‘জলবায়ু-অভিযোজিত কৃষির উন্নয়নে সমন্বিত উদ্যোগের বিকল্প নেই’
Published: 20th, June 2025 GMT
জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে কৃষিপ্রধান বাংলাদেশের প্রান্তিক কৃষকরা ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত। এক্ষেত্রে সরকারের সাথে বেসরকারি সংস্থাসমূহের কার্যকর সহযোগিতার মাধ্যমে টেকসই জীবিকা এবং খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব। যত ভালো কৃষিপণ্য বা প্রযুক্তি হোক না কেন, সমন্বিত উপায়ে সেগুলোর ফলাফল কৃষকের কাছে পৌঁছে দেওয়া জরুরি।
‘ব্র্যাক অ্যাডাপটেশন ক্লিনিক এবং দীর্ঘমেয়াদী কৃষি-পরামর্শমূলক পরিসেবার জন্য ACASA পোর্টালের সুবিধা প্রদান’ শীর্ষক প্রশিক্ষণ কর্মশালায় এসব উল্লেখ করেন সরকারের শীর্ষস্থানীয় কৃষি গবেষণা প্রতিষ্ঠানসমূহের বিশেষজ্ঞরা।
ব্র্যাক, বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল ও আকাসা প্রকল্পের যৌথ উদ্যোগে কর্মশালাটি গত ১৮-১৯ জুন রাজেন্দ্রপুরের বিসিডিএমমে অনুষ্ঠিত হয়।
বক্তারা উল্লেখ করেন, বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম। এখানে কৃষির ওপর নির্ভরশীল জনসংখ্যার একটি বিশাল অংশকে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলা করতে হচ্ছে। কৃষকরা প্রতিনিয়ত ফসলের উৎপাদনশীলতা হ্রাস, মাটির গুণগত মান কমে যাওয়া এবং খাদ্য নিরাপত্তা সংকটের সম্মুখীন হচ্ছেন। জলবায়ু পরিবর্তনজনিত চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সরকারি প্রতিষ্ঠানসমূহ যেমন DAE, BARC, BARI, BRRI, বাংলাদেশ ব্যাংক, ইত্যাদি এবং ব্র্যাক-এর মতো বেসরকারি সংস্থার মধ্যে কার্যকর সহযোগিতার মাধ্যমে টেকসই জীবিকা এবং খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব হবে।
বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিলের পরিচালক (কম্পিউটার ও জিআইএস) এবং ACASA প্রকল্পের পি-আই হাসান মো.
কর্মশালায় বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন ব্র্যাক জলবায়ু পরিবর্তন কর্মসূচি, নগর উন্নয়ন কর্মসূচি ও দুর্যোগ ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা কর্মসূচির পরিচালক ড. মো. লিয়াকত আলী, ফিল্ড সার্ভিস উইং, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, খামারবাড়ি, ঢাকার অতিরিক্ত পরিচালক (সম্প্রসারণ ও সমন্বয়) ড. আব্দুল আজিজ এবং অতিরিক্ত পরিচালক (অর্থকরী ফসল), কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, খামারবাড়ি, ঢাকার মো. মনিরুল ইসলাম।
ব্র্যাক অ্যাডাপটেশন ক্লিনিক বিষয়ে প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন ব্র্যাক জলবায়ু পরিবর্তন কর্মসূচির সিনিয়র প্রোগ্রাম ম্যানেজার তৌসিফ আহমেদ কোরেশী।
ব্র্যাক অ্যাডাপটেশন ক্লিনিক একটি সমন্বিত কৃষিসেবা কেন্দ্র-যা জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ঝুঁকিতে থাকা কৃষকদের জলবায়ু সহনশীল ফসলের জাত, চাষপদ্ধতি, আবহাওয়া ও জলবায়ু সম্পর্কিত তথ্য প্রদান এবং দক্ষতা বৃদ্ধির মাধ্যমে কৃষিতে টেকসই অভিযোজনে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। ২০২২ সাল থেকে ব্র্যাকের ১৯টি অ্যাডাপটেশন ক্লিনিক কাজ করছে জলবায়ু হটস্পটগুলোতে। ব্র্যাক অ্যাডাপটেশন ক্লিনিক ACASA পোর্টাল ও খামারি মোবাইল অ্যাপ থেকে প্রয়োজনীয় তথ্য ব্যবহার করে কৃষকদের সময়োপযোগী এবং নির্ভরযোগ্য কৃষি-সংক্রান্ত তথ্য সরবরাহ করবে।
বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল (BARC) ২০২৩ সাল থেকে “Atlas of Climate Adaptation in South Asian Agriculture (ACASA)” প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে। এই উদ্যোগের মূল লক্ষ্য হলো দক্ষিণ এশিয়াজুড়ে জলবায়ু-স্মার্ট কৃষি পরিকল্পনা বাস্তবায়নে সহায়তার জন্য স্থানভিত্তিক তথ্য সরবরাহ করা। এটি জলবায়ু সংক্রান্ত ঝুঁকি, প্রাকৃতিক দুর্যোগের প্রবণতা এবং কৃষি খাতে ক্ষতিগ্রস্ত জনগোষ্ঠী, ফসল ও পশুপালন খাতের ওপর প্রভাব বিশ্লেষণের মাধ্যমে অভিযোজন চাহিদা চিহ্নিত করতে সহায়তা করে।
ঢাকা/এসবি
উৎস: Risingbd
কীওয়ার্ড: চ কর চ কর ক উন স ল সরক র জলব য় সমন ব জলব য
এছাড়াও পড়ুন:
আমানত রক্ষা করা ইসলামের সামাজিকতার সৌন্দর্য
আধুনিক বিশ্বে ক্রমবর্ধমান আত্মকেন্দ্রিকতার প্রভাবে মানুষের মধ্যে পারস্পরিক বিশ্বাস ও দায়িত্ববোধ দুর্বল হয়ে পড়ছে। এই প্রেক্ষাপটে ইসলামের একটি মৌলিক মূল্যবোধ—‘আমানত’—চিন্তা ও চর্চা থেকে প্রায় হারিয়ে যাচ্ছে।
অথচ আমানত শুধু একটি সামাজিক বা অর্থনৈতিক ধারণা নয়, বরং এটি একটি বিস্তৃত আত্মিক ও নৈতিক দায়িত্ব, যা আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা মানুষের ওপর অর্পণ করেছেন।
পবিত্র কোরআনে এই আমানতের গুরুত্ব অত্যন্ত জোরালোভাবে বর্ণিত হয়েছে: ‘নিশ্চয়ই আমরা আমানত পেশ করেছিলাম আসমান, জমিন ও পাহাড়ের সামনে, তারা তা বহন করতে অস্বীকৃতি জানাল এবং তা হতে ভীত ছিল; কিন্তু মানুষ তা বহন করল। নিশ্চয়ই সে ছিল অত্যন্ত জুলুমকারী ও মূর্খ।’ (সুরা আহযাব, আয়াত: ৭২)
এই আয়াতে আমানতের মর্যাদা ও এর ওজনের গভীরতা প্রকাশ পায়। আল্লাহর এই দায়িত্ব মানুষের ওপর অর্পিত হওয়া তার বিশেষত্বের প্রমাণ, তবে এটি একই সঙ্গে তার জন্য একটি বড় পরীক্ষা।
নিশ্চয়ই আমরা আমানত পেশ করেছিলাম আসমান, জমিন ও পাহাড়ের সামনে, তারা তা বহন করতে অস্বীকৃতি জানাল এবং তা হতে ভীত ছিল। কিন্তু মানুষ তা বহন করল।সুরা আহযাব, আয়াত: ৭২আমানতের ব্যাপকতা‘আমানত’ শব্দটির অর্থ শুধু আর্থিক বা সামাজিক বিশ্বাসের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। এটি একটি ব্যাপক ধারণা, যা মানুষের জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। আমানতের মধ্যে রয়েছে:
ব্যক্তিগত আচরণে সততা: কথায়, কাজে ও প্রতিশ্রুতি রক্ষায় সত্যবাদিতা।
সামাজিক দায়িত্ব: পরিবার, সমাজ ও সম্প্রদায়ের প্রতি দায়িত্ব পালন।
পরিবেশের প্রতি যত্ন: আল্লাহর সৃষ্টির খিলাফা হিসেবে প্রকৃতির প্রতি বিশ্বস্ত থাকা।
আধ্যাত্মিক আনুগত্য: আল্লাহর প্রতি পূর্ণ সমর্পণ ও তাঁর আদেশ পালন।
আমানত একটি ইবাদতের অংশ, যা শুধু দুনিয়ার জন্য নয়, বরং আখিরাতের জবাবদিহির ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ। এটি মানুষের নৈতিকতা, আধ্যাত্মিকতা ও সামাজিক সম্পর্কের ভিত্তি গড়ে তোলে।
আরও পড়ুনইসলামে আমানত ও প্রতিশ্রুতি রক্ষার গুরুত্ব২২ জুলাই ২০২২নবী–যুগে আমানতের উদাহরণইসলামের প্রাথমিক যুগে নবীজি (সা.)-এর প্রতিষ্ঠিত মদিনার সমাজ আমানতের একটি জীবন্ত উদাহরণ। মুহাজির ও আনসারদের মধ্যে যে অভূতপূর্ব ভ্রাতৃত্ব গড়ে উঠেছিল, তা আমানতের বাস্তব প্রয়োগ। আনসাররা তাদের ঘরবাড়ি, সম্পদ এবং এমনকি হৃদয়ের ভালোবাসা মুহাজিরদের সঙ্গে ভাগ করে নিয়েছিলেন।
এই সম্পর্ক শুধু সম্পদের বণ্টন নয়, বরং পারস্পরিক দায়িত্ব ও বিশ্বাসের একটি আদর্শ প্রতিষ্ঠা করেছিল। এমনকি আবদুর রহমান ইবনে আউফ (রা.)-এর সঙ্গে তাঁর আনসারি ভাই সা’দ ইবনে রাবী (রা.) তাঁর সম্পদের অর্ধেক এবং এমনকি তাঁর স্ত্রীদের একজনকে তালাক দিয়ে তাঁকে বিয়ে করার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। এই ত্যাগ ও বিশ্বাস আমানতের প্রকৃত চিত্র। (সহিহ বুখারি, হাদিস: ৩৭৮০)
মুহাজির ও আনসারদের মধ্যে যে অভূতপূর্ব ভ্রাতৃত্ব গড়ে উঠেছিল, তা আমানতের বাস্তব প্রয়োগ। আনসাররা তাদের ঘরবাড়ি, সম্পদ এবং এমনকি হৃদয়ের ভালোবাসা মুহাজিরদের সঙ্গে ভাগ করে নিয়েছিলেন।এই ভ্রাতৃত্বের মাধ্যমে মদিনার সমাজে একতা, সহানুভূতি ও পারস্পরিক সহযোগিতার ভিত্তি গড়ে উঠেছিল, যা আজও মুসলিম সমাজের জন্য একটি আদর্শ।
আধুনিক সমাজে আমানতের অবক্ষয়দুর্ভাগ্যবশত, আজকের সমাজে আমানতের চর্চা দুর্বল হয়ে পড়ছে। বিশেষ করে অভিবাসী মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে পারস্পরিক অবিশ্বাস, গোষ্ঠীবদ্ধতা ও সংকীর্ণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। মসজিদগুলোতে জাতিগত ও সাংস্কৃতিক বিভেদ, পারিবারিক স্বার্থপরতা এবং একে অপরের প্রতি সন্দেহ সমাজের ঐক্যকে ভঙ্গ করছে। ব্যবসায়িক ক্ষেত্রেও প্রায়ই দেখা যায়, অসৎ আচরণ, প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ ও বিশ্বাসের অপব্যবহার।
এমনকি ব্যক্তিগত জীবনেও ‘নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত থাকা’ একটি নতুন সামাজিক আদর্শ হয়ে উঠেছে। মানুষ অন্যের প্রতি দায়িত্ব পালনে আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে। এটি শুধু সামাজিক সম্পর্কের ক্ষেত্রেই নয়, বরং পরিবেশের প্রতি দায়িত্ববোধ: আল্লাহ তা’আলা মানুষকে এই পৃথিবীর খলিফা বানিয়েছেন, যার মধ্যে পরিবেশ ও প্রকৃতির প্রতি দায়িত্বও অন্তর্ভুক্ত।
কিন্তু আজকের উন্নয়নের নামে বনভূমি ধ্বংস, নদী ও বাতাসের দূষণ এবং প্রাণপ্রবাহের ক্ষতি আমানতের এই দিকটিকে উপেক্ষা করছে। কুরআনে আল্লাহ বলেছেন, ‘শান্তি প্রতিষ্ঠার পর পৃথিবীতে পুনরায় বিপর্যয় সৃষ্টি করো না।’ (সুরা আরাফ, আয়াত: ৫৬)
প্রকৃতির প্রতি আমাদের দায়িত্ব হলো এটিকে সংরক্ষণ করা, অপচয় রোধ করা এবং সৃষ্টির ভারসাম্য বজায় রাখা।
আরও পড়ুনপ্রলোভনের এই যুগে নিজেকে রক্ষার উপায়০২ আগস্ট ২০২৫আমানতের নষ্টের ভবিষ্যদ্বাণীনবীজি (সা.) আমানতের অবক্ষয় সম্পর্কে সতর্ক করে বলেছেন: ‘মানুষ ঘুমাবে আর আমানত তার হৃদয় থেকে উঠিয়ে নেওয়া হবে...এমন সময় আসবে যখন বলা হবে, অমুক গোত্রে একজন বিশ্বস্ত মানুষ আছে।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস: ৭০৮৬; সহিহ মুসলিম, হাদিস: ১৪৫)
এই হাদিসটি একটি গভীর সতর্কবাণী। এটি ইঙ্গিত করে যে একটি সময় আসবে যখন বিশ্বস্ততা এতটাই বিরল হয়ে পড়বে যে একজন আমানতদার ব্যক্তিকে ব্যতিক্রম হিসেবে গণ্য করা হবে। এই ভবিষ্যদ্বাণী আধুনিক সমাজের বাস্তবতার সঙ্গে মিলে যায়, যেখানে স্বার্থপরতা ও অবিশ্বাস বৃদ্ধি পাচ্ছে।
মানুষ ঘুমাবে আর আমানত তার হৃদয় থেকে উঠিয়ে নেওয়া হবে...এমন সময় আসবে যখন বলা হবে, অমুক গোত্রে একজন বিশ্বস্ত মানুষ আছে।সহিহ বুখারি, হাদিস: ৭০৮৬আমানতের পুনর্জাগরণের উপায়আমানতের মূল্যবোধকে পুনরায় জীবন্ত করতে হলে আমাদের ব্যক্তিগত ও সমষ্টিগতভাবে কিছু পদক্ষেপ নিতে হবে:
সত্যবাদিতা ও প্রতিশ্রুতি রক্ষা: কথা ও কাজে সততা বজায় রাখা এবং প্রতিশ্রুতি পূরণ করা।
দায়িত্বশীলতা ও সততা: পরিবার, সমাজ ও কর্মক্ষেত্রে দায়িত্বশীল আচরণ।
ন্যায়পরায়ণ আর্থিক আচরণ: ব্যবসা ও আর্থিক লেনদেনে স্বচ্ছতা ও বিশ্বস্ততা।
প্রকৃতির প্রতি যত্ন: পরিবেশ সংরক্ষণ, অপচয় রোধ ও সৃষ্টির ভারসাম্য রক্ষা।
পারস্পরিক সহযোগিতা: সম্প্রদায়ের মধ্যে ভ্রাতৃত্ব ও ঐক্য গড়ে তোলা।
আমানত শুধু একটি সামাজিক দায়িত্ব নয়, বরং এটি একটি ইবাদত, যা আল্লাহর প্রতি আমাদের আনুগত্যের প্রকাশ। এটি ব্যক্তি, সমাজ ও পরিবেশের মধ্যে ভারসাম্য ও ন্যায় প্রতিষ্ঠার মাধ্যম। আমানতের চর্চাকে পুনরুজ্জীবিত করার মাধ্যমে আমরা একটি দয়ালু, ন্যায়ভিত্তিক ও ঐক্যবদ্ধ মুসলিম সমাজ গড়ে তুলতে পারি। এটি আমাদের দুনিয়ার শান্তি ও আখিরাতের সাফল্যের পথ প্রশস্ত করবে।
আরও পড়ুনআখিরাতে বিশ্বাস সত্কর্মের অনুপ্রেরণা০৪ মে ২০১৮