মক্কা থেকে মদিনা: কালজয়ী হিজরতের বীরত্বগাথা
Published: 10th, December 2025 GMT
ইতিহাসের পাতায় এমন কিছু ঘটনা থাকে, যা কেবল অতীতেরই অংশ নয় বরং তা ভবিষ্যতের জন্য আলোকবর্তিকা। সাহাবিদের মক্কা থেকে মদিনায় হিজরত তেমনই এক কালজয়ী অধ্যায়। এটি ছিল শুধু এক পবিত্র ভূমি ত্যাগ করে অন্য ভূমিতে আশ্রয় গ্রহণের সাধারণ ঘটনা নয়; এটি ছিল দুনিয়ার সবকিছু উপেক্ষা করে ইমান রক্ষার এক মহাকাব্যিক সংগ্রাম।
এই যাত্রাপথে সাহাবিরা যে আত্মত্যাগ, সাহস ও ধৈর্যের নজির স্থাপন করেছেন, তা কিয়ামত পর্যন্ত মুমিনদের জন্য শিক্ষণীয় দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে।
হিজরতের মাধ্যমে সাহাবিরা প্রমাণ করেছেন, ইমানের মূল্য তাঁদের কাছে ধনসম্পদ, পরিবার বা জন্মভূমির চেয়ে অনেক বেশি।ইমানের ডাকে সর্বোচ্চ ত্যাগআল্লাহর পথে যখনই কোনো মানুষ সত্যের আহ্বান নিয়ে দাঁড়ায়, তখনই তাকে চরম প্রতিকূলতার সম্মুখীন হতে হয়। মক্কার মুশরিকদের সীমাহীন অত্যাচার যখন মুমিনদের জীবন দুর্বিষহ করে তুলল, তখন মহান আল্লাহ তাআলা তাঁদের জন্য হিজরতের অনুমতি দিলেন।
এই হিজরতের ঘটনাকে কোরআনে অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে তুলে ধরেছে। যাঁরা নিজ ভিটামাটি থেকে বিতাড়িত হয়েছেন, তাঁদের বিষয়ে আল্লাহ বলছেন, ‘যাদেরকে নিজেদের বাড়িঘর থেকে অন্যায়ভাবে বের করে দেওয়া হয়েছে শুধু এ কারণে যে, তারা বলত, “আমাদের প্রতিপালক হলেন আল্লাহ।”’ (সুরা হজ, আয়াত: ৪০)
হিজরতের মাধ্যমে সাহাবিরা প্রমাণ করেছেন, ইমানের মূল্য তাঁদের কাছে ধনসম্পদ, পরিবার বা জন্মভূমির চেয়ে অনেক বেশি।
আল্লাহ তাআলা হিজরতকারী এই মহান ব্যক্তিত্বদের ‘সত্যবাদী’ উপাধিতে ভূষিত করে বলেছেন, ‘এই সম্পদ অভাবগ্রস্ত মুহাজিরদের জন্য, যারা নিজেদের ঘরবাড়ি ও ধনসম্পদ থেকে বিতাড়িত হয়েছে। তারা আল্লাহর অনুগ্রহ ও সন্তুষ্টি কামনা করে এবং আল্লাহ ও তাঁর রাসুলকে সাহায্য করে। তারাই হলো সত্যবাদী।’ (সুরা হাশর, আয়াত: ৮)
আরও পড়ুনআবিসিনিয়ায় প্রথম হিজরত১৫ এপ্রিল ২০২৩প্রখ্যাত চিন্তাবিদ মোহাম্মদ আল-গাজালি এই ঐতিহাসিক মুহূর্তের এক অসাধারণ বর্ণনা দিয়েছেন। তিনি বলেন, হিজরত কেবল এক স্থান থেকে আরেক স্থানে যাওয়া নয়, বরং এটা ছিল এমন এক মানুষের প্রতি জুলুম, যার শিকড় নিজ জন্মভূমিতে গভীরভাবে প্রোথিত ছিল। তাকে তার সম্পদ, স্বার্থ ও জীবন বিপন্ন করে শুধু নিজেকে বাঁচানোর জন্য বাধ্য করা হয়েছে। অজানা ভবিষ্যতের দিকে পরিবারের সদস্যদের নিয়ে যাত্রা করেও তাদের চেহারায় ছিল প্রশান্তির দীপ্তি। তিনি জোর দিয়ে বলেন, ‘এর কারণ হলো ইমান—যা পাহাড়ের চেয়েও ভারী!’ (ফিকহুস সিরাহ, পৃষ্ঠা: ১২৭, দারুল মাআরিফ, কায়রো, ১৯৫৮)
এই ইমান ছিল একমাত্র আল্লাহর প্রতি, যিনি আসমান ও জমিনের সবকিছুর মালিক।
‘আমাদের ছেলেকে যেহেতু তোমরা তার বাবার সঙ্গে যেতে দিচ্ছ না, সেহেতু আমরাও তাকে মায়ের কাছে থাকতে দেব না।’ ফলে তারা শিশু সালামাকে টানাটানি করে নিয়ে গেল, এতে তার হাত মচকে যায়।ত্যাগের অমর চিত্রগুলোসাহাবিদের হিজরতের প্রতিটি ঘটনা একেকটি ত্যাগ ও সাহসের উপাখ্যান:
১.
আবু সালামা ও উম্মে সালামার (রা.) মর্মান্তিক বিচ্ছেদ
প্রথম মদিনায় হিজরতকারী ছিলেন আবু সালামা ইবনে আব্দুল আসাদ (রা.)। তিনি তাঁর স্ত্রী উম্মে সালামা (রা.) ও তাঁদের শিশুপুত্র সালামাকে নিয়ে যাত্রা করেন। কিন্তু পথে উম্মে সালামার গোত্র বনু মুগিরা তাঁদের পথ আটকায়। তারা বলল, ‘আবু সালামার ওপর আমাদের জোর খাটল না, কিন্তু আমাদের বংশের মেয়েকে তুমি কোথায় নিয়ে যাচ্ছ?’
তারা বলপূর্বক উম্মে সালামাকে কেড়ে নিল।
অন্যদিকে আবু সালামার গোত্র বনু আব্দুল আসাদ বলল, ‘আমাদের ছেলেকে যেহেতু তোমরা তার বাবার সঙ্গে যেতে দিচ্ছ না, সেহেতু আমরাও তাকে মায়ের কাছে থাকতে দেব না।’ ফলে তারা শিশু সালামাকে টানাটানি করে নিয়ে গেল, এতে তার হাত মচকে যায়।
ফলস্বরূপ উম্মে সালামা তাঁর স্বামী, সন্তান ও জন্মভূমি সবকিছু থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে এক বছর ধরে মক্কায় বন্দী থাকলেন। এক বছর পর আল্লাহর ইচ্ছায় তিনি মুক্তি লাভ করে শিশু সালামাকে নিয়ে মদিনায় স্বামীর কাছে পৌঁছান। (ইবনুল কাইয়্যিম, জাদুল মাআদ, ৩/ ৯, মুআস্সাসাতুর রিসালাহ, বৈরুত, ১৯৮৬)
আবু সালামা (রা.) এরপরও কারও জন্য অপেক্ষা না করে আল্লাহর পথে একাকী হিজরত করেন।
২. বনু জাহাশের (রা.) শূন্য বাড়ি
আব্দুল্লাহ ইবনে জাহাশ তাঁর ভাই আবু আহমদ আব্দুল্লাহ (রা.), যিনি ছিলেন দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী ও কবি, এবং তাঁদের স্ত্রীদের নিয়ে হিজরত করেন। তাঁদের স্ত্রীদের মধ্যে ছিলেন নবীজির স্ত্রী জয়নব বিনতে জাহাশ এবং আব্দুল্লাহ ইবনে জাহাশের স্ত্রী উম্মে হাবিব বিনতে জাহাশ (রা.)।
তাঁদের হিজরতের ফলে মক্কায় তাঁদের বিশাল বাড়িটি তালাবদ্ধ ও জনশূন্য হয়ে পড়ে। মক্কার এক প্রান্তে যাওয়ার সময় উবাহ ইবনে রবিআ, আব্বাস ইবনে আব্দুল মুত্তালিব ও আবু জাহেল সেই শূন্য বাড়ির পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন। উবাহ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, ‘পৃথিবীর কোনো বাড়িই চিরদিন টিকে থাকে না, একদিন না একদিন বিপদ আসবেই।’ তখন আবু জাহেল আব্বাসকে বললেন, ‘এটা তোমার ভাতিজার কাজ, সে আমাদের ঐক্য ভেঙে দিয়েছে, আমাদের দলে বিভেদ সৃষ্টি করেছে।’
আবু জাহেলের এই কথাগুলো স্বৈরাচারীদের মানসিকতা তুলে ধরে—তারা নিজেরাই জুলুম করে, কিন্তু দোষ চাপায় অত্যাচারিতদের ওপর, যারা কেবল দাসত্ব প্রত্যাখ্যান করেছে।
আরও পড়ুনমদিনায় হিজরত: ইসলামের ৬টি মাইলফলক০২ জুলাই ২০২৫৩. ওমর ও আইয়াশ (রা.)-এর কৌশল
ওমর ইবনে খাত্তাব (রা.) আরও প্রায় বিশজন সাহাবিকে নিয়ে প্রকাশ্যে হিজরতের ঘোষণা দিয়ে মদিনার দিকে রওনা হন। তাঁর কাফেলার অন্যতম ছিলেন আইয়াশ ইবনে আবি রাবিআ। ওমর, আইয়াশ ও হিশাম ইবনে আস একটি নির্দিষ্ট স্থানে একত্র হয়ে হিজরতের পরিকল্পনা করেছিলেন, কিন্তু হিশাম আটকে পড়ায় তাঁরা দুজন যাত্রা করেন।
তাঁরা মদিনার কোবায় পৌঁছানোর পর আবু জাহেল এবং তাঁর ভাই হারিস সেখানে এসে আইয়াশকে বললেন, ‘তোমার মা শপথ করেছেন যে তোমাকে না দেখা পর্যন্ত তিনি মাথায় চিরুনি লাগাবেন না এবং ছায়াতেও যাবেন না।’
আইয়াশ এতে বিচলিত হলেন।
ওমর (রা.) সতর্ক করে বললেন, ‘আইয়াশ, তারা তোমাকে তোমার ইসলাম থেকে বিচ্যুত করতে চায়, সাবধান! আল্লাহর কসম, যদি তোমার মায়ের মাথায় উকুন হতো, তবে তিনি চিরুনি ব্যবহার করতেনই, আর যদি মক্কার গরম অসহনীয় হতো, তবে তিনি ছায়াতে যেতেনই।’
কিন্তু আইয়াশ তাঁর মায়ের শপথ রক্ষার কথা বলে আবু জাহেলের সঙ্গে যেতে রাজি হলেন।
ওমর (রা.) তাঁকে একটি দ্রুতগামী উটনি দিলেন এবং বললেন, ‘যদি তাদের সন্দেহজনক মনে হয়, তবে এই উটনীতে দ্রুত পালিয়ে যেও।’
নবীজি (সা.) তাঁর এই ত্যাগের কথা জানতে পেরে বললেন, ‘সুহাইব লাভবান হয়েছে, সুহাইব লাভবান হয়েছে!’পথে আবু জাহেল কৌশল করে আইয়াশের উটনিটি চাইল। আইয়াশ নেমে গেলে তারা দুজন তাকে ধরে বেঁধে মক্কায় প্রবেশ করায় এবং ঘোষণা দেয়, ‘মক্কাবাসী, আমরা আমাদের নির্বোধকে শাস্তি দিয়েছি, তোমরাও তোমাদের নির্বোধদের এভাবে শাস্তি দাও।’ (ইবনুল আসির, আল-কামিল ফি আত-তারিখ, ১/৫৭৪, দারুস সাদির, বৈরুত, ২০০৩)
৪. সুহাইব রুমির ‘লাভজনক’ ব্যবসা
সুহাইব ইবনে সিনান রুমি (রা.) যখন হিজরতের ইচ্ছা করলেন, তখন কোরাইশরা বাধা দিয়ে বলল, ‘তুমি আমাদের কাছে দরিদ্র ছিলে, এখন প্রচুর সম্পদের মালিক হয়েছ। তুমি তোমার সম্পদ ও জীবন দুটোই নিয়ে যাবে, তা হবে না।’ সুহাইব (রা.) বললেন, ‘যদি আমি আমার সব সম্পদ তোমাদের দিয়ে দিই, তবে কি তোমরা আমার পথ ছেড়ে দেবে?’
তারা রাজি হলো।
সুহাইব (রা.) হাসিমুখে তাঁর সব সম্পদ অবিশ্বাসীদের হাতে তুলে দিয়ে কেবল নিজের জীবন নিয়ে হিজরত করলেন। নবীজি (সা.) তাঁর এই ত্যাগের কথা জানতে পেরে বললেন, ‘সুহাইব লাভবান হয়েছে, সুহাইব লাভবান হয়েছে!’ (ইবনুল আসির, আল-কামিল ফি আত-তারিখ, ১/৫৭৪, দারুস সাদির, বৈরুত, ২০০৩)
নবীজির দৃষ্টিতে, ইমান বাঁচানোর জন্য দুনিয়ার সবকিছু ছেড়ে দেওয়াটাই ছিল প্রকৃত লাভ।
আরও পড়ুনমহানবী (সা.)–র হিজরত মদিনায় হলো যে কারণে২৯ জুন ২০২৫উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: হ জরত ক হ জরত র আল ল হ র জন য কর ছ ন মদ ন য় আম দ র বলল ন আরও প আইয় শ সবক ছ
এছাড়াও পড়ুন:
মক্কা থেকে মদিনা: কালজয়ী হিজরতের বীরত্বগাথা
ইতিহাসের পাতায় এমন কিছু ঘটনা থাকে, যা কেবল অতীতেরই অংশ নয় বরং তা ভবিষ্যতের জন্য আলোকবর্তিকা। সাহাবিদের মক্কা থেকে মদিনায় হিজরত তেমনই এক কালজয়ী অধ্যায়। এটি ছিল শুধু এক পবিত্র ভূমি ত্যাগ করে অন্য ভূমিতে আশ্রয় গ্রহণের সাধারণ ঘটনা নয়; এটি ছিল দুনিয়ার সবকিছু উপেক্ষা করে ইমান রক্ষার এক মহাকাব্যিক সংগ্রাম।
এই যাত্রাপথে সাহাবিরা যে আত্মত্যাগ, সাহস ও ধৈর্যের নজির স্থাপন করেছেন, তা কিয়ামত পর্যন্ত মুমিনদের জন্য শিক্ষণীয় দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে।
হিজরতের মাধ্যমে সাহাবিরা প্রমাণ করেছেন, ইমানের মূল্য তাঁদের কাছে ধনসম্পদ, পরিবার বা জন্মভূমির চেয়ে অনেক বেশি।ইমানের ডাকে সর্বোচ্চ ত্যাগআল্লাহর পথে যখনই কোনো মানুষ সত্যের আহ্বান নিয়ে দাঁড়ায়, তখনই তাকে চরম প্রতিকূলতার সম্মুখীন হতে হয়। মক্কার মুশরিকদের সীমাহীন অত্যাচার যখন মুমিনদের জীবন দুর্বিষহ করে তুলল, তখন মহান আল্লাহ তাআলা তাঁদের জন্য হিজরতের অনুমতি দিলেন।
এই হিজরতের ঘটনাকে কোরআনে অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে তুলে ধরেছে। যাঁরা নিজ ভিটামাটি থেকে বিতাড়িত হয়েছেন, তাঁদের বিষয়ে আল্লাহ বলছেন, ‘যাদেরকে নিজেদের বাড়িঘর থেকে অন্যায়ভাবে বের করে দেওয়া হয়েছে শুধু এ কারণে যে, তারা বলত, “আমাদের প্রতিপালক হলেন আল্লাহ।”’ (সুরা হজ, আয়াত: ৪০)
হিজরতের মাধ্যমে সাহাবিরা প্রমাণ করেছেন, ইমানের মূল্য তাঁদের কাছে ধনসম্পদ, পরিবার বা জন্মভূমির চেয়ে অনেক বেশি।
আল্লাহ তাআলা হিজরতকারী এই মহান ব্যক্তিত্বদের ‘সত্যবাদী’ উপাধিতে ভূষিত করে বলেছেন, ‘এই সম্পদ অভাবগ্রস্ত মুহাজিরদের জন্য, যারা নিজেদের ঘরবাড়ি ও ধনসম্পদ থেকে বিতাড়িত হয়েছে। তারা আল্লাহর অনুগ্রহ ও সন্তুষ্টি কামনা করে এবং আল্লাহ ও তাঁর রাসুলকে সাহায্য করে। তারাই হলো সত্যবাদী।’ (সুরা হাশর, আয়াত: ৮)
আরও পড়ুনআবিসিনিয়ায় প্রথম হিজরত১৫ এপ্রিল ২০২৩প্রখ্যাত চিন্তাবিদ মোহাম্মদ আল-গাজালি এই ঐতিহাসিক মুহূর্তের এক অসাধারণ বর্ণনা দিয়েছেন। তিনি বলেন, হিজরত কেবল এক স্থান থেকে আরেক স্থানে যাওয়া নয়, বরং এটা ছিল এমন এক মানুষের প্রতি জুলুম, যার শিকড় নিজ জন্মভূমিতে গভীরভাবে প্রোথিত ছিল। তাকে তার সম্পদ, স্বার্থ ও জীবন বিপন্ন করে শুধু নিজেকে বাঁচানোর জন্য বাধ্য করা হয়েছে। অজানা ভবিষ্যতের দিকে পরিবারের সদস্যদের নিয়ে যাত্রা করেও তাদের চেহারায় ছিল প্রশান্তির দীপ্তি। তিনি জোর দিয়ে বলেন, ‘এর কারণ হলো ইমান—যা পাহাড়ের চেয়েও ভারী!’ (ফিকহুস সিরাহ, পৃষ্ঠা: ১২৭, দারুল মাআরিফ, কায়রো, ১৯৫৮)
এই ইমান ছিল একমাত্র আল্লাহর প্রতি, যিনি আসমান ও জমিনের সবকিছুর মালিক।
‘আমাদের ছেলেকে যেহেতু তোমরা তার বাবার সঙ্গে যেতে দিচ্ছ না, সেহেতু আমরাও তাকে মায়ের কাছে থাকতে দেব না।’ ফলে তারা শিশু সালামাকে টানাটানি করে নিয়ে গেল, এতে তার হাত মচকে যায়।ত্যাগের অমর চিত্রগুলোসাহাবিদের হিজরতের প্রতিটি ঘটনা একেকটি ত্যাগ ও সাহসের উপাখ্যান:
১. আবু সালামা ও উম্মে সালামার (রা.) মর্মান্তিক বিচ্ছেদ
প্রথম মদিনায় হিজরতকারী ছিলেন আবু সালামা ইবনে আব্দুল আসাদ (রা.)। তিনি তাঁর স্ত্রী উম্মে সালামা (রা.) ও তাঁদের শিশুপুত্র সালামাকে নিয়ে যাত্রা করেন। কিন্তু পথে উম্মে সালামার গোত্র বনু মুগিরা তাঁদের পথ আটকায়। তারা বলল, ‘আবু সালামার ওপর আমাদের জোর খাটল না, কিন্তু আমাদের বংশের মেয়েকে তুমি কোথায় নিয়ে যাচ্ছ?’
তারা বলপূর্বক উম্মে সালামাকে কেড়ে নিল।
অন্যদিকে আবু সালামার গোত্র বনু আব্দুল আসাদ বলল, ‘আমাদের ছেলেকে যেহেতু তোমরা তার বাবার সঙ্গে যেতে দিচ্ছ না, সেহেতু আমরাও তাকে মায়ের কাছে থাকতে দেব না।’ ফলে তারা শিশু সালামাকে টানাটানি করে নিয়ে গেল, এতে তার হাত মচকে যায়।
ফলস্বরূপ উম্মে সালামা তাঁর স্বামী, সন্তান ও জন্মভূমি সবকিছু থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে এক বছর ধরে মক্কায় বন্দী থাকলেন। এক বছর পর আল্লাহর ইচ্ছায় তিনি মুক্তি লাভ করে শিশু সালামাকে নিয়ে মদিনায় স্বামীর কাছে পৌঁছান। (ইবনুল কাইয়্যিম, জাদুল মাআদ, ৩/ ৯, মুআস্সাসাতুর রিসালাহ, বৈরুত, ১৯৮৬)
আবু সালামা (রা.) এরপরও কারও জন্য অপেক্ষা না করে আল্লাহর পথে একাকী হিজরত করেন।
২. বনু জাহাশের (রা.) শূন্য বাড়ি
আব্দুল্লাহ ইবনে জাহাশ তাঁর ভাই আবু আহমদ আব্দুল্লাহ (রা.), যিনি ছিলেন দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী ও কবি, এবং তাঁদের স্ত্রীদের নিয়ে হিজরত করেন। তাঁদের স্ত্রীদের মধ্যে ছিলেন নবীজির স্ত্রী জয়নব বিনতে জাহাশ এবং আব্দুল্লাহ ইবনে জাহাশের স্ত্রী উম্মে হাবিব বিনতে জাহাশ (রা.)।
তাঁদের হিজরতের ফলে মক্কায় তাঁদের বিশাল বাড়িটি তালাবদ্ধ ও জনশূন্য হয়ে পড়ে। মক্কার এক প্রান্তে যাওয়ার সময় উবাহ ইবনে রবিআ, আব্বাস ইবনে আব্দুল মুত্তালিব ও আবু জাহেল সেই শূন্য বাড়ির পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন। উবাহ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, ‘পৃথিবীর কোনো বাড়িই চিরদিন টিকে থাকে না, একদিন না একদিন বিপদ আসবেই।’ তখন আবু জাহেল আব্বাসকে বললেন, ‘এটা তোমার ভাতিজার কাজ, সে আমাদের ঐক্য ভেঙে দিয়েছে, আমাদের দলে বিভেদ সৃষ্টি করেছে।’
আবু জাহেলের এই কথাগুলো স্বৈরাচারীদের মানসিকতা তুলে ধরে—তারা নিজেরাই জুলুম করে, কিন্তু দোষ চাপায় অত্যাচারিতদের ওপর, যারা কেবল দাসত্ব প্রত্যাখ্যান করেছে।
আরও পড়ুনমদিনায় হিজরত: ইসলামের ৬টি মাইলফলক০২ জুলাই ২০২৫৩. ওমর ও আইয়াশ (রা.)-এর কৌশল
ওমর ইবনে খাত্তাব (রা.) আরও প্রায় বিশজন সাহাবিকে নিয়ে প্রকাশ্যে হিজরতের ঘোষণা দিয়ে মদিনার দিকে রওনা হন। তাঁর কাফেলার অন্যতম ছিলেন আইয়াশ ইবনে আবি রাবিআ। ওমর, আইয়াশ ও হিশাম ইবনে আস একটি নির্দিষ্ট স্থানে একত্র হয়ে হিজরতের পরিকল্পনা করেছিলেন, কিন্তু হিশাম আটকে পড়ায় তাঁরা দুজন যাত্রা করেন।
তাঁরা মদিনার কোবায় পৌঁছানোর পর আবু জাহেল এবং তাঁর ভাই হারিস সেখানে এসে আইয়াশকে বললেন, ‘তোমার মা শপথ করেছেন যে তোমাকে না দেখা পর্যন্ত তিনি মাথায় চিরুনি লাগাবেন না এবং ছায়াতেও যাবেন না।’
আইয়াশ এতে বিচলিত হলেন।
ওমর (রা.) সতর্ক করে বললেন, ‘আইয়াশ, তারা তোমাকে তোমার ইসলাম থেকে বিচ্যুত করতে চায়, সাবধান! আল্লাহর কসম, যদি তোমার মায়ের মাথায় উকুন হতো, তবে তিনি চিরুনি ব্যবহার করতেনই, আর যদি মক্কার গরম অসহনীয় হতো, তবে তিনি ছায়াতে যেতেনই।’
কিন্তু আইয়াশ তাঁর মায়ের শপথ রক্ষার কথা বলে আবু জাহেলের সঙ্গে যেতে রাজি হলেন।
ওমর (রা.) তাঁকে একটি দ্রুতগামী উটনি দিলেন এবং বললেন, ‘যদি তাদের সন্দেহজনক মনে হয়, তবে এই উটনীতে দ্রুত পালিয়ে যেও।’
নবীজি (সা.) তাঁর এই ত্যাগের কথা জানতে পেরে বললেন, ‘সুহাইব লাভবান হয়েছে, সুহাইব লাভবান হয়েছে!’পথে আবু জাহেল কৌশল করে আইয়াশের উটনিটি চাইল। আইয়াশ নেমে গেলে তারা দুজন তাকে ধরে বেঁধে মক্কায় প্রবেশ করায় এবং ঘোষণা দেয়, ‘মক্কাবাসী, আমরা আমাদের নির্বোধকে শাস্তি দিয়েছি, তোমরাও তোমাদের নির্বোধদের এভাবে শাস্তি দাও।’ (ইবনুল আসির, আল-কামিল ফি আত-তারিখ, ১/৫৭৪, দারুস সাদির, বৈরুত, ২০০৩)
৪. সুহাইব রুমির ‘লাভজনক’ ব্যবসা
সুহাইব ইবনে সিনান রুমি (রা.) যখন হিজরতের ইচ্ছা করলেন, তখন কোরাইশরা বাধা দিয়ে বলল, ‘তুমি আমাদের কাছে দরিদ্র ছিলে, এখন প্রচুর সম্পদের মালিক হয়েছ। তুমি তোমার সম্পদ ও জীবন দুটোই নিয়ে যাবে, তা হবে না।’ সুহাইব (রা.) বললেন, ‘যদি আমি আমার সব সম্পদ তোমাদের দিয়ে দিই, তবে কি তোমরা আমার পথ ছেড়ে দেবে?’
তারা রাজি হলো।
সুহাইব (রা.) হাসিমুখে তাঁর সব সম্পদ অবিশ্বাসীদের হাতে তুলে দিয়ে কেবল নিজের জীবন নিয়ে হিজরত করলেন। নবীজি (সা.) তাঁর এই ত্যাগের কথা জানতে পেরে বললেন, ‘সুহাইব লাভবান হয়েছে, সুহাইব লাভবান হয়েছে!’ (ইবনুল আসির, আল-কামিল ফি আত-তারিখ, ১/৫৭৪, দারুস সাদির, বৈরুত, ২০০৩)
নবীজির দৃষ্টিতে, ইমান বাঁচানোর জন্য দুনিয়ার সবকিছু ছেড়ে দেওয়াটাই ছিল প্রকৃত লাভ।
আরও পড়ুনমহানবী (সা.)–র হিজরত মদিনায় হলো যে কারণে২৯ জুন ২০২৫