অন্তর্বর্তী সরকারের ব্যর্থতা, না দেশের ব্যর্থতা
Published: 25th, May 2025 GMT
একটি বাংলা গানের প্রথম কলি এ রকম, ‘আমার বয়স বাড়ে কিন্তু আমি বাড়ি না’। এককথায়, আমার বয়স হলেও আমি অপরিণত থেকে যাই।
বিখ্যাত স্কটিশ লেখক উইলিয়াম ব্যারি তাঁর উপন্যাসে ‘পিটার প্যান’ নামের একটি চরিত্র সৃষ্টি করেছিলেন। সেই চরিত্র সব সময় শিশুর মতো ব্যবহার করত। তার আশপাশের সবাই পরিপক্ব হলেও সে চিরকাল বালখিল্য ব্যবহার করে মানুষকে আমোদ দিত।
‘পিটার প্যান’ চরিত্রটি পরে ইংরেজি ভাষায় ব্যবহার করা হয় এমন একজন ব্যক্তির বর্ণনা দিতে, যিনি পরিপক্বতাতেও বড় হতে চায় না। মানুষটি চিরকাল অপরিপক্ব থেকে যায়, যে দুই বছরের শিশুর মতো আচরণ করে। এই মানুষগুলো কখনোই শৈশবের অহংকেন্দ্রিক, আত্মকেন্দ্রিক, অপরিণত পর্যায় অতিক্রম করতে পারে না।
আমি এই উপসর্গকে একটি দেশ বা জাতিকে বর্ণনা করার জন্য প্রসারিত করতে পারি, যদি এটি বর্ণনার সঙ্গে খাপ খায়।
আমি আমার প্রিয় দেশ বাংলাদেশের জন্য এই উপমা টানতে বাধ্য হচ্ছি। সমাজের অবস্থা দেখে মনে হয় না কোনো দায়িত্বশীল ব্যক্তি দেশে আছে। যে যার খুশিমতো আন্দোলন চালাচ্ছে। তার দাবি নিয়ে হয় অফিস ঘেরাও করছে কিংবা রাস্তা অবরোধ করছে, তার অধিকর্তা কিংবা প্রতিষ্ঠানপ্রধানের অপসারণ চাইছে। তাদের কাছে নিজের চাওয়া সবচেয়ে জরুরি, যা এখনই সমাধান করতে হবে। তা না হলে সে ঘেরাও ছাড়বে না, রাস্তায় কাউকে চলতে দেবে না, দরকার হলে আমৃত্যু অনশন করতেও রাজি।
মানুষের আচরণ থেকে বোঝা যায় না যে এটি এমন একটি দেশ, যার বয়স ৫৫ পার হতে চলেছে আর দেশের জনগোষ্ঠীর প্রায় অর্ধেক মধ্যবয়স পেরিয়ে গেছে। কিন্তু মানুষের আচরণ সেই ‘পিটার প্যান’ চরিত্রের মতো, তারা এত বছরেও বদলাতে পারেনি। প্রতিটি দাবির জন্য তারা তাৎক্ষণিক সন্তুষ্টি চায়। এ দাবির ব্যাপারে কেউ কম যায় না।
ছাত্র, সরকারি কর্মচারী, পুলিশ, ব্যবসায়ী, পরিবহনশ্রমিক এবং তারপর রাজনীতিবিদেরা যে দাবিগুলো উত্থাপন করেছেন, তার উদাহরণ নিন।
দেশ একটি বিশাল আন্দোলনের ময়দানে পরিণত হয়েছে, যেখানে প্রায় প্রতিটি গোষ্ঠী নিয়ত বিক্ষোভ জানাচ্ছে আর তাদের নালিশের তাৎক্ষণিক সমাধান চাইছে। তারা তাদের দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত নতিস্বীকার করবে না। এটা হয়তো থামত, কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে অনেক ক্ষেত্রে তারা জয়ী হয়েছে এবং তারপর অন্যান্য অসন্তুষ্ট অংশের কাছ থেকে নতুন দাবি উত্থাপিত হচ্ছে। এ এক অন্তহীন চক্র। কিন্তু কীভাবে এবং কখন এটি শুরু হয়েছিল?
৯ মাস আগে ছাত্রদের দ্বারা শুরু হওয়া ব্যাপক বিক্ষোভ আমাদের ইতিহাসের এক অন্যতম রাজনৈতিক আন্দোলনে রূপান্তরিত হয়েছিল, যার ফলে একটি অত্যন্ত অজনপ্রিয় সরকার এবং এর সমানভাবে অজনপ্রিয় নেতাকে ক্ষমতাচ্যুত করা হয়েছিল। কিন্তু ৯ মাস আগের অস্থিরতা এখনো শেষ হয়নি। দুর্নীতিগ্রস্ত ও অত্যাচারী শাসনের পতনে যে গণস্বস্তি ও আনন্দ উদ্যাপন করা হয়েছিল, তা হয়ে গেল ক্ষণস্থায়ী।
দীর্ঘদিন ধরে দুর্ভোগে থাকা জনগণের আশা ছিল, দেশ এক নতুন পথে যাবে। এর পাশাপাশি আরও একটি আশা ছিল, স্বৈরাচারী শাসনের শিকার জনগণ দেশে ন্যায়বিচার, সুশাসন এবং একে অপরের প্রতি শ্রদ্ধা ফিরিয়ে আনার যত্ন নেবে।
নিজেদের হারানো অধিকার ফিরিয়ে দিয়ে অন্যের অধিকারের প্রতিও শ্রদ্ধাশীল হবে।
ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের সরকারি ও বেসরকারি ক্যাডারদের মতো নতুন কোনো জুলুমবাজ দল গড়তে দেবে না। অন্তত আন্দোলনের প্রথম দিকে মানুষের আশা তা–ই ছিল।
কিন্তু আমাদের তরুণদের আন্দোলনের পর দেশ ও জনগণের আচরণে পরিবর্তন আশা করা গেলেও শেষ পর্যন্ত সব শ্রেণির মানুষকে সম্পৃক্ত না করতে পারলে দেশকে আইনের শাসন ও শৃঙ্খলায় ফিরিয়ে আনা সম্ভব হবে বলে মনে হচ্ছে না।
এর মূল কারণ, এ পর্যন্ত আমাদের অন্তর্বর্তী সরকার—যার সঙ্গে কিছু তরুণ আন্দোলনকারীও জড়িত—তারা দেশের অস্থিরতাকে এখনো দূর করতে পারছে না। তা নিজেদের মধ্যে মতবিভেদের জন্য হোক কিংবা অন্যান্য রাজনৈতিক দলের সঙ্গে মতবিরোধের জন্য হোক।
এটা ঠিক যে আগস্টের সরকার পরিবর্তন কোনো নির্বাচনের মাধ্যমে ছিল না, বরং এটা ছিল একটা গণ-আন্দোলনের পরিবর্তন। যেহেতু এ ধরনের আন্দোলনের নেতৃত্ব প্রথমে বিক্ষিপ্ত থাকে, তাই আইনশৃঙ্খলা স্থাপনে সরকারকে বেগ পেতে হয়। সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর জরুরি কাজ প্রথম দিকে বিঘ্নিত হয়। কিন্তু যখন একটি সরকার নিয়মমাফিক গঠিত হয় ও অন্তর্বর্তীকালীন দায়িত্ব নেয়, তখন দেশ আশা করে যে এই নতুন সরকার জনসাধারণের মৌলিক চাহিদা মেটাতে তৎপর হবে যত দিন তারা এ দায়িত্বে আছে।
এই মৌলিক চাহিদার মধ্যে অন্যতম দেশে আইনশৃঙ্খলা স্থাপন, মানুষের মৌলিক অধিকার, অর্থাৎ জানমালের নিরাপত্তা, স্বাধীনভাবে চলাফেরা এবং নিজের অধিকারের সঙ্গে অন্যের অধিকারের প্রতি সম্মান দেখানোর নিশ্চিত করা।
কিন্তু কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে নেতৃত্বের পরিবর্তন হলেও এই মৌলিক অধিকারগুলো সর্বস্তরে ছড়িয়ে পড়েনি। আমরা বুঝতে পারি, বছরের পর বছর ধরে চাপা পড়ে থাকা অভিযোগগুলো ভুক্তভোগী গোষ্ঠী থেকে হঠাৎ বিস্ফোরণের কারণ হতে পারে এবং আমরা জুলাই আন্দোলনের পরে প্রথম কয়েক সপ্তাহে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর মধ্যে নিষ্ক্রিয়তা দেখেছি।
এই জড়তা এমন একটি আইন প্রয়োগকারী সংস্থার কাছ থেকে এসেছিল, যা এত দিন একটি দুর্নীতিগ্রস্ত নেতৃত্বের অধীন কাজ করে আসছিল। তবে আমরা আশা করেছিলাম, অন্তর্বর্তী সরকার স্থিতিশীল হলে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে আসবে।
দুর্ভাগ্যবশত আগের সরকার চলে যাওয়ার প্রায় ৯ মাস পরও সেই স্থিতিশীলতার মুহূর্ত দেখা যাচ্ছে না। এই অস্থিতিশীলতায় অবদান রাখছে এমন ঘটনা বা যেসব গোষ্ঠী, যাদের ওপর সরকারের কোনো নিয়ন্ত্রণ আছে বলে মনে হয় না। শিক্ষার্থীরা তাদের প্রতিষ্ঠানপ্রধানদের অপসারণের জন্য চিৎকার করে এবং দাবি পূরণের জন্য সামান্যতম অজুহাতে তাদের রাস্তায় নেমে যায়।
চাকরিচ্যুত কর্মচারীরা চাকরি ফিরে পেতে চান বা রাস্তা অবরোধ করে তাঁদের ওপরওয়ালাকে অফিস থেকে সরিয়ে দিতে চান। অতি সম্প্রতি তরুণদের দ্বারা গঠিত একটি রাজনৈতিক দল তাদের দাবির তাৎক্ষণিক সমাধানের দাবিতে রাস্তা অবরোধ করে।
সর্বশেষ উদাহরণ, সরকারি কর্মকর্তাদের একটি অংশ কাজ থেকে বিরত থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে (এটিকে কলমবিরতি বলছে), কারণ তারা একটি সরকারি সংস্থাকে দ্বিখণ্ডিত করার সরকারি সিদ্ধান্তকে অনুমোদন করে না।
আমরা আমাদের কিছু জনগণের কর্মকাণ্ডকে শিশুসুলভ বলতে পারি, কিন্তু একে নিয়ন্ত্রণ করার এবং এ ব্যবহার বন্ধ করার জন্য কি কোনো প্রাপ্তবয়স্ক নেই সরকারে?
সমস্যার মূলে আমি এখন যা দেখছি, বর্তমান সরকারের কোনো আদেশ নিয়ন্ত্রণের কেন্দ্রীয় সমন্বয়কারী (ইংরেজিতে কমান্ড অ্যান্ড কন্ট্রোল) নেই। সরকারের শীর্ষে থাকা ব্যক্তিরা হয়তো রাজনীতিতে অভিজ্ঞ নন, কিন্তু তাঁরা খ্যাতিমান সংগঠন পরিচালনায় অভিজ্ঞ ব্যক্তি। তাঁদের জানা উচিত, সরকার পরিচালনা করা সবাইকে খুশি করা নয়।
প্রশাসন পরিচালনার জন্য প্রয়োজন দৃঢ়তা, শৃঙ্খলা ও আইনের প্রয়োগ। দায়িত্বে থাকা ব্যক্তিদের দায়িত্ব পালনে ব্যর্থতার জন্য দায়িত্ব নেওয়াও প্রয়োজন। এই দায়িত্বের ব্যর্থতা শুধু সরকারপ্রধানের ওপর বর্তায় না, যে মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে যিনি আছেন, প্রথমত তাঁর ওপর বর্তায়। সরকারপ্রধান সেই ব্যক্তি নন, যাঁর কাছে সব বিক্ষোভকারীকে প্রতিটি দাবি আদায়ের জন্য দৌড়াতে হবে। একইভাবে সব প্রতিবাদ রাস্তা অবরোধ ও অফিসের কার্যক্রম বন্ধের মাধ্যমে প্রদর্শন করার জন্য নয়। মানুষের অভিযোগ প্রকাশের অধিকার আছে, কিন্তু তা অন্যের চলাফেরার অধিকারে বাধা সৃষ্টি করার লাইসেন্স দেয় না।
দুর্ভাগ্যবশত দেশের বর্তমান বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি ইঙ্গিত দেয় না যে এগুলো শিগগিরই শেষ হতে চলেছে। কারণ, এখন পর্যন্ত সব মহলে বিরাজ করা বিভ্রান্তি নিরসনে সমন্বিত প্রচেষ্টার কোনো নজির আমরা দেখিনি। আমরা জানি, সচেতন জনগণের মতপ্রকাশের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করতে চায় না সরকার। কিন্তু সেই স্বাধীনতা দেশকে নৈরাজ্যে পরিণত করুক, এটা কেউ চায় না। এ স্বাধীনতা ক্রমেই মানবাধিকারের প্রথম নীতি, যা অন্যের অধিকারের আনুগত্য এবং সম্মান করাকে লঙ্ঘন করছে।
আমাদের যুবকেরা একটি ঐতিহাসিক আন্দোলনের কেন্দ্রবিন্দু ভূমিকায় ছিল। কিন্তু দেশকে আইনের শাসন দিতে ব্যর্থ একটি সরকারকে অপসারণের তাদের আন্দোলনের সাফল্য অচিরেই বাষ্পীভূত হয়ে যাবে, যদি বর্তমান অচলাবস্থা শিগগিরই শক্ত হাতে শেষ করা না যায়। বিক্ষোভ ও সমাবেশ শুরু হওয়ার আগে যাঁরা সেই সংস্থাগুলো পরিচালনা করছেন, তাঁরা থামাতে পারতেন বা পারেন, যদি তাঁরা এ সংস্থাগুলোর সমস্যা আগে থেকে চিহ্নিত করতে পারেন এবং তা সুরাহার জন্য প্রথমে নিজেরা এবং না পারলে তাঁর উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের কাছে যান। সরকারের উচিত এসব সমস্যা সমাধানের জন্য প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনাকে দায়িত্ব দেওয়া। তাদের রাস্তায় নামার দরকার নেই। যদি তারা সমস্যাগুলো সমাধান করতে না পারে, তবে সে ব্যবস্থাপনা পরিবর্তন করা দরকার।
এসব প্রতিষ্ঠানে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা দরকার। রাস্তাঘাট নিরাপদ করা দরকার, এগুলো সমাবেশের জায়গা নয়। পরিশেষে প্রত্যেক আইন লঙ্ঘনকারীর বিরুদ্ধে আইন প্রয়োগ করা দরকার। সরকারি–বেসরকারি যে–ই হোক।
শুধু আইন প্রয়োগ করে হয়তো আমরা একশ্রেণির মানুষের বালখিল্য ব্যবহার বন্ধ করতে পারব না। তবে দেশের মানুষের সার্বিকভাবে মানসিক পরিপক্বতার জন্য আমাদের দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যেও সামগ্রিকভাবে মানসিক পরিবর্তন দরকার। তাদেরও পরিপক্বতার প্রয়োজন। চাইলেই আজ ক্ষমতা হাতে আসবে, সেটা ঠিক নয়। জনগণ সেটা দেবে, যখন আপনাদের তারা উপযুক্ত মনে করবে। আশা করছি, আমাদের শিশুসুলভতা দূর হবে সবার ইচ্ছা থাকলে।
জিয়াউদ্দিন চৌধুরী সিভিল সার্ভিসের সাবেক কর্মকর্তা
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: র জন য প জন য প র সরক র র র সরক র ব যবহ র জনগণ র র বর ত হয় ছ ল চর ত র অন য র র র জন আম দ র ন একট দরক র ক ষমত প রথম সমস য অবর ধ
এছাড়াও পড়ুন:
বর্তমান সংকটের জন্য সরকার দায়ী, দলগুলোর চাপে সিদ্ধান্ত বদল
বর্তমান সংকটের জন্য সরকারকে দায়ী করে, সংকট উত্তরণে কয়েকটি রাজনৈতিক দলের মন যুগিয়ে চলার নীতি বাদ দিতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন তিনি দলের শীর্ষনেতারা। তারা বলেছেন, সরকার শুরু থেকে জনগণ বা গণঅভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষার কথা না ভেবে, কখনও বিএনপি, কখনও জামায়াত, কখনও এনসিপির চাপে সিদ্ধান্ত বদল করেছে, বর্তমান সংকটের এটাও একটা বড় কারণ।
বাংলাদেশ রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলন, এবি পার্টি ও আপ বাংলাদেশের যৌথ আয়োজনে রবিবার ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি মিলনায়তনে ‘স্বল্প আস্থার সমাজে সংস্কার ও নির্বাচনী ঐক্যের রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ’ শীর্ষক এক আলোচনা সভায় নেতারা এসব কথা বলেন।
প্রধান আলোচক অধ্যাপক মুশতাক হোসেন বলেন, ‘‘সমাজকে পরিবর্তন করতে যে জাতি জীবন দিতে পারে সেই জাতি অনেক শ্রদ্ধার। নতুন বন্দোবস্ত চুক্তি করে হয় না, কারণ কায়েমি স্বার্থবাদীরা নতুন বন্দোবস্ত মেনে নেয় না। তবে নতুন রাষ্ট্র ব্যবস্থার জন্য লড়াই চালিয়ে যেতে হবে।’’
ইংল্যান্ডের টরি পার্টির বিরুদ্ধে দুর্বল রাজনৈতিক দলগুলোর বিপ্লবের উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, ‘‘সেখানেও সমঝোতা হয়নি, সংগ্রামের মধ্য দিয়েই জনগণের বিজয় অর্জিত হয়েছিল।’’ বাংলাদেশে বিদ্যুৎ খাতে হাজার হাজার কোটি টাকা লুটপাটের অনুসন্ধান চলছে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘‘যারা ক্ষমতা কুক্ষিগত করতে চায় তারা উচ্চকক্ষ নিম্নকক্ষ সব জায়গা দখলের পদ্ধতি জানে।’’
তিনি বলেন, ‘‘আস্থার অভাবে ঝগড়া করে এদেশে রাজনৈতিক দলগুলো সবাই ক্ষতিগ্রস্ত হয় অথচ আস্থাশীল হলে সবাই লাভবান হতে পারত। এ দেশের মানুষের সহজে ক্ষমা করে দেয়ার প্রবণতার কারণে আওয়ামী লীগ বেচে গেছে। স্বার্থবাদী দলগুলো 'ভাইভাই রাজনীতি' করে বলেই স্বৈরাচার আর ফ্যাসিস্ট বারবার আসে।’’
অপরাধ করলে কোন না কোনভাবে শাস্তির ব্যবস্থা থাকতেই হবে জানিয়ে অধ্যাপক মুশতাক বলেন, ‘‘আস্থাহীনতা কমাতে হলে সামাজিক ব্যবস্থা জোরদার করতে হবে যেন অপরাধ করলে সামাজিকভাবে বয়কট করা হয়। অনিয়ম করলে তাকে সামাজিক, রাজনৈতিক এবং ধর্মীয়ভাবে শাস্তির মুখোমুখি করতে হবে।’’
তিনি বলেন, ‘‘সকল শ্রেণী পেশার মানুষের আস্থা অর্জন কঠিন হলেও নিজেদের মধ্যে আস্থা বজায় রাখতে হবে এবং চোরদের সাথে কখনো আপোষ করা যাবে না। যারা আওয়ামী লীগের সহযোগী ছিল তাদের কোন না কোনভাবে বিচার বা ক্ষমা চাওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে।’’
ঐক্যমত্য বা নতুন সংবিধান এখনি না হলেও লড়াই চালিয়ে গেলে জনতা পাশে থাকবে বলেও তিনি আশাবাদ জানান।
সভাপতির বক্তব্যে হাসনাত কাইউম বলেন, ‘‘অনেক মতদ্বৈততা থাকলেও দেশের প্রশ্নে এক হয়ে নতুন রাজনীতির জন্য কাজ করতে হবে। এখনি রাষ্ট্র সংস্কারের কাজ শুরু করতে হবে। হাসিনা-ওবায়দুল কাদেররা সাংবিধানিক পদ্ধতি এমনভাবে সাজিয়েছে তার মধ্যেই ফ্যাসিস্ট হওয়ার উপাদান নিহিত আছে। অতীতে জনগণের দাবি প্রতিষ্ঠা করতে পারার কারণে সফলতা এসেছে। এবার আন্দোলনের নেতৃত্বকে কিছু বুড়ো মানুষ ভুল পথে পরিচালিত করেছে, এবং টাকাওয়ালাদের কাছে নিয়ে গেছে, ফলে রাষ্ট্রের সংস্কার আজ অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে।’’
পুরোনো পথে নতুন বন্দোবস্ত বাস্তবায়ন হবে না। তিনটি দলের এই আয়োজন দল ও ব্যক্তি স্বার্থের জন্য নয় বলেও জানান তিনি।
মজিবুর রহমান মঞ্জু বলেন, ‘‘বিএনপি নেতা সালাহউদ্দিন আহমেদ কথায় কথায় সংবিধানের রেফারেন্স দেন, এটা ভালো। তবে তার কাছে প্রশ্ন- ফ্যসিস্ট হাসিনা সংবিধানের কোন আর্টিকেলের আলোকে আপনাকে গুম করে বিনা ভাড়ায় বিনা টিকিটে শিলংয়ে নিয়ে গিয়েছিল? আমাদের জানতে ইচ্ছে করে।’’
এবি পার্টি শক্তিশালী হলে তার লোকেরা পাবলিক টয়লেট ইজারা নেবে না এমন গ্যারান্টি নাই মন্তব্য করে মঞ্জু বলেন, এই সংস্কৃতি বদলানোর জন্যই নতুন রাজনীতি দরকার। নতুন রাজনীতি দাঁড়াতে না পারার কারণ খোঁজার আহ্বান জানান তিনি।
অধ্যাপক ইউনূসের সরকার তিন দলের চাপে পড়ে বারবার সিদ্ধান্ত বদল করে বলে অভিযোগ করে তিনি বলেন, ‘‘জনগণের জন্য যা ভালো সেটা করতে হবে; কোনো দলের স্বার্থ হাসিলের জন্য নয়।’’ জনগণের কথা না শোনায় উপদেষ্টাদের সমালোচনা করে তিনি বলেন, 'আপনাদের কিছুদিন পর জনগণের কাতারে আসতে হবে।'
সরকারের উদ্দ্যেশ্যে তিনি বলেন, এক-দুইটা রাজনৈতিক দলের মন যুগিয়ে চললে জুলাই শহীদ এবং আহতদের কাছে আজীবন ভিলেন হিসেবে অভিশাপ পেতে হবে।
আলি আহসান জুনায়েদ বলেন, হাসিনার হাতে ভেঙ্গে পড়া রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে কাজে লাগিয়ে রাজনৈতিক শক্তিগুলি ক্ষমতা ভোগের উৎসবে মেতেছে। ভোট কেন্দ্র দখলে অভ্যস্ত এবং বিপ্লব বিরোধীরা ক্ষমতায় আসলে জনগন আবারো হতাশ হবে বলে আশংকা প্রকাশ করেন তিনি।
জনগণকে অন্ধকারে রেখে চেয়ার নিয়ে কাড়াকাড়ি চলছে বলে মন্তব্য করেন তিনি। জনগনের রাষ্ট্র গঠন করতে রাজনৈতিক দলগুলোর রাজনীতি করা উচিৎ বলে মত দেন তিনি। গণভোটে দুইটা ব্যালট রাখার প্রস্তাব আবারো তুলে ধরেন তিনি। সংস্কার প্রশ্নে জনগণকে সাথে নিয়ে লড়াই চালিয়ে যাবার ঘোষণা দেন তিনি।
শহিদ উদ্দিন স্বপন বলেন, আইনের শাসন না থাকা এবং বৈষম্যের অর্থনৈতিক ব্যবস্থার কারণে বাংলাদেশে সব শ্রেণির মানুষের মধ্যে আস্থাহীনতা। জুলাই অভ্যুত্থানের পর সমাজ বিপ্লবের সম্ভাবনা তৈরি হলেও রাজনৈতিক নেতাদের পুরোনো চিন্তাচেতনার কারণে মানুষ আশাহত হয়েছে। যেটুকু অগ্রগতি গত ১৫ মাসে হয়েছে তাকে ভিত্তি ধরে লড়াই চালিয়ে যাওয়ার আহবান জানান তিনি।
সৈয়দ হাসিব উদ্দিন বলেন, এই মুহুর্তে চরম দুর্বল অবস্থায় আছে বাংলাদেশ, এটি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে। এই অবস্থার মোকাবেলায় নির্বাচন জরুরি। রাজনৈতিক দলগুলোকে গরম বক্তব্য না দিয়ে জনগনকে সাথে নিয়ে সংস্কার চালিয়ে যেতে হবে।
অধ্যাপক আব্দুল ওহাব মিনার বলেন, আমাদের দেশের সর্বস্তরে আস্থার প্রচণ্ড সংকট, এটি দূর করতে হলে রাজনৈতিক দলগুলোকে জনগণের কাছে পরীক্ষা দিতে হবে। তিনি বলেন, আমরা জীবিত থাকতে আওয়ামী লীগ এদেশে রাজনীতি করবে সেটি হতে পারে না। অহমিকা ছেড়ে সব দলকে ঐক্যের পথে আসার আহবান জানিয়ে তিনি বলেন, ডায়নোসর অনেক বড় ছিল কিন্তু আজ বিলুপ্ত হয়ে গেছে।
আরেফিন মো. হিজবুল্লাহ বলেন, ফ্যাসিবাদকে নির্মূল করতে শেখ মুজিবের ছবি টানানো অবশ্যই বন্ধ করতে হবে। রাজনৈতিক দলগুলোর কাঠামোগত ফ্যাসিবাদ সংকটকে তরান্বিত করছে। যেসব জায়গায় ফ্যাসিবাদ তৈরি হওয়ার আশংকা আছে সেগুলো বন্ধ করতে হবে।
দিদার ভুইয়া বলেন, ছেড়া 'স্যান্ডেল থেকে ফাইভস্টার হোটেল কোন বিপ্লবীর চরিত্র হতে পারে না।' রাজনৈতিক দলগুলোর নিজেদের মধ্যে আস্থাহীনতা বর্তমান সংকটের অন্যতম কারণ। উচ্চকক্ষে পিআর না মেনে বিএনপি নিজেদের ক্ষতি করছে। এমনকি নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ব্যাপক প্রাণহানির আশংকা তৈরি হচ্ছে।
ব্যারিস্টার জোবায়ের বলেন, প্রশাসনে নিজস্ব লোক সেট করতে ব্যস্ত তিন দল অথচ টেকসই রাষ্ট্র ব্যবস্থার জন্য রাজনৈতিক ইকো সিস্টেম জরুরি।
সভায় তিন দলের ঐক্যবদ্ধ পথ চলার অঙ্গীকার ব্যক্ত করা হয়।
রাইজিংবিডি/নঈমুদ্দীন নি