Samakal:
2025-06-13@15:58:15 GMT

গর্ত

Published: 12th, June 2025 GMT

গর্ত

জানালার ওপাশে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে থমথমে গভীর জঙ্গল। গাছগাছালির ফাঁকফোকর দিয়ে তাকালে দৃষ্টি হোঁচট খায় ডালপালার আড়ালে থাকা পাহাড়ের মাটির দেয়ালে। ঝুরঝুরে লাল মাটির পাহাড়, কিছু কিছু জায়গায় মাটি ধসে গিয়ে বিশ্রী ক্ষতের মতো দেখাচ্ছে। লতাগুল্মের ঝাড় মাটি খামচে বাদুড়ঝোলা হয়ে ঝুলছে পাহাড়ের গায়। বুনো ঘাস আর ঝোপঝাড়ের দঙ্গলে গোড়ালি ডুবিয়ে আকাশমুখো তাকিয়ে ডালপালা নাড়ছে গাছগুলো। এখানে ওখানে ঝোপের ভিতর হলদে পাপড়ি মেলে দিয়েছে অজস্র বুনো ফুল। হাপরের মতো একটা শোঁ শোঁ শব্দ ভেসে আসছে বাতাসের সাথে। সহসাই আবার থেমে যাচ্ছে শব্দটা। কাছাকাছি কোথাও ঝাউবন আছে বোধ হয়। জনমানুষের চিহ্ন নেই, বসতের চিহ্ন নেই কোথাও।
একটু দূরে বনের ভিতরে যেখানে গাছের ছায়া মেঘের মতো ঘন হয়ে নেমেছে মাটির ওপর, সেখানে ঝোপের ভিতর সকাল থেকেই লোকটা গর্ত খুঁড়তে লেগেছে। দুই হাতে মুঠো করে ধরা কোদালটা তার মাথার ওপর উঠছে আর নামছে। গর্তটা কোমর সমান গভীর হয়েছে বোধ হয়। পাশে জমে ওঠা মাটির স্তূপ আড়াল দিয়েছে লোকটাকে। তাকে দেখা যাচ্ছে না এখন।
লেজ নাচাতে নাচাতে কযেকটা ধূসর রঙের ছাতারে পাখি বের হয়ে এলো একটা ঝোপের ভিতর থেকে ঘাড় বাঁকিয়ে এদিক-সেদিক তাকাল, তীক্ষ্ণ স্বরে ডাকতে ডাকতে একে একে উড়ে গেল বনের ভিতর।
ঘরে বসে ক্লান্ত চোখ মেলে দেখছেন সৈয়দ আকমল। সামনের আঙিনা থেকে কোনো কিছুর আওয়াজ পেয়ে পাশের জানালায় দৃষ্টি ফেরালেন। একটা ছোট বাচ্চা ছেলে মুখ দিয়ে ঝিকঝিক শব্দ করতে করতে একটা সুপারির খোল টেনে নিয়ে যাচ্ছে। খোলের ভিতর কিছু মাটির চাঙ্গড়। উঁচু চৌকিটায় পা ঝুলিয়ে বসে থেকে পা ধরে গেছে। সৈয়দ আকমল উঠে জানালার কাছে দাঁড়ালেন। তাকে দেখতে পেয়ে মুখ তুলে তাকাল ছেলেটি। চোখাচোখি হওয়ায় যেন লজ্জা পেয়েছে, মাথা নিচু করে খোলের প্রান্তটা টানতে টানতে দ্রুত ঘাসবনের আড়ালে মিলিয়ে গেল।
লোকটা এখন গর্ত থেকে উঠে এসেছে। জানালায় দাঁড়ানো আকমল সাহেবের দিকে এক পলক তাকাল। মাথায় পেঁচিয়ে রাখা গামছাটা খুলে মুখের ঘাম মুছতে মুছতে বলল, ‘বসের অর্ডার, গর্তটা খুঁড়ে রাখলাম।’ 
কথাটা আকমল সাহেবকে উদ্দেশ করে বলল নাকি নিজেকে শোনাল বোঝা গেল না। লোকটা অর্থাৎ সিরু মস্তানের কথায় এটুকু বোঝা গেল কারও নির্দেশে গর্তটা খোঁড়া হয়েছে। কার নির্দেশে, কেন গর্তটা খোঁড়া হয়েছে– এ বিষয় নিয়ে সৈয়দ আকমল মাথা ঘামাচ্ছেন না। তিনি অন্যমনস্ক, চিন্তামগ্ন। গত রাতের ঘটনাটা ঘুরেফিরে মাথায় জট পাকাচ্ছে। 
এশার নামাজ শেষে মসজিদ কমিটির কিছু আলোচনা ছিল। সেটা শেষ হতে বেশ রাত হলো। মসজিদ থেকে বের হয়ে আলো-আঁধারি পথে তিনি বাড়ির দিকে হাঁটছিলেন। ছাইরঙা ছেঁড়া ছেঁড়া মেঘ চাঁদটাকে আড়াল করে আকাশে ভাসছে। অনেক তারা ফুটেছে আকাশে। মিয়া বাড়ির লিচু গাছে হুটোপুটি করছে বাদুড়গুলো। ডানা ঝাপটে উড়ে যাচ্ছে অন্ধকার আকাশে। সেই সময় একটা সাদা মাইক্রোবাস শক্ত ব্রেক কষে তার পাশে এসে থামল। দরজা খুলে লাফ দিয়ে নামল দুই-তিনজন। কিছু বুঝবার আগেই তাকে জাপটে ধরে গাড়ির ভিতর টেনে নেয়। বাধা দিয়েছিলেন। মাথায় শক্ত কিছুর আঘাত পেয়ে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন। 
যখন জ্ঞান ফিরেছে তখন অনেক রাত। ঘাড় নাড়তেই ব্যথায় টনটন করে উঠল মাথার ডান পাশটা। চোখ মেলে তাকাতেই ঘুটঘুটে কালো ধোঁয়ার মতো অন্ধকার চারপাশ থেকে ঠেসে ধরল। মনে হলো একটা ঘরে চৌকির ওপর তার শরীরটা নেতিয়ে পড়ে আছে। চৌকিতে জাজিম নেই। শক্ত কাঠ খোঁচা দিচ্ছে পিঠে। কেমন একটা অপরিচিত বোটকা গন্ধ ভাসছে বাতাসে। সামনেই জানালা, কপাট খোলা। ওপাশে হাঁ করে আছে রাত। একটু কাত হয়ে চোখ ঘোরালেন ডানে-বাঁয়ে। মাথার ব্যথাটা খচ করে কামড়ে ধরল। আর নড়াচড়ার চেষ্টা করলেন না। মড়ার মতো পড়ে থাকলেন চৌকির ওপর।  এলোমেলো দুঃস্বপ্নের ভিতর রাতটা আধো ঘুম আধো জাগরণে কেটেছে। যখন ভোরের আলো ফুটেছে, খোলা জানালায় কেউ একজন এসে দাঁড়ালে  তিনি সজাগ হলেন। অপরিচিত একটা মুখ। কপালের চামড়ায় পুরু ভাঁজ, চোয়াল জাগানো থুতনিতে একগোছা দাড়ি। মাথায় কাঁচা-পাকা চুলের জটা ঘাড় অবধি নেমেছে। ঢুলু ঢুলু লালচে চোখ মেলে ভিতরে উঁকি দিয়ে কিছু দেখছিল। মনে হলো তাকেই যেন খুঁটিয়ে দেখছে। একসময় গলা খাঁকারি দিল লোকটি, তাকে উদ্দেশ করে বলল, ‘আমি সিরু মস্তান। কিছু লাগলে আমারে ক’বেন। তবে ঘরের বাইরে আসা যাবে না। দরজায় তালা।’ কিছুক্ষণ পরেই লোকটা আবার দেখা দিল। হাতে একটা কাগজের মোড়ক অন্য হাতে ছোট অ্যালুমিনিয়ামের মগ। বলল, ‘নাশতা খান।’  সৈয়দ আকমল জানালার শিক গলিয়ে অনিচ্ছুক হাত বাড়িয়ে মোড়কটা নিয়ে চৌকির একপাশে রাখেন পুরিয়াটা। একটা আধপোড়া আটার রুটি, ভেতরে বুটের ডাল। মগে পানি। কাল রাত থেকে কিছু খাওয়া হয়নি। পেটে ক্ষুধা। তবু খাওয়ার ইচ্ছা নেই তার। কাগজে মোড়ানো রুটি আর ডাল যেমন রেখেছিলেন তেমনি পড়ে থাকে। একটা ডাঁশ মাছি উড়ে এসে হাঁটতে থাকে খাবারের ওপর।
দুশ্চিন্তা আর অবসাদে সৈয়দ আকমলের শরীর ভেঙে পড়তে চাইছে। অনেক প্রশ্ন ঘুরঘুর করছে মাথার ভিতর। তবে কথা বলতে ইচ্ছা করছে না। কিছু জিজ্ঞাসা করলে যে সদুত্তর পাবেন সিরু মস্তান নামের লোকটার আচরণে সে রকম মনে হচ্ছে না। লোকটার কথাবার্তা খটখটে, নীরস। ভাবভঙ্গি অমার্জিত। সময় চলছে না। খুব ছটফট লাগছে। সৈয়দ আকমল শান্ত থাকার চেষ্টা করছেন। ঘুরেফিরে বাড়ির কথা মনে হচ্ছে। ঘরে যতক্ষণ থাকেন, নাতনি টুম্পা তার সঙ্গেই থাকে। বাচ্চাটা নিশ্চয় খুব খুঁজছে তাকে। বউমার উদ্বিগ্ন চেহারাটা ভেসে উঠল তার চোখে। ছেলে অনিক হয়তো থানা আর পার্টি অফিসে ছোটাছুটি করছে। এতক্ষণে তার নিঁখোজ হওয়ার খবর রটে গেছে পাড়া-মহল্লায়। লোকজন তাকে খোঁজাখুঁজি করতে লেগেছে। বন্ধ ঘরে একটাই দরজা। দু’পাশের দেয়ালে দুটো জানালা। জানালা আটকে রেখেছে পুরু লোহার শিকের ঘের। ঘরের ভিতর দিকে একপাশে ঘুপচির মতো জায়গা। প্রস্রাব-পায়খানার জায়গা হবে। আধবোজা দরজা ঠেলে ঝাঁঝালো একটা গন্ধ আসছে ভিতর থেকে। অসহনীয় বন্দিদশা। কিছুই করার নেই শুধু অপেক্ষা করা ছাড়া। তবে অপেক্ষাটা কিসের জন্য সেটাও খোলাসা করে মনকে বোঝাতে পারছেন না। মনে অস্থিরতা উইপোকার মতো ঝাঁক বেঁধে উড়ছে। নিজের সামর্থ্যের কাছে হার মেনে কেউ যখন নিজেকে নিয়তির হাতে ছেড়ে দেয় তিনি সে রকম একটা মানসিকতায় নিজেকে ন্যস্ত করেছেন। 
গাছগাছালির ফাঁকফোকরে দিনের আলো। সবুজ স্ফটিকের মতো জ্বলছে জঙ্গলের ভিতরটা। বুনো ঘাস আর ঝোপঝাড়ে রোদের তেজ দেখে অনুমান করা যায় সময়টা মধ্যাহ্নের কাছাকাছি। জোহরের ওয়াক্ত শুরু হয়ে গেছে। সৈয়দ আকমল খোদাভক্ত নামাজি লোক। ফজরের নামাজ কাজা হয়েছে। এখন জোহর নামাজের সময়। ভেতর থেকে নামাজ আদায় করার তাগিদ দিচ্ছে যেন কেউ। নামাজে দাঁড়ালে কিছুক্ষণের জন্য হলেও মনের অস্থিরতা ভুলে থাকা যেত।
সৈয়দ আকমল জানালায় দাঁড়িয়ে গলার স্বর খানিকটা উঁচু করে হাঁক দিলেন, ‘একটু শুনবে।’ 
সিরু মস্তান বোধ হয় ধারেকাছেই ছিল। অচিরেই জানালায় দেখা দিল। ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে আছে।  
‘একটু পানি দিতে পারবা? অজু করব।’ 
কিছু না বলে কোথাও মিলিয়ে গেল সিরু মস্তান। ফিরে এলো অল্পক্ষণ পরেই। জানালার শিক গলিয়ে হাতটা মেলে ধরল তার দিকে। সিরুর হাতের মুঠোয় একটা মাটির ঢেলা। 
‘পানি দিতে পারব না। পানি আনতে কমলা ঝিরি যাওয়া লাগবে। এক ঘণ্টার পথ। বাড়ির সীমানার বাইরে যাওয়ার অর্ডার নাই আমার। এই মাটির ঢেলা দিয়া তায়াম্মুম বানান।’
অগত্যা তায়াম্মুমে অজু সারলেন তিনি। নামাজে দাঁড়ানোর জন্য একটা পরিষ্কার জায়গার খোঁজে এদিক-সেদিক তাকাচ্ছেন, জানালায় একটা কিছুর নড়াচড়া তার মনোযোগ টেনে নিল। বারান্দা থেকে জানালা বেশ উঁচু। কেউ বোধ হয় জানালার নিচ থেকে শিকের ভিতর দিয়ে একটা প্লাস্টিকের পানির বোতল ঠেলে দেওয়ার চেষ্টা করছে। কিছুটা কৌতূহলে তিনি জানালার কাছে এগিয়ে গেলেন। ফর্সা চকচকে একটা ছোট ন্যাড়া মাথা তার নজরে এলো প্রথমে। তারপর হাড়জিরজিরে খালি গা, কোমরে ফিতে দিয়ে বাধা ময়লা হাফপ্যান্ট। ঘাড় উঁচু করে জানালার দিকে তাকিয়ে আছে বাচ্চা ছেলেটা। এই ছেলেটাকে তিনি সুপারির খোল টেনে নিয়ে যেতে দেখেছিলেন। চোখাচোখি হতেই মুখ নামিয়ে মেঝের দিকে তাকাল। তবে ছোট ছোট দুটো হাতে পানির বোতলটা উঁচু করে জানালার শিকের সাথে ঠেসে ধরে রাখল। 
প্রচণ্ড ধমক দিয়ে কোথা থেকে ছুটে এলো সিরু মস্তান। ছোঁ মেরে বোতলটা কেড়ে নিল ছেলেটার হাত থেকে। ক্রুদ্ধ চোখে বাচ্চাটার দিকে তাকিয়ে থাকল কিছুক্ষণ তারপর জোরে কান টেনে দিয়ে গলা চড়িয়ে বলল, ‘মাতুব্বরি শিখতেছ না? ঘরে পানি নাই, এই পানি দিলে খাবি কী?’ 
কানে টান পড়ায় গোত্তা খাওয়া ঘুড়ির মতো কাত হয়ে পড়ে যাচ্ছিল ছেলেটা। নিজেকে সামলে সোজা হয়ে দাঁড়াল। মুখটা নামিয়ে রাখল মাটির দিকে। ফোঁসফোঁস করে শ্বাস ফেলছে। দাঁড়ানোর ভঙ্গি দেখে বোঝা যাচ্ছে খুব রাগ হয়েছে তার। সৈয়দ আকমল বললেন, ‘আহা, মারতেছ কেন? ছোট মানুষ, বুঝতে পারে নাই।’ ছেলেটির দিকে তাকিয়ে কোমল গলায় বললেন, ‘আমি তো অজু করেছি বাবা। পানির দরকার হবে না।’ সিরু মস্তানকে বললেন, ‘ছেলে তোমার?’ 
‘আমারই তো। ছাওয়ালডারে রাইখা ওর মা আরেক ডাকাইতের সাথে পলাইছে। আমার পোলা আমি তো আর ফেলাইয়া দিতে পারি না। সাথে রাখছি।’ মস্তানের কণ্ঠস্বরে রাগের ঝাঁজ। 
সৈয়দ আকমলের স্নেহের দৃষ্টি গড়িয়ে পড়ল ছেলেটির ওপর। ছোট্ট নাতনি টুম্পার জন্য কষ্টটা তার বুকের ভিতরে তোলপাড় করতে থাকল। 
‘আই, ঘরে চল্,’ সিরু মস্তান চেঁচিয়ে বলল। ছেলেটির মধ্যে নড়াচড়ার কোনো লক্ষণ দেখা গেল না। শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে সে। মস্তান তাকে টেনেহিঁচড়ে পাশের ঘরে ঢুকল। কিছুক্ষণ তর্জনগর্জন, তারপর সব চুপচাপ। গোটা বাড়িটা আবার জঙ্গলের গভীর নৈঃশব্দ্যে ডুবে গেছে।
আঙিনার সামনের দিকে গাছগাছালির ছায়া ক্রমশই গাঢ় হচ্ছে। মনে হচ্ছে সূর্যটা এখন পাহাড় টপকে কাত হয়ে নিচে নামছে। সন্ধ্যা লাগতে না লাগতেই জঙ্গল থেকে অন্ধকারের স্রোত ভাসিয়ে দিল চারপাশ। সিরু মস্তান জানালার পাশে বারান্দায় পা ছড়িয়ে বসেছে। পায়ের কাছে জ্বলছে একটা কুপি। বাতাসে কাঁপছে কুপির শিখা। সিরু মস্তানের ছায়াটা ভূতের মতো গড়াগড়ি দিচ্ছে মেঝের ধুলোয়। মস্তানের হাতে একটা কলকি। মুঠোয় পুরে টান দিচ্ছে। কলকির মাথায় লাল আগুনের ফুলকি লকলক করে জ্বলে উঠছে অন্ধকারে। কয়েকটা শেয়াল নেমেছে আঙিনায়। ঢুলু ঢুলু চোখে জন্তুগুলোর গতিবিধি লক্ষ্য করছে সিরু মস্তান। শেয়ালগুলো একটু কাছাকাছি আসতেই সে মেঝের ওর লাঠি ঠুকল। 
‘হুস্ হুস্!’ 
শেয়ালগুলো ঝোপের ভিতর উধাও হয়ে গেল চোখের পলকে। 
‘চাচা মিয়া, এই জঙ্গলের শিয়ালগুলি বড়ই খাটাশ। সকাল বেলা গর্ত খুঁড়লাম না, অইখানে আরও তিনটা গর্ত আছে। তিনটা গর্তে তিনটা মানুষ আছে। এখন মানুষগুলো নাই, শুধু হাড়গোড়। শিয়ালে মাটি আঁচড়ায়ে হাড়গোড় বার করে নিয়া আসে। কুড়মুড় কইরা চাবায়।’ সিরু মুখ উঁচু করে ভুস ভুস করে ধোঁয়া ছাড়ল। 
কুপির চারপাশে ফরফর শব্দে উড়ছে কয়েকটা মথ। ঘরের চালে দাপাদাপি করছে জংলি বাতাস। দূরে বনের ভিতর কোথাও একটা পাখি চিৎকার করে ডাকছে। অনেকক্ষণ ধরে ডাকল। সিরু মস্তান ভ্রুক্ষেপহীন, চুপচাপ কলকি টানছে।
‘চাচা মিয়া, ভয় পাইছেন?’ 
লোকটার নেশা হয়েছে। মুখের গেঁরো ফসকে কথা বেরিয়ে আসছে। ‘অর্ডার করে একজন, কাম করে তার লোকজন,’ সিরু মস্তানের খনখনে গলা বেজে উঠল আবার। ‘আপনারে এইখানে কে আনছে। সেইটা আমি যেমন জানি, আপনিও জানেন। আজকে গর্তটা খোঁড়া হইছে তার অর্ডারে।’ 
মস্তানের কথায় হেঁয়ালির ভাব আছে। কথার অর্থ পরিষ্কার সৈয়দ আকমলের কাছে। তিনি অনুভব করলেন ভয়ের শীতল সাপ তার পা দুটো পেঁচিয়ে ওপরে উঠে আসছে। 
দুই সপ্তাহ আগের ঘটনা হবে। নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী ছানাউল্ল্যা তার অফিসে এসেছিল প্রস্তাবটা নিয়ে। বলেছিল, ‘দুইবার তো ইলেকশন করলেন। এইবার আসনটা আমার জন্য ছেড়ে দেন। আসেন, নিজেদের মধ্যে একটা ফয়সালা করি।’ 
সরীসৃপের মতো পলকহীন শীতল চোখে তার দিকে স্থির তাকিয়ে ছিল। ছানাউল্যা এলাকার ভুঁইফোড় সংগঠনের নেতা। সাংসদের পছন্দের লোক। মাদকের কারবারে জড়িত। এলাকায় আধিপত্য কায়েম করার জন্য তার একটা বাহিনী আছে। খোঁড়া নাসেরের মতো ভাড়াটে খুনিও আছে তার হাতে। ছানাউল্যার প্রস্তাবে দমে যাননি সৈয়দ আকমল। বলেছিলেন, ‘আমাকে সমঝোতার কথা বলবা না। ফয়সালার ভার ভোটারদের ওপর। নির্বাচনের মাঠে তারাই ফয়সালা করবে। এইটা আমার শেষ কথা, ছানাউল্ল্যা। কথাটা মনে রাখবা।’ 
শব্দ করেই চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়েছিল ছানাউল্ল্যা। ‘আকমল সাহেব, আপনে রাজনীতি করেন, আমিও করি। রাজনীতিতে  শেষ কথা কিছু নাই। আপনিও মনে রাখবেন।’
বারান্দার আলো-আঁধারিতে খুকখুক শব্দ করে কেশে উঠল সিরু মস্তান। দুই হাত মাথার ওপর প্রসারিত করে আড়মোড়া ভাঙল। ঘাড় উঁচু করে জঙ্গলের দিকে তাকিয়ে থাকল কিছুক্ষণ। ‘আমি ডাকাইত। ডাকাইতের কাম ভালো বুঝি। রাজনীতি বুঝি না। রাজনীতির ক্যাচালে যখন নেতারা ডাকাইতের কাম করে, তখন আমার কষ্ট লাগে।’ গলার স্বর খাদে নামিয়ে বলল, ‘চাচা মিয়া, নামাজের ওয়াক্ত যাইতেছে। আপনারে কি অজুর পানি দিব? নমাজ পইড়া আল্লারে ডাকেন। আমি একটা গাড়ির শব্দ শুনতেছি। খোঁড়া নাসের আসার কথা। সে আসতেছে।’ v

.

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: ঝ প র ভ তর ন র ভ তর ব ধ হয় র জন য ছ ন উল র জন ত ক ত হয় অর ড র র ওপর বলল ন

এছাড়াও পড়ুন:

নাফ নদী আর সীমান্ত দেখতে কক্সবাজারের যে দুটি স্থানে পর্যটকের ভিড়

ঈদের ছুটিতে কক্সবাজারে এসেছেন কয়েক লাখ পর্যটক। সাগর, নদী, পাহাড় আর ঝরনা ঘুরে দেখার পর অনেকে ৮৪ কিলোমিটার দীর্ঘ কক্সবাজার-টেকনাফ মেরিন ড্রাইভ হয়ে পৌঁছে যাচ্ছেন নাফ নদীর তীরে। পাঁচ কিলোমিটার চওড়া নাফ নদীর ওপারে (পূর্ব দিকে) মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য। বর্তমানে এ অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ রয়েছে দেশটির স্বাধীনতাকামী সশস্ত্র সংগঠন আরাকান আর্মির হাতে।

টেকনাফ সীমান্তের অন্তত ৮০ কিলোমিটারজুড়ে যেকোনো জায়গা থেকে নাফ নদী ও মিয়ানমার সীমান্ত দেখা যায়। তবে সবচেয়ে ভালো দেখা যায় চারটি পয়েন্ট থেকে—হ্নীলা ইউনিয়নের পাহাড়চূড়ার জাদিমুরা, টেকনাফ পৌরসভার নেটং বা দেবতার পাহাড়, চৌধুরীপাড়ার ট্রানজিট জেটি এবং শাহপরীর দ্বীপ জেটি। এর মধ্যে শাহপরীর দ্বীপ এবং ট্রানজিট জেটিতে সবচেয়ে বেশি পর্যটকের সমাগম হচ্ছে। স্থানীয় বাসিন্দারাও সেখানে ভিড় করছেন। জেটিতে উঠে নাফ নদী, প্যারা বন, জেলেদের মাছ ধরার দৃশ্য এবং ওপারের রাখাইন রাজ্যের মংডু শহর দেখার সুযোগ মিলছে।

গত সোমবার বিকেলে শাহপরীর দ্বীপ জেটিতে গিয়ে দেখা গেছে, কয়েক শ নারী-পুরুষের ভিড়। বেশির ভাগই পর্যটক। তাঁরা ৫৫০ মিটার দীর্ঘ জেটির শেষ প্রান্তে দাঁড়িয়ে রাখাইন রাজ্যের ছবি তুলছেন। জেটির এক-তৃতীয়াংশ নদীর পানিতে বিস্তৃত। সেখানে দাঁড়ালে মনে হয় সাগরের বুকে দাঁড়িয়ে আছেন।

কেউ সিঁড়িতে, কেউবা রেলিংয়ের পাশে বসে নদীর সৌন্দর্য উপভোগ করছেন। এই জেটি দিয়েই স্থানীয় বাসিন্দারা ট্রলার ও স্পিডবোটে সেন্ট মার্টিন যাতায়াত করেন।

জেটিতে কথা হয় ঢাকার মিরপুরের ব্যবসায়ী আকমল হোসেনের সঙ্গে। স্ত্রী-সন্তানসহ পরিবারের ছয়জন সদস্য নিয়ে এসেছেন তিনি। ঢাকায় একটি কোচিং সেন্টার পরিচালনা করেন। শুক্রবার ঢাকা থেকে কক্সবাজারে পৌঁছে শাহপরীর দ্বীপ ঘুরতে এসে জেটির খোঁজ পান।

আকমল হোসেন (৫২) বলেন, ‘নাফ নদীর এই সীমান্তটা এতই সুন্দর যে না এলে বুঝতাম না। পাশাপাশি শাহপরীর দ্বীপের ইতিহাসটাও জানা হলো। সম্রাট শাহ সুজা ও তাঁর স্ত্রী পরীবানুর নামের সঙ্গে মিলিয়ে দ্বীপের নামকরণ—বেশ চমকপ্রদ।’

কুমিল্লার মতিউল ইসলাম বলেন, ‘সেন্ট মার্টিন দেখতে চেয়েছিলাম; কিন্তু পর্যটকদের এখন ট্রলার ও স্পিডবোটে উঠতে দেওয়া হচ্ছে না। পত্রপত্রিকায় এত দিন রাখাইন রাজ্য দখল, মর্টার শেল পড়ার খবর পড়েছি। আজ সীমান্তটা চোখে দেখলাম।’

ঢাকার কেরানীগঞ্জ থেকে পরিবার নিয়ে জেটিতে আসেন আইনজীবী সিরাজুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘২৫ বছর আগে টেকনাফ এসেছিলাম। তখন এই জেটি ছিল না। এখন জেটিতে দাঁড়িয়ে মিয়ানমারের জলসীমা আর নাফ নদীর সৌন্দর্য দেখা যায়।’

কয়েকজন পর্যটক অভিযোগ করেন, জেটিতে উঠতে ১০ টাকার টিকিট কাটতে হলেও শৌচাগার নেই। এতে নারী ও শিশুদের সমস্যায় পড়তে হচ্ছে।

জেটির ইজারাদারের পক্ষে আদায়কারী নুরুল ইসলাম বলেন, জেলা পরিষদ থেকে ইজারা নিয়ে জেটি পরিচালনা করা হচ্ছে। সেন্ট মার্টিনগামী যাত্রী ও পর্যটকদের কাছ থেকে জনপ্রতি ১০ টাকা, ইজিবাইক, টমটম, মোটরসাইকেল ও অটোরিকশার জন্য ২০ টাকা নেওয়া হচ্ছে। ঈদের দ্বিতীয় দিন থেকে ভিড় বাড়ছে। প্রথম দিন ৮০০ দর্শনার্থীর কাছ থেকে ৮ হাজার টাকা আয় হয়েছে। এখন দ্বিগুণ আদায় হচ্ছে।

টেকনাফের নাফনদীর শাহপরীর দ্বীপ জেটি। নাফনদীর ওপারে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য। সোমবার দুপুরে

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • নাফ নদী আর সীমান্ত দেখতে কক্সবাজারের যে দুটি স্থানে পর্যটকের ভিড়