কিংমেকার ‘পি কে’ চাইছেন বিহারের রাজা হতে
Published: 22nd, October 2025 GMT
আগামী দিনে ভারতীয় রাজনীতি কোন খাতে বইবে, নভেম্বরের বিহার বিধানসভার নির্বাচন সেই হদিস দেবে। ভোটের ফল বোঝাবে, ৩৫ বছরের বিহারি ভোট-রাজনীতি দ্বিমুখী চরিত্র ছেড়ে প্রকৃত অর্থে ত্রিমুখী হবে কি না। ২০ বছর ধরে ৯ বারের সমাজতন্ত্রী মুখ্যমন্ত্রী নীতীশ কুমার রাজনৈতিক সন্ন্যাস নেবেন কি না, সম্ভবত তা–ও বোঝা যাবে। বয়সের ভার ও অসুস্থতার কারণে নীতীশ ন্যুব্জ। বিজেপির কেউ মুখ্যমন্ত্রী হয়ে বিহার শাসন করতে পারবেন কি না, সেটাও নির্ধারিত হবে এই ভোটে এবং অবশ্যই বোঝা যাবে, বিহার জিতে ‘ইন্ডিয়া’ জোট সর্বভারতীয় স্তরে মোদির বিজেপিকে কোণঠাসা করতে পারবে কি না।
উঁকিঝুঁকি মারা এতগুলো সম্ভাবনার অভিমুখ একাধিক হলেও এবার যাঁর উপস্থিতি সবার মনে নানাবিধ প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে, তাঁর নাম প্রশান্ত কিশোর পান্ডে ওরফে ‘পি কে’। ১০ বছর ধরে নামটি পরিচিতি পেয়েছে ভোট পরিচালনার দক্ষতার কারণে। ৪৮ বছরের এই বিহারি ব্রাহ্মণ, রাজনীতিসচেতন ভারতীয়রা যাঁকে ‘মাস্টার স্ট্র্যাটেজিক’ বা ভোটকুশলী হিসেবে জানে, পর্দার আড়াল থেকে বেরিয়ে এই প্রথম তিনি ভোটযুদ্ধে নেমেছেন অন্য রাজনৈতিক সংস্কৃতি তৈরির বাসনায়।
ভোটের বাকি মাত্র তিন সপ্তাহ। ৬ ও ১১ নভেম্বর দুই দফার ভোট। ফল ঘোষণা ১৪ তারিখ। অথচ এখনো সবচেয়ে বড় হেঁয়ালি হয়ে শীতের কুয়াশার মতো ঝুলে রয়েছেন পি কে। তাঁর উপস্থিতি নিয়ে হাজারটা প্রশ্ন। যাবতীয় রাজনৈতিক রহস্যও তাঁকে ঘিরেই।
কোনো ভোটে কোনো ব্যক্তিবিশেষকে নিয়ে এমন আগ্রহ বিরল। পি কে সেই আগ্রহ সঞ্চার করেছেন তাঁর কৃতিত্বের কারণে। ভোটকুশলী হিসেবে জাতীয় রাজনীতিতে তাঁর আবির্ভাব নরেন্দ্র মোদির হাত ধরে। ২০১৪ সালের লোকসভা ভোট তাঁর হাতেখড়ি। এর পর থেকে পলিটিক্যাল স্ট্র্যাটেজিক হিসেবে তাঁর গ্রাফ ঊর্ধ্বমুখী। মোদির দিল্লি জয়ের পর তিনি দায়িত্ব নেন পাঞ্জাবে কংগ্রেসের অমরিন্দর সিংয়ের নির্বাচনী প্রচারের। ২০১৫ সালে মুখ্যমন্ত্রী হন অমরিন্দর। ২০১৯ সালে অন্ধ্র প্রদেশে জগনমোহন রেড্ডি, ২০২০ সালে দিল্লিতে অরবিন্দ কেজরিওয়াল এবং ২০২১ সালে পশ্চিমবঙ্গে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ও তামিলনাড়ুতে এম কে স্ট্যালিনকে জেতাতে তাঁর কৌশল স্বীকৃত। ব্যর্থ হয়েছেন একবারই। ২০১৭ সালে। উত্তর প্রদেশ বিধানসভার ভোটে কংগ্রেসকে তিনি তরাতে পারেননি। সেই পি কে অন্তরাল থেকে বেরিয়ে কিংমেকারের ভূমিকা ছেড়ে নিজেই রাজা হতে চাইছেন। বিহারের ভাগ্যবিধাতা হতে তিন বছর আগে গড়েছেন ‘জন সুরাজ পার্টি’। তিন বছর ধরে রাজ্য চষেছেন। ২৪৩ আসনেই প্রার্থী দেবেন। যদিও জানিয়েছেন, নিজে প্রার্থী হবেন না; দলীয় প্রার্থীদের প্রচারের স্বার্থে।
এমন ঝুঁকি অনেকেই নেন। তাহলে পি কে-কে ঘিরে এত আগ্রহের কারণ কী? কারণটা তাঁর রাজনৈতিক প্রচার। তিন বছর ধরে নিরলস জনসম্পর্কের সময় একটা কথাই তিনি বলছেন—বিহারকে ঘুরে দাঁড়াতে হলে রাজনীতিকে জাতপাতের বেড়া ভেঙে এগোতে হবে। বিহারবাসীকে জাতের গণ্ডি ছেড়ে বেরিয়ে বুঝতে হবে, কারা কীভাবে তাদের ব্যবহার করছে। শোষণ করছে। জাতভিত্তিক রাজনীতির ধারাবাহিকতা ভেঙে নতুন রাজনৈতিক সংস্কৃতির জন্ম না দিলে বিহারিদের কষ্ট ঘুচবে না। তারা অন্যের হাতের পুতুল হয়েই নাচবে।
তিন বছর ধরে এসব বলে চলা পি কে এত বছরের ভোট পরিচালনার অভিজ্ঞতার আলোয় যা করতে চলেছেন, তাতে সফল হবেন কি না অজানা। তবে কয়েকটি বিষয় স্পষ্ট। প্রথমত, তাঁর প্রচারে উপচে পড়া জনতার ৮০ শতাংশ তরুণ। জাতপাতের আগল ভেঙে নতুন বিহার তারা গড়তে চায় কি না পরের কথা, পি কে যদিও তাদের চোখে স্বপ্ন দেখছেন।
দ্বিতীয়ত, ব্যক্তি বা নেতা হিসেবে পি কেই হয়ে উঠেছেন মিডিয়ার সেরা আকর্ষণ। তাঁর মতো এত সাক্ষাৎকার আর কেউ দিচ্ছেন না।
তৃতীয়ত, তিনি নিজেকে তৃতীয় শক্তি হিসেবে জাহির করেছেন। বলছেন, কাউকে হারিয়ে কাউকে জেতানো তাঁর লক্ষ্য নয়। তিনি চান বিহারকে জেতাতে। তাই ভোটের পর কোনো জোটের দিকে তিনি ঢলবেন না।
চতুর্থত, শুধু এসব বলা নয়, সদিচ্ছার প্রমাণও রাখছেন। মোদির বিজেপিকে যেমন রেয়াত করছেন না, তেমনই তুলাধোনা করছেন নীতীশ-লালু-তেজস্বী-রাহুলদের রাজনীতি। সমালোচনার ধার এতটাই যে সাধারণ মানুষ যেমন তা শুনতে পছন্দ করছে, তেমনই তা আকর্ষণ করছে মিডিয়াকেও। ফলে ভোটের প্রাক্কালে পি কে হয়ে উঠেছেন মূল আকর্ষণ।
রাজনৈতিক আক্রমণের নমুনা দিলে বিষয়টি বুঝতে সহজ হবে। মোদি সম্পর্কে বলছেন, উনি চান না বিহারে শিল্প হোক। কারণ, তা হলে গুজরাট, মহারাষ্ট্র, তামিলনাড়ু সস্তার শ্রমিক পাবে না। প্রধানমন্ত্রী গুজরাটে গিয়ে বুলেট ট্রেন চালানোর কথা বলেন, ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্ক তৈরির কথা বলেন, অথচ বিহারে বলেন সস্তায় আরও বেশি খাদ্য দেবেন। আরও বন্দে ভারত ট্রেন চালাবেন। আরও ট্রেন মানে আরও বেশি সস্তার বিহারি শ্রমিকের ভিন রাজ্যে পাড়ি দেওয়া। একের পর এক জনসভা ও সাক্ষাৎকারে মোদিকে আক্রমণ করে পি কে বলছেন, ১১ বছরে বিহারকে তিনি কিচ্ছুটি দেননি।
পি কে একটা সময় জেডিইউ নেতা নীতীশ কুমারের ঘর করেছিলেন। সহসভাপতি হয়েছিলেন। বেরিয়ে এসেছেন সাড়ে তিন বছর আগে। নীতীশ প্রসঙ্গে তিনি বলছেন, তাঁর রাজনীতি শেষ। আর মুখ্যমন্ত্রী হবেন না। এবার ২০টি আসনও জেডিইউ জিততে পারবে না। বলছেন, পরিতাপ এটাই, সৎ হয়েও যে সরকার নীতীশ চালাচ্ছেন, বিহারের ইতিহাসে তত দুর্নীতিগ্রস্ত সরকার কখনো আসেনি। কংগ্রেস সম্পর্কে বলছেন, বিহারে দলটার নিজস্ব বলতে কিছুই নেই। তারা লালু প্রসাদের উচ্ছিষ্টভোগী। লালুপুত্র তেজস্বী সম্পর্কে বলছেন, বাবার জঙ্গলরাজেই তিনি আবদ্ধ। পি কের দৃষ্টিতে তেজস্বী ও রাহুল দুজনেই টবে পরিচর্যা করা বাহারি গাছ।
ভোটের আবহে এসব কথা শুনতে ভালো লাগলেও পি কের ক্ষমতা ঘিরে দুটি প্রশ্ন বড় হয়ে উঠছে। প্রথমত, জনসমর্থনকে ভোটে পরিণত করার মতো সাংগঠনিক শক্তি তিনি আয়ত্ত করতে পেরেছেন কি না। দ্বিতীয়ত, প্রতিষ্ঠিত দলগুলোর দানখয়রাত নীতির মোকাবিলা কীভাবে করবেন। শাসক এনডিএ রাজ্যের ১ কোটি ২১ লাখ নারীকে স্বনির্ভর হতে এককালীন ১০ হাজার টাকা করে অনুদান দিচ্ছে। শিক্ষিত বেকার যুবাদের দিচ্ছে মাসিক ২ হাজার টাকা করে ভাতা। তেজস্বী প্রতি পরিবারের একজনকে সরকারি চাকরি দেবেন বলেছেন। পি কের প্রতিশ্রুতি সেখানে স্রেফ ‘পলায়ন’ রোধ।
বিহারের জনসংখ্যার ৭ শতাংশ পরিযায়ী শ্রমিক। ভিনরাজ্যে কাজের সন্ধানে যাওয়া তাঁর কাছে ‘পলায়ন’। শুধু এতে চিড়ে ভিজবে? এই পুঁজি নিয়ে রাজ্য দখলের স্বপ্ন দেখা কি আকাশকুসুম কল্পনা নয়? জবাবে পি কে বলেছেন, ‘হয় দেড় শ আসন পাব, নয়তো দশেরও কম। ফল যা–ই হোক, থেমে যাব না।’
কিছু পরিসংখ্যান জরুরি। গতবার এনডিএ ও ইন্ডিয়ার প্রাপ্ত ভোটের পার্থক্য ছিল মাত্র ১২ হাজার। ২০ কেন্দ্রে জয়–পরাজয়ের ব্যবধান ছিল ১ হাজারের কম ভোটে। ৩২ কেন্দ্রে ব্যবধান ৫ হাজার। কেন্দ্রপিছু ২ থেকে ১০ হাজার ভোট টানলে কার কপাল পুড়িয়ে কার হাসি চওড়া করবেন পি কে? তাঁর জবাব, প্রতিষ্ঠিতদের সর্বনাশ না হলে বিহারে পৌষ মাস আসবে না।
১৯৮৩ সালে অন্ধ্র প্রদেশের এন টি রাম রাও, ১৯৮৫ সালে আসামের প্রফুল্ল মহন্ত, ২০১৩ সালে দিল্লির অরবিন্দ কেজরিওয়ালের মতো ভোট-ভাগ্য নিয়ে পি কে কি হবেন বিহারের নতুন রংধনু? নাকি ‘ভোট–কাটুয়া’ সেজে এনডিএ বা ইন্ডিয়ার কাউকে ভাসাবেন, কাউকে ডোবাবেন?
সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায় প্রথম আলোর নয়াদিল্লি প্রতিনিধি
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ম খ যমন ত র র জন ত ক র র জন ত ত ন বছর বলছ ন
এছাড়াও পড়ুন:
আগামী শুক্র-শনিবার চলবে বিমানবন্দরের শুল্কায়ন কার্যক্রম
হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অগ্নিকাণ্ডের কারণে আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রম সচল রাখতে শুক্র ও শনিবার শুল্কায়ন কার্যক্রম পুরোদমে চলবে। ঢাকা কাস্টমস হাউসের সব শুল্ক দল তাদের নিজ নিজ অফিসে উপস্থিত থেকে কার্যক্রম চালাবে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) এই আদেশ জারি করেছে। বিমানবন্দরের কার্গো ভিলেজে অগ্নিকাণ্ডে কুরিয়ার সার্ভিস এবং আমদানি অংশে ব্যাপক ক্ষতি হওয়ায় এই বিশেষ ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।