১৯৭১ এর জুনের শেষ সপ্তাহে দেরাদুন এর চকরাতায় ট্রেনিং শেষ করে একসঙ্গে দুইটি ব্যাচের সদস্য আগরতলা হয়ে ঢাকায় ঢুকি। স্কোয়াড দুটির নেতা ছিলেন- কামরুল হাসান খসরু ও মোস্তফা মহসিন মন্টু। আমি মন্টুর স্কোয়াডে ছিলাম। তিনি একটি স্বোয়াড তিনটি ভাগে ভাগ করলেন। এক ভাগের দায়িত্ব দিলেন আমাকে। আমার শেল্টার ছিল ডেমরার মাতুয়াইল। একদিন হঠাৎ করে ভারী অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে ডেমরা এলাকার মাতুয়াইল আর  পোস্তাগোলা হয়ে ফতুল্লা এলাকা ঘেরাও করে পাক আর্মি।


আমি যে বাড়িতে ছিলাম বাড়ির কর্তা মসজিদে ফজর নামাজ পড়তে গিয়ে দেখেন পাকবাহিনী গ্রাম ঘিরে ফেলেছে।ফিরে এসে আমাকে ঘুম থেকে জাগালেন। আমি বাড়ি থেকে বের হয়ে যে পথ দিয়ে পালাতে চেষ্টা করি, সেখানেই পাক- বাহিনীর অবস্থান। অগত্যা আমি ফিরে এলাম। বাড়ির কর্ত্রীকে আমি আপা বলে ডাকতাম- তিনি আমাকে অসুস্থতার ভান করে বিছানায় শুয়ে থাকতে বললেন আর বিছানার পাশে কিছু ওষুধের বোতল রেখে দিলেন। এরপর এক বালতি পানি এনে আমার মাথায় পানি দিতে থাকলেন।

আরো পড়ুন:

শরীরে লুকিয়ে রেখেছিলেন গোপন নথি

৮ ডিসেম্বর হানাদারমুক্ত হয়েছিল কুষ্টিয়ার যেসব স্থান

পাক সেনা বাড়িতে তল্লাশি শুরু করলো। আমার বাড়ির মালিকের কাছে জানতে চাইলো আমার কী হয়েছে? বাড়ির কর্তা চোস্ত উর্দুতে বললেন ‘বোখার’। পাশের বাড়ির এক ছেলে আর তার বাবা পাক-সেনাদের দেখে ভয়ে দৌড়ে পালাতে চেষ্টা করে, বাবা-ছেলেকে গুলি করে মেরে ফেলে পাক সেনা।  বাবা ও ছেলেকে গুলি করে হত্যা করার পরে নিহত ব্যক্তির স্ত্রীকে মুরগি ধরে দিতে বলে। স্বামী সন্তানের লাশ পড়ে থাকলো আর উঠানে ভাত ছিটিয়ে মোরগ ধরে দিলেন সেই স্বামী ও সন্তান হারানো নারী। কি নির্মম পৈশাচিকতা! আমি বেঁচে যাই আপার তাৎক্ষণিক বুদ্ধিমত্তা আর গৃহকর্তার চোস্ত উর্দু বলার কারণে।

নারায়ণগঞ্জের পাগলায় দেলপাড়া স্কুলে আর্মি ক্যাম্প ছিল।ঢাকা শহর প্রতিরক্ষার জন্য পাক- বাহিনী ঢাকার  প্রবেশস্থলে ঘাঁটি তৈরি করে।জুলাই মাসে সিদ্ধান্ত নেই— এই ক্যাম্পে অতর্কিত আক্রমণ করে আমরা অস্ত্র ছিনিয়ে নিব। অস্ত্র সংগ্রহ করতে হলে ক্যাম্পে প্রবেশ করে অস্ত্র ছিনিয়ে আনতে হবে। ব্যাপারটা সহজ ছিল না।এই ক্যাম্পে প্রতিরক্ষা বিষয় খোঁজ খবর করতে শুরু করি।ক্যাম্পের আশপাশের মানুষদের ওরা বিভিন্ন কাজে নিয়োজিত করতো। কাজ করার বাহানায় তারা ক্যাম্পে প্রবেশ করতে পারতো। শেষে তাদের কাছ থেকেই পাক-সেনাদের খোঁজ নিতে শুরু করি। জানতে পারি স্কুলের উপর তলায় গার্ড রুমে দুজন সেন্ট্রি পাহারায় থাকে, তাদের হাতে থাকে এলএমজি। নিচের তলায় রান্না ঘরই হলো তাদের অস্ত্র রাখার জায়গা।
আমরা ক'জন— কিবরিয়া, কবির, ফজলু, কেমু, নাজিম, সামাদ ক্যাম্পের কাছে অবস্থান করতে থাকি।পাকসেনাদের জন্য ট্রাক ভর্তি রেশন এসেছিলো।  সামাদ তাদের ট্রাকের সামনে দাঁড়াতেই ট্রাক থেকে মালামাল খালাস করতে ওকে ডেকে নেয় পাক সেনারা। আমরাও তাই চেয়েছিলাম। সামাদ যাতে ভালো করে ভেতরটা দেখে আসে। সামাদ মাল খালাস করে দেওয়ারপর, তাকে পারিশ্রমিক হিসাবে এক কেজি চাল দেয় তারা।

আমরা আক্রমণের প্ল্যান করলাম।মাতুয়াইল স্কুলে এক্সারসাইজ করলাম, কারণ ঐ দুটো স্কুলের গঠন প্রায় একই রকম।হিসাব করলাম কত সময় লাগবে।কত গুলি খরচ হবে, অস্ত্র যদি নিতে পারি, অস্ত্রগুলো কাছাকাছি কোথায় লুকিয়ে রাখা যাবে, যদি ঢোকার আগে প্রতিরোধ হয়, তাহলে গোলাগুলি করে তাহলে কীভাবে ফিরবো আর আমরা কী ভাবে প্রতিরোধ করবো ইত্যাদি। 

জুলাই এর শেষ সপ্তাহ ২৯/৩০ তারিখ হবে। রাতে, আমরা আর্মি ক্যাম্পের স্কুলের পাশে একটি বাড়িতে প্রবেশ করি।বাড়িটি ছিল একজন মুচির। হিন্দু দলিত সম্প্রদায়ের হওয়ায় ক্যাম্পের পাক সেনাদের সাথে সে সম্পর্ক গড়তে পেরেছিলো। আমাদের দেখে বাড়ির লোক হতভম্ব হয়ে, ভয়ে কাঁপতে থাকে। তাকে চুপ থাকতে বলি। আমাদের মধ্যে দু'জন গেলো দুটো বাঙ্কার আক্রমণ করতে। আমরা পাঁচজন ক্যাম্পের কাছে লুকিয়ে থাকি। ব্যাঙ্কারে গ্রেনেড ছোড়ার শব্দে আমরা সিগন্যাল পেয়ে ভেতরে প্রবেশ করি।

ক্যাম্পে পাক আর্মি ঘুমিয়েছিল। জেগে উঠে অস্ত্র ধরতে যাবে তৎক্ষণাৎ গ্রেনেড থ্রো করে কবির আর কিবরিয়া। দোতলা থেকে পাক আর্মি নেমে আসছিল, সিঁড়ির গোড়া থেকে গুলি করলেও ভয় ছিল। বেশি সময় থাকা যাবেনা। বাঙ্কারে গ্রেনেড থ্রো করাতে কাজ হয়েছিল। আমরা ককটেলের বোতলে পেট্রোল ভরে, বোতলে হাই এক্সক্লুসিভে ডিটোনেটর বসিয়েছিলাম। আমাদের কাছে গুলি ও গ্রেনেড কম থাকায় হিসাব করে খরচ করতে হতো। এজন্য এই কৌশল অবলম্বন করতে হয়েছিলো। ঢাকা শহরে এর আগে এ ধরনের অপারেশন আর হয়নি।

স্থানীয়দের কাছ থেকে জেনেছিলাম, সে রাতেই ঢাকা থেকে পাক আর্মি এসে আহত, নিহতদের নিয়ে যায়। আমাদের সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ অপারেশন ছিল ১২ অক্টোবর দুপুর ১২ টায় যাত্রাবাড়ী আর গেন্ডারিয়া এলাকায় দয়াগঞ্জ আর্মি ক্যাম্প আক্রমণ।  ওই আক্রমণে আমার টুআইসি কিবরিয়া নিহত হন।

অনুলিখন: লিনু হক

ঢাকা/লিপি

.

উৎস: Risingbd

কীওয়ার্ড: চ কর চ কর প ক আর ম আম দ র হয় ছ ল

এছাড়াও পড়ুন:

জরিপ বা নির্বাচনের ফলাফল, কোনোটাই ভুল নয়

প্রথম আলোর সাম্প্রতিক জরিপটি নিয়ে অনেক আলোচনা হবে—হোক। বিশ্লেষণ সব সময়েই সুলক্ষণ। বর্তমান লেখা এ বিশেষ জরিপটির বিশ্লেষণ নয়। নির্বাচনের মৌসুম। জরিপ শব্দটি সবচেয়ে বেশি শুনতে হবে আমাদের। লেখাটি সব মহলের সব ধরনের নির্বাচনপূর্ব জরিপ বিষয়টিতে আলো ফেলার চেষ্টা। যে জরিপ এখনো হয়নি, হওয়ার প্রস্তুতি চলছে, সেটিও এ আলোচনার বাইরে থাকবে না।

আমরা আজ পর্যন্ত কখনোই একটি সত্যিকার আলাপ সামনে আনিনি। কেন আনিনি, সেটি এক পরম বিস্ময়! সত্যটি হচ্ছে, নির্বাচন যতটা সিরিয়াস রাজনৈতিক বিষয়, ততটাই বিনোদনের বিষয়। জরিপ সেই বিনোদনের ঝলমলে পোশাক।

ধরা যাক, একটি পোশাকি ইতিহাসাশ্রিত ফ্যান্টাসি মঞ্চস্থ হবে। নাম ‘নবাব সিরাজউদ্দৌলা’। গল্প যতই আকর্ষণীয় হোক, নবাব সিরাজউদ্দৌলাকে লুঙ্গি-পাঞ্জাবি পরিয়ে দিলে সেরা গল্পটিই মাঠে মারা যাবে। অথচ ঝলমলে হীরা-জহরত-পান্নাখচিত রাজকীয় সিল্ক-শেরওয়ানি, মাথায় তাজ, কোমরে তলোয়ার গুঁজে দিলে গল্প খানিকটা দুর্বল হলেও দারুণ উপভোগ্য বিনোদন হয়ে উঠতে পারে। ‘নির্বাচন’ সিরাজউদ্দৌলা চরিত্র হলে ‘জরিপ’ তার ঝলমলে পোশাক। জরিপগুলো নির্বাচনকে উপভোগ্য করে।

আরও পড়ুননির্বাচন নিয়ে জনমত জরিপ: পুরো সত্যি নয়, কিন্তু সত্যির খুব কাছাকাছি০২ অক্টোবর ২০২৫

আরভিং গফম্যান নামের একজন সমাজবিজ্ঞানী মনে করেন, সমাজটিই আস্ত এক নাট্যশালা। তাঁর সোশ্যাল ড্রামাটার্জি তত্ত্ব দেখায় ব্যাকস্টেজ (পেছনের মঞ্চ, দৃষ্টির বাইরে) আর ফ্রন্টস্টেজ (নাট্যমঞ্চ, দৃশ্যমান) নিয়েই সমাজ। একেকটি প্রতিষ্ঠান, একেকটি দরকারি কর্মকাণ্ড, একেকটি বিনোদন।

নির্বাচনের জরিপকেও দিকনির্দেশনা না ধরে বিনোদন হিসেবে নেওয়াই ভালো। ‘ফলাফল তো প্রায় ঠিকই হয়ে গেছে, জরিপে দেখাচ্ছে’ ভাবনায় টেলিভিশনে, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে রাজনৈতিক আলোচনা যা হয়, সেগুলোকেও বিনোদন ধরে নেওয়াই নিরাপদ।

বহু দেশে নির্বাচনের আগের জরিপ বারবার নির্জলা ভুল প্রমাণিত হয়েছে। তবু মানুষ জরিপ পছন্দ করে। গণকের ভাগ্য গণনাকে যে রকম পছন্দ করে, সে রকম। যুক্তরাজ্যে ১৯৯২ সালের নির্বাচনকে আজও বলা হয় ‘শাই টোরি ইফেক্ট’-এর ক্ল্যাসিক উদাহরণ। প্রায় সব জরিপে মনে হয়েছিল কনজারভেটিভরা হেরে যাচ্ছে, অথচ তারাই জিতল বড় ব্যবধানে। ২০১৫ সালেও জরিপগুলো ভুল প্রমাণিত হলো। সব কটি জরিপ বলেছিল, ‘হাড্ডাহাড্ডি লড়াই’। কিন্তু ব্যালট গুনতেই দেখা গেল, অনায়াসে জিতে গেল কনজারভেটিভরা।

বাংলাদেশের মতো দেশে বড় সমস্যা ভোটের ফল মেনে না নেওয়া। এবারের নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও যথার্থ হলে ফলাফল যা-ই হোক মেনে নেবেন—এমন প্রতিজ্ঞা কোনো দলের কোনো নেতাই এখনো করেননি। জরিপগুলোর সমস্যা—সেগুলো রাজনৈতিক কর্মী-সমর্থকদের মধ্যে ‘আমরাই জিততে চলেছি’ ধরনের মনোভাব ও বিশ্বাস তৈরি করে দিতে পারে।

নাটকীয় ঘটনা ঘটল ২০১৬ সালের ব্রেক্সিট ভোটের সময়। বেশির ভাগ জরিপেই ‘রিমেইন’ বা ইউরোপীয় ইউনিয়নে যুক্ত থাকার পক্ষে সমর্থন এগিয়ে ছিল। কিন্তু চূড়ান্ত গণভোটে ‘লিভ’ (ত্যাগ করা) জিতে গেল। এরপর বিশেষজ্ঞরা বসলেন চুলচেরা বিশ্লেষণে। সিদ্ধান্ত এল জরিপ ফোনে করলে মতামতদাতাদের এক রকম দৃষ্টিভঙ্গি মেলে। তাঁরা তাড়াতাড়ি ফোন ছেড়ে দেওয়ার জন্য কী বলেন না বলেন, সে বিষয়ে সিরিয়াস থাকেন না।

অনলাইনে জরিপে আরেক রকম ফল আছে। সম্ভবত সঠিক মতামতে মেলে। কারণ, মতামতদাতারা সময় নিয়ে ভেবেচিন্তে বুঝেশুনে উত্তর দেন। ফোনে ভরসাও কম। তাঁরা ভয় পান—হয়তো তাঁদের কথা রেকর্ড করা হচ্ছে। অথবা তাঁরা ভাবেন, তাঁরা চিহ্নিত হয়ে পড়ছেন ইত্যাদি।

যুক্তরাষ্ট্রে ২০১৬ সালে হিলারি ক্লিনটনের জনপ্রিয়তা নিয়ে জাতীয় জরিপটি সঠিকই ছিল। কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ রাজ্যগুলোর জরিপে ট্রাম্পকে একেবারেই পিছিয়ে পড়া দেখায়। একই জরিপ-বিপর্যয় ২০২০ ও ২০২৪ সালেও প্রায় সব কটি জরিপেই দেখা গেছে। টক শোতে বিশ্লেষকেরা ব্যাখ্যা করলেন—অনেক ভোটার, বিশেষ করে রিপাবলিকানপন্থীরা জরিপে কম অংশ নেন। তাঁরা অনেকেই বয়স্ক, ভাবনায় পুরোনোপন্থী। ভোট–ভাবনাকে একান্ত গোপনীয় বিষয় ভাবেন। গোপনীয় জরিপও আদতে গোপন কি না, সন্দেহ করেন। ফলে জরিপগুলোর নির্ভরযোগ্যতা কমে গেছে।

ভারতে ২০০৪ সালের নির্বাচনেও সব বড় জরিপ বলছিল, বিজেপির জোট ক্ষমতায় ফিরবে। শেষমেশ কংগ্রেসের নেতৃত্বাধীন জোট নির্বাচনে জেতে।

২.

জরিপকারীদের ভুল হয় বলার সুযোগ কম। বেশির ভাগ জরিপকারী সংস্থাই পরিসংখ্যানবিশেষজ্ঞদের নেতৃত্বে জরিপগুলো করে থাকে। জরিপের সীমাবদ্ধতা, দুর্বলতা সম্পর্কে তারা সম্পূর্ণই ওয়াকিবহাল থাকে। তাহলে এমনটিও কি হওয়া সম্ভব যে জরিপের ফলাফলও ভুল নয়, নির্বাচনের ফলাফলও ভুল নয়?

খুবই সম্ভব। ‘ভোটিং বিহেভিয়ার’ বা ভোটদাতার আচরণের মতো বিচিত্র ও বৈচিত্র্যপূর্ণ বিষয় খুব কমই আছে। বাংলাদেশেও মতামত জরিপের বদলে ভোটিং বিহেভিয়ার নিয়ে বেশি বেশি গবেষণা দরকার। যতটুকু জানি, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান উপাচার্য অধ্যাপক ইয়াহইয়া আখতারের একটি গবেষণা আছে উল্লেখ করার মতো। আরও কিছু অনুল্লেখযোগ্য গবেষণার কথা শুনেছি, তবে খুঁজে পাইনি।

বাংলাদেশের মতো দেশে বড় সমস্যা ভোটের ফল মেনে না নেওয়া। এবারের নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও যথার্থ হলে ফলাফল যা-ই হোক মেনে নেবেন—এমন প্রতিজ্ঞা কোনো দলের কোনো নেতাই এখনো করেননি। জরিপগুলোর সমস্যা—সেগুলো রাজনৈতিক কর্মী-সমর্থকদের মধ্যে ‘আমরাই জিততে চলেছি’ ধরনের মনোভাব ও বিশ্বাস তৈরি করে দিতে পারে।

অনেকের ধারণা, এসব জরিপ ভোটারদের মধ্যে ‘জিতে যাবে’ পূর্বাভাস পাওয়া দলটির প্রতি ভোটারদের আনুকূল্য ও ঝোঁক তৈরি করতে পারে। যদি তা-ই হতো, এতগুলো দেশে এত এত জরিপ-বিপর্যয় ঘটানো উল্টো ফলাফলের উদাহরণ মিলত না। আজকাল আমরা ‘সুইং ভোটার’–এর কথা আগের চেয়ে অনেক বেশি শুনি।

এ বর্গটি কোনো দলের অন্ধ সমর্থক নয়। দুনিয়াজুড়েই দলীয় অন্ধত্ববাদের মৃত্যু ঘটছে। দোদুল্যমান ভোটারের সংখ্যা হুড়মুড়িয়ে বাড়ছে। বর্গটির ক্ষমতাও সীমাহীন। তাদের মনোভঙ্গি, ভাব-ভাবনা-বিচার-বিবেচনা কখন কোন কারণে কতবার কতভাবে বদলাবে, বলা কঠিন। বাংলাদেশেও বর্গটি সংখ্যায় বৃহদাকার হয়েছে। জরিপ নয়, আগামী নির্বাচনের নিয়ামক-নির্ণায়ক হবে ‘দোদুল্যমান ভোটগোষ্ঠী’।

দুনিয়াজুড়ে ভোটিং বিহেভিয়ারের বিচিত্রতা বোঝাতে সমাজবিজ্ঞানীরা বহু দশক ধরে তুলনামূলক গবেষণা করেছেন। রাজনৈতিক বিজ্ঞানী সিমুর মার্টিন লিপসেট ও স্টেইন রোক্কানের ধ্রুপদি কাজ পার্টি সিস্টেমস অ্যান্ড অ্যালাইনমেন্টস (১৯৬৭) বইয়ে দেখানো হয় যে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে ভোটারদের আচরণ এক রকম নয়; বরং প্রতিটি দেশের ঐতিহাসিক বিভাজন—শ্রমিক বনাম মালিক, গির্জা বনাম রাষ্ট্র, কেন্দ্র বনাম প্রান্তিক অঞ্চল ইত্যাদি আলাদা আলাদা ‘ক্লিভেজ’ (বিভাজন) তৈরি করে। এসব সামাজিক ফাটলরেখা (ফল্ট লাইনস) একেক দেশে একেকভাবে দলীয় ভোট আইডেনটিটির সমীকরণ গড়ে তোলে। ফলে ভোটের ধরনও হয় জটিল এবং দেশভেদে ভিন্ন ভিন্ন রকম।

এ ধারণাকে আরও এগিয়ে নিয়েছেন ক্রেম ব্রুকস ও দুই সহগবেষক তাঁদের ‘ক্লিভেজ-বেজড ভোটিং বিহেভিয়ার ইন ক্রস-ন্যাশনাল পারস্পেকটিভ’ গবেষণায়। তাঁরা দেখান, ‘একটা সর্বজনীন নিয়মে’ ভোটার আচরণ ব্যাখ্যা করা যায় না। ফাটলগুলো (ধর্ম, বর্ণ, লিঙ্গ, আঞ্চলিকতা, বৈষম্য, শ্রেণি, সামাজিক গতিশীলতা ইত্যাদি) বাড়া-কমা ভোটার আচরণে ব্যাপক প্রভাব ফেলে।

মার্কিন রাজনৈতিক বিজ্ঞানী রাসেল ডালটন ও ক্রিস্টোফার অ্যান্ডারসন ‘কম্পারেটিভ স্টাডি অব ইলেকটোরাল সিস্টেমস’ নামে একটি প্রকল্প চালান। প্রকল্পের তথ্য নিয়ে সম্পাদনা করেন সিটিজেনস, কনটেক্সট অ্যান্ড চয়েজ বইটি। ক্লিভেজ ধরতে পারাকে তাঁরা বলছেন ‘কনটেক্সট’ (প্রেক্ষাপট)। এটিকে রাজনৈতিক বিজ্ঞানী পিপা নরিস ও রোনাল্ড ইংলহার্ট বলেছেন ‘কালচারাল ব্যাকল্যাশ’ (সাংস্কৃতিক অভিঘাত)।

ক্লিভেজ সাধারণত একাধিক হয়। কিন্তু সবচেয়ে বড় ক্লিভেজটিই ভোটারের আচরণ ঠিক করে দেয়। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় ক্লিভেজটি, ‘কনটেক্সট’টি এবং ‘কালচারাল ব্যাকল্যাশটি কী? গভীর বিশ্লেষণে নিশ্চিত হওয়া যায় যে তিনটিরই উত্তর ‘ট্রাস্টলেসনেস’—রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতি আস্থাহীনতা ও বিশ্বাসহীনতা। ২০২৬-এর নির্বাচন সুষ্ঠু ও অবাধ হলে তাঁরাই জিতে আসবেন, যাঁরা বাংলাদেশের আমনাগরিকের (সুইং ভোটার) মধ্যে আস্থা ও নির্ভরতার অবস্থান তৈরি করতে পারবেন।

হেলাল মহিউদ্দীন যুক্তরাষ্ট্রের নর্থ ডেকোটার মেভিল স্টেট ইউনিভার্সিটিতে সমাজবিজ্ঞান অধ্যাপনায় নিয়োজিত

*মতামত লেখকের নিজস্ব

সম্পর্কিত নিবন্ধ