ভূরাজনৈতিক প্রেক্ষাপট থেকে দেখতে গেলে, সাত বছর পর ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির আকস্মিক চীন সফরের ঘোষণা একটি উঁচুমানের কৌশল। মোদির এই পদক্ষেপের পেছনে যে ডোনাল্ড ট্রাম্পের শুল্ক আছে, সেটা কারোরই চোখ এড়িয়ে যাওয়ার কোনো কারণ নেই।

ট্রাম্প ভারতের ওপর ৫০ শতাংশ শুল্ক আরোপের ঘোষণা দিয়েছেন। এটি ব্রিকসের (ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত, চীন, দক্ষিণ আফ্রিকা) কোনো সদস্যের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের দেওয়া দ্বিতীয় সর্বোচ্চ শাস্তিমূলক শুল্ক।

প্রথম শাস্তির খড়গটা নেমে এসেছে ব্রাজিলের ওপর। কারণ, তারা ২০২২ সালে অভ্যুত্থান প্রচেষ্টার অভিযোগে সাবেক প্রেসিডেন্ট জইর বোলসোনারোকে বিচারের মুখোমুখি করেছে। দক্ষিণ আফ্রিকার ওপর শুল্ক শাস্তি চাপানো হয়েছে ৩০ শতাংশ। সাব-সাহারান আফ্রিকার দেশগুলোর মধ্যে এটি সর্বোচ্চ। নাইজেরিয়া, ঘানা, লেসোথো ও জিম্বাবুয়েকে মাত্র ১৫ শতাংশ শুল্ক ধরা হয়েছে।

এখন ভারতের ওপর যখন ৫০ শতাংশ শুল্কের বোঝা চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে, তখন মোদি ওয়াশিংটনের বদলে বেইজিং যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। মোদি সেখানে বহুপাক্ষিক সাংহাই কো-অপারেশন অর্গানাইজেশনের সম্মেলনে অংশ নেবেন। সম্মেলনটি শুরু হবে ৩১ আগস্ট।

ট্রাম্প অবশ্য ব্রিকসের সদস্যরাষ্ট্রগুলোর ওপর আরও ১০ শতাংশ শুল্ক বসানোর হুমকি দিয়েছেন। তার বড় কারণ হলো, ব্রিকস সদস্যরা ডলারকে বিশ্বের রিজার্ভ মুদ্রা হিসেবে সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছে। ট্রাম্প ব্রিকসের বিরুদ্ধে ‘আমেরিকা-বিরোধী নীতি’ অনুসরণের অভিযোগ তুলছেন।

গত মাসে ব্রিকসের সদস্যদেশগুলো ব্রাজিলে মিলিত হয়েছিল ডলারের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে পারে এমন একটি বিনিময় মুদ্রাকে বাস্তবে রূপ দেওয়ার উদ্দশ্য নিয়ে। কিন্তু ভারত ও চীনের মধ্যে বিরোধের কারণে সেটি প্রায় অসম্ভব বলে মনে হচ্ছিল।

জাপানের আর্থিক সেবা প্রদানকারী সংস্থা নোমুরা হোল্ডিংসের অর্থনীতিবিদদের মতে, ভারতের অস্থিতিশীল অর্থনীতির জন্য ৫০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করার মানে হচ্ছে, তা বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্রের ওপর কার্যত একটি ‘বাণিজ্যিক অবরোধ’ আরোপ করা। এটা এমন এক দেশের বিরুদ্ধে আরোপ করা হচ্ছে, যে দেশটি দীর্ঘদিন ধরে চীনের আঞ্চলিক উচ্চাভিলাষের বিপরীতে একটি পাল্টা শক্তি হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে।

সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে, শাস্তির এই খড়গ নেমে আসছে রাশিয়ার কারণে, যে দেশটির প্রতি দীর্ঘদিন ধরেই অনুরাগ পোষণ করে আসছিলেন ট্রাম্প।

ট্রাম্প এখন বুঝতে শুরু করেছেন যে ভ্লাদিমির পুতিন হোয়াইট হাউসকে প্রকাশ্যে অগ্রাহ্য করছেন। ফলে আপাতত তিনি মস্কোর বিরুদ্ধে অবস্থান নিচ্ছেন। আর এই মুহূর্তে ট্রাম্প প্রশাসন ভারতের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নিচ্ছে, তার কারণ হলো রাশিয়া থেকে সস্তায় তেল আমদানি করছে ভারত। ভারত বছরে প্রায় ২৭৫ বিলিয়ন ডলারের তেল মস্কো থেকে কিনছে বলে অনুমান করে হচ্ছে।

লন্ডনভিত্তিক সংস্থা ক্যাপিটাল ইকোনমিকসের অর্থনীতিবিদ শিলান বলেন, শাহ ভারত থেকে আমদানি করা পণ্যের ওপর প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ঘোষিত অতিরিক্ত ২৫ শতাংশ শুল্ক যদি বহাল থাকে, তবে উদীয়মান উৎপাদনকেন্দ্র হিসেবে ভারতের আকর্ষণ ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। ৫০ শতাংশ শুল্ক যথেষ্ট বড়, যা বাস্তবে প্রভাব ফেলতে পারে।

ফলে বিশ্বের পঞ্চম বৃহত্তম অর্থনীতি ভারত একটি অর্থনৈতিক অস্থিরতার মধ্যে ঢুকে পড়তে যাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র ভারতের সবচেয়ে বড় বাণিজ্যিক অংশীদার। ২০২৪ সালে ভারত যুক্তরাষ্ট্রে ৮৭ দশমিক ৪ বিলিয়ন ডলারের পণ্য রপ্তানি করেছে।

বাড়তি এই শুল্ক ভারতের অর্থনীতির কিছু খাত অন্য দেশের তুলনায় বেশি ঝুঁকিপূর্ণ।

সুইজারল্যান্ডের বহুজাতিক বিনিয়োগ ব্যাংক ও আর্থিক পরিষেবা প্রতিষ্ঠান ইউবিএসের অর্থনীতিবিদ তানভি গুপ্তা জৈন বলেন, আমরা মনে করি রত্ন ও গয়না, পোশাক, বস্ত্র এবং অন্যান্য রাসায়নিক পণ্য যুক্তরাষ্ট্রের শুল্কের বেশি প্রভাব পড়বে। এসব খাতে সরকারি সহায়তা দিতে হতে পারে।

কৌশলবিদ রজত আগরওয়াল বলেন, শেয়ারবাজারে শুল্কের প্রভাবে মুদ্রাবাজারে অস্থিরতা সৃষ্টি হচ্ছে, স্বল্পমেয়াদে যেটি বৈদেশিক বিনিয়োগপ্রবাহকে চাপে ফেলেছে।

ভারতের বিরুদ্ধে ট্রাম্পের এই অবস্থান তাঁর বাণিজ্যযুদ্ধকে দুর্বল করে দিতে পারে। এতে করে সি চিন পিং আর বাড়তি প্রণোদনা পাবেন, এই আশায় ট্রাম্পের সঙ্গে ‘মহা দর–কষাকষি’র বাণিজ্যচুক্তিতে আগ্রহী না–ও হতে পারেন।

জাপান, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও অন্যান্য দেশের সঙ্গে ট্রাম্প শুল্ক নিয়ে চুক্তি করার পর গত কয়েক দিনে নানা আলোচনা ও বিভ্রান্তি তৈরি হয়েছে। যেমন ২২ জুলাই জাপানের সঙ্গে চুক্তির পর থেকে দুই পক্ষই ১৫ শতাংশ শুল্কের নিয়ম-কানুন নিয়ে মতবিরোধে জড়ায়।

এদিকে নরেন্দ্র মোদি, রাজনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ কৃষকদের আশ্বস্ত করছেন যে তিনি ওয়াশিংটনের কাছে তাদের বিক্রি করবেন না। ভারতের রাজধানীতে কৃষি খাত–সংক্রান্ত এক সম্মেলনে মোদি বলেন, ‘আমি কখনোই কৃষক, পশুপালক ও জেলেদের স্বার্থে আপস করব না। আমি ব্যক্তিগতভাবে জানি, আমাকে এর জন্য বড় মূল্য চুকাতে হবে—আমি এর জন্য প্রস্তুত।’

ভারতের রপ্তানিমুখি শিল্প খাতগুলো উদ্বেগ প্রকাশ করছে। দেশটির রত্ন ও গয়না রপ্তানিকারকদের সংগঠন বিবৃতিতে বলেছে, ‘এই পদক্ষেপ ভারতের অর্থনীতির ওপর ব্যাপক প্রভাব ফেলবে—গুরুত্বপূর্ণ সরবরাহ শৃঙ্খলাগুলোয় ব্যাঘাত সৃষ্টি হবে, রপ্তানি থমকে যাবে এবং হাজারো লোকের জীবিকা ঝুঁকিতে পড়বে। আমরা সরকারের কাছে আশু পদক্ষেপ দাবি জানাচ্ছি।

ভারতের ওপর আরোপ করা ট্রাম্পের শুল্ক নিয়ে সবাই অবশ্য আতঙ্কিত নয়। লন্ডনভিত্তিক বহুজাতিক ব্যাংক বার্কলেজের অর্থনীতিবিদেরা লিখেছেন, ‘এটি ভারতের ওপর আরও দৃশ্যমান অর্থনৈতিক ক্ষতি করতে পারে, কিন্তু আমরা আগেও উল্লেখ করেছি যে ভারতের অর্থনীতির বেশির ভাগটা অভ্যন্তরীণ হওয়ায়, এ ব্যথাটা খুব বেশি হবে না।’

ভারতকে নিয়ে ট্রাম্পের নিজস্ব লক্ষ্য কী, সেটি ব্রিকস সদস্যদের কাছে স্পষ্ট হচ্ছে।

গত মাসে ব্রিকসের সদস্যদেশগুলো ব্রাজিলে মিলিত হয়েছিল ডলারের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে পারে এমন একটি বিনিময় মুদ্রাকে বাস্তবে রূপ দেওয়ার উদ্দশ্য নিয়ে। কিন্তু ভারত ও চীনের মধ্যে বিরোধের কারণে সেটি প্রায় অসম্ভব বলে মনে হচ্ছিল।

এখন ট্রাম্প যখন ভারত ও চীনকে একে অপরের কাছে ঠেলে দিচ্ছেন, এই গতিপথ দ্রুত বদলাতে পারে, যা ওয়াশিংটন এবং বিশ্বের জন্য অপ্রত্যাশিত হতে পারে।

উইলিয়াম পেসেক জাপানে বসবাসকারী সাংবাদিক ও লেখক

এশিয়া টাইমস থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে সংক্ষিপ্তাকারে অনূদিত

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: য ক তর ষ ট র ত র ওপর র জন য সদস য

এছাড়াও পড়ুন:

ছাত্র সংসদের দাবিতে ভাসানী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের দৃঢ অবস্থান

মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে (মাভাবিপ্রবি) কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (মাকসু) প্রতিষ্ঠার দাবিতে আমরণ ও প্রতীকী অনশন কর্মসূচি পালন করছেন শিক্ষার্থীরা।

সোমবার (১১ আগস্ট) বেলা  ১১টার দিকে প্রশাসনিক ভবন প্রাঙ্গণে অপরাধ তত্ত্ব ও পুলিশবিজ্ঞান বিভাগের স্নাতকোত্তর শ্রেণির শিক্ষার্থী আক্তারুজ্জামান সাজু আমরণ অনশন শুরু করেন। তার সঙ্গে সংহতি জানিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের আরো কয়েকজন শিক্ষার্থী প্রতীকী অনশনে অংশ নেন। 

মঙ্গলবার (১২ আগস্ট) দ্বিতীয় দিনের মতো কর্মসূচি চলছে। অনশনরত আক্তারুজ্জামান অসুস্থ হওয়ায় স্যালাইন দেওয়া হয়েছে।

শিক্ষার্থীরা জানান, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ৯ দফা দাবির অন্যতম হলো দেশের প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজে ছাত্র সংসদ প্রতিষ্ঠা। এই লক্ষ্যেই ২১ জুলাই তারা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কাছে দাবিপত্র দেন। কিন্তু নির্ধারিত সময় পেরিয়ে গেলেও রিজেন্ট বোর্ড থেকে কোনো সিদ্ধান্ত আসেনি।

পরবর্তীতে ২ আগস্ট প্রশাসনের সঙ্গে বৈঠকে ১০ আগস্টের মধ্যে রিজেন্ট বোর্ডে প্রস্তাবটি পাস করানোর আহ্বান জানানো হয়। তবে সেই সময়সীমা পেরিয়ে গেলেও দাবি বাস্তবায়িত হয়নি। 

আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা জানান, দাবি পূরণ না হওয়া পর্যন্ত  আমরণ অনশন চালিয়ে যাবেন।

অনশনস্থলে শিক্ষার্থীরা “ভাত নয়, আইন খাবো”, “তালা ভাঙছি, মাকসু আনবো”, “ইনকিলাব জিন্দাবাদ”সহ বিভিন্ন স্লোগান দিচ্ছেন। 

গতকাল রাত ১০টার দিকে অনশনরত শিক্ষার্থীদের শারীরিক অবস্থা পর্যবেক্ষণে এসে শিক্ষার্থী কল্যাণ ও পরামর্শদান কেন্দ্রের পরিচালক অধ্যাপক ড. মো. ফজলুল করীম বলেন, “শিক্ষার্থীদের দাবিটি পরবর্তী রিজেন্ট বোর্ডে তুলব। যদি তখনও সমাধান না আসে, তারা পরবর্তী কর্মসূচি নিতে পারেন। আমরা অনশন ভাঙানোর চেষ্টা করেছি এবং সার্বক্ষণিক নজরদারি রাখছি যেন কোনো নিরাপত্তা বা স্বাস্থ্যঝুঁকি না হয়।”

বিশ্ববিদ্যলয়ের প্রক্টর অধ্যাপক ড. মো. ইমাম হোসেন বলেন, “শিক্ষার্থীদের আবেদনের বিষয়ে প্রশাসন আলোচনা করেছে এবং একটি মিটিংও হয়েছে। আবেদনটি বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন অনুযায়ী কীভাবে বাস্তবায়ন করা যেতে পারে, সেই প্রক্রিয়া চলছে।”

ঢাকা/আবিদ/ইভা 

সম্পর্কিত নিবন্ধ