বিশ্ব মানবাধিকার দিবস আজ বুধবার। এ বছর দিবসের প্রতিপাদ্য ‘মানবাধিকার আমাদের প্রতিদিনের অপরিহার্য বিষয়’। অথচ বাংলাদেশে জাতীয় মানবাধিকার কমিশন এক বছরের বেশি সময় ধরে অকার্যকর।

আওয়ামী লীগের দেড় দশকের শাসনামলে মানবাধিকার লঙ্ঘনের চরম সব ঘটনার পর জুলাই অভ্যুত্থান মানুষকে করে তুলেছিল আশাবাদী। কিন্তু অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় আসার পর গত বছরের নভেম্বরে মানবাধিকার কমিশনের তৎকালীন চেয়ারম্যান কামাল উদ্দিন আহমেদসহ সব সদস্যকে পদত্যাগ করতে হয়। অভিযোগ রয়েছে, তাঁদের পদত্যাগে বাধ্য করা হয়। আওয়ামী লীগ আমলে এই মানবাধিকার কমিশনের ভূমিকাও অবশ্য ছিল প্রশ্নবিদ্ধ।

এরপর গত মার্চে আইন উপদেষ্টা অধ্যাপক আসিফ নজরুল মানবাধিকার কমিশন আইন সংস্কার করে মাসখানেকের মধ্যে নতুন কমিশন গঠনের আশ্বাস দিয়েছিলেন। কিন্তু তারপর আট মাস গড়িয়ে গেলেও মানবাধিকার কমিশন এখনো গঠিত হয়নি। এর মধ্যে এক মাসের বেশি সময় আগে মানবাধিকার কমিশন অধ্যাদেশ জারি হয়। নতুন আইনের অনেক বিষয় মানবাধিকারকর্মীরা ইতিবাচক দৃষ্টিতে দেখলেও কিছু বিষয় নিয়ে প্রশ্নও তৈরি হয়েছে।

সার্বিক মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী শাহদীন মালিক প্রথম আলোকে বলেন, ‘জুলাই চেতনার মূল বিষয় ছিল রাষ্ট্রের পীড়নের হাত থেকে যথাসম্ভব সুরক্ষা। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে তা হয়নি।’

মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) হিসাব অনুযায়ী, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে অক্টোবর মাস—এই ১০ মাসে যতজন গণপিটুনিতে নিহত হয়েছেন, গত পাঁচ বছরের কোনো বছরে তা ঘটেনি।

মানবাধিকার পরিস্থিতি

অন্তর্বর্তী সরকার গুমসহ মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনার বিচারে ইতিবাচক পদক্ষেপ নিলেও মব আক্রমণ, পিটিয়ে হত্যার মতো ঘটনার সংখ্যা বৃদ্ধি বড় প্রশ্ন তৈরি করেছে।

মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) হিসাব অনুযায়ী, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে অক্টোবর মাস—এই ১০ মাসে যতজন গণপিটুনিতে নিহত হয়েছেন, গত পাঁচ বছরের কোনো বছরে তা ঘটেনি।

আসকের হিসাব অনুযায়ী, গত জানুয়ারি থেকে অক্টোবর পর্যন্ত গণপিটুনিতে নিহত হন ১৬৫ জন। ২০২১ সালে এই সংখ্যা ছিল ২৮ জন, ২০২২ সালে ৩৬ জন, ২০২৩ সালে ৫১ জন, ২০২৪ সালে ১২৮ জন। ২০২৪ সালের মাঝামাঝিতে গণ-অভ্যুত্থানের পর অন্তর্বর্তী সরকার আসে। এ সরকারের আমলে অর্থাৎ ২০২৪ সালের আগস্ট থেকে শুরু করে চলতি বছরের অক্টোবর পর্যন্ত ২৬১ জন গণপিটুনিতে নিহত হয়েছেন।

‘মব’ সৃষ্টি করে চাঁদাবাজি, আক্রমণ, ঘেরাও, নারীদের হেনস্তা করার নানা অভিযোগ এই সময়ে ছিল আলোচিত। এসব ঘটনা প্রতিরোধে সরকারের নির্লিপ্ততার অভিযোগ যেমন রয়েছে, তেমনি দায়িত্বশীল কারও কারও বক্তব্য এর প্রতি সমর্থনসূচক বলে সমালোচনাও ওঠে।

জুলাই চেতনার মূল বিষয় ছিল রাষ্ট্রের পীড়নের হাত থেকে যথাসম্ভব সুরক্ষা। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে তা হয়নি।শাহদীন মালিক, জ্যেষ্ঠ আইনজীবী, সুপ্রিম কোর্ট

আসকের জ্যেষ্ঠ সমন্বয়কারী আবু আহমেদ ফয়জুল কবির প্রথম আলোকে বলেন, কোথাও মব তৈরি করে চাঁদাবাজি করা হচ্ছে, আবার কোথাও মুক্তিযোদ্ধাকে হেনস্তা করা হচ্ছে, কোথাও নারীর পোশাকের স্বাধীনতা ও খেলাধুলার অধিকার হরণ করার চেষ্টা হচ্ছে, কোথাও শিল্প-সংস্কৃতির অধিকার রোধ করার চেষ্টা করা হচ্ছে। এটা রাষ্ট্রীয় শৃঙ্খলার ওপর সরাসরি আঘাত।

অন্তর্বর্তী সরকারের সময় গুম ও বিচারবহির্ভূত হত্যার সংখ্যা (১৪ মাসে ৪০ জন) কমে এলেও অজ্ঞাতনামা লাশ উদ্ধারের সংখ্যা বেড়েছে। মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশনের (এমএসএফ) হিসাব অনুযায়ী, ২০২৩ সালে দেশের অজ্ঞাত লাশ উদ্ধারের সংখ্যা ছিল ৩৫২। ২০২৪ সালে ছিল ৫০৪ জন। আর চলতি বছরের নভেম্বর মাস পর্যন্ত সংখ্যাটি দাঁড়িয়েছে ৫৮৬।

এমএসএফের নির্বাহী পরিচালক সাইদুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘আগে এসব লাশের পরিচয় মিলত। কিন্তু এখন পুলিশ বা কেউ তা নিয়ে কিছু বলে না। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কাউকেও কিছু বলতে শুনিনি।’

সন্ত্রাসবিরোধী আইন, বিশেষ ক্ষমতা আইনের অপপ্রয়োগের অভিযোগ অন্তর্বর্তী সরকারের বিরুদ্ধেও উঠেছে।

কারা হেফাজতে মৃত্যুও বাড়ছে দেশে। আসকের হিসাব অনুযায়ী, চলতি বছরের অক্টোবর মাস পর্যন্ত ৮৩ জন কারা হেফাজতে মারা গেছেন। গত বছর ছিল ৬৫ জন, ২০২৩ সালে ১০৬ জন এবং ২০২২ সালে ৬৫ জন। অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে মোট মারা গেছেন ১১২ জন।

ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপর নিপীড়নও অব্যাহত রয়েছে। হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের হিসাব অনুযায়ী, ২০২৪ সালের ৪ আগস্ট থেকে চলতি বছরের ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত দেশে ২ হাজার ৬৭৩টি সংখ্যালঘু নিপীড়নের ঘটনা ঘটে। এর মধ্যে ৮২ হত্যা, ৪৪টি ধর্ষণের ঘটনা।

ঐক্য পরিষদের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক মনীন্দ্র কুমার নাথ প্রথম আলোকে বলেন, সংখ্যালঘুদের হামলা কখনোই থামেনি। তবে বর্তমান সরকার ধর্মীয় উগ্রবাদকে আশকারা দিয়ে পরিস্থিতি ভয়ানক করে তুলেছে। বাংলাদেশের ক্যাথলিক সম্প্রদায়ের আর্চবিশপ বিজয় ডি ক্রুজ প্রথম আলোকে বলেন, বাংলাদেশের খ্রিষ্টান সম্প্রদায় এখন সত্যিই অনিরাপদ বোধ করছে।

সন্ত্রাসবিরোধী আইন, বিশেষ ক্ষমতা আইনের অপপ্রয়োগের অভিযোগ অন্তর্বর্তী সরকারের বিরুদ্ধেও উঠেছে।

ক্ষমতার বেশির ভাগ সময় এই সরকার মানবাধিকার কমিশনকে অকার্যকর রেখেছে। এখন একটি আইন সংশোধন করে আর বিস্তর মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা নির্লিপ্তভাবে দেখে সময় পার করছে অন্তর্বর্তী সরকার।সাঈদ আহমেদ, বাংলাদেশ ব্যুরোপ্রধান, এসএএফএইচআর

নতুন অধ্যাদেশ

মানবাধিকার সুরক্ষার লক্ষ্য নিয়ে জারি হয়েছে জাতীয় মানবাধিকার কমিশন অধ্যাদেশ, ২০২৫। গত ৩০ অক্টোবর উপদেষ্টা পরিষদে তা চূড়ান্ত অনুমোদনের পর আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল বলেছিলেন, আগে মানবাধিকার কমিশন দুর্বল ছিল; নিয়োগ পদ্ধতিতে ত্রুটি এবং এখতিয়ারে মারাত্মক ঘাটতি ছিল। নতুন অধ্যাদেশের লক্ষ্য হলো কমিশনকে সত্যিকারের ক্ষমতাসম্পন্ন প্রতিষ্ঠানে পরিণত করা, যাতে এটি মানবাধিকার লঙ্ঘন রোধে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে।

কমিশন আগে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অপরাধ নিয়ে কোনো তদন্ত করতে পারত না। সরকারের কোনো দপ্তরের কাছে কোনো বিষয়ে ব্যাখ্যা বা প্রতিবেদন চাইলে তা পাওয়ার কোনো বাধ্যবাধকতা ছিল না। নতুন অধ্যাদেশে সেই ক্ষমতা পেয়েছে কমিশন।

এসব ভালো কিছু বিষয় অধ্যাদেশে থাকলেও এর কার্যকারিতা নিয়ে কিছু প্রশ্ন উঠেছে। প্রথমত, পরবর্তী সরকার এই অধ্যাদেশ পাস না করলে কী হবে? দ্বিতীয়ত, নির্বাচন ফেব্রুয়ারিতে হওয়ার কথা থাকায় তার আগে হয়তো নতুন কমিশন হবে না।

কলম্বোভিত্তিক দক্ষিণ এশিয়ার মানবাধিকারকর্মীদের নেটওয়ার্কের (এসএএফএইচআর) বাংলাদেশ ব্যুরোপ্রধান সাঈদ আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, ক্ষমতার বেশির ভাগ সময় এই সরকার মানবাধিকার কমিশনকে অকার্যকর রেখেছে। এখন একটি আইন সংশোধন করে আর বিস্তর মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা নির্লিপ্তভাবে দেখে সময় পার করছে অন্তর্বর্তী সরকার। এটা একধরনের দায় মোচন।

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: হ স ব অন য য় ম নব ধ ক র স র ম নব ধ ক র প রথম আল ক গণপ ট ন ত ২০২৪ স ল সরক র র ক র যকর বর ম স র ঘটন আহম দ ক ষমত বছর র ন আইন

এছাড়াও পড়ুন:

অন্তর্বর্তী সরকার দুর্নীতি দমনে কতটা সফল

২০২৪ সালের ৫ আগস্ট গণ-অভ্যুত্থানে স্বৈরশাসক শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর ৮ আগস্ট অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার রাষ্ট্রক্ষমতা গ্রহণ করে। কয়েক দিনের মধ্যেই সরকার অনেকগুলো সংস্কার কমিটি গঠন করে। দুর্নীতি দমনে সরকারের করণীয় সম্পর্কে সুপারিশ দেওয়ার দায়িত্ব প্রদান করা হয় ড. ইফতেখারুজ্জামানের নেতৃত্বাধীন কমিটিকে। ওই বছরের ডিসেম্বরে কমিটি তাদের সুপারিশমালা সরকারের কাছে জমা দেয়।

আমার কাছে মনে হয়েছিল, এই কমিটি দুর্নীতি সমস্যাটির সমাধানে খুব সাহসী সুপারিশ প্রণয়ন করতে পারেনি। এরপরও সরকার সুপারিশগুলোর বাস্তবায়নে নিষ্ঠার সঙ্গে এগিয়ে যাবে বলেই আশা করেছিলাম। কিন্তু প্রতিবেদন জমা দেওয়ার এগারো মাস পার হওয়ার পর সুপারিশ বাস্তবায়নে সরকার ডাহা ফেল করেছে বলেই মনে করি।

দুর্নীতি বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন অর্জনে ব্যর্থতার জন্য প্রধানত দায়ী। বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বিজয় অর্জনের মাধ্যমে স্বাধীন দেশ হিসেবে যাত্রা শুরু করেছে। আর ভিয়েতনাম যুক্তরাষ্ট্রকে চরম রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে পরাজিত করে অর্থনৈতিক উন্নয়নের পথে যাত্রা শুরু করেছে ১৯৭৫ সালের সেপ্টেম্বরে।

আরও পড়ুনরাজনীতি ও আমলাতন্ত্রে সংস্কার ছাড়া দুর্নীতি দমন অসম্ভব০৮ ডিসেম্বর ২০২৪

লজ্জাজনক পরাজয় মেনে নিয়ে দক্ষিণ ভিয়েতনাম থেকে ১৯৭৫ সালে পালাতে হয়েছিল যুক্তরাষ্ট্রকে। দুই দশকের বিধ্বংসী যুদ্ধে বিজয় অর্জনের পর ভিয়েতনাম বাংলাদেশের মতো বিশ্বের সবচেয়ে দরিদ্র দেশ হিসেবে বিবেচিত হতো। ১৯৭৫ সালে সমাজতান্ত্রিক ভিয়েতনাম যখন বিজয়ী দেশ হিসেবে যাত্রা শুরু করেছিল, তখন ‘জ্বলে পুড়ে–মরে ছারখার/ তবু মাথা নোয়াবার নয়’—সুকান্তের এই অবিস্মরণীয় কবিতার লাইনটি আক্ষরিকভাবে প্রযোজ্য ভিয়েতনামের জনগণের ক্ষেত্রে। এতৎসত্ত্বেও ভিয়েতনাম কখনোই কোনো দেশের কাছে মাথানত করেনি, ভিক্ষার জন্য হাত পাতেনি। এমনকি অনুদান ও ‘সফট লোনের’ আশায় জাতিসংঘের স্বল্পোন্নত দেশের ক্যাটাগরিতে অন্তর্ভুক্ত হতেও আবেদন করেনি।

অথচ কী নিদারুণ কষ্টকর ছিল ১৯৭৫-পরবর্তী বছরগুলোয় ভিয়েতনামের জনগণের জীবন! ভিয়েতনামের জনগণের মাথাপিছু জিডিপি ১৯৭৪ সালে ছিল মাত্র ৬৫ ডলার। ১৯৮৬ সালে ‘দোই মোই’ সংস্কার কার্যক্রম গ্রহণের আগে ১৯৮৫ সালে তা ছিল ২৮৫ ডলার। অথচ ২০২৫ সালে আইএমএফের প্রাক্কলন অনুযায়ী, ভিয়েতনামের মোট জিডিপি ৪৯০ বিলিয়ন ডলার। দেশটির মাথাপিছু প্রকৃত জিডিপি ৪ হাজার ৮০৬ ডলারে পৌঁছে গেছে, যেটা ‘মিরাকল’ বলা হচ্ছে। ক্রয়ক্ষমতার সমতার ভিত্তিতে ভিয়েতনামের মাথাপিছু জিডিপি পৌঁছে গেছে ১৭ হাজার ৪৮৪ পিপিপি ডলারে।

২০২৪ সালে ভিয়েতনামের মাত্র ২ শতাংশ জনগণ দারিদ্র্যসীমার নিচে অবস্থান করছে। অথচ ২০২৫ সালের জুনে বাংলাদেশের মাথাপিছু জিডিপি ছিল ২ হাজার ৮২০ ডলার, আর ২০২৫ সালের নভেম্বর মাসে বাংলাদেশের ২৪ শতাংশ জনগণ দারিদ্র্যসীমার নিচে অবস্থান করছে বলে জানিয়েছে বিশ্বব্যাংক। ২০২২ সালে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসাবে এই অনুপাত ছিল ১৮ দশমিক ৭ শতাংশ।

আরও পড়ুনসরকারি কর্মচারীদের দুর্নীতি কি সরকার নিজেই ঠেকাতে চায়০৬ জুলাই ২০২৪

প্রাইমারি শিক্ষা ও বৃত্তিমূলক (ভোকেশনাল) শিক্ষাকে সবচেয়ে বেশি অগ্রাধিকার দিয়ে ভিয়েতনাম ২০০০ সালের মধ্যেই তার পুরো জনসংখ্যাকে শতভাগ শিক্ষিত করে তুলেছে। জনগণের বিশাল একটি অংশকে প্রযুক্তিগত দক্ষতা অর্জনে সফল করে তুলেছে। দেশটির জনগণের শতভাগ ২০২৫ সালে স্বাস্থ্যবিমার আওতায় সেবা পেয়ে চলেছে। অর্থনৈতিক উন্নয়নের সুফলকে কয়েকটি নগরে কেন্দ্রীভূত না করে দেশটি গ্রামীণ জনগণের মধ্যে উন্নয়নের সুফল পৌঁছে দিতে পেরেছে। এখন ভিয়েতনামে প্রতিবছর বৈদেশিক বিনিয়োগের প্রবাহ দাঁড়াচ্ছে ২০-২৫ বিলিয়ন ডলার।

এই ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক গতিশীলতার পেছনের চাবিকাঠি হলো, ভিয়েতনামে দুর্নীতির প্রকোপ অনেক কম, দেশটির শ্রমশক্তি বাংলাদেশের চেয়ে অনেক শিক্ষিত, দক্ষ ও পরিশ্রমী। ভিয়েতনামের ভৌত অবকাঠামো উন্নয়ন চমকপ্রদ। বন্দর, মহাসড়ক ও সুলভ গণপরিবহনের ক্ষেত্রে ভিয়েতনাম দ্রুত আধুনিকায়নে সফল একটি দেশ।

তৈরি পোশাক রপ্তানিতে দেশটি এখন বাংলাদেশকে হটিয়ে মাঝেমধ্যে চীনের পর বিশ্বের দ্বিতীয় অবস্থান দখল করে নিচ্ছে। ইলেকট্রনিকস পণ্য রপ্তানিতে এখন সিঙ্গাপুরের পর ভিয়েতনাম দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় দ্বিতীয় অবস্থানে উঠে এসেছে। চাল রপ্তানিতে থাইল্যান্ডকে হটিয়ে ভিয়েতনাম ভারতের পর বিশ্বের দ্বিতীয় অবস্থানে উঠে এসেছে। ব্রাজিলের পর কফি রপ্তানিতে দেশটি বিশ্বে দ্বিতীয় স্থানে উঠে এসেছে। সাড়ে ৯ কোটি জনসংখ্যার দেশ ভিয়েতনামের মোট রপ্তানি আয় বাংলাদেশের চেয়ে কয়েক গুণ বেশি। ২০২৪ সালে ভিয়েতনামের রপ্তানি আয় ছিল ৪০৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার।

সাধারণ জনগণ তাদের দৈনন্দিন জীবনে এখনো দুর্নীতির প্রকোপে জর্জরিত। আওয়ামী লীগের পতনের পর অনেক জায়গায় বিএনপির নেতা-কর্মীরা চাঁদাবাজিতে মেতে ওঠায় জনগণের নাভিশ্বাস উঠছে। ভূমিসংক্রান্ত প্রতিটি ক্ষেত্রে দুর্নীতির প্রকোপ আগের মতোই রয়ে গেছে। কাস্টমস, ভ্যাট ও আয়কর বিভাগের প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতিতে কোনো আঁচড়ই পড়েনি। সরকারি অনেক অফিসেই সেবা পেতে হলে আগের মতো ঘুষ দিতে হচ্ছে। বিচার বিভাগের ঘুষ-দুর্নীতির প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা আগের মতোই বহাল রয়ে গেছে।

ভিয়েতনামের অর্থনৈতিক মিরাকলের যে সংক্ষিপ্ত বর্ণনা দেওয়া হলো, তার প্রধান উদ্দেশ্যই হলো এই কথা বলা যে বাংলাদেশের তুলনামূলক পশ্চাৎপদতার জন্য সবচেয়ে বেশি দায়ী এখানকার দুর্নীতির অব্যাহত তাণ্ডব। ২০০১ থেকে ২০০৫ সাল বাংলাদেশ বার্লিনভিত্তিক দুর্নীতি গবেষণা সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের দুর্নীতির ধারণা সূচকে পরপর পাঁচবার বিশ্বে চ্যাম্পিয়ন ছিল। ২০২৪ সালেও দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে আফগানিস্তানের পর সবচেয়ে বেশি দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে বাংলাদেশ। অতএব অন্তর্বর্তী সরকারের সংস্কার মিশনে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব পাওয়া সমীচীন ছিল দুর্নীতি দমন।

কিন্তু জনমনে ইতিমধ্যে ধারণা সৃষ্টি হয়েছে যে সরকার সাংবিধানিক সংস্কার কিংবা নির্বাচনব্যবস্থার সংস্কারে যতখানি আন্তরিক, তার তুলনায় দুর্নীতি দমনে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণে অনীহা দেখিয়ে চলেছে। আমরা বুঝতে পারি, দেড় বছরের শাসনকালে অন্তর্বর্তী সরকার দুর্নীতির বিরুদ্ধে সংগ্রামে খুব বেশি সফলতা দেখাতে পারবে না। কিন্তু সংগ্রাম শুরু করতে বাধা কোথায়? দুর্নীতির বিরুদ্ধে তারা কঠোর সংগ্রাম শুরু করে এগিয়ে নিয়ে গেলে ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচিত সরকার ক্ষমতায় এসে ওই সংগ্রাম চালিয়ে নিতে বাধ্য হবে না? বাংলাদেশে শেখ হাসিনার আমলে বেপরোয়া দুর্নীতি, পুঁজি–লুণ্ঠন ও পুঁজি পাচারের সংস্কৃতি চালু হয়েছিল। 

আরও পড়ুনপরস্পর যোগসাজশে যেভাবে দুর্নীতি হয়ে থাকে২০ আগস্ট ২০২৪

শেখ হাসিনার পতনের পর অন্তর্বর্তী সরকারের একটি শ্বেতপত্রে দাবি করা হয়েছে, ২০০৯ থেকে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট পর্যন্ত বাংলাদেশ থেকে মোট ২৩৪ বিলিয়ন ডলার বিদেশে পাচার হয়ে গেছে। কিন্তু শুধু শেখ হাসিনার দুর্নীতির ভয়াবহতা বর্ণনা করলেই হবে না, গত ১৫ মাসে সমাজকে দুর্নীতিমুক্ত করতে অন্তর্বর্তী সরকার কী কী ‘সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ’ গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করেছে, সেই প্রশ্নটাও আসবে?

সরকারের প্রধান উপদেষ্টা এবং বেশির ভাগ উপদেষ্টা দুর্নীতি করেন না বলে জনমনে বিশ্বাস জন্মেছে; কিন্তু প্রত্যেক উপদেষ্টার নিয়ন্ত্রণাধীন মন্ত্রণালয়গুলোয় দুর্নীতি দমনে কী কী পদক্ষেপ গৃহীত ও বাস্তবায়িত হয়েছে, সেই ব্যাপারে একটি শ্বেতপত্র প্রণয়ন এখন সময়ের দাবি বলে মনে করি। 

সাধারণ জনগণ তাদের দৈনন্দিন জীবনে এখনো দুর্নীতির প্রকোপে জর্জরিত। আওয়ামী লীগের পতনের পর অনেক জায়গায় বিএনপির নেতা-কর্মীরা চাঁদাবাজিতে মেতে ওঠায় জনগণের নাভিশ্বাস উঠছে।

ভূমিসংক্রান্ত প্রতিটি ক্ষেত্রে দুর্নীতির প্রকোপ আগের মতোই রয়ে গেছে। কাস্টমস, ভ্যাট ও আয়কর বিভাগের প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতিতে কোনো আঁচড়ই পড়েনি। সরকারি অনেক অফিসেই সেবা পেতে হলে আগের মতো ঘুষ দিতে হচ্ছে। বিচার বিভাগের ঘুষ-দুর্নীতির প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা আগের মতোই বহাল রয়ে গেছে।

ঘুষ-দুর্নীতির জন্য কোনো স্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারীর চাকরি গত ১৫ মাসে যাওয়ার কোনো খবর পত্রপত্রিকায় পড়েছি বলে মনে পড়ছে না। দুর্নীতি দমন কমিশন সাবেক সরকারের অনেক কর্তাব্যক্তির বিরুদ্ধে মামলা শুরু করলেও কর্মরত কোনো কর্মকর্তা বা কর্মচারীর বিরুদ্ধে মামলা শুরু করেছে বলে খবর প্রকাশিত হচ্ছে না।

দেশের সংবিধানে কিছু ত্রুটি থাকার কারণে শেখ হাসিনা স্বৈরাচারী শাসন জারি করতে পেরেছিলেন, দুর্নীতি-পুঁজি লুণ্ঠন-পুঁজি পাচার যার প্রধান বৈশিষ্ট্যে পরিণত হয়েছিল। কিন্তু দেশের ‘এক নম্বর সমস্যা’ দুর্নীতি, তাই দুর্নীতি দমনকে অগ্রাধিকার না দেওয়াটা অন্তর্বর্তী সরকারের বড় ভুল বলে মনে করি।

মইনুল ইসলাম অর্থনীতিবিদ ও অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

* মতামত লেখকের নিজস্ব

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • বেগম রোকেয়া: মৃত্যুর প্রায় এক শ বছর পরেও কেন প্রাসঙ্গিক
  • অন্তর্বর্তী সরকার দুর্নীতি দমনে কতটা সফল
  • ইসলামী ব্যাংকের বার্ষিক সাধারণ সভা ১১ ডিসেম্বর
  • যুদ্ধবিরতি ভঙ্গ করে দক্ষিণ লেবাননে ব্যাপক বিমান হামলা ইসরায়েলের
  • আমাদের কেউ ম্যান্ডেট দেয়নি, কত সময়ের মধ্যে নির্বাচন দিতে হবে: সাখাওয়াত হোসেন
  • ঢাকার সাত কলেজ নিয়ে যে ব্যাখ্যা দিল শিক্ষা মন্ত্রণালয়
  • জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অনার্স ৪র্থ বর্ষের ইনকোর্স পরীক্ষাসংক্রান্ত জরুরি বিজ্ঞপ্তি
  • ৫ বছরে বিদেশি ঋণ বেড়েছে ৪২%
  • মূল্যস্ফীতি আবার বাড়ল, নভেম্বরে এই হার ৮.২৯ শতাংশ