একটি বাংলা গানের প্রথম কলি এ রকম, ‘আমার বয়স বাড়ে কিন্তু আমি বাড়ি না’। এককথায়, আমার বয়স হলেও আমি অপরিণত থেকে যাই।

বিখ্যাত স্কটিশ লেখক উইলিয়াম ব্যারি তাঁর উপন্যাসে ‘পিটার প্যান’ নামের একটি চরিত্র সৃষ্টি করেছিলেন। সেই চরিত্র সব সময় শিশুর মতো ব্যবহার করত। তার আশপাশের সবাই পরিপক্ব হলেও সে চিরকাল বালখিল্য ব্যবহার করে মানুষকে আমোদ দিত।

‘পিটার প্যান’ চরিত্রটি পরে ইংরেজি ভাষায় ব্যবহার করা হয় এমন একজন ব্যক্তির বর্ণনা দিতে, যিনি পরিপক্বতাতেও বড় হতে চায় না। মানুষটি চিরকাল অপরিপক্ব থেকে যায়, যে দুই বছরের শিশুর মতো আচরণ করে। এই মানুষগুলো কখনোই শৈশবের অহংকেন্দ্রিক, আত্মকেন্দ্রিক, অপরিণত পর্যায় অতিক্রম করতে পারে না।

আমি এই উপসর্গকে একটি দেশ বা জাতিকে বর্ণনা করার জন্য প্রসারিত করতে পারি, যদি এটি বর্ণনার সঙ্গে খাপ খায়।

আমি আমার প্রিয় দেশ বাংলাদেশের জন্য এই উপমা টানতে বাধ্য হচ্ছি। সমাজের অবস্থা দেখে মনে হয় না কোনো দায়িত্বশীল ব্যক্তি দেশে আছে। যে যার খুশিমতো আন্দোলন চালাচ্ছে। তার দাবি নিয়ে হয় অফিস ঘেরাও করছে কিংবা রাস্তা অবরোধ করছে, তার অধিকর্তা কিংবা প্রতিষ্ঠানপ্রধানের অপসারণ চাইছে। তাদের কাছে নিজের চাওয়া সবচেয়ে জরুরি, যা এখনই সমাধান করতে হবে। তা না হলে সে ঘেরাও ছাড়বে না, রাস্তায় কাউকে চলতে দেবে না, দরকার হলে আমৃত্যু অনশন করতেও রাজি।

মানুষের আচরণ থেকে বোঝা যায় না যে এটি এমন একটি দেশ, যার বয়স ৫৫ পার হতে চলেছে আর দেশের জনগোষ্ঠীর প্রায় অর্ধেক মধ্যবয়স পেরিয়ে গেছে। কিন্তু মানুষের আচরণ সেই ‘পিটার প্যান’ চরিত্রের মতো, তারা এত বছরেও বদলাতে পারেনি। প্রতিটি দাবির জন্য তারা তাৎক্ষণিক সন্তুষ্টি চায়। এ দাবির ব্যাপারে কেউ কম যায় না।
ছাত্র, সরকারি কর্মচারী, পুলিশ, ব্যবসায়ী, পরিবহনশ্রমিক এবং তারপর রাজনীতিবিদেরা যে দাবিগুলো উত্থাপন করেছেন, তার উদাহরণ নিন।

দেশ একটি বিশাল আন্দোলনের ময়দানে পরিণত হয়েছে, যেখানে প্রায় প্রতিটি গোষ্ঠী নিয়ত বিক্ষোভ জানাচ্ছে আর তাদের নালিশের তাৎক্ষণিক সমাধান চাইছে। তারা তাদের দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত নতিস্বীকার করবে না। এটা হয়তো থামত, কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে অনেক ক্ষেত্রে তারা জয়ী হয়েছে এবং তারপর অন্যান্য অসন্তুষ্ট অংশের কাছ থেকে নতুন দাবি উত্থাপিত হচ্ছে। এ এক অন্তহীন চক্র। কিন্তু কীভাবে এবং কখন এটি শুরু হয়েছিল?

৯ মাস আগে ছাত্রদের দ্বারা শুরু হওয়া ব্যাপক বিক্ষোভ আমাদের ইতিহাসের এক অন্যতম রাজনৈতিক আন্দোলনে রূপান্তরিত হয়েছিল, যার ফলে একটি অত্যন্ত অজনপ্রিয় সরকার এবং এর সমানভাবে অজনপ্রিয় নেতাকে ক্ষমতাচ্যুত করা হয়েছিল। কিন্তু ৯ মাস আগের অস্থিরতা এখনো শেষ হয়নি। দুর্নীতিগ্রস্ত ও অত্যাচারী শাসনের পতনে যে গণস্বস্তি ও আনন্দ উদ্‌যাপন করা হয়েছিল, তা হয়ে গেল ক্ষণস্থায়ী।

দীর্ঘদিন ধরে দুর্ভোগে থাকা জনগণের আশা ছিল, দেশ এক নতুন পথে যাবে। এর পাশাপাশি আরও একটি আশা ছিল, স্বৈরাচারী শাসনের শিকার জনগণ দেশে ন্যায়বিচার, সুশাসন এবং একে অপরের প্রতি শ্রদ্ধা ফিরিয়ে আনার যত্ন নেবে।

নিজেদের হারানো অধিকার ফিরিয়ে দিয়ে অন্যের অধিকারের প্রতিও শ্রদ্ধাশীল হবে।
ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের সরকারি ও বেসরকারি ক্যাডারদের মতো নতুন কোনো জুলুমবাজ দল গড়তে দেবে না। অন্তত আন্দোলনের প্রথম দিকে মানুষের আশা তা–ই ছিল।

শুধু আইন প্রয়োগ করে হয়তো আমরা একশ্রেণির মানুষের বালখিল্য ব্যবহার বন্ধ করতে পারব না। তবে দেশের মানুষের সার্বিকভাবে মানসিক পরিপক্বতার জন্য আমাদের দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যেও সামগ্রিকভাবে মানসিক পরিবর্তন দরকার। তাদেরও পরিপক্বতার প্রয়োজন। চাইলেই আজ ক্ষমতা হাতে আসবে, সেটা ঠিক নয়। জনগণ সেটা দেবে, যখন আপনাদের তারা উপযুক্ত মনে করবে। আশা করছি, আমাদের শিশুসুলভতা দূর হবে সবার ইচ্ছা থাকলে।

কিন্তু আমাদের তরুণদের আন্দোলনের পর দেশ ও জনগণের আচরণে পরিবর্তন আশা করা গেলেও শেষ পর্যন্ত সব শ্রেণির মানুষকে সম্পৃক্ত না করতে পারলে দেশকে আইনের শাসন ও শৃঙ্খলায় ফিরিয়ে আনা সম্ভব হবে বলে মনে হচ্ছে না।

এর মূল কারণ, এ পর্যন্ত আমাদের অন্তর্বর্তী সরকার—যার সঙ্গে কিছু তরুণ আন্দোলনকারীও জড়িত—তারা দেশের অস্থিরতাকে এখনো দূর করতে পারছে না। তা নিজেদের মধ্যে মতবিভেদের জন্য হোক কিংবা অন্যান্য রাজনৈতিক দলের সঙ্গে মতবিরোধের জন্য হোক।

এটা ঠিক যে আগস্টের সরকার পরিবর্তন কোনো নির্বাচনের মাধ্যমে ছিল না, বরং এটা ছিল একটা গণ-আন্দোলনের পরিবর্তন। যেহেতু এ ধরনের আন্দোলনের নেতৃত্ব প্রথমে বিক্ষিপ্ত থাকে, তাই আইনশৃঙ্খলা স্থাপনে সরকারকে বেগ পেতে হয়। সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর জরুরি কাজ প্রথম দিকে বিঘ্নিত হয়। কিন্তু যখন একটি সরকার নিয়মমাফিক গঠিত হয় ও অন্তর্বর্তীকালীন দায়িত্ব নেয়, তখন দেশ আশা করে যে এই নতুন সরকার জনসাধারণের মৌলিক চাহিদা মেটাতে তৎপর হবে যত দিন তারা এ দায়িত্বে আছে।

এই মৌলিক চাহিদার মধ্যে অন্যতম দেশে আইনশৃঙ্খলা স্থাপন, মানুষের মৌলিক অধিকার, অর্থাৎ জানমালের নিরাপত্তা, স্বাধীনভাবে চলাফেরা এবং নিজের অধিকারের সঙ্গে অন্যের অধিকারের প্রতি সম্মান দেখানোর নিশ্চিত করা।

কিন্তু কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে নেতৃত্বের পরিবর্তন হলেও এই মৌলিক অধিকারগুলো সর্বস্তরে ছড়িয়ে পড়েনি।  আমরা বুঝতে পারি, বছরের পর বছর ধরে চাপা পড়ে থাকা অভিযোগগুলো ভুক্তভোগী গোষ্ঠী থেকে হঠাৎ বিস্ফোরণের কারণ হতে পারে এবং আমরা জুলাই আন্দোলনের পরে প্রথম কয়েক সপ্তাহে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর মধ্যে নিষ্ক্রিয়তা দেখেছি।

এই জড়তা এমন একটি আইন প্রয়োগকারী সংস্থার কাছ থেকে এসেছিল, যা এত দিন একটি দুর্নীতিগ্রস্ত নেতৃত্বের অধীন কাজ করে আসছিল। তবে আমরা আশা করেছিলাম, অন্তর্বর্তী সরকার স্থিতিশীল হলে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে আসবে।

দুর্ভাগ্যবশত আগের সরকার চলে যাওয়ার প্রায় ৯ মাস পরও সেই স্থিতিশীলতার মুহূর্ত দেখা যাচ্ছে না। এই অস্থিতিশীলতায় অবদান রাখছে এমন ঘটনা বা যেসব গোষ্ঠী, যাদের ওপর সরকারের কোনো নিয়ন্ত্রণ আছে বলে মনে হয় না। শিক্ষার্থীরা তাদের প্রতিষ্ঠানপ্রধানদের অপসারণের জন্য চিৎকার করে এবং দাবি পূরণের জন্য সামান্যতম অজুহাতে তাদের রাস্তায় নেমে যায়।

চাকরিচ্যুত কর্মচারীরা চাকরি ফিরে পেতে চান বা রাস্তা অবরোধ করে তাঁদের ওপরওয়ালাকে অফিস থেকে সরিয়ে দিতে চান। অতি সম্প্রতি তরুণদের দ্বারা গঠিত একটি রাজনৈতিক দল তাদের দাবির তাৎক্ষণিক সমাধানের দাবিতে রাস্তা অবরোধ করে।

সর্বশেষ উদাহরণ, সরকারি কর্মকর্তাদের একটি অংশ কাজ থেকে বিরত থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে (এটিকে কলমবিরতি বলছে), কারণ তারা একটি সরকারি সংস্থাকে দ্বিখণ্ডিত করার সরকারি সিদ্ধান্তকে অনুমোদন করে না।

আমরা আমাদের কিছু জনগণের কর্মকাণ্ডকে শিশুসুলভ বলতে পারি, কিন্তু একে নিয়ন্ত্রণ করার এবং এ ব্যবহার বন্ধ করার জন্য কি কোনো প্রাপ্তবয়স্ক নেই সরকারে?
সমস্যার মূলে আমি এখন যা দেখছি, বর্তমান সরকারের কোনো আদেশ নিয়ন্ত্রণের কেন্দ্রীয় সমন্বয়কারী (ইংরেজিতে কমান্ড অ্যান্ড কন্ট্রোল) নেই। সরকারের শীর্ষে থাকা ব্যক্তিরা হয়তো রাজনীতিতে অভিজ্ঞ নন, কিন্তু তাঁরা খ্যাতিমান সংগঠন পরিচালনায় অভিজ্ঞ ব্যক্তি। তাঁদের জানা উচিত, সরকার পরিচালনা করা সবাইকে খুশি করা নয়।

প্রশাসন পরিচালনার জন্য প্রয়োজন দৃঢ়তা, শৃঙ্খলা ও আইনের প্রয়োগ। দায়িত্বে থাকা ব্যক্তিদের দায়িত্ব পালনে ব্যর্থতার জন্য দায়িত্ব নেওয়াও প্রয়োজন। এই দায়িত্বের ব্যর্থতা শুধু সরকারপ্রধানের ওপর বর্তায় না, যে মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে যিনি আছেন, প্রথমত তাঁর ওপর বর্তায়। সরকারপ্রধান সেই ব্যক্তি নন, যাঁর কাছে সব বিক্ষোভকারীকে প্রতিটি দাবি আদায়ের জন্য দৌড়াতে হবে। একইভাবে সব প্রতিবাদ রাস্তা অবরোধ ও অফিসের কার্যক্রম বন্ধের মাধ্যমে প্রদর্শন করার জন্য নয়। মানুষের অভিযোগ প্রকাশের অধিকার আছে, কিন্তু তা অন্যের চলাফেরার অধিকারে বাধা সৃষ্টি করার লাইসেন্স দেয় না।

দুর্ভাগ্যবশত দেশের বর্তমান বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি ইঙ্গিত দেয় না যে এগুলো শিগগিরই শেষ হতে চলেছে। কারণ, এখন পর্যন্ত সব মহলে বিরাজ করা বিভ্রান্তি নিরসনে সমন্বিত প্রচেষ্টার কোনো নজির আমরা দেখিনি। আমরা জানি, সচেতন জনগণের মতপ্রকাশের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করতে চায় না সরকার। কিন্তু সেই স্বাধীনতা দেশকে নৈরাজ্যে পরিণত করুক, এটা কেউ চায় না। এ স্বাধীনতা ক্রমেই মানবাধিকারের প্রথম নীতি, যা অন্যের অধিকারের আনুগত্য এবং সম্মান করাকে লঙ্ঘন করছে।

আমাদের যুবকেরা একটি ঐতিহাসিক আন্দোলনের কেন্দ্রবিন্দু ভূমিকায় ছিল। কিন্তু দেশকে আইনের শাসন দিতে ব্যর্থ একটি সরকারকে অপসারণের তাদের আন্দোলনের সাফল্য অচিরেই বাষ্পীভূত হয়ে যাবে, যদি বর্তমান অচলাবস্থা শিগগিরই শক্ত হাতে শেষ করা না যায়। বিক্ষোভ ও সমাবেশ শুরু হওয়ার আগে যাঁরা সেই সংস্থাগুলো পরিচালনা করছেন, তাঁরা থামাতে পারতেন বা পারেন, যদি তাঁরা এ সংস্থাগুলোর সমস্যা আগে থেকে চিহ্নিত করতে পারেন এবং তা সুরাহার জন্য প্রথমে নিজেরা এবং না পারলে তাঁর উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের কাছে যান। সরকারের উচিত এসব সমস্যা সমাধানের জন্য প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনাকে দায়িত্ব দেওয়া। তাদের রাস্তায় নামার দরকার নেই। যদি তারা সমস্যাগুলো সমাধান করতে না পারে, তবে সে ব্যবস্থাপনা পরিবর্তন করা দরকার।

এসব প্রতিষ্ঠানে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা দরকার। রাস্তাঘাট নিরাপদ করা দরকার, এগুলো সমাবেশের জায়গা নয়। পরিশেষে প্রত্যেক আইন লঙ্ঘনকারীর বিরুদ্ধে আইন প্রয়োগ করা দরকার। সরকারি–বেসরকারি যে–ই হোক।

শুধু আইন প্রয়োগ করে হয়তো আমরা একশ্রেণির মানুষের বালখিল্য ব্যবহার বন্ধ করতে পারব না। তবে দেশের মানুষের সার্বিকভাবে মানসিক পরিপক্বতার জন্য আমাদের দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যেও সামগ্রিকভাবে মানসিক পরিবর্তন দরকার। তাদেরও পরিপক্বতার প্রয়োজন। চাইলেই আজ ক্ষমতা হাতে আসবে, সেটা ঠিক নয়। জনগণ সেটা দেবে, যখন আপনাদের তারা উপযুক্ত মনে করবে। আশা করছি, আমাদের শিশুসুলভতা দূর হবে সবার ইচ্ছা থাকলে।

জিয়াউদ্দিন চৌধুরী সিভিল সার্ভিসের সাবেক কর্মকর্তা

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: র জন য প জন য প র সরক র র র সরক র ব যবহ র জনগণ র র বর ত হয় ছ ল চর ত র অন য র র র জন আম দ র ন একট দরক র ক ষমত প রথম সমস য অবর ধ

এছাড়াও পড়ুন:

তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বিলুপ্ত করে হাইকোর্টের দেওয়া ১৩৯ পৃষ্ঠা রায়ের পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি প্রকাশ

বহুল আলোচিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিলসহ সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীতে আনা কয়েকটি বিষয় অবৈধ ঘোষণা করা রায়ের পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি প্রকাশ করেছেন হাইকোর্ট।

মঙ্গলবার বিচারপতি ফারাহ মাহবুব ও বিচারপতি দেবাশীষ রায় চৌধুরীর সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চের স্বাক্ষরের পর ১৩৯ পৃষ্ঠার পূর্ণাঙ্গ এ রায় প্রকাশ করা হয়।

এর আগে ২০২৪ সালের ১৭ ডিসেম্বর বহুল আলোচিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিলসহ সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীতে আনা কয়েকটি বিষয় অবৈধ ঘোষণা করে রায় দেন হাইকোর্ট। একইসঙ্গে সংবিধানে গণভোটের বিধান ফিরিয়ে এনেছেন আদালত।

আদালত রায়ের পর্যবেক্ষণে বলেন, গণতন্ত্র হচ্ছে আমাদের সংবিধানের মৌলিক কাঠামোর অংশ। এই গণতন্ত্র বিকশিত হয় অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ এবং প্রভাবমুক্ত নির্বাচনের মধ্যে দিয়ে। কিন্তু দলীয় সরকারের অধীনে বিগত তিনটি সংসদ নির্বাচনে জনগণের ইচ্ছার কোনও প্রতিফলন হয়নি। দলীয় সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচনের আত্মবিশ্বাস জনগণের মধ্যে জন্ম নেয়নি। যার ফলশ্রুতিতে হয়েছে জুলাই গণঅভ্যুত্থান। রায়ে হাইকোর্ট বলেছেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা জনগণের অভিপ্রায় অনুযায়ী সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল এবং এটি সংবিধানের মৌলিক কাঠামোর অংশে পরিণত হয়েছে।

বিচারপতি ফারাহ মাহবুব ও বিচারপতি দেবাশীষ রায় চৌধুরীর হাইকোর্ট বেঞ্চ এ রায় ঘোষণা করেন।

আদালতে রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান, ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদ উদ্দিন, রিটকারী সুজনের বদিউল আলমের পক্ষে ছিলেন সিনিয়র আইনজীবী ড. শরিফ ভূঁইয়া। বিএনপির পক্ষে ছিলেন সিনিয়র আইনজীবী জয়নুল আবেদীন, ব্যারিস্টার কায়সার কামাল, ব্যারিস্টার বদরুদ্দোজা বাদল, ব্যারিস্টার রুহুল কুদ্দুস কাজল, অ্যাডভোকেট ফারজানা শারমিন পুতুল। জামায়াতের পক্ষে ছিলেন অ্যাডভোকেট মোহাম্মদ শিশির মনির, ব্যারিস্টার এহসান সিদ্দিকী। ইনসানিয়াত বিপ্লবের পক্ষে শুনানি করেন অ্যাডভোকেট ইশরাত হাসান। চার আবেদনকারীর পক্ষে ছিলেন ব্যারিস্টার জুনায়েদ আহমেদ চৌধুরী, ব্যারিস্টার নিশাত মাহমুদ, ইন্টারভেনর হিসেবে ছিলেন ব্যারিস্টার হামিদুল মিসবাহ।

তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বিলুপ্তি সংক্রান্ত পঞ্চদশ সংশোধনী আইনের ২০ ও ২১ অনুচ্ছেদ সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক ও বাতিল ঘোষণা করে এ রায় দেন হাইকোর্ট। রায়ে আদালত বলেন, অনুচ্ছেদ দুটি সংবিধানের মৌলিক কাঠামোকে ধ্বংস করেছে, যেটি হচ্ছে গণতন্ত্র। পঞ্চদশ সংশোধনী মাধ্যমে সংবিধানে যুক্ত ৭ক, ৭খ, ৪৪ (২) অনুচ্ছেদ সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক ও বাতিল ঘোষণা করেছেন আদালত। পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে ৫৪টি ক্ষেত্রে সংযোজন, পরিমার্জন ও প্রতিস্থাপন আনা হয়েছিল।

রায়ে আদালত বলেছেন, পঞ্চদশ সংশোধনী আইন পুরোটা বাতিল করা হচ্ছে না। বাকি বিধানগুলোর বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ভার আগামী জাতীয় সংসদের ওপর ছেড়ে দিয়েছেন আদালত। রায়ে আদালত আরও বলেছেন, সংসদ আইন অনুসারে জনগণের মতামত নিয়ে বিধানগুলো সংশোধন, পরিমার্জন ও পরিবর্তন করতে পারবে। এর মধ্যে জাতির পিতার স্বীকৃতির বিষয়, ২৬ মার্চের ভাষণের বিষয়গুলো রয়েছে।

গণভোটের বিষয়ে রায়ে হাইকোর্ট বলেন, গণভোটের বিধান বিলুপ্ত করা হয়, যেটি সংবিধানের ১৪২ অনুচ্ছেদের অংশ ছিল। এটি ১৯৯১ সালে দ্বাদশ সংশোধনীতে যুক্ত হয়। সংবিধানের ১৪২ অনুচ্ছেদের গণভোটের বিধান বিলুপ্তি সংক্রান্ত পঞ্চদশ সংশোধনী আইনের ৪৭ ধারা সংবিধানের মৌলিক কাঠামোর সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ হওয়ায় বাতিল ঘোষণা করা হলো। ফলে দ্বাদশ সংশোধনীর ১৪২ অনুচ্ছেদ পুনর্বহাল করা হলো।

হাইকোর্টের রায়ে ৭ ক, ৭ খ এবং ৪৪ (২) অনুচ্ছেদ বাতিল করা হয়েছে। ৭ ক অনুচ্ছেদে সংবিধান বাতিল, স্থগিতকরণ ইত্যাদি অপরাধ এবং ৭ খ সংবিধানের মৌলিক বিধানাবলি সংশোধন অযোগ্য করার কথা বলা ছিল। এদিকে ৪৪ অনুচ্ছেদে মৌলিক অধিকার বলবৎকরণ বিষয়ে বলা আছে। ৪৪ (২) অনুচ্ছেদ বলছে, এই সংবিধানের ১০২ অনুচ্ছেদের অধীন হাইকোর্ট বিভাগের ক্ষমতার হানি না ঘটিয়ে সংসদ আইনের দ্বারা অন্য কোনও আদালতকে তার এখতিয়ারের স্থানীয় সীমার মধ্যে ওই সব বা এর যেকোনও ক্ষমতা প্রয়োগের ক্ষমতা দান করতে পারবেন। এই অনুচ্ছেদটি বাতিল ঘোষণা করা হয়েছে রায়ে।

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • শক্তিশালী নির্বাচিত নির্বাহী বিভাগ কেন জরুরি
  • রাজনীতির নীতিহীনতা
  • ‘ঢাকায় মানবাধিকার কমিশনের কার্যালয় স্থাপন জনগণ মেনে নেবে না’
  • নির্বাচন পেছানোর ষড়যন্ত্র জনগণ মানবে না: রিজভী
  • খুলনায় এনসিপির সমাবেশে ২০ হাজার লোক সমাগমের প্রস্তুতি
  • বিচার, সংস্কার ছাড়া নির্বাচন মানব না
  • জনগণ পাশে থাকলে দিল্লি পালাতে হয় না, লন্ডন থাকতে হয় না: হাসনাত আবদুল্লাহ
  • সন্ত্রাসী, চাঁদাবাজ ও মাদকাসক্ত ব্যক্তির বিএনপিতে ঠাই নাই : সাখাওয়াত 
  • হাইব্রিড নেতারা অন্যের ছেলের ভবিষ্যৎ নষ্ট করে নিজের ছেলের ভবিষ্যৎ গড়ে
  • তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বিলুপ্ত করে হাইকোর্টের দেওয়া ১৩৯ পৃষ্ঠা রায়ের পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি প্রকাশ