে থাকার প্রশ্ন।
এই মুহূর্তে আন্তর্জাতিক মহল জরুরি হস্তক্ষেপ না করলে পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে উঠবে। আর তখন শুধু ভারত-পাকিস্তান অঞ্চলে নয়, গোটা দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলে অস্থিরতা ছড়িয়ে পড়বে। দক্ষিণ এশিয়ায় বিশ্বের সবচেয়ে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর বসবাস। এখানে মানুষ প্রতিদিন ৩ দশমিক ৬৫ ডলারের কম আয় করে কোনোমতে টিকে থাকে। যুদ্ধ হলে এই সব দরিদ্র মানুষের জীবন আরও বিপন্ন হবে।
পুরোদস্তুর যুদ্ধ না হলেও সীমিত মাত্রায় সংঘাত হতে পারে। আর তা হচ্ছেও। দুই দেশের মধ্যে এমন সংঘাত নতুন কিছু নয়। এমন ছোটখাটো সংঘর্ষেও বিপুল অর্থনৈতিক ও মানবিক ক্ষতি হতে পারে। আর তা পাকিস্তানের মতো দুর্বল দেশের জন্য কম মারাত্মক হবে না।
ইউসুফ নজর পাকিস্তানি লেখক
ফিন্যান্সিয়াল টাইমস থেকে নেওয়া। ইংরেজি থেকে অনুবাদ।
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: প ক স ত ন র জন য ধরন র র ওপর অবস থ
এছাড়াও পড়ুন:
গোয়েন্দাগিরির অভিযোগে ইউক্রেনে যুক্তরাজ্যের সামরিক প্রশিক্ষক গ্রেপ্তার
রাশিয়ার হয়ে গোয়েন্দাগিরি ও গুপ্তহত্যার পরিকল্পনার অভিযোগে যুক্তরাজ্যের সামরিক প্রশিক্ষককে গ্রেপ্তার করেছে ইউক্রেন কর্তৃপক্ষ।
গ্রেপ্তার ৪০ বছর বয়সী রস ডেভিড কাটমোর নামের ওই ব্যক্তি স্কটল্যান্ডের ডানফার্মলাইন শহরের বাসিন্দা। ইউক্রেন কর্তৃপক্ষের দাবি, রুশ গোয়েন্দা সংস্থা এফএসবি ২০২৪ থেকে ২০২৫ সালের মধ্যে ‘ইউক্রেনের ভূখণ্ডে নিশানাভিত্তিক হত্যাকাণ্ড চালানোর’ জন্য কাটমোরকে নিয়োগ করেছিল।
কিয়েভ প্রসিকিউটরের দপ্তর জানিয়েছে, ‘২০২৪ সালের মে মাসে কাটমোর ইউক্রেনীয় ইউনিটগুলোর অবস্থানের কো-অর্ডিনেট, প্রশিক্ষণকেন্দ্রের ছবি এবং সামরিক সদস্যদের শনাক্ত করা যায়, এমন তথ্য পাচার করেছিলেন।’
প্রসিকিউটর দপ্তর আরও জানায়, ‘কাটমোরের যোগাযোগের বিশদ বিশ্লেষণ করে নিশ্চিত হওয়া গেছে, তিনি রুশ বিশেষ গোয়েন্দা সংস্থার স্বার্থে অন্যান্য কাজও করেছিলেন।’
কাটমোর এর আগে ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর হয়ে মধ্যপ্রাচ্যে দায়িত্ব পালন করেন। গত বছরের শুরুতে তিনি ইউক্রেনের সেনাবাহিনী ও পরে সীমান্তরক্ষী বাহিনীকে প্রশিক্ষণে সহায়তা দিতে ওই দেশে যান।
যুক্তরাজ্যের গণমাধ্যম ‘দ্য টাইমস’ বলছে, ইউক্রেন কর্তৃপক্ষের তদন্তে কাটমোরই প্রধান সন্দেহভাজন। তাদের দাবি, দক্ষিণ ইউক্রেনের ওডেসায় রুশ গোয়েন্দা কর্মকর্তারা তাঁকে নিয়োগ দেন। ইউক্রেনের সামরিক ইউনিটের অবস্থান–সংক্রান্ত গোপন তথ্য সরবরাহের জন্য তাঁকে ছয় হাজার ডলার দেওয়ার কথা ছিল। দোষী সাব্যস্ত হলে কাটমোরের সর্বোচ্চ ১২ বছরের কারাদণ্ড হতে পারে।
কাটমোর বিভিন্ন রুশপন্থী সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম গ্রুপে ‘সেবা দেওয়ার প্রস্তাব’ দিয়ে পোস্ট করার পর এফএসবি কর্মকর্তারা তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করেন। ইউক্রেনের অভ্যন্তরীণ গোয়েন্দা সংস্থার দাবি, কাটমোরকে বিস্ফোরক তৈরির নির্দেশনা পাঠানো হয় এবং তাঁকে একটি গোপন স্থানও দেওয়া হয়, যেখান থেকে তিনি একটি পিস্তল সংগ্রহ করেন।
ইউক্রেনের গণমাধ্যম বলছে, ইউক্রেনীয় কর্মী দেমিয়ান হানুল, ইরিনা ফারিওন এবং পার্লামেন্ট সদস্য আন্দ্রি পারুবিইকে হত্যার জন্য অস্ত্র সরবরাহ করার সন্দেহভাজন ব্যক্তির তালিকায় রয়েছেন কাটমোর। এই তিনজনই আততায়ীর হাতে নিহত হয়েছেন।
২০২২ সালে রাশিয়ার পূর্ণমাত্রার আগ্রাসন শুরুর পর থেকে হাজারো মানুষ ইউক্রেনের সশস্ত্র বাহিনীতে যোগ দিয়েছেন। দেশটির প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির আহ্বানে সাড়া দিয়ে অভিজ্ঞ বিদেশি সেনারাও দেশটিকে সাহায্য করতে এগিয়ে এসেছেন।
যুক্তরাজ্যের পররাষ্ট্র দপ্তরের এক মুখপাত্র এ বিষয়ে বলেছেন, ‘ইউক্রেনে আটক যুক্তরাজ্যের এক নাগরিককে আমরা কনস্যুলার সহায়তা দিচ্ছি। আমরা ইউক্রেনীয় কর্তৃপক্ষের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রাখছি।’