বিতর্কিত তিনটি জাতীয় সংসদ নির্বাচন আয়োজনে জড়িত নির্বাচন কমিশনের (ইসি) সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার, নির্বাচন কমিশনার ও সচিবালয়ের সচিবদের ভূমিকা তদন্তে অবিলম্বে কমিটি গঠনের জন্য সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের নির্দেশ দিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস।

গতকাল সোমবার রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের এক বৈঠকে এ-সংক্রান্ত আলোচনা শেষে এমন নির্দেশ দেন প্রধান উপদেষ্টা। পরে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানিয়েছে ।

এই বৈঠকে আরও উপস্থিত ছিলেন জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ, সদস্য বদিউল আলম মজুমদার, ইফতেখারুজ্জামান, সফররাজ হোসেন ও মোহাম্মদ আইয়ুব মিয়া। অন্যান্যের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন প্রধান উপদেষ্টার মুখ্য সচিব সিরাজ উদ্দিন মিয়া ও প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মনির হায়দার।

বৈঠকে নির্বাচন কমিশন সংস্কার কমিশনের প্রধান বদিউল আলম মজুমদার বলেন, সব রাজনৈতিক দল একমত হয়েছে যে অতীতের তিনটি বিতর্কিত নির্বাচন আয়োজনে কর্মকর্তাদের ভূমিকা তদন্ত করা এবং তাঁদের জবাবদিহির আওতায় আনা প্রয়োজন।

জুলাইয়ের মধ্যে জুলাই সনদ

বৈঠকে কমিশন সদস্যরা জুলাই সনদ তৈরির কাজের অগ্রগতি সম্পর্কে প্রধান উপদেষ্টাকে অবহিত করেন। কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেন, বেশ কিছু বিষয়ে ঐকমত্য হয়েছে। শিগগিরই সব রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনার ভিত্তিতে সনদ চূড়ান্ত করা সম্ভব হবে।

প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, ‘সবাই জুলাই সনদের জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে। আশা করি, আগামী জুলাই মাসের মধ্যে আমরা এটি জাতির সামনে উপস্থাপন করতে পারব।’

‘প্রবাসীদের ভোটাধিকার নিশ্চিত করতে হবে’

বৈঠকে প্রধান উপদেষ্টা তাঁর লন্ডন সফরের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেন। অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, লন্ডনে বাংলাদেশি কমিউনিটির যাঁদের সঙ্গেই দেখা হয়েছে, তাঁরা সংস্কার নিয়ে জানতে চেয়েছেন। বাংলাদেশি শিক্ষার্থীরা খুব আগ্রহী। তাঁরা বিস্তারিতভাবে ঐকমত্য কমিশনের কাজ নিয়ে তাঁর (প্রধান উপদেষ্টা) সঙ্গে আলোচনা করেছেন, মতামত দিয়েছেন।

প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘যেখানেই গিয়েছি, সেখানকার প্রবাসী বাংলাদেশিরা আমাকে জিজ্ঞেস করছেন, “আমরা আগামী নির্বাচনে ভোট দিতে পারব তো?” আমাদের প্রবাসীদের ভোটাধিকার নিশ্চিত করার জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা করতে হবে। পোস্টাল ব্যালট এবং আর কী কী অপশন আছে, সেগুলো নিয়ে ভাবতে হবে, সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলোচনায় বসতে হবে।’

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: ম হ ম মদ ঐকমত য

এছাড়াও পড়ুন:

জুলাই সনদ নিয়ে জট খুলুন, সময় কিন্তু চলে যাচ্ছে

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং ১ ঘণ্টা ৪০ মিনিট কথা বলে দুই দেশের উদ্বেগজনক বাণিজ্য বিরোধের মীমাংসা করতে পারলেও আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোর বিজ্ঞ নেতারা দীর্ঘ আলোচনা করে ঠিক করতে পারছেন না কীভাবে নির্বাচন ও সংস্কার কাজটি করা যাবে।

অনেক আলোচনা ও বিতর্কের পর ১৭ অক্টোবর বৃষ্টিস্নাত বিকেলে জাতীয় সংসদের দক্ষিণ প্লাজায় বেশ ঘটা করে ২৫টি দল জুলাই সনদে সই করেছিল; চারটি বামপন্থী দল রাষ্ট্রের মূলনীতি পরিবর্তন করার প্রতিবাদে সনদে সই দেয়নি, তাতে অবাক হইনি। কিন্তু ছাত্রনেতৃত্ব থেকে গড়ে ওঠা জাতীয় নাগরিক পার্টি, যারা জুলাই সনদের দাবিটি প্রথম তুলেছিল, তাদের সই না দেওয়াটা অস্বাভাবিক ঠেকেছে। এটা নিয়ে তারা যে দর–কষাকষি করছে, তার পেছনে কি নীতিগত অবস্থান, না ভোটের হিসাব–নিকাশ মুখ্য ছিল, সেই প্রশ্নও উঠেছে।

এদিকে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন সরকারের কাছে জুলাই সনদ বাস্তবায়নের আইনি ভিত্তি দেওয়ার লক্ষ্যে যে সুপারিশমালা সরকারের কাছে পেশ করেছে, তা নিয়ে রাজনীতির মাঠ বেশ গরম। বিএনপিসহ বেশ কিছু দল একে প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ ও তামাশা বলেও অভিহিত করেছে। আবার কেউ কেউ স্বাগতও জানিয়েছে। রাজনৈতিক দলগুলোর পরস্পরবিরোধী অবস্থান নিয়ে অনেকেই প্রশ্ন করেছেন, জুলাই সনদ ও আইনি ভিত্তি নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলো একমত না হতে পারলে নির্বাচন হবে কীভাবে?

রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে তিনটি বলয় তৈরি হয়েছে। একটি বলয় হলো বিএনপি ও তাদের সমর্থক-অনুসারী দল। আরেকটি হলো জামায়াতে ইসলামী ও এর অনুসারী দল। তৃতীয়টি হলো জাতীয় নাগরিক পার্টি। আবার কোনো কোনো দল দুই নৌকায় পা দিয়ে রেখেছে। যেখানে গিয়ে ভোটের মাঠে সুবিধা করা যাবে, শেষ পর্যন্ত তাদের সঙ্গে যাবে।

মাঠে সক্রিয় থাকা ৩০টি রাজনৈতিক দলকে নিয়েই সরকার তথা জাতীয় ঐকমত্য কমিশন দীর্ঘ আট মাস ধরে আলোচনা করে ৮৪টি বিষয়ে ঐকমত্যে পৌঁছেছে। এর মধ্যে ৪৮টি বিষয় যেহেতু সংবিধানের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট, সেহেতু এগুলোর আইনি ভিত্তি তৈরির জন্য জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের পক্ষ থেকে কিছু সুপারিশ করা হয়েছে, যা নিয়ে আবার মতভেদ দেখা দিয়েছে। যদিও সনদ তৈরির সময় বলা হয়েছিল, তারা আইনি ভিত্তির সুপারিশ করবে না। কিন্তু অসমাপ্ত সনদ করতে গিয়ে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন আরও জট পাকিয়ে ফেলেছে।

জুলাই সনদের বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলো ঐকমত্যে আসতে না পারলে নির্বাচনের অনিশ্চয়তা কাটবে না। সরকার বলছে, তারা ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন করতে বদ্ধপরিকর। কিন্তু প্রতিযোগী রাজনৈতিক দলগুলোকে রাজি করাতে না পারলে কীভাবে সেই নির্বাচন হবে? প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস নির্বাচন সামনে রেখে বড় আক্রমণের আশঙ্কার কথা বলেছেন। সেই আশঙ্কা মোকাবিলার দায়িত্ব তো সরকারকেই নিতে হবে। 

যেসব বিষয়ে রাজনৈতিক পক্ষগুলোর মধ্যে মতবিরোধ তীব্র, তার একটি হলো গণভোটের তারিখ। জামায়াতে ইসলামী ও তাদের অনুসারীরা বলছে, নভেম্বরেই গণভোট হতে হবে। অন্যদিকে বিএনপি ও তাদের অনুসারীদের দাবি, সংসদ নির্বাচনের আগে গণভোট হতে পারবে না। তাঁরা মনে করেন, আগে গণভোটের দাবি তোলা নির্বাচনকে পিছিয়ে দেওয়ার দুরভিসন্ধি ছাড়া কিছু নয়। 

জাতীয় ঐকমত্য কমিশন অবশ্য দুই বিকল্প প্রস্তাবই সরকারের কাছে পেশ করেছে। সমস্যা হলো যিনি সরকারপ্রধান, তিনি ঐকমত্য কমিশনেরও প্রধান। স্বাভাবিকভাবে প্রশ্ন আসে কে কার কাছে প্রস্তাব পেশ করেছেন।

দ্বিতীয়ত, জুলাই সনদে ঐকমত্যের পাশাপাশি রাজনৈতিক দলের আপত্তিগুলো লিপিবদ্ধ হলেও আইনি ভিত্তির সুপারিশে বাদ দেওয়া হয়েছে। বিএনপি ও তাদের অনুসারীদের প্রধান আপত্তি এখানেই। জুলাই সনদে বলা হয়েছে, যেসব বিষয় রাজনৈতিক দলগুলো আপত্তি জানিয়েছে, নির্বাচনে তারা জনগণের রায় পেলে সেটি বাস্তবায়ন করতে বাধ্য নয়। কিন্তু আইনি ভিত্তিতে যখন সেটি বাদ দেওয়া হয়েছে এবং সংসদ নির্বাচনের আগে গণভোটের মাধ্যমে সেটি অনুমোদন করে নিলে সংসদের সার্বভৌমত্ব নষ্ট হবে।

তাদের তৃতীয় আপত্তির জায়গা হলো স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতে আইনি ভিত্তি অনুমোদিত হয়ে যাওয়া। জাতীয় ঐকমত্য কমিশন বলেছে, যদি ৯ মাসের মধ্যে জাতীয় সংসদ উল্লিখিত বিষয়ে আইন পাস না করে, তাহলে সেটা স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতে অনুমোদিত হয়ে যাবে। ঐকমত্য কমিশনের এই আইনি ভিত্তির সঙ্গে ১৯৭০ সালে ইয়াহিয়া খান প্রণীত এলএফওর মিল খুঁজেও পেয়েছেন কোনো কোনো বিশ্লেষক।

প্রথম আলোর প্রতিবেদনে বলা হয়, রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে তীব্র অনৈক্যের কারণে জুলাই জাতীয় সনদ বা সংস্কার প্রস্তাব বাস্তবায়নে ‘দুরূহ চ্যালেঞ্জ’ দেখছে সরকার। তবে গণভোটসহ সনদ বাস্তবায়নের বিষয়ে দ্রুত সিদ্ধান্ত নেবে সরকার। এ ক্ষেত্রে অন্তর্বর্তী সরকার জাতীয় নির্বাচনের দিন একই সঙ্গে গণভোট করার বিষয়টিও গভীরভাবে চিন্তা করছে বলে জানা গেছে। তবে এ বিষয়ে এখনো সিদ্ধান্ত হয়নি।’ (প্রথম আলো, ৩১ অক্টোবর ২০২৫)

সিদ্ধান্তটি কবে হবে, কেমন হবে? যদি একই দিনে দুই ভোট করার পক্ষে সরকার সিদ্ধান্ত নেয়, তাহলে জামায়াত ও এনসিপি কি মেনে নেবে? আর যদি সংসদ নির্বাচনের আগে গণভোট হয়, বিএনপি কি তা গ্রহণ করবে? যদি না করে, কী পরিস্থিতি তৈরি হবে?

রাজনৈতিক দলগুলোকে জুলাই সনদের পক্ষে এনে সরকার যতটুকু বাহবা পেয়েছিল, তার বেশি সমালোচিত হয়েছে আইনি ভিত্তি দিতে গিয়ে। এখানে কোনটি ন্যায্য, কোনটি অন্যায্য; তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হলো তারা রাজনৈতিক দলগুলোকে একমতে আনতে ব্যর্থ হয়েছে। রাজনৈতিক দলগুলো যেমন একে অপরকে বিশ্বাস করবে না, তেমনি তাদের বড় অংশ সরকারের প্রতিও আস্থাশীল নয়। নির্বাচনের বিষয়ে শুরু থেকে সরকারের দ্বিধাদ্বন্দ্ব রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে যেমন সন্দেহ বাড়িয়েছে, তেমনি সরকারের প্রতিও একধরনের অনাস্থা সৃষ্টি করেছে।

সংস্কারের বিষয়ে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের যেখানে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়ার কথা ছিল, রাজনৈতিক দলের সংস্কার, সেখানেই তারা কম গুরুত্ব দিয়েছে। তারা এই একটি বিষয়ে শক্ত অবস্থান নিলে রাষ্ট্রীয় ও রাজনীতির সংস্কারকাজ অনেকটা সহজ হতো। এখন রাজনৈতিক দলগুলো সরকারের চাপে সনদে যতই সই করুক না কেন, কাজ করবে তাদের মতো করে। জাতীয় ঐকমত্য কমিশন সংবিধানের দাঁড়ি, কমা, সেমিকোলন নিয়ে যতটা ব্যস্ত ছিল, রাজনৈতিক দলের গণতন্ত্রায়ণ নিয়ে ততটাই উদাসীন থেকেছে। 

জুলাই সনদের বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলো ঐকমত্যে আসতে না পারলে নির্বাচনের অনিশ্চয়তা কাটবে না। সরকার বলছে, তারা ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন করতে বদ্ধপরিকর। কিন্তু প্রতিযোগী রাজনৈতিক দলগুলোকে রাজি করাতে না পারলে কীভাবে সেই নির্বাচন হবে? প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস নির্বাচন সামনে রেখে বড় আক্রমণের আশঙ্কার কথা বলেছেন। সেই আশঙ্কা মোকাবিলার দায়িত্ব তো সরকারকেই নিতে হবে। 

রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বিভাজন যত বাড়বে, আক্রমণের আশঙ্কারও তত জোরদার হবে। এই সহজ সত্যটি সরকারের নীতিনির্ধারকেরা যত দ্রুত উপলব্ধি করবেন, ততই মঙ্গল। ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন করতে চাইলে অবিলম্বে সৃষ্ট জট খোলার ব্যবস্থা করুন। প্রয়োজনে আবার রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে বসুন। সময় কিন্তু চলে যাচ্ছে।

সোহরাব হাসান, সাংবাদিক ও কবি

* মতামত লেখকের নিজস্ব

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • ছাত্রদলের কমিটি নেই ১৪ মাস, স্থবির কার্যক্রম
  • মামলায় ঝুলে গেছে এফবিসিসিআইয়ের নির্বাচন
  • সনদ বাস্তবায়নে দ্রুত সিদ্ধান্ত, আরপিওতে পরিবর্তন আসছে
  • গণসংযোগ ও লিফলেট বিতরণ করলেন সিলেট-৬ আসনে বিএনপির মনোনয়নপ্রত্যাশী আদিবা হোসেন
  • তড়িঘড়ি না করে সংবিধান সংস্কারে আলোচনা চালিয়ে যাওয়ার আহ্বান
  • কিছু রাজনৈতিক দল ঐকমত্য কমিশনে গিয়ে ফাঁদে পড়েছে: জাপা মহাসচিব
  • ঐকমত্য কমিশন হাজির করেছে অনৈক্যের দলিল: বিএনপি নেতা জহির উদ্দিন স্বপন
  • সম্মেলনের প্রায় তিন মাস পর রাজশাহী মহানগর বিএনপির আংশিক কমিটি
  • জুলাই সনদ নিয়ে জট খুলুন, সময় কিন্তু চলে যাচ্ছে
  • হিন্দুদের ভাগ্যোন্নয়নে প্রয়োজন ইসলামি সরকার: গোলাম পরওয়ার